কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

অর্পিতা দাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


পোস্ত

রোজ সূর্য ডোবার আগে অবধি আমি দূরবীণ চোখে লাগিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকি। অদ্ভূত সোনালি হয়ে যায়  ঘাসের মাথাগুলো। খুব হাওয়া দেয় মাঝে মাঝে। আমার ভেঙে পড়া জমিদার বাড়ির জানালাগুলো খটখট করে দুলে ওঠে। আর ঢেউয়ের মত পুরোটা নড়ে মাঠটা। আমি ধুলোতে পা ঘষে ঘষে এঘর ওঘর করি চোখে দূরবীণ লাগিয়ে ।  ছোটবেলায় এই মামাবাড়ি আমাকে খুব টানত। খুব চাইতাম যদি কোন এক রহস্যময় কুলুঙ্গিগুলো থেকে কোনদিন একটু গুপ্তধন বেরিয়ে আসে! ছোটবেলায় দেখতাম আমার মামার ছেলে মেয়েরা কুলুঙ্গিতে জুতোর বাক্সতে মাটির অদ্ভুত অদ্ভুত পুতুল বানিয়ে রাখত। কী আনন্দ যে হত... দুপুরবেলায় মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি উঠে আসত গুপ্তধন আর বড়দের সংসার। সেখানে বর সারাদিন পর কাজ করে ফিরলে ওর বউ ওকে খেতে দেয়। তারপর নানারকম সংসারের টুকিটাকি কথা বলে, যেমন সিনেমায় বলে। তারপর একসাথে ঘুমিয়ে পড়ে। হাতে বোনা কাঁথার তলায়। কিন্তু পুতুলগুলোর একদিন বয়স বেড়ে গেল। হারিয়ে গেল। আশ্চর্য ফাঁকা হয়ে গেছে এখন মামাবাড়িটা। কিন্তু তাও ভাল লাগে এখানে এমনি এমনিই ঘুরে বেড়াতে। আর ঘুরে ঘুরে দেখতে। রোজ দূরবীণ লাগিয়ে।

আমি দেখি। কাঁপা কাঁপা হাতে খয়েরী রঙের একটা ছোটছেলে পা টিপে টিপে যায়। রোজ মুঠো করে কী নিয়ে যায়? আমি বিকেলবেলা হলেই চোখে দূরবীণ লাগিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকি। ছেলেটার খালি গা। ঘন সোনালি ঘাসের মধ্যে কোত্থেকে জানি উদয় হয়। পা টিপে টিপে কোনরকমে হাঁটে আলের ওপর দিয়ে।

একদিন আমি থাকতে পারলাম না। নিচে নেমে এলাম। বাড়ি থেকে নেমে এলে, নিচ থেকে বাড়িটা দেখে ভয় লাগে। ফাঁকা দরজা-জানালার দিকে চোখ চলে যায়। মাঝে মাঝে ছবি দেখতে পাই, হুট করে এ জানালা থেকে ও জানালা সরে যায়। হঠাৎ পেছন দিকের দরজাটা খটখট করে দুলে ওঠে। আমি ঘাসের মধ্যে ছেলেটাকে খুঁজতে লাগলাম।

আমি আর থাকতে না পেরে ছুটে গেলাম মাঠে। সোনালি ঘাসগুলো উঁচু উঁচু ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ছে আমার চারপাশে। আমি কোন রকমে সাঁতরে এগিয়ে গেলাম প্রায়। ছেলেটাকে হারিয়ে ফেললাম না তো? আমার বাইনোকুলারটা  কোথাও ফেলে এলাম বোধহয়! এবার দেখতে পেয়েছি। ছেলেটা আমার মুখোমুখি। হাতটা এখনও মুঠো করে রাখা। 'কী  নিয়ে যাস রোজ মুঠো করে?' ছেলেটা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। সঙ্কোচ না, বিস্ময়ে। যেন পুতুল খেলতে খেলতে হঠাৎ চোখের সামনে একটা জীবন্ত পুতুলকে নিজে থেকে রান্না করতে দেখছে। আবার জিজ্ঞেস করলাম। ছেলেটা অদ্ভূত ভাষায় বলে উঠল 'পোস্ত’। ছেলেটার কথা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। বাংলাটা অন্য ভাষার মত শুনতে লাগল।

'কী করিস এটা নিয়ে?'

'রান্না হয়।'

'এইটুকু রান্না?'

'হ্যাঁ, আমাদের ঘরে ছোট ছোট বাটি তো, তাই পোস্ত ছাড়া অন্য কিছু ধরে না।'

'বাবাকে বলিসনি কেন, বড় বাটি কিনতে?'

'বাবা তো মাটির ভেতরে থাকে, ওখানে সব কিছু গুঁড়ো গুঁড়ো... বড় কিছু পাওয়া যায় না...'

আমি ছেলেটার পায়ের ছাপের ওপর পা ফেলতে ফেলতে যাচ্ছিলাম। ও দূর থেকেই কথা বলছিল। বাংলার মত নয়। আমি শুনছিলাম আর কথাও বলছিলাম। মাঠের সোনালি সমুদ্রটা শেষ হয়ে আসছিল। আমরা মাঠ শেষে কয়েকটা ছোট  কুঁড়ের দিকে এগোচ্ছিলাম। সামনাসামনি আসতে দেখলাম একটা পোড়া কুঁড়ের মধ্যে ছেলেটা ঢুকে গেল। চারপাশের কুঁড়েগুলোও পোড়া। আমি ঘরগুলো দেখে হালকা হয়ে গেলাম। আমার ঘরের মতই ফাঁকা। আমার মতই স্বচ্ছ অবয়ব।

একটা লোক এল তারপর। লোকটা ভীষণ রাগী গলায় গটমট করে একবার কুঁড়েতে ঢুকল। ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘাড় থেকে ব্যাগ। মুখের এক কোণে চুরুট ধরিয়ে অদ্ভুত ভাষায় বলল, 'হোয়াট ইস দিস ননসেস অল আ্যাবাউট? হোয়্যার ইস হি?'

খুব রেগে আছে লোকটা। আমাকে দেখতে পায়নি। কাউকে একটা খুব খুঁজছে। লোকটা খুব কালো। কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো চুল ঘাড় অবধি। এদিক ওদিক ছটফট করছে। ঠিক তখনই আর একটা লোক কুঁড়েতে ঢুকতে যাচ্ছিল। প্রায় ধাক্কা লাগতে লাগতে সামলে নিল।

এই লোকটা অনেক শান্ত। কী রকম শান্ত গলায় যেন ঘুম পাড়ানি গল্প বলার মত বলল, 'আরে মিঞা... ইতনি জলদি ভি মত করো। হাত পয়ের ধো লো... তব তক বন্দোবস্ত হো জায়েগি…'

কালো কোঁকড়ানো চুলের লোকটা রেগেমেগে গটমট করে 'ব্রাডি হেল’ বলে বেরিয়ে গেল। শান্ত লোকটা নীল লুঙ্গি পরে একটা গান ধরল। 'ঘুঙ্গারু বাঁধ মীরা নাচে রে... পগ ঘুঙ্গারু বাঁধ মীরা নাচি রে...’ আরও ধোঁয়া এসে ঠান্ডা করে দিচ্ছিল কুঁড়েটাকে।

সন্ধে নামছে। কেউ একটা উনুন জ্বালালো বোধহয়। মিঞ্জা এখনো গেয়ে যাচ্ছে। ছোট ছেলেটা বাইরে এসে বলে গেল  'বাবা আসছে'। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম। কই, কেউ আসছে না তো! ছেলেটা বোধহয় বুঝতে পারল। যেন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা ঘরের ভেতরে আসছে"। আমি এই প্রথম কুঁড়ের ভেতরে ঢুকলাম। পোড়ামাটি ল্যাপা কুঁড়ের মেঝে। আর কিছু নেই। পোড়ো ছোট একটা বাটি। একটা পোড়া থালাও আছে। তবে যে ছেলেটা বলেছিল যে ছোট বাটি ছাড়া ওদের ঘরে আর কিছু নেই? আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই ছেলেটা আমায় ঘাড় নাড়িয়ে চুপ করতে বলল। যেন আমি কথা না বলি। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ কুঁড়েটা একটু দুলে উঠল যেন। থালা আর বাটিটা হঠাৎ দমকা হাওয়ায় সরে গেল। পোড়ো মেঝেটাতে জমাট একটা ধোঁয়া কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুরতে লাগল। ছেলেটা মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে খুব আপন চোখে তাকিয়ে রইল ধোঁয়াটার দিকে। ওর বাবা আসছে। আমি বুঝলাম, এই সময়ে আর ঘরে থাকার দরকার নেই। বাইরে গিয়ে দাঁড়ানোই ভাল। আমি কুঁড়ের সামনে উঠোনটাতে আগের মত গিয়ে দাঁড়ালাম। তোড়জোড় হচ্ছে। মিঞা গল্প বলার গলায় কালো লোকটাকে খুব বোঝাচ্ছে। লোকটা খুব অধৈর্য হয়ে আছে। ‘বাট আই ত্যাম হাঙ্গরী... হোয়াই আর উই ওয়েটিং?’ ‘আরে মিঞা... থোড়া সবর করো... ফল মিঠা হোগি’। মিঞার কথা শুনলে মনে মনে খুব মজা লাগে। কথার ধরনটাই এমন। রাগী লোকটা এপাশ ওপাশ একবার পায়চারি করতে না করতেই হঠাৎ বলে উঠল, ‘দেয়ার হি ইজ...’

একটা লোক ঢুকল। কাঁধে কুড়ুল... খাটো করে গামছা কোমরে জড়ানো... মনে হল মাঠে মাটি কেটে ফিরছে। কুঁড়ের সামনে এসে কাঁধ থেকে কুডুলটা নামিয়ে রাখল। খুব ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমার জন্য অপেক্ষা করসো তোমরা! কি করি? এত কাজ, আর একটু সবুর কর, আমি হাত পা ধুয়ে এখুনি আসসি’। মিঞা নরম গলায় বলল, ‘কোই গল নেহি মিঞা... কোই গল নেহি...’

তারপর বাচ্চা ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলল – ‘এ বাবু, থালি লে আও বাবু!’

বাচ্চা ছেলেটা কুঁড়ে থেকে বেরোল, হাতে থালা নিয়ে। এবার বোধহয় খাওয়া হবে। কালো লম্বা লোকটা এবার বিরক্তি কাটিয়ে হাঁপ ছেড়ে মিঞার পাশে এসে বসল। ছেলেটা থালাটা ওদের সামনে এনে রাখল। থালায় একমুঠো পোস্ত ছড়ানো। মাঠে কাজ করা লোকটাও ওদের পাশে এসে বসল। বাচ্চা ছেলেটাও বসল। চারজনে এবার পোস্ত ছড়ানো থালায় একসাথে গোল করে হাত রাখল। ছোট থালায় সবার হাত সবার সাথে ঠেকে গেল। সবাই যেন কীরকম একটা ঘোরে চলে গেছে। ঘোর মাখানো গলায় ডেকেই চলেছে। থালার পোস্তগুলো আস্তে আস্তে কাঁপছে, থালার এদিক থেকে ওদিক গড়াচ্ছে। ওদের হাতগুলোও আস্তে আস্তে দুলছে যেন। তারপর ওই চাষীটাও ডাকতে শুরু করল, ‘মা গো... আমার মা...মা গো...!’ উঠোন থেকে ওই কুঁড়েটার যেন কয়েক যুগ দূরত্ব। সবাই একটা অদ্ভূত সুরে ডেকেই চলেছে।  যেটা কুঁড়ে অবধি আস্তে আস্তে ভেসে যাচ্ছে। মিঞা ডেকে উঠল, 'আম্মি, আম্মি' ভীষণ কাতর গলায়। মনে হল, কতদিন মাকে দেখেনি। সবাই আধা চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে ডেকে যাচ্ছে। সন্ধ্যের ধোঁয়াটা আস্তে আস্তে কালো হয়ে যাচ্ছে।  পোড়া কুঁড়েটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া মাখানো সুর শুনে যাচ্ছে। এবার বোধহয় মা রান্না করে খাবার বেড়ে দেবে। বাবা আসবে থালা নিয়ে।

কুঁড়ের ভেতর থেকে দমকা একটা হাওয়া বেরোল। ভুস ভুস করে কালো ধোঁয়া চতুর্দিক ঢেকে ফেলল প্রায়। সবাই আরো জোরে সুর করে দুলতে লাগল। ধোঁয়াটা কুন্ডুলী পাকিয়ে আস্তে আস্তে থালাটাকে গ্রাস করল। ওদের চোখে মুখে কী অসাধারণ এক শান্তি! ওদের খাওয়া মিটে গেল বোধহয়। কালো লম্বা লোকটাকে খুব শান্ত দেখাচ্ছে।

আমিও খুব হালকা হয়ে গেলাম হঠাৎ করে। অন্ধকার দিয়ে হেটে হেঁটে বাড়ি ফেরবার সময় ভাবলাম আমার খটখটে দরজা জানালাগুলোয় কতদিনের ধুলো জমে আছে। কাল বা পরশু বা অন্য একদিন ধোঁয়াটাকে আমার বাড়িতে টেনে  আনব। কালো মেঝের ওপর জমাট ধোঁয়া ভরে থাকবে... নাহলে তো বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে থাকে।

খুব রাতে আরও ওপরে উঠে যাই আমি। দূর... আরও দূর থেকে পুরো মাঠটা দেখতে পাই। হাওয়ায় দুলতে থাকা মাঠ, জঙ্গল... কত কী দেখতে দেখতে আমি নিস্তব্ধ হয়ে যাই। ওপর থেকে দেখি চতুর্দিক কেমন লালচে আলোয় ভরে আছে।  আমি ভাবনার মধ্যে ভুলে যাই আমার অস্তিত্ব। আস্তে আস্তে হাওয়া হয়ে যাই।

 

 


2 কমেন্টস্: