কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ১৭




শিকাগো থেকে ওয়াল যাবার পথে যেমন মানকাটো শহরে এক রাত থেমেছিলাম, সেই একই হিসেবমতো গার্ডিনার থেকে সিয়াটল যাবার পথে এক রাতের অতিথি হলাম মিসৌলাতে। গার্ডিনার থেকে যদি US-৮৯ N আর ইন্টারস্টেট ৯০ ধরে সোজা উত্তর পশ্চিম দিকে যাওয়া যায় তাহলে ২৭৯ মাইল দূরে পড়বে মিসৌলা। ছোটোখাটো স্টপ নিয়ে চলে গেলে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টার পথ। নেটিভ আমেরিকানরা এই জায়গার নাম দিয়েছিলো নেমিসুলাটাকু (Nemissoolatakoo) বা অতর্কিত আক্রমণের নদী। তার থেকেই এখন নাম হয়েছে মিসৌলা। ১৮০৫ সালে নদীপথে এই এলাকাতে এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন ক্যাপ্টেন মেরিওয়েদার লুইস আর সেকেন্ড লিউটেনান্ট উইলিয়াম ক্লার্ক। ক্যাপ্টেন মেরিওয়েদার লুইস এই এলাকার বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, মায়াময় নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী "scenes of visionary enchantment.”

বেশ সকাল সকাল তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে আমার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে ইয়েলোস্টোন নদী। আমি তার রূপমুগ্ধ। সে আমার পাশে পাশে চলেছে নিজের খেয়ালমত। লিভিংস্টোন পৌঁছে একটা ম্যাকডোনাল্ড থেকে ব্রেকফাস্ট স্যান্ডউইচ আর অরেঞ্জ জুস্ তুলে নিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে যেই ইন্টারস্টেট ৯০তে উঠেছি, নদী অমনি অভিমান করে অন্যদিকে বেঁকে গেল। পথে পড়ল বোজম্যান (Bozeman), ম্যাডিসন নদী, জেফারসন নদী আর কত না পাহাড়ী এলাকা। পেরিয়ে গেলাম থ্রী ফর্কস (Three Forks) নামের এক শহর। এই এলাকাতেই ম্যাডিসন, জেফারসন আর গ্যালাটিন নদী মিলে মিশে মিসৌরির জন্ম দিয়েছে। উত্তর আমেরিকার দীর্ঘতম নদী ... ক্যাপ্টেন মেরিওয়েদার লুইস আর সেকেন্ড লিউটেনান্ট উইলিয়াম ক্লার্কের যাত্রাধমনী। এর পরেই বোল্ডার নদীর সঙ্গে দেখা। এমনি করে কত না নদী আর ঝর্ণা খানিকটা করে আমার সঙ্গে পথ চলে, আবার নিজের খেয়ালে দূরে সরে যায়।

মেঘ ছেয়েছে পাহাড়চূড়োয়। মেঘ ছেয়েছে নদীর জলে। মানুষের গতি প্রকৃতিও ঠিক এমনধারা। কখনও নদীর মত ঢেউ তুলে পাশে আসে, মুগ্ধ হই, সাঁতারের অপারগতা ভুলে গিয়ে আকুল হয়ে নিমজ্জিত হই, স্রোতস্বিনী হই। নদী পাড় ভেঙে, বসতি ভেঙে ভেসে যায় তার নিজের খেয়ালে। আমাদেরও পরিস্থিতি পাল্টায়, অবস্থান পাল্টায়, অবচেতন পাল্টায়। তখন তুমি আর নেই সে তুমি। নদীর ওপর অভিমান করা বৃথা। তাকেও তড়িঘড়ি মোহনায় পৌঁছতে হবে। সেখানেই তার তর্পণ। সেও খুব সুখে নেই।

'দুহাত তোমার স্রোতে, সাক্ষী থাকো, সন্ধ্যানদীজল।

এমন তর্পণদিনে বহু মঠ পেরিয়ে পেরিয়ে

তোমার দুঃখের পাশে বসে আছি এই ভোরবেলা।

আরো যারা এ-মুহূর্তে নেই হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে

আমার শরীর ঘিরে এমন সম্পূর্ণ যবনিকা-

তাদের সবার শ্বাস দুহাতে অঞ্জলি দিয়ে আজ

এইখানে বসে ভাবি আমার সম্বল স্থির থাকা।

আমার সম্বল শুধু ঝুমকোঘেরা মঠ অবিকল

আমার নদীর নাম সন্ধ্যানদী, তুমি তার জল।'

এরপরে যে শহরে পৌঁছলাম তার নাম বাট (Butte)। মন্টানার সবচেয়ে ঐতিহাসিক শহর। একসময়ে শিকাগো আর স্যান ফ্রান্সিসকোর মধ্যবর্তী সর্ববৃহৎ জনপদ। সোনা, রুপা আর তামার খনির আকর ছিল এই এলাকা। বহুদূর থেকে মানুষ আসতো খনিজের আকর্ষণে। রকি মাউন্টেনের কন্টিনেন্টাল ডিভাইডের ঠিক পশ্চিমে হলো এই শহর। এই এলাকায় বিভিন্ন ছোট ছোট নদীর পুষ্টিতে লালিত ক্লার্ক ফর্ক নদী বয়ে গেছে আমার আজকের গন্তব্য মিসৌলার পাশ দিয়ে।

হোটেলটি ছাপোষা অথচ ছিমছাম। মিসৌলা শহরে ঢুকতেই দেখি পাহাড়ের গায়ে বড় করে M খোদাই করা আছে। সেটিকে মধুবাণী ভেবে পুলকিত হবার কোনো কারণ ছিলো না কারণ মিসৌলাতেই ইউনিভার্সিটি অফ মন্টানা। তবু হলাম। কাউন্টারের ছেলেটিকে কাগজপত্র দেখলাম।

Welcome to Missoula. Here are your keys. Are you visiting the University?’

Thank you. I am just passing through. Can you suggest some places I could visit this evening?’

Well there are some nice hikes in the area. This is a beautiful place.’

Hikes?’

ছেলেটির বোধ হয় আমার মুখের ভাব দেখে মায়া হল।

Yes some of them are only half day hikes.’

মনে মনে বললাম

'Yikes !!'

মৃদু হেসে বাক্স প্যাঁটরা সমেত ঘরে গেলাম। বেশ গোছানো সুন্দর ঘরটি। জানালার পর্দা সরালেই ক্লার্ক নদী দেখা যাচ্ছে। হাত মুখ ধুয়ে চা বিস্কুট সমেত জানালার পাশে বসে প্রথমেই কোথায় কী ভাল ভাল খাবার পাওয়া যায় সেটা  দেখে নিলাম। গুগলে নানা মানুষের মন্তব্য পড়ে যে সিদ্ধান্তে এলাম সেটা হলো পড়ন্ত দুপুরে এখানকার টাগলিয়ারে ডেলিক্যাসেন (Tagliare Delicatessen) থেকে একটা ইটালিয়ান স্যান্ডুইচ দিয়ে লাঞ্চ আর রাত্রিবেলা জু থাই (Zoo Thai)তে মাছ ভাত খেয়ে বেশ একটা পশ্চিম-পূর্ব সমন্বয় ঘটাবো। পরবর্তী জ্ঞাতব্য হল স্যান্ডুইচ কোথায় বসে খাবো। সব ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম যে একটা ছোট নদীর ধারে গ্রীনো পার্কে (Greenough park) বসে স্যান্ডুইচ খাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত হবে। পরে জেনেছিলাম সেই সরু নদীর নাম রাটেলস্নেক ক্রিক (Rattlesnake creek )। তার কেন এমন নাম হলো সেটা নিয়ে আর পর্যালোচনা করিনি।

টাগলিয়ারে ডেলিক্যাসেন গিয়ে চোখ মন রসনা সব জুড়োলো। কাউন্টারে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা রকম চীজ, অলিভ, ওয়াইন, কিওর্ড মিট আর ওভেন গরম টাটকা রুটি। আমি একটা জম্পেশ ইটালিয়ান স্যান্ডুইচ অর্ডার করে বললাম দুই ভাগে প্যাক করে দিতে। একটা আজ এক্ষুনি খাবো আর একটা আগামীকাল ব্রেকফাস্টে। আর লোভে পড়ে গোটা পাঁচেক গোট চীজের পুর দেওয়া ক্ষুদে চেরী টমেটো কিনলাম। ওই ব্যালেন্সড ডায়েট কনসেপ্ট আর কি। কাউন্টারের মেয়েটি খুব সুন্দর করে আমাকে স্যান্ডুইচ দুটো প্যাকেটে ভাগ করে দিলো। একটা প্যাকেটে লাল কালিতে লিখে দিলো নাউ (Now) আর অন্যটাতে লিখলো লেটার (Later)।




আমি সমস্ত লাঞ্চ ব্যবস্থা পাকা করে গ্রীনো পার্কের সেই তদাপি নাম না জানা রাটেলস্নেক ক্রিকের পাশে একটা গাছতলায় নিশ্চিন্তমনে বসে এককাপ তোফা দার্জিলিঙের সঙ্গে নাউ-কে আপন করে নিলাম। কত যে পাখি দেখলাম সেখানে। এই প্রথম গাছের লাগোয়া পাথরের ওপরে ফোন ক্যামেরা বসিয়ে টাইমারে ছবি তুললাম। একটি ঝোড়ো কাক দূরবীণ হাতে হাসিমুখে চেয়ে রইল। তারপর অনেকটা সময় ধরে ক্লার্ক নদীর ধার ঘেঁষে পাহাড় ঘেরা মিসৌলাকে চিনলাম জানলাম।

বাজ মোটামুটি বুঝে গ্যাছে যে আমি ওর আনলিমিটেড মাইলেজের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবো। রাত্তিরের অল্প সময় ছাড়া ওর আর বিশ্রাম নেই। তাই সেও আর চাকার হাওয়া ইত্যাদি নিয়ে খ্যাচাখেচি করে না। মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে পথ চলে। এমনি করে অনেকটা পথ, অনেকগুলি গান, অনেক খানি ভালো লাগা পেরিয়ে, জু থাইতে স্যামন মাছের নারকোল লেবুপাতা দেওয়া ঝোল আর ভাত খেয়ে ঘরে ফেরা।

রাত নেমেছে M লেখা মিসৌলা শহরে। ঘরে ফিরছে বাজ। শচীন কত্তা গাইছেন-

'হাসো না, হাসো না সে হাসি মধুময়

তুমি আর নেই সে তুমি

জানি না, জানি না কেন এমন হয়,

জানি না

জানি না, জানি না কেন এমন হয়

তুমি আর নেই সে তুমি

তুমি আর, তুমি আর

তুমি আর নেই সে তুমি।'

 

(ক্রমশ)

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন