কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন (পর্ব ৪)




ছেলেদের সঙ্গে মিশে গ্রামের পথে বড় হতে হতে আচমকা একদিন ঋতুমতী হয়ে মহিলা মহলে প্রবেশ। জানা ছিল বিভিন্ন গাছে ওঠার বিভিন্ন কায়দা, জানতাম যাবতীয় পাখিদের নাম এবং ধাম। সাপ খুঁজে বেড়ানো, কচুরিপানা ফাটানো।

অবাক হওয়ার সেই শুরু। সব কিছু গোপন রাখার পাঠ। কেউ না জানতে পারে, কেউ না দেখতে পায়, বিশেষত পুরুষ যেন মোটেই টের না পায়। সেই সময় কেবল কেয়ার ফ্রি ও এঞ্জেলা নামে দুটো কোম্পানি ছিল। বাবা কিনে আনতেন, আমার আর মা’র জন্য। তবু কেন এই গোপনতা, কেন পেতেই হবে লজ্জা বুঝতে পারিনি। ছোটো বয়সে অনেক সময়ই ম্যানেজ করতে পারিনি, বিছানার চাদরে জামায় লাগত, বিশেষত জড়োসড়ো থাকার অভ্যাস ছিলো না। সেসবই বাবা সতর্ক করে দিতেন। প্রথম বছর মা সেসব দাগ পরিস্কার করে দিয়েছেন, একবার বাবাও। আমার তখন বারো।

এখন তো আমাদের ছেলেমেয়েরা ক্লাস এইটেই এসব পড়ে বিস্তারিত। সবচেয়ে মুস্কিল হলো, আমাকে যেন শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হলো। এটা কোরো না, সেটা নয়, ওটা ছোঁবে না, যেন নিষিদ্ধ ব্যাপার। অপরাধ। দেখতাম অম্বুবাচির সময় কামাখ্যায় মন্দির বন্ধ। পুরুষরা লাল কাপড় মাদুলি করে পরছে, বিক্রি করছে।

যাইহোক, এই যে আমি মানুষ থেকে কেবল নারীর সংকীর্ণ পরিসরে প্রবেশ করলাম, এর জন্য মনে মনে সতত বিদ্রোহ জেগে উঠল। মায়ের প্রতি অভিমান, যিনি কখনো ছেলে মেয়ে ফারাক করে মিশতে শেখাননি। আমরা যে সময় বড় হয়েছি তখন মূলত সাদাকালো টিভি। আর সবচেয়ে খারাপ হতো কোনো প্রসিদ্ধ ব্যক্তি মারা গেলে। ব্যস সাতদিন ধরে একনাগাড়ে এক ভদ্রলোক করুণ সুরে বেহালা বাজাতেই থাকতেন। যেটুকু বা অনুমতি ছিল, শিশুসুলভ অনুষ্ঠানে অনুমতি তাও বন্ধ।

বৃহস্পতিবার চিত্রমালা বাংলা সিনেমার গান আর বুধবার হিন্দি, চিত্রহার। সেটাও উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে হতো। সিনেমা বলতে মা বাবার সঙ্গে গুপি গায়েন বাঘা বায়েন, ফেলুদা, টেন কম্যাণ্ডমেন্টস, বর্ন ফ্রি এসব। মা বাবারা অনেক ক্ষেত্রেই গিনিপিগের মতো মনে করে সন্তানকে। অবাস্তব একটা জায়গা থেকে মানুষ করতে চায়। ভুলভাল।

অথচ ছোটরা যে সত্যি অতটা ছোটো হয় না, তা ছোটোবেলায় বুঝেছি। আমরা বন্ধুরা রীতিমতো প্রাপ্তমনস্ক আলোচনা করতাম মানুষ ও পৃথিবীর গূঢ় তত্ব নিয়ে।

ছোটরা অনেক বেশি বিবেচক, বড় হয়ে বুঝেছি। পড়ার সময় তখন ভাবছি বিষবৃক্ষর হীরাকে নিয়ে। লোডশেডিং রোজ হতো, সন্ধ্যাবেলা নিয়মিত কলকাতা 'ক' এ নাটক শুনতাম। রেডিও সঙ্গী ছিল। শনিবারের বারবেলা তারপর হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্স-এর ক্যাঁচ করে শব্দটা, শ্রাবন্তী মজুমদারের মনের মতো গান মনে রাখার কথা এইসব মিস হতো না।

এমন একদিন চারিদিক হঠাৎ থমথমে হয়ে গেল। মা স্তব্ধ, পাড়ায় গুঞ্জন, বাবা অনেক অনেক রাতে পায়ে হেঁটে রেললাইন ধরে কাতারে কাতারে মানুষের সঙ্গে বাড়ি ফিরলেন।গম্ভীর পরিবেশ। ফিসফাস। আমার বয়স বারো।

টিভি জানালো প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দেহরক্ষী দ্বারা খুন হয়েছেন। তাঁর দৃপ্ত ভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস, স্মার্টনেস ছাপিয়ে মানসচক্ষে কল্পনা করলাম ছোট্টখাট্ট শরীর, বক্ষ ভেদ করে চলে যাচ্ছে বুলেট। লুটিয়ে পড়ছেন তিনি। সেই প্রথম নিজের রাষ্ট্র সম্পর্কে শ্রদ্ধাহীন হয়েছিলাম। তা ক্রমশ বেড়েছে পরবর্তীকালে।

কিন্তু আরো কিছুও বাকী ছিল, ঘটনা আরো তীব্র আরো অশ্লীল ব্যাপার, এই মৃত্যুর পরে। আমার শৈশবে স্মার্টনেসের পরিভাষা, একটি রাজনৈতিক জ্ঞানী বাচ্চা মেয়ের আদর্শ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর লাল গোলাপ ঢাকা দেহ শায়িত, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস। এমনকি কলকাতাতেও বিশেষ রাজ্যের মানুষগুলির লাশ পড়ছে। আমি ইতিহাসে পড়ছি  মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি, অশোক ও বৌদ্ধধর্মের কথা। পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতা মেলাতে পারছি না। ইংরেজরাও এমন করেই নাকি নির্দোষ ব্যক্তিদের হত্যা করেছিল, তাই আমরা স্বাধীন। আমি আজ অবধি অবশ্য কোনো স্বাধীন মানুষ দেখিনি আক্ষরিক ভাবে। কষ্ট আমারও হচ্ছিল, রাগ আমারও হচ্ছিল, সব চিঠির আকারে আমার ডায়রিতে লিখছি।

একটা দৃশ্য মনে ছবি হয়ে আছে। জনহীন ধ্বংস উৎসবের পর যেন পলাশীর প্রান্তরে একা এক বৃদ্ধা ন্যুব্জ নারী দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে। নীলপাড় শাড়ি। যেমন তাঁর ব্যাপারে অনেক কথা শুনছি পরে তা সত্য হতে পারে কিন্তু এই দৃশ্যটাও যে সত্য তাও তো ঠিক।

একবার আমাদের পাড়ায় বিদেশি বিনিয়োগ পোষিত চোখের হাসপাতাল পরিদর্শনে তিনি এসেছিলেন। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম। কাছে ডেকে আদর করেছিলেন। কিছু কথা টুকটাক, মনে নেই। তিনিই মাদার টেরেসা।

ছোটোবেলা সাদাকালো ছিলো না। অনেক রং খেলা করত চারিদিকে।

ছোটোবেলায় গ্রামের সেই যাত্রাপালায় রানীর অল্প গোঁফ আর মাঝে অন্ধকারে বিড়ি খাওয়া, ধারে বসে কিছু মানুষ উচ্চকিত বাজনার মধ্যে বিড়বিড় করে সংলাপ বলছেন, সেই সংলাপ যা স্টেজে বলা হচ্ছে। এভাবে আমার মনে হতো অসম্ভব অভিনয় করা। তাঁরা প্রম্পটার। যাত্রা ছাড়া প্রম্পটার-এর কাজ করেছে বন্ধুরা পরীক্ষার হলে পরের দিকে।

নতুন ক্লাসে এখনকার মতোই জানুয়ারি মাসে আসত নতুন বই খাতা। বাবা মলাট দিতেন, আমি গন্ধ শুঁকতাম। ফুলের চেয়ে প্রিয় নতুন সেসব বইয়ের গন্ধ। ক্লাস শুরুর আগেই বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের বই পড়া শেষ হয়ে যেত। আবার স্কুল। কেউ কেউ নতুন। তাকে ঘিরে আলাপের পালা।

এর মধ্যে ক্লাস থ্রি-তে আমার প্রিয় বন্ধু সুমনা স্কুল ছেড়ে চলে গেল আর ক্লাস ফোরে আরেক প্রিয়বন্ধু তিথি প্রখ্যাত  এক সাহিত্যিকের কন্যা, চলে গেল পড়তে শান্তিনিকেতনে।

আবার একা হলাম স্কুলে। একা একা উদাস মাঠে ঘোরাঘুরি। ঠিকানা? নেওয়া হয়নি। মনে পড়ে ওদের। কেমন আছে কোথায় জানি না।

সেই সময় প্রতি রাতে বোমার আওয়াজ, সকালে প্রায় লাশ মিলত খালে।

নতুন বাস এলো। প্রশান্ত সূর এসেছিলেন। বাবাকে উদ্বোধনে ডাকা হলো। আমি পাশে।

মিষ্টির দোকানে তখন তৈরি হতো ঢাকাই পরোটা। বিরাট বড়ো গোল মুচমুচে সঙ্গে ছোলার ডাল, লাল দই, পয়ধি।

বাজারে সেই সময় বিরাট বিরাট কাছিম আসত। ওটা দেখার জন্যই মূলত বাবার হাত ধরে বাজার যেতাম ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের লাল সাজিব্যাগ নিয়ে। বিক্রেতারা মামনি বলতেন। কেউ একটা আলু, দুটো লঙ্কা, একটা পাতিলেবু স্নেহ করে ভরে দিতেন। কোনো দাম ছিলো না তার।

মন পাল্টে গেছে সবার। সঙ্গতিও।

সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসলেই সন্ধ্যাপিসী প্রচণ্ড টাইট করে লাল ফিতে আর কালো দড়ি দিয়ে কলা বিনুনি, কখনো দোলা বিনুনি করে দিত। খুব লাগত।

মাথায় ডাবর আমলা অথবা নারকোল তেল। কিন্তু আমার প্রিয় ছিল লাল রঙের একটু চিটচিটে জমাকুসুম। গন্ধটা সুন্দর নাকে লেগে আছে।

শীতকালে মায়ের জন্য বাবা আনতেন নিভিয়া ক্রিম। আর বালিগঞ্জ বাড়িতে দাদামশাই আনতেন সুন্দর লম্বাটে বোতলে তুহিনা। জানি না তুহিনা পাওয়া যায় কিনা আর।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন