সিনেমার পৃথিবী – ২৯
আজ ডেনমার্ক ও নরওয়ের ছবি নিয়ে কাটাছেঁড়ার দিন। শুরুতেই আপনাদের জানানোর জন্য দু-এক কথা, আমি জন্মসূত্রে ও ভোটার হিসেবে হুগলী জেলার শ্রীরামপুরের বাসিন্দা। আর এই শ্রীরামপুর, শ্রীরামপুর হয়ে ওঠার বহু আগে ছিল ড্যানিশদের ঘাঁটি। ১৭৫৫ থেকে ১৮৪৫। তখন এই শহরের নাম ছিল ফ্রেডারিক নগর। হুগলী নদীর দু’পাড়ে বিভিন্ন শহরে যেমন ইংরেজ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, পর্তুগীজরা কোন এককালে জমিয়ে বসেছিল, তেমনি সেই সময় এই শহরে ড্যানিশরা জাঁকিয়ে ব্যবসা করত। এমনকি ১৮১৮ সালে উইলিয়াম কেরি যখন শ্রীরামপুর কলেজ তৈরি করেন, তখন কোথায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়? সেই সময় শ্রীরামপুর কলেজ ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে নিজেরাই ডিগ্রি দিত, ফলে এটা ছিল বকলমে বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজরা ১৮৪৫ সালে ড্যানিশদের থেকে শ্রীরামপুর কিনে নেওয়ার পর আস্তে আস্তে বিভিন্ন নিয়ম বদল হয়। আর এই কারণেই দেখবেন, হুগলী নদীর দু’পাড়ের পুরনো বাসিন্দারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কথা উঠলেই নিজেদের শহর ও সেইসব দেশের ঔপনিবেশিকতা নিয়ে খুব ইতিহাসপ্রবণ ও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন, একটু-আধটু লেকচার ঝাড়তে চান, সে আমার মত পাঁড় নন-ইতিহাসবিদ লোকেরাও। ওগুলো হুগলী জেলার মুদ্রাদোষ, ভাল না লাগলে শুনবেন না, দু’কানের মধ্যে একটা চ্যানেল তৈরি করে এককান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যকান দিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেবেন।
যাইহোক, আজ আমরা শুরু করব ডেনমার্কের বিখ্যাত পরিচালক কার্ল থিয়োডোর ড্রেয়ার-কে (১৮৮৯-১৯৬৮) নিয়ে। কার্ল ড্রেয়ার ছিলেন একদম শুরুর দিকের ড্যানিশ সিনেমার পথিকৃত। ওনার সিনেমায় যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে ওঠে, সেগুলো শুরু হয় মনস্তত্ব দিয়ে। সেখান থেকে সামাজিক অবক্ষয় হয়ে ভয়, মৃত্যু ও অশুভের ছায়া অব্ধি। কিন্তু পুরোটাই স্লো মোশনে। ক্যামেরা কখনোই দ্রুত নয়। মাঝে মাঝে লঘুচ্ছলে মনে হয়, জীবনানন্দ নিশ্চয়ই ওনার সিনেমা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সারা জীবনে মাত্র ১৪টা ছবি বানিয়েছেন। এছাড়াও কিছু শর্ট ফিল্ম এবং ডকুমেন্টরী। ওনার সিনেমার ভেতর উল্লেখযোগ্য - দ্য পার্সন’স উইন্ডো (১৯২০), লিভস আউট দ্য বুক অব স্যাটান (১৯২১), মাইকেল (১৯২৪), মাস্টার অব দ্য হাউজ (১৯২৫), দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক (১৯২৮), ভ্যাম্পায়ার (১৯৩২), ডে অব র্যাথ (১৯৪৩), টু পিপ্ল (১৯৪৫), অর্ডেট (১৯৫৫),গারট্রুড (১৯৬৪) ইত্যাদি। এর ভেতর আজ ড্রেয়ারের মাত্র দুটো সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলো ১১ নং পর্বে উল্লেখ করেছিলাম - দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক এবং অর্ডেট।
চোদ্দ শতকের মাঝামাঝি থেকে পনেরো শতকের মাঝামাঝি অব্ধি একশ বছরের বেশি সময় ধরে ইংরেজ ও ফ্রেঞ্চদের যুদ্ধ চলেছিল। ফ্রান্সের সেই মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে জোয়ান অব আর্ক নামক এক বীরকন্যা ফ্রান্সের সেনাবাহিনীকে অনেক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ১৪৩১ সালে তাকে ইংরেজরা ধরে ফেলে এবং পুড়িয়ে মেরে ফেলে। ফ্রান্সে আজো কেউ কেউ তাকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা হিসেবে দেখেন। ‘দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক’ জোয়ানের ধরা পড়ার পর এবং পুড়িয়ে মারার আগে তার যে বিচার চলেছিল, সেই নিয়ে এক নির্বাক চলচ্চিত্র। এই ছবি বানানোর জন্য কার্ল ড্রেয়ারকে ফ্রান্সে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ছবির মুখ্য চরিত্রে ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত অপেরা অভিনেত্রী রেনি জিন ফ্যালকোনেটি। এবং এটা সত্যি যে ফ্যালকোনেটির অভিনয়ের জন্য এই সিনেমা আরো অনবদ্য হয়ে উঠেছে।
নির্বাক চলচ্চিত্রের জমানায় যে কটা সিনেমা একদম প্রথম সারিতে থাকবে, ‘দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক’ তাদের মধ্যে অন্যতম। এই সিনেমার জন্য ড্রেয়ার অনেক রকম কলাকুশলীত্ব গ্রহণ করেছিলেন। একদিকে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, অন্যদিকে বিচারের নামে প্রহসন, এই দুয়ের দোলাচলে এই সিনেমা। জার্মান এক্সপ্রেসনিজম নিয়ে আমি আগেই বলেছিলাম, এই ছবিতে এক্সপ্রেসনিস্ট লাইটিং ব্যবহার করা হয়েছে। স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স আগেও বিশ্লেষণ করেছি, এখানে সেই টেকনিক। অদ্ভুত এক অ্যাঙ্গল থেকে শুরু করে। নিঃশ্বাসের খুব কাছাকাছি যখন ফ্যালকোনেটিকে ভয় দেখানো হচ্ছে। এক সেটের সঙ্গে আরেক সেটের যোগসূত্র, যখন ক্যামেরা এক সেট থেকে আরেক সেটে মসৃণ চলে যাচ্ছে। আর ক্লোজ-আপে ফ্যালকোনেটির মুখের ওপর যখন ক্যামেরা, তার মুখে যখন একসঙ্গে যন্ত্রণা আর স্বাধীনতার আনন্দ। অনবদ্য মাস্টারমিস। হ্যাঁ, আপনি বলতেই পারেন ছবি মন্থর, ক্যামেরার কাজ ধীরে। কিন্তু নির্বাক জমানায় সেটাও এক মস্ত সাফল্য, যা এই ছবিকে পুরোপুরি বুঝতে সাহায্য করে। সমালোচক রজার এবার্ট এই ছবি প্রসঙ্গে অসাধারন এক কথা বলেছিলেন। সেটা দিয়েই শেষ করি – ‘you cannot know the history of silent film unless you know the face of Renee Maria Falconetti. In a medium without words, where the filmmakers believed that the camera captured the essence of characters through their faces, to see Falconetti in Dreyer’s “The Passion of Joan of Arc” is to look into eyes that will never leave you’।
জোয়ান অব আর্ক যদি বিশ্বাসের ছবি হয়, তাহলে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলের ছবির নাম ‘অর্ডেট’। গ্রাম্য ডেনমার্কের এক সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবার, বাবা বিপত্নীক, তার তিন ছেলের বড় মিকেল ভগবানে বিশ্বাস করে না। মিকেলের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। মেজোছেলে জোহানেস নিজেকে যীশুখৃষ্ট বলে ভাবে। ছোটছেলে অ্যান্ডার্স স্থানীয় এক নেতার মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এখানে শুধু যে এই পরিবারের নিজেদের ভেতরের ধর্মীয় সংঘাত দেখানো হয়েছে, তা নয়, এই পরিবারের সঙ্গে গ্রামের অন্যান্যদেরও কিছু কিছু ঝামেলার জায়গা রয়েছে। যাহোক, সিনেমার শেষদিক একটু গতানুগতিক যে কারণে এই ছবির ফিনিশিং আমার ভাল লাগেনি। কিন্তু এই ছবি ড্রেয়ারের কেরিয়ারের এক মাইলস্টোন।অর্ডেট মানে শব্দ, the word। সিনেমার থিম এক নাটকের স্টেজ শো থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কি সেই শব্দ? ড্রেয়ার যা অনুচ্চারিত রেখেছেন? আমার মতে, বিশ্বাস। এক শব্দ যা দিয়ে অনেক কিছুর সংজ্ঞা দেওয়া যায়। অনেক কিছু মেনে নেওয়া যায়। আবার উল্টোদিকে যুক্তি তর্ক উঠে আসে। আসলে এই সিনেমা ড্রেয়ার এক প্রিজম হিসেবে ব্যবহার করেছেন যেখানে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা দিয়ে মানুষের অবস্থা বোঝাতে চেয়েছেন। এবং যেটা না বললেই নয়, তা হল এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি। প্রথম কথা, ছবির সেট বেশ সহজ। আউটডোর শটগুলো প্রাণবন্ত। দূর থেকে দিগন্তে পায়চারি যেন এক মুঠো সবুজ বাতাস। প্রার্থনার সময়ে সামনে পেছনে দুলন্ত মানুষগুলো যেন হিপনোটিক। সাদা কালো আলো মনে ছড়িয়ে পড়ে, আস্তে আস্তে। সিনেমা শুরুর সময় ভুরু কুঁচকে উঠলেও পরবর্তীকালে ড্রেয়ার আমাদের এক ম্যাজিকের ভেতর নিয়ে চলে যান, যা ছবি শেষ হবার পরেও চোখে লেগে থাকে। এই ছবি দেখলে, আমি নিশ্চিত, আপনাদের মনে জাপানের পরিচালক ওজুর কথা মনে পড়বেই।
ড্রেয়ারের ছবি ছেড়ে দিলে ডেনমার্কে অন্যান্য যেসব পরিচালকদের কথা উঠে আসে, তারা ড্রেয়ারের পরবর্তী প্রজন্মের। এদের ভেতর আমি চারজন পরিচালকের চারটে ছবি পাঠকদের দেখার জন্য সুপারিশ করব - গ্যাব্রিয়েল অ্যাক্সেলের ‘ব্যাবেটে’জ ফিস্ট’ (১৯৮৭), বিলি অগস্টের ‘পেলে দ্য কনকয়ারার’ (১৯৮৮), সুজেন বিয়া-র ‘ইন আ বেটার ওয়ার্’ (২০১০) এবং থমাস ভিন্টারবার্গের ‘অ্যানাদার রাউন্ড’ (২০২০)।
২১ নম্বর পর্বে ডেনমার্কের অভিনেতা ম্যাজ মিকেলসেন-কে নিয়ে আলোচনা করার সময় ‘অ্যানাদার রাউন্ড’ নিয়ে কয়েক লাইন লিখেছিলাম। মিকেলসেনের অভিনয় যেখানে প্রধান উপজীব্য। তাই এখানে কাটাছেঁড়া করব ১৯৮৭-র ছবি ‘ব্যাবেটে’জ ফিস্ট’ আর ২০১০-এর ছবি ‘ইন আ বেটার ওয়ার্ল্ড’ নিয়ে।
উনিশ শতকের শেষদিকে ডেনমার্কের এক ধর্মীয় পরিবারে ফ্রান্স থেকে আসা একটি উদ্বাস্তু মেয়ে আশ্রয় নেয়। সেই পরিবারের দুই মেয়ে তাদের বাবার কথা ও ধর্মীয় অনুশাসনের কথা ভেবে বিয়ে করেনি। তাদের বাবা অনেকদিন হল মারা গেছেন। এবার তাদের পরিবারে ব্যাবেটে নামক এই উদ্বাস্তু মেয়েটি আসার পর সে একজন পরিচারিকা হিসেবে পরিবারের লোকেদের খেয়াল রাখতে শুরু করে। তারপর একদিন সে অনেক টাকার লটারী পায়। চলে যাবার আগে সে এই পরিবারের লোকেদের ও তাদের আত্মীয়দের একদিন ফ্রান্সের খাবার রেঁধে খাওয়াতে চায়। তার প্রতি এই পরিবার সহানুভূতি দেখানোর জন্য। সেই ডিনার সেটের অভিজ্ঞতা নিয়েই ছবি ‘ব্যাবেটে’জ ফিস্ট’।
বন্ধুত্ব, কৃতজ্ঞতা, ধর্মীয় অনুশাসন, আচার অনুষ্ঠান, খাবার লোভ – অনেক কিছু নিয়ে ১০২ মিনিটের এই ছবি। ব্যাবেটে খুব কম উপাদান নিয়েও একজন শিল্পীর মত রান্না করতে ভালবাসে। তার মতে, ‘the long cry from the heart of the artist is “give me a chance to do my very best” । খাবার পর সবার মনে এক অদ্ভুত আনন্দ আসে। আমারও মনে পড়ে যায়, লকডাউনের সময় আমরা কিভাবে বাড়ির ভেতর মাত্র কিছু জিনিষ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়েছি। খাবারের মূল্য বুঝতে শিখেছি। সময়ের সঙ্গে খাবারের গুরুত্ব কিভাবে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে, সেটাও বুঝেছি। এই ছবি, একটু অন্যভাবে দেখলে, সেই সময়ের দলিল। এই ছবি বেশ কয়েকটা পুরস্কার পেয়েছে যার মধ্যে অস্কার একটা।
সুজেন বিয়া পরিচালিত ‘ইন আ বেটার ওয়ার্ল্ড’ প্রায় দু’ঘন্টার ছবি। ছবির মূল চরিত্র দুই স্কুলপড়ুয়া ছাত্র। এক ডাক্তার, যার বাড়ি ডেনমার্ক কিন্তু কর্মস্থল আফ্রিকার এক রিফিউজি ক্যাম্প, বাড়ি আর কর্মস্থলে ঘনঘন যাতায়াত করেন। তার ঘরোয়া জীবন বেশ জটিল। স্ত্রীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ চলছে এবং ছেলে স্কুলে অন্যান্য ছেলেদের কাছে র্যাগিং-এর শিকার। এইসময় আরেকটি ছেলে সেই স্কুলে ভর্তি হয় এবং ডাক্তারের ছেলে ইলিয়াস-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায়। যে ছেলেরা ডাক্তারের ছেলেকে বিরক্ত করত, তাদের পাল্টা মার দেয়। প্রতিশোধ নেবার জন্য ইলিয়াসকে একটা ছুরি দেয়। একদিন ইলিয়াস যখন আরেকটা ছেলের সঙ্গে মারামারি করছে, ডাক্তার এসে দুজনকে ছাড়াতে যায়। কিন্তু অন্য ছেলেটির বাবা, এক মেকানিক, ডাক্তারকে সপাটে এক চড় মারে অন্য ছেলেটিকে ছোঁওয়ার জন্য। নিজের ছেলের কাছে ডাক্তার ছোট না হবার জন্য সেই মেকানিকের গ্যারাজে ইলিয়াস ও তার বন্ধুকে নিয়ে কথা বলতে যায়। বোঝাতে যায়। কিন্তু সেই মেকানিক এবারেও ডাক্তারকে বেশ কয়েকটা থাপ্পড় মারে। গালাগাল দেয়। বাবার এই অপমান দেখে ইলিয়াস ও তার বন্ধু প্ল্যান করে মেকানিকের সেই গ্যারাজ বোম মেরে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই বোমের আঘাতে ইলিয়াস নিজে জখম হয়। শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, ইলিয়াস ও তার বাবার বন্ধুত্ব আবার জমে উঠেছে। ডাক্তারের সঙ্গে তার স্ত্রীর সম্পর্কও আবার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে।ড্যানিশ ভাষায় এই ছবির মূল টাইটেল ছিল ‘Haevnen’ যার অর্থ প্রতিশোধ। সেটাকে আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে নরম করে তোলার জন্য মূলভাষার এই পরিবর্তন। সেই নিয়ে এই মেলোড্রামা ছবি। বলে রাখা ভাল, বিয়া ইমোশন ড্রামা নিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন। এই ছবির স্ট্রাকচার এবং এক সিনের সঙ্গে আরেক সিনের সাদৃশ্য মোটামুটি বোঝা যায়। দর্শক অনুমান করতে পারেন। পাহাড়ের মাথায় বা শেষ দৃশ্য, কি হতে চলেছে এগুলো বলে দেওয়া যায়। আফ্রিকার সিনগুলোর ইন্টারকাট এই ছবিকে আরেকটু আকর্ষণীয় বানিয়েছে। তবে ছবির মূল বিষয়বস্তু আরেকটু জটিল, আরেকটু অবজেক্টিভ হলে ভাল হত। এখানে যেন মনে হচ্ছে এই ছবি উচ্চবিত্তের এক বিশেষ শ্রেণীকে মাথায় রেখেই করা হয়েছে। আরেকটু ছড়িয়ে পড়লে, আরেক মাত্রা বাড়াতে পারলে, এই ছবিকে আমি ফুল মার্কস দিতাম। আপাতত দিতে পারছি না।
নরওয়ে থেকে আজ অব্ধি মাত্র ৬টা সিনেমা অস্কারের জন্য নমিনেটেড হয়েছিল – নাইন লাইভস (১৯৫৭), দ্য পাথফাইন্ডার (১৯৮৭), দ্য আদার সাইড অব সানডে (১৯৯৬), এলিং (২০০১), কোন-টিকি (২০১২) এবং দ্য ওয়র্স্ট পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (২০২১)। যদিও এর কোনোটাই অস্কার পায় নি। এর মধ্যে আমার সবকটাই দেখা। এবং ‘কোন-টিকি’ এখনো অব্ধি ও দেশের সর্বোচ্চ টাকা তোলা ছবি বলে মনে করা হয়। যাইহোক, নরওয়ের সিনেমা নিয়ে আমার সীমিত জ্ঞান এবং স্পেসের অভাবে আজ একটা ছবি নিয়েই আলোচনা করব। বেশি নয়।
আজ আমরা দেখব জোয়াকিম ট্রায়ারের ‘দ্য ওয়র্স্ট পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’। এই ছবির জন্য মুখ্য চরিত্র রেনাতে রাইন্সভে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন। এবং সিনেমা বলতে যদি বহমান জীবন বোঝায়, যদি ফেলিনির ‘লা ডোলচে ভিটা’ বোঝায়, তাহলে একেও সেই ব্র্যাকেটে রাখতে হবে। আমরা সত্যজিৎ বা মৃণালের কলকাতা ট্রিলজি দেখেছি। এই ছবি জোয়াকিমের ‘অসলো’ ট্রিলজির শেষ সিনেমা। রোমান্টিক ড্রামা।
নামের ভেতর একটা প্যারোডি আছে। অসলোর এক স্বাধীনচেতা তরুণী জুলি, ডাক্তারির ছাত্রী। নিজেকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কেরিয়ার নিয়েও পারে না। ডাক্তারি ছেড়ে সে সাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনো শুরু করে। তারপর ফটোগ্রাফি নিয়ে। তার প্রেমিক এক্সেল তার থেকে ১৫ বছরের বড় একজন কমিক আর্টিস্ট। এক্সেলের খামারবড়িতে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে গিয়ে এক্সেল তাকে বিয়ে করার প্রোপোজাল দেয়, কিন্তু জুলি সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফেরত আসার পথে এক বিয়েবাড়িতে সে ইভিন্ড নামক অন্য এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, যদিও জুলি আর ইভিন্ড দুজনেরই ফিঁয়াসে আছে। জুলি তার ৩০তম জন্মদিন তার মায়ের কাছে পালন করে। হঠাৎ একদিন জুলি এক্সেলকে ছেড়ে দিয়ে ইভিন্ডের সঙ্গে লিভ ইন থাকতে শুরু করে। কিছুদিন পর সে বুঝতে পারে সে গর্ভবতী। কিন্তু এই আগত সন্তানের বাবা কে? একদিন জুলি জানতে পারে এক্সেল ক্যানসারে ভুগছে। সে এক্সেলকে বলে সে প্রেগন্যান্ট। আবার ফিরে এসে ইভিন্ডকেও বলে দেয় সে প্রেগন্যান্ট। সন্ধেবেলা সে জানতে পারে এক্সেল মারা গেছে। ইভিন্ড তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। এবং বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে তার গর্ভপাত হয়ে যায়।
অনেকদিন পর, জুলি যখন কোন এক সিনেমার ফটোগ্রাফি শুটিং করছে, সে দেখতে পায় সিনেমার অভিনেত্রীর জন্য বাইরে ইভিন্ড ও তাদের বাচ্চা অপেক্ষা করছে। জুলি বাড়ি ফিরে এসে সারাদিন ধরে তার তোলা ফটোগুলো এডিট করতে শুরু করে।
অনবদ্য সিনেমা। শুধু থিমের জন্য। এইরকম বোহেমিয়ান ভালবাসার প্লট, বহমান জীবনের প্লট খুব কম ছবিতেই দেখা যায়। আমি ঐসব exquisite, wistful, instant classic এসব বলব না। শুধু বলব অনবদ্য পরিচালনা এবং রাইন্সভে-র ‘messy young woman’ অভিনয় ততোধিক উপভোগ্য। এবং আমি যেটা উপলব্ধি করেছি, তা হল ঘরোয়া জীবন ও আর্টিস্টিক জীবনের সংঘাত কখনো সখনো অনিবার্য। সেই সংঘাত এরকম সিদ্ধান্তহীনতার জন্ম দিতেই পারে। এই সিনেমায় আরো দেখুন নরওয়ের রাজধানী অসলো-র সৌন্দর্য। অসলো-র নাগরিক জীবন।
তাহলে নর্ডিক দেশের ছবির আলোচনা এই অব্ধিই।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন