কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

শতাব্দী দাশ

সমকালীন ছোটগল্প



জন্মদিন 

জন্মদিনে কিছুতেই সুনেত্রকে ডাকবে না মিমি। সুনেত্র ইনকরিজিবল। তৃণা ভাবে, ইনকরিজিবল শব্দটা সে নিজে ছোটবেলায় জানতই না মনে হয়। সুনেত্রকে দেখেনি তৃণা। দেখেনি কারণ তৃণা মিমিকে স্কুলে দিতে বা স্কুল থেকে আনতে যায় না। কিন্তু সুনেত্রর কথা মিমির মুখে শুনেছে। সুনেত্রকে নিয়ে, মানে সুনেত্রকেই নিয়ে, আলাদা কোনো আগ্রহ তার আছে কিনা, তৃণা নিশ্চিত নয়। বরং সুনেত্রর গল্পকে সে ব্যবহার করেছে মিমির জরুরি শিক্ষায়।

যেদিন স্কুলবাস দেরিতে ঢুকেছিল বলে মিমি আর কোথাও জায়গা না পেয়ে সুনেত্রর পাশে বসেছিল, সেদিন অফিস থেকে ফিরে তৃণা দেখল, মিমি ফুঁসছে। সেদিনই প্রথম সুনেত্র নামের ছেলেটার কথা বিশদে শুনল সে। সারাদিন মিমিকে জ্বালিয়েছে৷ খাতায় জল উল্টেছে। ম্যামের কথা ফলো করতে না দিয়ে 'কী লিখলি আমায় দেখা' করেছে দিনমান। মিমি মায়ের পিছন পিছন ঘুরঘুর করতে করতে নালিশ করতে থাকে।

ভেবে দেখলে, তৃণা যে স্কুলে পড়ত, সে স্কুলে এমন স্যাম্পেল অনেক ছিল। তৃণা তাই 'পাগলা দাশু'-র কোনো চরিত্র ভেবে মজা পেয়েছিল প্রথমে। ক্রমে জানা গেল, সুনেত্র ভাল করে কথা বলতে পারে না৷ টিফিন খেতে পারে না গুছিয়ে। সুনেত্র বোর্ড থেকে টুকতে পারে না৷ টেস্টের পর টেস্টে গাড্ডা খায়… সুনেত্র না-পারা-র এক মস্ত ঢিবি। সুনেত্রর ব্যর্থতার কথা যত শুনতে লাগল তৃণা, তত বোঝা গেল, বিষয়টা ছেলেমানুষি উৎপাতের না। তৃণা মিমিকে বোঝাল, ও হয়ত স্পেশাল চাইল্ড। ও আরও একটু সহানুভূতি ডিসার্ভ করে।

অথচ, উপকরণ বা আয়োজন, কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। মিমিদের আপ-টু-ডেট স্কুলে তখন এম্প্যাথি আর সিম্প্যাথির তফাত পড়াচ্ছিল ভ্যালু এডুকেশন ক্লাসে। ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজেও, গুলমোহর বইতে এক জাপানি গপ্পো ছিল, যেখানে এক বালক ক্লাসের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিল বলে ত্রাতা হয়ে এসেছিল এক শিক্ষক, যে তাকে দিয়ে পাখির শিস দেওয়ালো স্কুলের অনুষ্ঠানে। আর সে বালক রাতারাতি হিট করে গেল। অনেকটা 'তারে জমি পর'-এর মতো। গল্পে শিশুদের দুয়োরে যেমন অবধারিত দেবদূত নেমে আসে, বাস্তবে তেমন হয় না। কিন্তু ভেবে দেখলে, সুনেত্রর থেকে বেশি চিন্তা তৃণার হল মিমিকে নিয়ে। মেয়েটা অবুঝ হয়ে যাচ্ছে। সে যত বোঝায়, পিছিয়ে পড়া বন্ধুকে সাহায্য করাই যায়, মিমি তত বলে, তাতে তার সময় বয়ে যাচ্ছিল।

- স্ট্রেঞ্জ! আমি তো ক্লাস ফলো করতে পারছিলাম না! ম্যাম তো বকল আমাকে ডিকটেশন নিতে পারিনি বলে৷

-বকুক। তাও হেল্প করবে। কাউকে সাহায্য না করে এগিয়ে যাওয়াকে এগিয়ে যাওয়া বলে না।

বলছিল বটে তৃণা। কিন্তু মিমি-র বিস্মিত মুখ তার প্রত্যয় কেড়ে নিচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল, একটা সুচারু পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে সে ওলোট পালট বকছে। তারপর মিমি কেটে কেটে সেই অমোঘ কথাটা বলল।

-মানুষ মানুষকে ফেলেই এগিয়ে যায়। যখন কেউ সামনে থাকে, তখন ধরেই নেওয়া যায় অন্য কেউ পিছনে আছে।

বারো বছরের মিমি যেদিন এ কথা বলল, সেদিন সত্যি ভয় পেল তৃণা। মনে হল ছোট্ট মিমিটা দৌড়চ্ছে, খুব খুব জোরে। বিরাম নেই। ফিরে তাকানোর ফুরসৎ নেই।ধাবমান একটা স্নেহের পুত্তলি ক্রমে বিন্দুবৎ হয়ে ফেড আউট করে যাচ্ছে৷

 

**********

ঘুমন্ত মিমির চুলে বিলি কাটতে কাটতে অয়নের অপেক্ষা করছে তৃণা। এমনিতে অয়ন এসব পছন্দ করে না। বউ ভাত বেড়ে বসে থাকবে, এ আদিখ্যেতার ঘোরতর বিরোধী সে। তৃণার এই গৃহকোণটি বেশ একটা সাম্যচর্চার ইনকিউবেটার, যার চাপ তাপ সবই নিয়ন্ত্রণ করে তৃণা আর অয়ন। তাছাড়া তৃণারও সকালে বেরোনো থাকে। যে বিএড কলেজে সে পড়ায়, তা জেলায়। তাই সে রোজ ঘুমিয়ে পড়ে খাবার টেবিলে অয়নের খাবার ঢাকা দিয়ে। আজ মনে হল, কথা বলা দরকার।

অয়ন নিজের চাবি দিয়ে দরজা খোলে, টের পায় তৃণা। প্রায় নিঃশব্দে ঢোকে। জামাকাপড় ছেড়ে ওয়াশরুমে যায়। খাবার টেবিলে এসে তৃণা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে।

-ঘুমোওনি?

-না। ঘুম আসছে না। তোমার কি ইদানীং রোজ এত দেরি হচ্ছে?

-আর বোলো না। বিরাট চাপ প্রজেক্টটায়। তাছাড়া টিমমেটস ভাল নয়। একটা ল্যাদোস নতুন মেয়ে এসেছে। এক কথা কতবার যে বোঝাতে হয়! আরেকজন হল মন্ডল, ওকে তো চেনো। কোটায় ঢুকেছে তো…

তৃণার কথা বলার ইচ্ছে চলে যায়। তবু, অয়ন ছাড়া আর কাকে বলবে?

-মিমিকে নিয়ে একটু কথা আছে।

-কী হল? ক্লাস টেস্টের খাতা বেরিয়েছে? রেজাল্ট খারাপ? ও ঠিক হয়ে যাবে। আমিও, জানলে, ছোটবেলায় একদম পড়তাম না। সিক্স-সেভেনের রেজাল্ট ধুয়ে কেউ জল খায় না।

শি উইল শাইন ইন প্রপার টাইম। আফটার অল, আমার মেয়ে।

-সেসব নয়। রেজাল্ট ভাল হয়েছে। ওর কথাবার্তা ভাল লাগছে না।

-কী বলেছে? ঝগড়া করেছে?

-ঠিকমতো যেন মানুষ হচ্ছে না।

-কী হয়েছে বলবে?

-অয়ন, আমরা কি পিছিয়ে পড়া বন্ধুকে অবহেলায় ফেলে যেতাম? অন্ধ খোঁড়া মানুষ দেখলে পথের ধারে ফেলে যেতাম?

অয়নের চোখ কুঁচকে আসে। বলে,

-দেখো, অন্ধ খোঁড়া দেখলে অনুকম্পা… অনুকম্পা বশতঃ পথ পের করে দেওয়া... কলার তোলা, এসব আমরা করেছি বটে। কিন্তু বন্ধুত্বের কথা যদি বলো, তুমি কি তোমার সব বন্ধুদের মনে রেখেছ আদৌ?

তৃণার মনে পড়ে, স্কুলের বন্ধুদের একটা গেট টুগেদার হয়েছিল ক'দিন আগে। সুখী মেয়েরা সুখের গল্প করেছিল। তাদের কারও জীবনে বিচ্ছেদ নেই, একাকীত্ব নেই, অপূর্ণতা নেই, গৃহহিংসা নেই। শুধু স্বামী  আর সন্তান আছে। যারা এসেছিল, তাদের নামই কষ্ট করে মনে করতে হচ্ছিল। যারা আসেনি তাদের নাম বা অস্তিত্ব কিছুই মনে পড়েনি। ডিভোর্সি একজন এসেছিল বটে। ঝাড়া হাত-পা বলে তাকে কয়েকবার সমবেত ভাবে বলা হয়েছিল, 'ইশ, তুই কি ভাল আছিস রে!' সে জোর করে হেসেছিল। শোনা গিয়েছিল, বিবাহিত অবস্থায় সে ফুলটাইম হাউস ওয়াইফ ছিল। ফলত ডিভোর্সের পরে তার মাজাটা এমন ভেঙেছিল যে কোনোমতে একটা বেসরকারি চাকরি সম্বল করে খোঁড়াচ্ছিল সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু কেউ শুনতে রাজি নয় বলে সে কথা না বাড়িয়ে পিজ্জা খেয়েছিল। ওর নাম কী ছিল? দেবযানী না দেবস্মিতা?

তৃণার আর বলা হয় না অয়নকে মিমির কথা। খেই হারিয়ে গেছে। অয়ন বলে চলেছে, অফিসের ওই ল্যাদোস মেয়েটাকে নিয়ে কী যে সমস্যা তার! আর কোটায় আসা মণ্ডল…প্রজেক্টের কাজ পিছিয়ে পড়বে তো…অ্যায়সে ক্যায়সে চলেগা….

 

******

অবশেষে তৃণা সুনেত্রকে দেখল রেজাল্টের দিন।  চ্যাপ্টাপানা মুখ ঘাড়ে-গদ্দানে বেঁটেখাটো ছেলেটার। একটা সরল হাসি আর আদুরে ভাব। রেজাল্ট যে খারাপ হয়েছে তা নিয়ে বিশেষ কষ্ট বোধহয় নেই। মিমি বিজয়ীর মতো এসে উচ্চতর সব গ্রেড সম্বলিত কাগজখানি মায়ের হাতে দিল৷ তারপর ওই ছেলেটির দিকে ইশারা করে বলল, 'তোমার প্রিয় সুনেত্র আর আমাদের সেকশনে থাকবে না।'

ফেল তো করানো যায় না আজকাল। কিন্তু পিছিয়ে-পড়াদের ভালোদের থেকে বেছে আলাদা করা তাতে আটকায় না। সত্যি বলতে, তৃণা জানে, ইনক্লুসিভ এ্ডুকেশন নিয়ে যত তত্ত্ব কপচানো হয়, তত প্রয়োগ নেই। পরিকাঠামোও নেই। এমতাবস্থায় পিছিয়ে পড়া সেকশনের জন্য যদি বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়, তাও মন্দ নয়। কিন্তু আবারও মিমির শ্লেষ তাকে বিপর্যস্ত করে। ওইভাবে কথা বলছে কেন? ও কি বুঝতে পারছে না ওর আচরণ রূঢ়? তৃণা দেখে, মিমির অন্য বন্ধুদেরও সুনেত্র সম্পর্কে দুটোই মাত্র প্রতিক্রিয়া। হয় এড়িয়ে যায়। নয় শ্লেষ হানে। এ অসংবেদনা সমবেত। মিমিকে বকে লাভ নেই।

সুনেত্রর মা আসেনি রেজাল্টের দিনেও। সুনেত্র বুকে বোতল ঝুলিয়ে সবার অলক্ষ্যে পুলকারে উঠে  যায়। তৃণা তার গতিবিধি হাঁ করে দেখে। সুনেত্রর চোখদুটো ভারি মায়াবী। কে রেখেছিল নাম? সে কি তখনও জানত না তার গোপন অসুখ? তাই বুঝি আদর করে অমন নাম রাখতে পেরেছিল? সুনেত্রর মুখটা সব সময়ই এমন হাসিহাসি থাকে যে বোঝা যায় না ও সত্যি খুশি নাকি দুখী। দুঃখেষুঅনুদ্বিগ্নমনাসুখেষুবিগতস্পৃহ সুনেত্র একটা ব্যস্ত রাস্তার একেবারে প্রান্তে দাঁড়ানো একটা পুলকারে একা উঠে যায়।

 

**********

ভাল রেজাল্টের পুরস্কার হিসেবে মিমি চাইল নিজের জন্মদিনে বন্ধুদের নিয়ে পার্টি। সবই আদান প্রদান সম্পর্কিত, তৃণাও একটা ডিল করল অতএব। সুনেত্রকেও ডাকা হোক। মিমি আঁতকে উঠল।

-সুনেত্র এলে অন্য বন্ধুরা আসবে না যে!

-কেন আসবে না?

-ও ডিস্টার্বিং।

- তোমাদের কোনো সমস্যা করবে না। আমি দেখভাল করব।

অগত্যা হাত-পা ছুঁড়ে রাজি হয় মিমি। তৃণা শোনে সে তার বন্ধুদের ফোনে নেমন্তন্ন করছে আর সুনেত্র আসবে এই সংবাদ দেওয়ার সময় দুঃখপ্রকাশ করছে এমনভাবে যেমনটা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা বর‍যাত্রীর সামনে করে। এমনটা কবে হয়ে গেল মেয়েটা? ইনক্লুসিভ এডুকেশনের ধ্বজাধারী তৃণার আঁতে লাগে। অভিভাবকদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপে পিং করে তৃণা। 'এখানে সুনেত্রর মা আছেন?' কেউ সাড়া দেয় না। অনেক পরে একজন দুজন বলে, তারা কেউ সুনেত্রর মাকে চেনে না। থাকলেও তিনি ইন্যাক্টিভ। তারও ঘণ্টাখানেক পর অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। দ্বিধান্বিত স্বর কেঁপে ওঠে।

-আপনি সুনেত্রর মাকে খুঁজছিলেন? কেন?

-আপনি কি তিয়াষাকে চেনেন? সুনেত্রর বন্ধু। আমি ওর মা। আপনি সুনেত্রকে নিয়ে তিয়াষার জন্মদিনে আসবেন প্লিজ?

-সুনেত্রকে তো কেউ কখনও জন্মদিনে ডাকেনি! তাছাড়া ওর তো সেকশনও চেঞ্জ হয়ে গেছে।

-হ্যাঁ, ধরুন এটা পার্টিং গিফট। আর তো কিছু করতে পারি না।

-ওর বাবা কিন্তু চান না, ছেলে খুব একটা বাইরে যাক। ওঁর নাকি সুখ্যাতি নষ্ট হয়।

-আপনি আসতে পারবেন না একবার ওকে নিয়ে?

-কিন্তু কেন? আউট অফ কমপ্যাশন কাউকে নেমন্তন্ন করা কি খুব ভাল? তাতে তার অপমান হয় না?

তৃণা হাজার ভোল্টের ঝটকা খায়। একা মিমি নয়, তৃণাও মনে হয় সিম্প্যাথি আর এম্প্যাথির তফাত বোঝেনি ভাল। সে চুপ থাকে। চুপ থেকে সে ভাবতে থাকে, তার কাছে সুনেত্র কতটা সুনেত্র, আর কতটা ইনক্লুসিভিটি তত্ত্বের প্রয়োগ— বা একটা সাইমুলেশন ক্লাস। ওপাশের দ্বিধান্বিত স্বরটিকে এবার বিমর্ষ শোনায়।

-সরি। চিনি না তো আপনাকে। কেউ তো ওকে সেভাবে ডাকেনি কখনও। ওকে বলব আমি, তিয়াষা ডেকেছে জন্মদিনে। আমরা চেষ্টা করব যেতে।

তৃণার মনে হয়, এক্ষণে ইনকিউবেটার অকেজো হয়ে গেছে। চাপ তাপ কিছুই নিয়ন্ত্রণে নেই তার। যেভাবে সে চাইছে ডিমের প্রস্ফুটন, তেমনটা হচ্ছে না। সে মাথা পেতে নেয় অনাম্নী সেই মায়ের শ্লেষ। তৃণার মনে পড়ে, দেবস্মিতা নয়, মেয়েটার নাম দেবযানীই। তার নাম্বার নিয়েছিল কি খেয়ালে সেদিন! আচ্ছা, ওকে কি ডাকবে মিমির জন্মদিনে? আউট অফ কমপ্যাশন নয়, খড়কুটো হিসেবে? তৃণা একটা চাকা লাগানো জুতো পরা পায়ে কেবলই এগিয়ে যাচ্ছে। তার থামা দরকার খড়কুটো যাইহোক ধরে। নাহলে পিছলে যাবে। আছাড় খাবে। নিজেই আছাড় খেলে মিমিকে দেখবে কে?

আসবি রে দেবযানী? সুনেত্র, আসবি রে?

 

 

 

 

 

  



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন