কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধারাবাহিক উপন্যাস   


দিগন্তসেনা




পিপীলিকা, দ্বিধা আর মহিমা বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছেছে। তাই শামাঙ্গী ওদের সঙ্গে কয়েকটা দিন আলাদা করে কাটাবে  বলে ভাবল যাতে ওদের এই সময়ের জীবন ও সমাজ সম্পর্কিত নানা সমস্যায় ও সাহায্য করতে পারে। ও ওদের নিয়ে লাতিন আমেরিকায় এমনিতেই জনসংযোগ বিষয়ক কিছু কাজ ছিল, সেখানেই গেল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ও ওদের নিয়ে দেদার আড্ডা আর মজা করতে থাকল। নানা জায়গায় নানা রকম খাবার খেল। মেক্সিকোর উত্তর আর দক্ষিণ দিকটা ঘুরে ঘুরে দেখাতে দেখাতে ওদের ও মায়াদের আর আজতেকদের নানা গল্প বলতে লাগল। পাশের গুয়াদেলুপেও গেল। যেখানে যেখানে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের অবশেষগুলো মাথা তুলে এখনও কিছুটা নিজেদের জানান দিচ্ছে, এখনও সদর্পে তাদের অতীতকে ঘোষণা করছে, ওদেরও সেইখানে নিয়ে গেল। এখানে ও যেবার প্রথম এসেছিল সেইসব গল্প বলতে বলতে আস্তে আস্তে মেয়েদের ঋতুমতি হবার  কারণগুলো ব্যাখ্যা করে বলতে লাগল। তারপর তার ব্যতিক্রমের সম্ভাবনার কথা ও কারণগুলো বুঝিয়ে বলল। পেরুতে গিয়ে ঘুরে দেখে ও ওর ছোটবেলার গল্প আর সেই প্রবাদটা ‘মেয়েদের চোদ্দহাত কাপড়ে কাছা না আঁটার’ গল্প বলল। তারপর তার মানে আবিস্কার করার জন্য শকুন্তলাকে ঘিরে যে ঘটনাটা ঘটেছিল সেটাও বলল। শকুন্তলার সন্তান জন্ম দেওয়ার আর চৈতি ও উপত্যকার গল্পও বলল। মেয়েদের আর ছেলেদের শারীরিক তফাৎ ও গড়নের তফাৎ নিয়ে নানা গল্প করল। সকলেরই যে একটা নয়, দু দুটো করে খিদে হয় আর সেগুলোর উৎসস্থলের কথাও বুঝিয়ে বলতে বাকী রাখল না। পাশাপাশি সেই খিদেটা কীভাবে মেটাতে হবে যা খুব দরকারি, তাও শিখিয়ে দিল। সেইসঙ্গে ও ওর বয়ঃসন্ধিকালের গল্প আর অন্যদের হাবভাবের কথাও বলে সামাজিক চোখ রাঙানির কথাও বলল। এই কদিনের ছুটি কাটিয়ে তারপর আবার জীবনের বাঁধাধরা সময়ানুপাতিক কাজগুলোয় ফিরে গেল।

শকুন্তলা শ্যামাঙ্গী আর চৈতিকে নিয়ে শ্যামাঙ্গীর বাড়িতেই খুব প্রয়োজনীয় আর কিছুটা গোপন এক বৈঠকে শামাঙ্গীকে জানাল যে ওর মনে হচ্ছে মূল ভূখন্ডের নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব দলটাকে আস্তে আস্তে রাজনীতির আঙিনায় নিয়ে যাবার খুব প্রয়োজন আর সেই সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার গণমাধ্যম দুটো, বেতার আর দূরদর্শন ব্যবহারের সুযোগ থেকে ওরা বঞ্চিত হচ্ছে বলে কতটা জনসংযোগের ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে সেটাও জানাল। শ্যামাঙ্গীর মনে হল কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে সঙ্গেই ও ওর সম্মতি জানিয়ে দিল। ফলে ওরা নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব-এর পরবর্তী কোর কমিটির বৈঠকে তা নিয়ে আলোচনা করে ঘোষণা করে দিল যে দলটা এখন থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করবে। এই ঘোষণায় ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব যদি রাজনীতিতে এসে ভোটে দাঁড়ায় তাহলে তো তাদের ভরাডুবি অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এ কথাটা সকলেই মনে মনে রেখে দিল। ভাবল, প্রকাশ্যে বলে নিজেদের দুর্বলতা পার্টিকর্মী ও সহকর্মী সমর্থকদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলার কোন প্রয়োজন নেই। বরং ওরা নানা কথা বলে শামাঙ্গীদের দলটাকে দুর্বল আখ্যা দিতেই উঠে পড়ে লাগল। শ্যামাঙ্গী, শকুন্তলা, চৈতি বা ওদের দলের সদস্যরা এতটা গন্ডমূর্খ নয় যে  ওদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আঁচ করে নিতে পারবে না। তবে মুখে কেউ কিছুই বলল না। অন্যদিকের কেউ কেউ প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিল যে শুধু ধর্ষণের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে কাজ করে ওরা আসলে কিছুই করতে পারবে না। কথাটা যে চৈতি বা শকুন্তলা এমনকি দলের অন্যরাও ভাবেনি, তা নয়। সেটা তারা ইতিমধ্যেই ভেবে তাদের কাজের ধারা ও গতি বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্তও নিয়ে নিয়েছে সামনে কোন কোন কর্মসূচী কীভাবে পালন করবে। ইতিমধ্যে কোর কমিটির  অন্যদের সঙ্গে চৈতি আর শকুন্তলাও নানা জায়গায় জনসভা করে বেড়াতে লাগল।

(১৪)

নতুন সরকার আর তার নানা দফতর কোথায় কে কেমন কাজ করছে সেটা দেখা দরকার বলে শ্যামাঙ্গী এবার এক একদিন এক একজনের কাজের নমুনা দেখতে যাবে বলে ঠিক করতেই মনে হল সুদাম আর ভ্যালেনতিনা ইয়েব্রা ইতিমধ্যেই দু দুবার আলাদা আলাদা করে দেখে এসেছে। তাই এক্ষুণি না গেলেও চলবে। তারপর হঠাত মনে হল, যাবে যখন ভেবেছে তখন আপাতত ক্রীড়া দফতর ও পরিবহন দফতরটা দেখে আসাটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যাওয়ার ঠিক আগেই শ্যামাঙ্গীর মনে পড়ে গেল তার চোদ্দজন ছেলেকে বয়ঃসন্ধিকালীন শিক্ষা ও উপদেশ  দেবার জন্য সেক্সোলজিস্ট ডঃ সাধুখাঁ ও মনোবিদ ডঃ তেরেস্কোভের কাছে সেদিনের পরেরদিনই ওদের পাঠাবার জন্য সময় নেওয়া আছে আগে থেকে। তাই সে তার সহকারী পেদ্রো গুয়েররেসকে পাঠালো আবাসিক বিদ্যালয়ে যাতে সে কাল রবিবার সকালেই ওদের নিয়ে আসতে পারে ছুটি করিয়ে আবাসিক বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আর সোজা যেন চলে যেতে পারে দুজন ডাক্তারের চেম্বারে সকাল সকাল যাতে একই দিনে তাদের সবার শিক্ষা ও উপদেশ দেওয়ার ব্যাপারটা সম্পন্ন হয়ে যায়। ফলে শনিবার আর রবিবার দিনটা পার করে শেষে সোমবার দিন সে  যায় সরকারি প্রশাসন ভবনে পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট দুই মন্ত্রীর ঘরে। প্রথমে গেল জি ল্যাব্রুসের ঘরে। তার সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করল কাজ করতে গিয়ে কোথায় কোথায় তার অসুবিধে হচ্ছে আর কীভাবে সে কাজগুলো করছে তার পদ্ধতিগুলো।  তারপর গেল আদ্রিয়ানা আলারকার ঘরে। সেখানে গিয়েও ও একইভাবে সমস্ত ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল আর তার বলা কথাগুলো শুনতে লাগল। আদ্রিয়ানা আলারকার ঘরেই  জি ল্যাব্রুসকে ডেকে পাঠিয়ে তিনজনে একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করল আর তাতে স্থির হল প্রত্যাশিত মেট্রোরেল প্রকল্পটা দক্ষিণের দিকে আরও কিছুটা দূর অব্দি নিয়ে যাওয়া হবে। তার জন্য আরও যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন হবে, অর্থ  দফতরে সেটা জানান হবে এখনই যাতে সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাওয়া যায়। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে শ্যামাঙ্গী চলে গেল ক্রীড়া দফতরে। তিনজন মন্ত্রী লুদিভিন দ্যুভাল, রামন পিসাররো ও জন ব্রাউনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আলোচনা করে জেনে নিল তাদের কাজের গতিপ্রকৃতি ও অসুবিধে সুবিধের কথা। লুদিভিন দ্যুভাল ওকে জানাল ক্রীড়া দফতরের তরফ থেকে কয়েকটি ক্লাবকে বেছে নিয়ে সেখানে প্রচুর ছেলেমেয়েদের শুটিং শেখানো্র ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ও তখন বলল যে ও জানে লুদিভিন এই ব্যবস্থাটা করতে পারে আর লুদিভিন দ্যুভাল আবার বলল সেইসব ক্লাবগুলো ও যদি দেখতে যেতে চায়, তাহলে দেখতে যেতে পারে। এ ছাড়াও জুডো ও বক্সিং শেখানো হচ্ছে যাতে তারা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারে সেই জন্যে। ও  লুদিভিনের কাছ থেকে ক্লাবের নাম আর তাদের শেখানোর সময়গুলো জেনে নিল। জন ব্রাউন বলল যে বিদেশে যে ভাবে খেলার জগতে পেশাদারী ভাবে খেলাকে বেছে নেওয়ার ট্রেনিং দেওয়া হয়  ও সেইভাবেই ছেলেমেয়েদের মোটামুটি পাঁচ ছ’বছরের মধ্যে যাদের বয়েস তাদেরকে ক্রিকেট ও ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ও টেবিল টেনিস, কবাডি ও বাস্কেটবল খেলাগুলো শেখানো আর তাদের থাকার ব্যবস্থাও একটা কিছু করার কথাও সে ভাবছে। কেননা বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা দূর দূর থেকে আসে। ফলে আসতে যেতেই তাদের বেশ খানিকটা  সময় ও শ্রম নষ্ট হয়ে যায়। এই প্রকল্পটা একটু ভেবে দেখলে ভালো হয়। ও জানাল সমস্ত ব্যপারটার ডিটেলস ফাইল বন্দী করে সুদাম চট্টোপাধ্যায়ের কাছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দিতে। তারপর দেখা যাক সে এই বিষয়ে কী ভাবে, সেই মত এগানো যাবে। লুদিভিন ও জন ব্রাউন চলে গেলে রামন পিসাররোর সঙ্গে শ্যামাঙ্গী নিরিবিলিতে কথা বলতে শুরু করল। রামন পিসাররো বলল যে ওরা যদি এভাবে খে্লাধুলোয় গুরুত্ব সহযোগে অর্থ বিনিয়োগ করে তাতে যেমন প্রতিভাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা উঠে আসবে, ঠিক তেমনি বডি ফিটনেস ও শৃঙ্খলিত জীবনযাপনের জন্য যদি কখনও দরকার হয়, দেশরক্ষার কাজে বা হঠাত যুদ্ধ বা দাঙ্গা বাঁধলে বা এমনিও এখান থেকে সেনাবাহিনীতে কেউ চাইলে যোগদান করতে পারবে। রামন পিসাররোর এই কথাটা শ্যামাঙ্গীর কান দিয়ে সোজা মাথায় চলে গিয়ে একেবারে মগজের মাঝখানে যেন স্থায়ী আসনে বসে গেল। ও তখন রামন পিসাররোকে বলল যে শুধু এই জন্যেই লুদিভিন ও জন ব্রাঊন চলে গেলে ওর সঙ্গে রামন পিসাররোর নিরিবিলিতে কথা হোক, ও চেয়েছিল। ও ওখান থেকে বেরিয়ে এসে সুদামের সঙ্গে দেখা করে কথা বলল আর সব কথা জানিয়ে রাখল। তারপর বাড়ির দিকে রওনা দিল। ফিরে দেখল, শকুন্তলা আর চৈতি ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ওকে দেখে ওরা বলল যে প্যান্টশার্টকোর্টটাইএ ওকে নাকি একদম কর্পোরেটদের মত দেখাচ্ছে। ও ওদের বসিয়ে পোশাক বদলে আবার এল আর চা কফি খাবারের ব্যবস্থা করতে বলল। চৈতি আর শকুন্তলার সঙ্গে দেদার আড্ডা আর হাসি, ঠাট্টা আর মজার মধ্যেই শ্যামাঙ্গী বলল যে শ্রাবণ-সোফিয়া বিয়ের ভয়ে এখানে আসছে না নাকি এখানকার ভয়ে বিয়ে করছে না নাকি অন্যকিছু। সপ্তাহে দুতিন দিন শ্রাবণ এখানে থাকে আর তারপরই আবার চলে যায় বিদেশে। ওর মনে হয় আসলে এটা একটা বিদেশী আগ্রাসন যেটা কিনা আসলে ষড়রিপু থেকে উদ্ভুত। এইভাবে কোন মন্ত্রী কাজ করে শোনা যায়নি। চৈতি বলল, তাতে যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্যই তো দুজন করে মন্ত্রী রাখা হয়েছে। তখন ও বলল যে আসলে দুজন করে মন্ত্রী রাখা হয়েছে বলেই এটা হচ্ছে। শ্যামাঙ্গী শকুন্তলাকে বলল, ‘তারপর?’ সঙ্গে সঙ্গে চৈতি বলল, ‘আরে, ছানাপোনা,  ছানাপোনা! তাই না পিপি? তুমি তাই জানতে চাইছ তো?’ শকুন্তলা বলে, ‘পিপি, আমি, আমি চৌত্রিশ পিস দিয়েছি।  বল। দিইনি? তুমি তো একটা দিয়েই ফাঁকিতে বাজিমাত করে দিলে। বল, পিপি, এটা কি ঠিক হল?’ শ্যামাঙ্গী বলে ‘জনবিস্ফোরণ হচ্ছে। তুই তার হোতা’। এইভাবে চাপান উতোর হতে হতেই শ্যামাঙ্গী বলল যে পুপুর মেয়ে আগমনীর কান্ড কারখানা। আর তখনই শকুন্তলা বলল ইলোরার কথা। চৈতিও সঙ্গে সঙ্গে বলল যাজ্ঞসেনীর নানা ক্রিয়াকলাপ, যা শুনে থ হয়ে গেল শ্যামাঙ্গী। তারপর বলল, ‘দাঁড়া। দেখতে হচ্ছে তো বেটা দুটোকে!’ সঙ্গে সঙ্গে ওরা বলল, ‘বেটা  নয় পিপি! বেটি, বেটি! ওরা বলে আর শ্যামাঙ্গী শুনে নিজের ভুলটা ঠিক করে নেবার বদলে তুমুল হাসিতে ফেটে পড়ে। হঠাত বাইরের দরজার দিক থেকে শুভেচ্ছা গুড়গুড় করে ঘরে ঢুকে আসছে দেখে শ্যামাঙ্গী বলে, ‘এই, তুই আবার কোথা থেকে এলি?’ কথাটা যেন তৈরীই ছিল আগে থেকে, শকুন্তলা শুধু মুখে একবার যেন দায়িত্ব নিয়ে উচ্চারণ করে দিল। এমনিভাবে বলল, ‘কেন! তোমার পেট থেকে! কোন সন্দেহ আছে’? শ্যামাঙ্গী হাসবার উপক্রম  করতে করতেও নিজেকে সামলে নিয়ে দেখল যে  ওর সহকারী পেদ্রো গুয়েররেস ঘরে ঢুকল। ও তাকাতেই ওকে পেদ্রো বলল যে দুদিন ধরে বায়নাটা করতে করতে আজ দুপুরে স্কুল থেকে ফোন এসেছিল যে ও শ্যামাঙ্গীর কাছে আসতে চায়। তাই পেদ্রো নিজেই গিয়েছিল স্কুলে ওকে আনতে। শ্যামাঙ্গী শুভেচ্ছাকে কাছে ডাকল, ‘আয়, মম, কাছে আয়’, বলে ওকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আবার ওদের সঙ্গে কথা  বলতে শুরু করল। 

সকালে উঠে বেরোবার তোড়জোড় করতেই শুভেচ্ছা এসে শ্যামাঙ্গীর পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকল। ও ওকে বলল যে  ও অফিসের কাজে বেরোবে। শুভেচ্ছা জেদ ধরে বসে ও-ও যাবে মার সঙ্গে। জোরে একটা ধমক দিতেই মেয়েটা  ফুঁপিয়ে কেঁদে  উঠল। শ্যামাঙ্গী  ওকে কোলে নিয়ে আদর করে ওর মান ভাঙাল। তারপর কাজের জন্য আজ নতুন যে এসেছে তাকে বলল ওকে তৈরী করে দিতে, তারপর ওকে নিয়েই বেরোল। যে সব ক্লাবগুলোর কথা বলেছিল, সেই সব ক্লাবগুলোতে পেদ্রো গুয়েররেস ওকে নিয়ে গেল। ও শুভেচ্ছাকে হাত ধরে নিয়ে দেখতে দেখতে ঢুকল। দেখল যে অনেক কমবয়সী ছেলেমেয়েরাই রাইফেল শুটিং শিখছে। তার মধ্যে ওর চোদ্দজন ছেলেও আছে আর তারা ওর দিকে তাকাতে তাকাতে এতই অমনোযোগী হয়ে পড়ল যে একজনের শুটিঙের ফলে অন্যজনের হাতের বন্দুক আর এক জনের মাথার ওপর উঠে সোজা আকাশের দিকে ঠা ঠা ঠা ঠা করে গুলিবর্ষণ করেই চলল। পরিস্থিতি দেখে তার পাশের জন এমন ভয় পেল যে দৌঁড়তে শুরু করে দিল। সেই দৌঁড় শেষ পর্যন্ত এমন সংক্রামক হল যে গোটা ট্রেনিঙের চেহারাটাই বদলে গেল। ওর মনে হল ওর ঢোকাতেই কোথাও ভুল ছিল। ও সোজা বেরিয়ে গিয়ে নতুন করে ঢুকল। তখনও আগের বারের মতই পুনরাবৃত্তি দেখতে পেল। ওর  খুব ক্লান্ত লাগল। এত ক্লান্ত লাগল যে ওর খুব ইচ্ছে হল মাঠে গিয়ে প্রত্যেকটা ছেলেমেয়েকে ধরে ধরে শুটিং শিখিয়ে দিতে। ও জানে যে  ও ইচ্ছে করলেই সেটা করতে পারে। ওকে না বলার জন্য এমন কেউই নেই যে এগিয়ে আসতে পারে। তবু ও ওটা করল না। সোজা বেরিয়ে এসে গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে দিয়ে পেদ্রো আর শুভেচ্ছাকে ডাকাল। তারপর পেদ্রো ওকে জিজ্ঞেস করল পরের ক্লাবগুলোতে যাবে কিনা। ও বলল ও যাবে। ঠিক সেই সময়ই পেদ্রো ডানদিক থেকে তাকাতেই দেখতে পেল শ্যামাঙ্গীর মুখ চোখ নীল হয়ে গেছে। শরীর আর চোখের ভেতর থেকে পোড়া গন্ধ বেরাতে লাগল। ও সোজা বাড়ি ফিরে সবাইকে খবর দিল। ততক্ষণে বসার ঘরের সোফায় শ্যামাঙ্গী আধ ঝোলা হয়ে শুয়ে আছে আর শুভেচ্ছা ওর মাথাটা নিজের কোলের ওপর নিয়ে ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মন্ত্রীসভার প্রায় সব মন্ত্রীরা এসে ভিড় করল ওর ছোট একটা মামুলি বাড়িতে। কেউ একজন ওকে বিছানায় শোয়ানোর কথা বলতেই অন্যরা সেটা সঙ্গে সঙ্গে করে ফেলল। মাঝরাতে ও দেখল ওর পোশাক বদল করা হয়েছে। ওর কী হয়েছে, কী হচ্ছে আর কী হতে যাচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে সবটাই গুলিয়ে ফেলল আর বুঝতে পারল আস্তে আস্তে ও একটা আগ্রাসনের শিকার হতে যাচ্ছে। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই ওর মনে হল জীবন আসলে ঋণাত্বক আর ধনাত্বক এই দুই প্রকারের আগ্রাসনেরই একটা দ্বান্দিক ফলাফল মাত্র। ও দেখল ওর শরীরের এক খন্ডাংশ বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। হঠাত করেই মনে হল ওকে এই আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সবসময় নিজের কাছাকাছি রাখা ভীষণ জরুরী। ততক্ষণে শুভেচ্ছা ঘুম ভেঙে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। ফলে ও আর কোথাও যেতে পারছে না। ও আবার বিছানায় শুভেচ্ছার পাশটাতে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়েই ওর সঙ্গে কথা বলার মধ্যে দিয়ে ওকে বোঝাতে চেষ্টা করল যে মানুষ মাত্রেই, সকলেই কোন না কোন এক আগ্রাসনের শিকার। আর জীবনযাপনের আসল মানে হল সেই আগ্রাসনের হাত থেকে উত্তরণের একটা প্রচেষ্টা মাত্র। শুভেচ্ছা মার কথা কিছুই বুঝতে পারল না। ও জিজ্ঞেস করল যে আগ্রাসন মানে কী? তখন শ্যামাঙ্গী ওকে বলতে থাকল যে মানুষ আসলে লোভের দাসত্ব করে। পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে জয় করার বদলে, ষড়রিপুকে বশ্যতা মানানোর বদলে মানুষ নিজেই ওগুলোর বশ্যতা শিকার করে নেয়। সেই জন্যেই লাতিন আমেরিকার সমস্ত সোনারুপো আর অজস্র গাছগাছালি, পেট্রোলিয়াম, এমন কি মানুষগুলো্কে পর্যন্ত অধিকার করে নিয়ে, স্পানিয়ার্ডরা তাদের বশ মানিয়ে নিজেদের খেয়ালখুশির খিদমত খাটতে ইন্ডিয়ানদের বাধ্য করেছিল। শুভেচ্ছা ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল যে ও নাকি এসব কিছুই কোনদিন শোনেনি আর এগুলোর একটা বর্ণও কিছু বুঝতে পারছে না। তখন শ্যামাঙ্গী কিছুই ভেবে উঠতে পারল না ওর কী করা উচিত আর। ও প্রথমেই শুভেচ্ছাকে জিজ্ঞেস করল যে ও কবে কখন স্কুলে ফিরে যাবে। ও বলল যে ও আর কোনদিনই স্কুলে ফিরে যাবে না। বরং ও এখন থেকে শ্যামাঙ্গীর কাছেই থাকবে। শ্যামাঙ্গী তখন ওকে জিজ্ঞেস করল যে ও লেখাপড়া করতে চায় কিনা। ও জানালো যে ও চায়। তবে সেটা শ্যামাঙ্গীর এখানে থেকেই। শ্যামাঙ্গী জানতে চাইল যে শুভেচ্ছা কেন এটা করতে চাইছে। শুভেচ্ছা বলল যে তাহলে ও শ্যামাঙ্গীকে দেখতে পারবে। সে বেচারা  আরও জানাল যে ওর মার খুব শরীর খারপ, ও না থাকলে ওর মা হয়তো মরে যাবে, আর মা ছাড়া তো এই পৃথিবীতে ওর আর কেউ নেই। শ্যামাঙ্গী যখন বলল যে সেই জন্যেই তো ওর আরও বেশি করে স্কুলে যাওয়া উচিত, কেননা ওখানকার সবাই ওর দেখাশোনা করতে পারবে, তাতে ও ওকে পাল্টা বোঝাবার চেষ্টা করল যে ওই কারণেই ও ওখানে ফিরে না গিয়ে এখানে ও ওর মাকে দেখবে আর ওর মা ওকে দেখবে। ও হবে ওর মায়ের মা আর ওর মা তো ওর মা হয়েই আছে। আবার উল্টো দিক থেকে ওর মা হবে ওর মেয়ে আর ও তো ওর মায়ের মেয়ে হয়েই আছে। এই হিসেব শ্যামাঙ্গী আগে কখনও কোথাও শোনেনি। আস্তে আস্তে ও নিজেকে এই হিসেবের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার ভেতর হারিয়ে ফেলল আর কিছুক্ষণ পর ও হঠাতই আবিস্কার করল এর ভেতরে হারিয়ে যেতে ওর খুব আরাম আর তৃপ্তি লাগছে। ওর মানময়ীর কথা মনে হল। যেন ও মানময়ীর স্পর্শ পেল। শুভেচ্ছাকে বলল, ‘তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে কী বলা হবে?’ তাতে শুভেচ্ছা জানালো যে এই ব্যাপারে  ওর কাউকে দরকার নেই, ও নিজেই যা বলবার বলবে। ফলে সহকারী পেদ্রো গুয়েররেস ওকে স্কুলে নিয়ে গেল ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে যেটা কিনা ওর খুব ভালো লাগল, কিন্তু স্কুলে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ও একাই কথা বলে সমস্ত বিষয়টার যুক্তি আর ব্যাখ্যা দিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে ওর সব জিনিসপত্র নিয়ে যেতে বলল। তখন ও বলল যে ও সেই জন্যেই তো এখান থেকে চলে যেতে চাইছে। শেষ পর্যন্ত সব জিনিসপত্র নিয়ে পেদ্রো গুয়েররেসের কাছে এসে ও দাঁড়াল। পেদ্রো ওকে বাড়িতে নিয়ে এল শ্যামাঙ্গীর কাছে। ও ফিরে এসে খুব গম্ভীরভাবে শ্যামাঙ্গীর সামনে আধো আধো উচ্চারণে ঘোষণা করল, ‘আজ থেকে আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকব। তোমাকে ছেড়ে আমিও কোথাও  যাব না। তুমিও আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। শুধু প্রাত্যহিক মামুলি কাজগুলোকে এই আওতার বাইরে রাখা হবে’। আর এই ভাবেই শুরু হয়ে গেল শ্যামাঙ্গী আর শুভেচ্ছার যৌথ জীবনপর্ব, যার ফলে শুভেচ্ছা হয়ে উঠবে সমস্ত চাপা দেওয়া, গুপ্ত যন্ত্রণা ও আত্মকথার এক বিস্তৃত বই। সেই বইয়ের পাতায় পাতায় থাকবে প্রতি মুহূর্তে নব  তরঙ্গের দীক্ষা, মেরুদণ্ডে থাকবে বোধ বিন্যাসের অভূতপূর্ব আয়তাকার সংযম, মলাটের ওপরে জীবনের আকাঙ্ক্ষায় নিমজ্জিত তুলির টানে অঙ্কিত ঋজু ও দৃপ্ত সময়চেতনা। প্রতিটি পাতায় পাতায় আরও যা থাকবে – জাগতিক বিষণ্ণতা ও যন্ত্র্ণার সেই মেলবন্ধন যেটা ছাড়া ওদের গোটা পরিবারের ঐহিক উদ্দেশ্য ও যাপন চিরকালের মত  ব্যর্থ হয়ে যাবে। ব্যর্থ হয়ে যাবে ওর মায়ের জন্ম, চর্যাপদ, এমনকি মৃত্যুও। তাই ও গোটা জীবন ভর নিজেকে সেগুলোর একটা চলমান ও জীবন্ত প্রদর্শন কক্ষ হিসেবে বয়ে বেড়াতে থাকবে সেই ততদিন পর্যন্ত যতদিন না আরও অন্য কেউ এসে ওগুলোর পার্থিব ভার ওর থেকে রীতিমত ছিনিয়ে নিয়ে ওর ওপর নিজের অধিকারের গৌরব ও তার নিশান উড়িয়ে দিয়ে ভাগ করে নেবে ওর সব কিছু আর ওর সঙ্গে নিজের চলার ছন্দ ও লয় মিলিয়ে নিয়ে স্পর্ধিত পদক্ষেপে হেঁটে যাবে পাশাপাশি। 

সেই নতুন করে বাড়িটা ভেঙে গড়ার বা বাগানে সব্জি ফলানোর দিনগুলো থেকে মানময়ী অনেকটা দূর চলে এসেছে। সংসার এখন অন্যের দায়িত্বে। ছেলেমেয়ে, নাতিপুতি নিয়ে আদিখ্যেতা আর খেলাধুলো করবার এই দিনগুলোতে দায়দায়িত্বহীন জীবনের গতিতে একটু একটু করে নৈরাজ্য মাথা চারা দিয়ে উঠছে যেন শরীরে। ক্রমশ তার ঋজু ও দৃপ্ত  চলন এবং বলনও কোথাও একটা হারিয়ে যাচ্ছে। শৈশব আর যৌবনের নানা কথা আজকাল জীবনে এসে উঁকি দিয়ে যায় বার বার প্রায় দিনই। অনঙ্গও আস্তে আস্তে তার বহনযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে বয়সজনিত কারণেই মূলত। ফলে মানময়ীর ব্যাপারে তার চিরকেলে দায়িত্বজ্ঞানটা আজকাল আর খুব একটা কাজ করে না। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে ক্ষেপে ওঠে।  অকারণ স্খলন পতনে আগ্রাসন শুরু হয় আর সেটা প্রত্যেকবারই নতুন নতুন বিন্দুতে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যেকটা বিন্দুই তার আগেরটার চেয়ে অগ্রগামী স্থান, কাল ও পাত্র – এই তিনটির নিরিখেই। অতএব ক্ষয় ও লয় তো অবশ্যম্ভাবী। শ্যামাঙ্গীর অস্তিত্বের এক অপর হল অনঙ্গ। সেটা জন্মাবধি। পরে তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধগামী হয়েছে, ঊর্ধমুখী হয়েছে। আঁচল দিয়ে আড়াল করে রেখেছেন চিরকাল মানময়ী এইজন্যে শ্যামাঙ্গীকে। শ্যামাঙ্গী লড়াকু, প্রতি আক্রমণ ও প্রতি আগ্রাসনে বিশ্বাসী যেখানে মানময়ী চিরকালই অক্ষম। মানময়ীর বাগান চিরকালই আলোকিত। শ্যামাঙ্গীর অন্ধকার বাগানে চলে নিরন্তর আলোর উঁকিঝুঁকি। এইটুকু পারম্পরীন তফাৎ যেটা আসলে অনেকটা, কিন্তু অনেকটা নয়, সেটা ওর মা বাবা দুদিক থেকেই যদিও এসেছে আর দুজনেরই আলোময়তা যেন খুব পরিকল্পনা মাফিক সাজানো গোছানো ভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে শ্যামাঙ্গীর মধ্যে। সমস্ত ধনাত্বক বিষয়ের সমাহারেই শ্যামাঙ্গী যেন বিকশিত। ঋণাত্বক সব কিছু যেন খুব পরিকল্পিত ভাবেই ওর মধ্যে অনুপস্থিত, একথা সকলেরই মনে হয়।

এর মধ্যে ফাগুন আর শ্রাবণ ফিরে ওই বাড়িতেই থাকতে শুরু করে। বিবাহের অন্তসারশূন্যতা নিয়ে এ পরিবারে  যদিও আর কারো মনেই খুব একটা প্রশ্ন নেই। তবু একটা উৎসবের কথা কেউই ফেলে দিতে পারে না। বিবাহের জন্য উৎসব, না উৎসবের জন্যেই বিয়ে এই প্রশ্নে প্রায় সকলেই দ্বিতীয় দলে। তাই খাতা কলম আর সই সাবুদ ছাড়া বাকী সব বর্জন করা হল। কনেরাও রীতিমত প্যান্টশার্ট আর কোটে বুটে নিজেদের মুড়ে সইসাবুদ করে বড় হোটেলের গ্রান্ড পার্টিতে পানপাত্র হাতে দেদার হাসি মজা করতে করতে সময় কাবার করে দিল। বুফে সিস্টেমে খাওয়াদাওয়া নাম মাত্র সেরে যে যার  মত ফিরে গেল। রাতে বিছানায় শুয়ে গল্প করতে করতে শ্রাবণ সোফিয়াকে বলে, ‘আজকের রাতটাকে ফুলসজ্জা না বাসর রাত কি একটা যেন বলা হতো আগে।‘ সাসা জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’ শ্রাবণ বলল, ‘ওই রকমই চল ছিল। অবশ্য এখনও যে একেবারে নেই তা নয়’। সেই ফাঁকে সোফিয়া তার ক্লান্তিকে ঘুমের ঊষ্ণতায় মুড়ে নিল। ফাগুন আর অভিনন্দা হাসি আর গল্পে নানা লোকের পোশাক আর হাবভাব নিয়ে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল। নাতিদের বিয়ে দেখে মানময়ী আর অনঙ্গ খুব বিশেষ কিছুই বলল না। কেননা ওদের বলার মত তেমন কিছুই ছিল না। সুদাম আর অলংকৃতা, বুঁচি আর সম্রাট একটু সুখী মনে করল নিজেদেরকে। অনঙ্গ মনে মনে ভাবল দিনকাল বদলেছে। তাই সে এবার নিজেকেও বদলে ফেলবে।

(ক্রমশ)             

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন