কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


আলগা সোসাইটির নাট বল্টু

 

এ জগতে কমপ্লেন থাকবেই। এবারে যে কমপ্লেনটা আমার দিকে ধেয়ে এলো সেটা এরকম।

"তোর স্মৃতি টাটানগর রেল কলোনিতেই আটকে আছে কেন? বাকি সব এলাকা কি বানের জলে ভেসে গেছে?"

যায়নি রে ভাই। আছে। সব আছে। তবে তাদের আকর্ষণীয় হতে হবে তো। সাদামাটা হলে তো আর পাঠক পছন্দ করবে না।

আজ তাই যে গল্প বলবো সেটা আমার গল্প নয়, অতনুর কাছে শোনা। বলবো তার জবানিতেই।

ইয়ে। প্রথমেই জায়গাটার নাম বলতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। মনে হলো ফস করে সেটা বলে দেওয়াটা উচিত হবে না। পুরনো গল্প হলেও জায়গাটা তো এখনো বহাল তবিয়তেই আছে। খুব একটা পাল্টায়নি বোধহয়। সুতরাং কেউ কিছু মনে করে ফেলতে পারে। তাই জায়গার নাম আপাতত বাদ। চরিত্রের নামের মতো জায়গার একটা নতুন নাম দেওয়াতো আমার এক্তিয়ারে নেই। সে সব ক্ষমতাশালী মুখ্যমন্ত্রী, প্রধান  মন্ত্রীদের থাকে।

তবে নাম হিসেবে অতনু থাক। কানুনগোবাবুও থাক।

অতনু আমাকে বলেছিলো।

কানুনগোবাবু অভিজ্ঞ মানুষ। টাইটেল যখন কানুনগো, তার কথা কানুন মেনেই হবে। তিনি বলেছিলেন  এখানকার ব্যাপার স্যাপার নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নেই। এটা হচ্ছে আলগা সোসাইটি। এখানে অনেক কিছুই ঘটে। যা অন্যত্র ঘটে না। আর সে সব নিয়ে এখানে কারো কোনো হেলদোল নেই। অতনু তুমিও হেলবে না দুলবে না। পারলে তুমিও মিশে যাবে এদের আলগা সোসাইটিতে। ঠিক আমার মতো...।

কানুনগোবাবু আরো বলেছিলেন-

-আজ রাতটা আমার বাসায় থাকো। কাল তোমার জন্যে বাসা খুঁজে দেবো। মানে যদি সম্ভব হয় আর কি। এখানে হোটেল রেস্টুরেন্ট নেই। বাসা টাসাও কেউ ভাড়া দেয় না কেউ। বাসাই নেই কাছে পিটে তো ভাড়া দেবে কি? আমার এটা জবর দখল কোয়ার্টার। রেলওয়ে গেটম্যানের কোয়ার্টার। সে এ্যাক্সিডেন্টে মরেছে। জানি না তার মৃত্যু সংবাদ ওপরে জানানো হয়েছে কি না। আসলে কে জানাবে?

এটা একটা সমস্যা বটে। এখানকার সিঙ্গেল লাইনটা টানা চলে গেছে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। সেই লাইনের দুই ধারের স্টেশন দুটো এখান থেকে যথেষ্ট দূরে। এখানে একটা রাস্তা গেছে লাইনটাকে আড়াআড়ি কেটে। একদা এই রাস্তায় কাঠের লড়ি যেতো। এখন যায় না। কাঠের লড়ি মানে চোরাই কাঠের লড়ি। তাদের জন্যই এখানে একটা রেলগেট বানিয়ে একজন গেটম্যান বহাল করেছিলো রেল। সরকারকে সবাইকে নিয়েই চলতে হয়। চোরাই কাঠের ট্রাক হলেও। তারাও তো দেশের নাগরিক। আবার এই লাইনে কয়েকটা মালগাড়ি ছাড়া আর কোনো ট্রেন চলে না। ট্রেনে ট্রাকে টক্কর হলে জান মালের লোকসান হতেই পারে। সবার জন্যই সুরক্ষা আবশ্যিক। সুতরাং রেলগেট এবং গেটম্যান। এবং একটা ঝুলন্ত রেল লাইনের টুকরো। সেটার গায়ে বেশ কটা ফুটো। সেই ফুটোর মধ্যে একটা আলগা বড়ো সাইজের বল্টু গোঁজা। যেরকমটা লাইনের স্লিপারে থাকে। যাদের কাজ স্লিপারকে লাইনের সঙ্গে জুড়ে রাখা। এখানে অবশ্যি তার ভুমিকা আলাদা। তাকে দিয়ে রেল লাইনের টুকরোটাকে পেটানো হয়। পেটালে ঠং ঠং আওয়াজ হয়। গেটম্যানের ডিউটি ট্রেন আসতে দেখলে ঐ বল্টু দিয়ে লাইনের টুকরোটাকে পেটানো। ঠং ঠং ঘন্টার আওয়াজ মানে ট্রেন আসছে। সুতরাং সবাই সাবধান। তবে কেউই সাবধান হয় না। না ট্রাক না লোকজন। গেটম্যান যে পদ্ধতিতে ট্রেন আসছে টের পায়, বাকি সবাইও সেই পদ্ধতিতেই ট্রেনের আসাটা টের পায়। খালি চোখেই ট্রেন আসা পরিষ্কার দেখতে পায়। আগেই বলেছি এইখানে লাইনটা বহুদূর থেকে সোজা এসে বহুদূর পর্যন্ত সোজা চলে গেছে। তাই দূর থেকেই ট্রেন যে আসছে সেটা দেখা যায়। প্রথমে দূর দিগন্তে কালো বিন্দু হয়ে ট্রেন দেখা দেয়। ক্রমে বিন্দুটাও বড়ো হতে থাকে। মানে ট্রেন এগিয়ে আসছে। ঐ বিন্দুটা ঠিক কতো বড়ো হয়ে উঠলে ও ঘন্টি বাজানো শুরু করবে, সেটা গেটম্যানের হিসেব আছে।

প্রতিদিনই এই ঘন্টা শুনে এদিক ওদিক থেকে কিছু মানুষ বের হয়ে আসে। তারা এই এলাকার লোক। তারা এই মালগাড়ি চেপে সফর করবে। এখানে স্টেশন নেই। কোনোরকমের প্যাসেন্জার ট্রেনের চলাচল নেই। তাই তাদের এই মালগাড়িই ভরসা। তারা লাইনের ধারে ধারে রেডি হয়ে থাকে। যখন সামনে দিয়ে ট্রেনটা হেলতে দুলতে যায়। ওরা টপাটপ তাতে উঠে পড়ে। হাতে ধরার মতো কিছু একটা আর পা ঠেকাবার মতো কিছু একটা পেলেই তারা তাতেই ঝুলে পড়ে। আর ঝুলতে ঝুলতে গন্তব্যে চলে যায়। গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছলে আবার টপাটপ গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। এই যাত্রার কোনো ভাড়া নেই। তবে মাঝে মধ্যে হাত ফসকে পড়ে একটু আধটু আহত হওয়া আছে।

নিহত হওয়ার কেস মাত্র একটাই। হাত ফস্কে পড়ে তার হাঁটুতে যে ঘা’টা হয়েছিলো, সেটাতে পচন ধরে গেছিলো। সেটা আর সারেনি। সে ব্যক্তি আবার অন্য কেউ নয়, গেটম্যান স্বয়ং।

এটা আদিবাসী প্রধান জঙ্গুলে এলাকা। ছোটো ছোটো আদিবাসী গ্রামগুলো জঙ্গলের অনেক ভেতরে। এখানটা ফাঁকা। এখানে ব্যাঙ্কের শাখা হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু সরকারের financial inclusion policy অনুসারে এখানে একটা ব্যাঙ্কের শাখা খোলা হয়েছিলো। এতো দিন সেটা ছিলো One man branch. আমি এসে পড়ায় বেড়ে two men হয়েছিলো।

যে জিপটা আমাকে পৌঁছে দিয়েছিলো, সেটা লেভেল ক্রসিং-এর ওপার থেকেই ফিরে গেছিলো। আমি  ঝোলা কাঁধে এগিয়ে গেছিলাম। কোত্থাও কেউ নেই, তাই ব্যাঙ্কটা কোথায়, জিজ্ঞেস করার উপায়ও নেই। হাঁটতে হাঁটতে লাইন পেরোলাম। লাইন পেরিয়ে একটা পাকা ঘর। তার পাশেই টিউবওয়েল একটা। খুব তেষ্টা পেয়েছিলো। টিউবওয়েল টিপে জল খেতে গেলাম তো ভয়ানক বেকায়দায় পড়ে গেলাম। হাতলে চাপ দিলে জল তো পড়ছে। কিন্তু হাতল ছেড়ে সে জলের কাছে পৌঁছানোর আগেই জল পড়া থেমে যাচ্ছে। তখনই বিপদভঞ্জন কানুননবাবু দেখা দিয়েছিলেন। উনি আমার নাম ধরে ডেকে বলেছিলেন-

-অতনু তো? বাহ্। এসে গেছো। দাঁড়াও আমি টিবল টিপে দিচ্ছি।

জল খাওয়ানোর পর বলেছিলেন

-ধুলো মেখে তো ভূত হয়ে গেছো। চান করে নাও।

জামাটামা খুলে টিবলের নীচে বসে পড়ো। টিপে দিচ্ছি। আরে লজ্জা কিসের। এখানে লজ্জা করার মতো কোনো লোকজন নেই।

সুতরাং সেভাবেই স্নান হলো। ধুলোর সাথে সাথে পথশ্রমও ধুয়ে গেলো। তারপর আমাকে নিয়ে উনি সেই পাকা ঘরটাতে ঢুকলেন। ছোটো ঘর। কিন্তু তার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে দুটো খাটিয়া পাতা। কানুনগোবাবু বললেন-

-আমি হচ্ছি কানুনগো। এতোদিন পর্যন্ত এইখানের ব্যাঙ্কের মানিজার টু সাফাই কর্মী মানে A to Z সমস্ত কর্মচারী। এখন তুমি এসেছো তাই দায়িত্ব হাফ হাফ।

তবে দায়িত্ব আর কি! কিস্যু না। ধরে ধরে কিছু জিরো ব্যালান্স একাউন্ট খুলেছি। মাঝে মাঝে তাতে একশ টাকা জমা করে একশ টাকা তোলার ফল্স এন্ট্রি করা। যাতে একাউন্ট জীবন্ত থাকে। আর যা যা কাজ সে সব নিজেকে জীবন্ত রাখার কাজ।

এরপর উনি এখানকার সম্পর্কে কিছু জানকারি দিয়েছিলেন। সেসব আগেই বলেছি।

কুসনি এসেছিলো একটু পরে। কানুনগোবাবু তাকে বললেন-

-এই দেখ নুতন বাবু। যেমন আমায় দেখিস। তেমন একেও দেখবি। যা এই কাপড়গুলো ধুয়ে দে। কুসনি আমার ছাড়া কাপড়গুলো নিয়ে চলে যেতেই আমার মনে হলো টিউবওয়েলটা তো টিপে দেওয়া দরকার। আমার ইরাদা বুঝে কানুনগোবাবু হেসে উঠে বলেছিলেন-

-দরকার নেই, ও একাই পারবে।

কীভাবে একা পারলো সেটা একটা চমকপ্রদ দৃশ্য। এতে কুসনির গোটা শরীরেরই ভুমিকা আছে।  টিউবওয়েলের উপর শরীর রেখে পায়ের চাপ দিয়ে টিউবওয়েলের হাতল টিপছিলো ও। আর নলের মুখের নিচে আমার কাপড়গুলো রাখা ছিলো। ও হাত ঝুঁকিয়ে সেগুলোকে মাঝে মাঝে আছড়াচ্ছিলো।

নির্মেদ চকচকে কালো শরীর। তার অধিকাংশটাই উন্মুক্ত। রোদ পিছলে পড়ছে তার উপর। পায়ের ওঠা নামার সাথে সাথে ঢেউ তুলে তুলে পায়ের পেশিরাও ওঠা নামা করছে। কৃষ্ণ কালো রমণীয় দৃশ্য।

কানুনগোবাবু বলেছিলেন-

-এখন দেখে নাও ভালো করে। রাতে কিন্তু ভালো করে দেখতে পাবে না। এ দেশে মিটি সুনুমের মানে কেরোসিন তেলের বড়ো অভাব। তাই লন্ঠন বেশিক্ষণ জ্বলবে না। তুমি আমার সাথে এই ঘরেই থাকবে। এই খাটে আমি আর ওই খাটে তুমি। কুসনি থাকবে ভাগ করে দুই খাটেই। আজকের রাতের জন্য।

পরের ব্যবস্থা পরে দেখা যাবে।

আলগা সোসাইটির আলগা নিয়মের সাথে প্রথম দিনেই পরিচয় হয়ে গেছিলো। জানা গেছিলো কুসনি আর কেউ নয় মৃত গেটম্যানের জরু বা বিবি। তবে সে বিধবা নয়। রেলের কাগজে ওর বর এখনো বেঁচে আছে।

তারপর কানুনগোবাবু বলেছিলেন, কাজটা কিন্তু সহজ নয়। আমি ট্রাই করেও পারিনি। আমাকে অবাক হতে দেখে বলেছিলেন-

- ঐ পা দিয়ে টিবল টেপার কথা বলছিলাম।

আমি প্রশ্ন করেছিলাম।

- ব্যাঙ্কটা?

- সে হবে খন। পালিয়ে তো আর যাচ্ছে না।

লাল চালের ভাত আর সিম জারমের ঝাল ঝাল ঝোল। সিম জারম মানে বন মুরগির ডিম। রাঁধলেন কানুনগোবাবু। খেলাম আমরা তিনজন একসাথে। কানুনগোবাবু আমি আর কুসনি। খাওয়া শেষে সেই আগের পদ্ধতিতেই পা দিয়ে টিউবওয়েল চালিয়ে এঁটো থালা ধোয়া হোলো। তারপর কুসনি ঘরে এসে থালাগুলো তুলে রেখে আমাকে ডাক দিলো-

-আয় কেনে, টিপে দিবি। আমি সিনাবো।

চোখের ইশারায় কানুনগোবাবু আমাকে যেতে নির্দেশ দিলেন।

এবার কাজটা কুসনির জন্য খুব সহজ। পরনে একটাই কাপড়। সেই কাপড়টা খুলে টিউবওয়েলের উদোম  নিচে বসে যাওয়া। আমার জন্য কাজটা ভীষণ কঠিন। টিউবওয়েলের হাতল চেপে নগ্ন কুসনির উপর জলধারা ফেলা।

কুসনির সিনান হয়ে গেলে ও আমার আর ওর নিজের ভেজা কাপড় মেলে দিলো। না কোনো টাঙ্গানো দড়ি বা তার টারে নয়। জল দিয়ে আগেই ধুয়ে নিয়েছিলো কয়েকটা ঝোপ। সেই ঝোপের উপরে সেগুলো বিছিয়ে দিলো।

এরপর একটা চেন তালা দিয়ে কানুনগোবাবু টিউবওয়েলের হাতলটাকে পাশের একটা লোহার খুঁটিতে বেঁধে দিয়েছিলেন। এতে করে আর কেউ টিউবওয়েলের হাতল টিপতে পারবে না। কানুনগোবাবু বলেছিলেন-

-কাজটাকে মোটেও অমানবিক ভাববে না। এলোমেলো হাতল টিপে টিউবওয়েলটা বিগড়ে গেলে মহা সব্বোনাশ। এর আগে একবার বিগড়ে ছিলো। রিপেয়ার হতে হতে তিনমাস পার।

তাই এই সাবধানতা।

এরপর আমরা তিনজনে চলেছিলাম ব্যাঙ্কের দিকে।

খানিক হাঁটার পর কুঁড়ে ঘরটা। এর পরেই জঙ্গল শুরু। ছোটো ঘরটাতে একটা টেবিল একটা চেয়ার একটা  ছোটো ক্যাসবাক্স। আর কটা কাগজ ভরা প্যাকিং বাক্স। ঘরের ছাদটা টালির। এটাই ব্যাঙ্ক। এই বাড়িটার মালিক ব্যাঙ্ক নিজেই।

ব্যাঙ্কই বানিয়ে নিয়েছে এটা।

আগে ব্রাঞ্চে একা কানুনগোবাবু ছিলেন এখন তো আমি এসে গেছি। ফলে দুইজন।চেয়ার তো একটা। কে কোথায় বসবো?

কানুননবাবু বলেছিলেন-

- একটা দিন তো। তুমি আজ এসেছো । আজ চেয়ারে তুমিই বসো। আর কাল তো আমি বাড়ি যাবো। বাড়ি যাবো আফটার ওয়ান ইয়ার।

একটু ভেবে বলেছিলেন - নাকি তারও বেশি। এক সাল বাদ বউ বাচ্চার সঙ্গে দেখা হবে। ফেরার পথে আর একটা চেয়ার নিয়ে আসবো খন। আর হ্যাঁ ডোন্ট ওরি। এক সপ্তাহের মধ্যেই ফিরে আসবো।

আমি চোখ কপালে তুলে বলেছিলাম।

- ততদিন এখানে আমি একা থাকবো?

- একা কেন? কুসনি আছে তো? কুসনি তোমার দেখা শোনা করবে। ইয়ে, তুমিও কুসনির দেখাশোনা করবে।

সেই রাতে তারই একটা হাফ ট্রায়াল রান হলো।

পরদিন সকালে কানুনগোবাবু বললেন। - হ্যাঁ গো অতনু। কুসনি বললো রাতে তুমি কিছুই করোনি।

না না বাপু ওরকম করবে না। কুসনি ইনসাল্টেড ফিল করেছে। আরে বললাম না এটা আলগা সোসাইটি। এখানে এখানকার নিয়মেই সব চলে। সে নিয়ম ভাঙ্গাটা বেনিয়ম হবে।

যখন মালগাড়ি এলো। কুসনি ঘন্টা বাজিয়ে দিলো। একটা ঝোলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাকিদের সাথে কানুনগোবাবুও লাইন ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর ট্রেন এলে বাকিদের মতো তাতে উঠে ঝুলে পড়লেন। এভাবে ঝুলতে ঝুলতে উনি পরের স্টেশনে চলে যাবেন। সেই স্টেশন দিয়ে প্যাসেঞ্জার ট্রেন যায়। তবে তার  গতিপথ অন্য লাইন দিয়ে। কুসনি আর আমি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কানুনগোবাবুর চলে যাওয়া দেখলাম। দেখতে দেখতে একসময় কুসনি আমার হাতটা খামচে ধরেছিলো। দেখেছিলাম ওর চোখে জল। মেয়েটা কানুনগো বাবুকে ভালোবাসে।

সেই রাতে আমরা দুজন দুই খাটিয়াতে শুলাম। তবে পুরো রাত নয়। না সে রাতে কুসনিকে ইনসাল্টেড হতে দিইনি।

কানুনগোবাবু ফিরেছিলেন এক সপ্তাহ নয়, দু সপ্তাহ পরে। ফিরেছিলেন জিপে একটা নতুন চেয়ার সমেত। চেয়ার ছাড়াও আরো আনেক জিনিসপত্র। চাল তেল নুন মসলা। মানুষের বেঁচে থাকতে যা যা লাগে।

না আমার জন্য অন্য বাসা খুঁজে পাওয়া যায়নি। একবছর ঐ গেটম্যানের ঘরেই কেটে গেছিলো। আমি সিম জারমের ঝোল রান্না করতে শিখে গেছিলাম। মালগাড়িতে ঝুলে ঝুলে যেতে শিখে গেছিলাম। ভাগ করে সাথে শোওয়া শিখে গেছিলাম।

মাসে একবার মালগাড়িটা থেমে থেমে বিশেষ কায়দায় হুইসেল দিতো। মানে সেদিন বেতনের দিন। মালগাড়ির গার্ড কুসনির বরের বেতনের খামটা নিয়ে দাঁড়াতো। কুসনি হাত বাড়িয়ে খামটা নিয়ে নিতো।  সেই খামের উপরে টিপছাপ দিয়ে খামটা ফেরত দিতে হতো ফিরতি ট্রেনে। সেই গার্ডের হাতেই।

কার টিপ ছাপ সেটা মেলানোর প্রশ্নই নেই। শুধু ছাপটা থাকলেই হলো। এরকমই চলছিলো।

তারপর একদিন আমার ট্রান্সফার অর্ডার এসে গেছিলো। এ ব্রাঞ্চ থেকে অন্য ব্রাঞ্চে যেতে হবে আমাকে।

আবার একা হয়ে যাবেন কানুনগোবাবু।

যাওয়ার দিন জিপ এসেছিলো আমাকে নিতে। সেদিনও দেখেছিলাম কুসনির চোখে জল। কানুনগোবাবুর হাত খামচে ধরে সে কাঁদছে। দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে।

আলগা সোসাইটির সম্পর্কগুলো নিয়ম বহির্ভূত হলেও মোটেও আলগা নয়।

এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমার প্রমোশন হয়েছে। এদিকে ওদিকে কয়েকটা বদলি হয়ে ফিরে এসেছি এই এলাকার কন্ট্রোল অফিসে। এখন আবার অন্য যুগ। Financial inclusion policy-কে তাকে তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন Closer, merger-এর যুগ। ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে VRS মানে স্বেচ্ছা অবসর স্কিম চালু হয়ে গেছে।

একদিন দেখি কন্ট্রোল অফিসে কানুনগোবাবু এসে হাজির। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে এক গাল হেসে উনি বলেছিলেন-

- আগেই খবর পেয়েছি, আপনি এখানে আছেন।

- কানুনগোবাবু আপনি আমাকে 'আপনি' বলছেন কেন? তুমি বলতেন তো।

- সে তো ওখানে। ওখানকার নিয়ম কি এখানে চলে?

- চলে। চলে খুব চলে।

তারপর কি ব্যাপার?

- ব্যাপার মানে, VRS নিয়ে নিলাম।

- ওমা কেন?

- ঐ ব্রাঞ্চটাতো তুলে দেওয়া হয়েছে।

- তাতে কি? সে জন্য তো আপনার চাকরি যাবে না। বরং ভালোই হবে ভালো জায়গায় বদলি হবেন, অন্য ব্রাঞ্চে।

আবার একগাল হাসি দিয়ে কানুনগোবাবু বলেছিলেন-

- অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে। ঐ আলগা সোসাইটির বাইরে আর কোথাও তো আমি টিকতে পারবো না।

- ওখানেই বা টিকবেন কি করে?

- ওই যে নাট বল্টু আছে।

বলে তিনি দুটো কালো কালো মিষ্টি দেখতে ছেলেকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। অফিসের সোফায় তারা চুপচাপ বসে আছে। ওদের চেহারায় কুসনির আদল স্পষ্ট।

চোখ মটকে চাপা গলায় কানুনগোবাবু বলেছিলেন, আমার ছেলে। একটা, মানে বড়োটা আপনারও হতে পারে। বলে হো হো করে হেসে উঠে ঝটপট হাসিটা গিলে ফেলেছিলেন।

তাঁর কাছে আর যা যা খবর পাওয়া গেছিলো, তা হলো, তাঁর আগের পরিবারের সঙ্গে তাঁর আর কোনো সম্পর্ক নেই। তারা সবাই ইউপি চলে গেছে। সেখানেই তাঁর বউয়ের বাপের বাড়ি। ওদের কোনো দোষ নেই। সব দোষ কানুনগোবাবুর। এই সোসাইটি তো আর আলগা সোসাইটি নয়। এখানে এরকম আলগা চরিত্রের বদমায়সি মেনে নেওয়া হয় না।

-আপনার নাট বল্টু মানে বাচ্চা দুটো তো খুব ছোটো। এখন আপনার চলবে কি করে?

-এই তো VRSএর দরুন কতোগুলো টাকা পেলাম। কুসনির বরের চাকরিটা তো এখনো আছে। মাসে মাসে মালগাড়ির গার্ড নিয়মিত বেতনের খাম পৌঁছে দিয়ে যায়। নো প্রব্লেম। আমাদের ঠিক চলে যাবে। তাছাড়া আলগা সোসাইটিতে খরচই বা কি?

মনে হয় আলগা সোসাইটির সাথে উনার বন্ডিংটা নাট বল্টুর দরুন আরো মজবুত হয়েছিলো।

এর পরের খবর আর জানি না।

কারণ আমি তো আলগা সোসাইটির লোক নই। আমার কোনো টান বোধ নেই।

আমি দেখেছিলাম বলতে বলতে অতনুর গলা ধরে এসেছে। চোখ দুটোও ছল ছল করছে। মানে অতনু ষোলোআনা সত্যি বলছে না!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন