কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

বিমানকুমার মৈত্র

 

সমকালীন ছোটগল্প


বসন্তযোদ্ধা

প্রত্যেক 'তুমি'র জন্যই একটি 'তার'এর দরকার পড়ে। আমাদের নকশিকাঁথার ভেজা কথাগুলি শুকোবার জন্য। যে ছেলেটি আর যে মেয়েটি নিজের নিজের ছাদে খুঁটির মত ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে এই গল্পের নকশিকাঁথা তৈরি করে যাচ্ছিল, তাদের মধ্যে প্রতিভাস বড় ব্যাকুল হয়ে পড়ল।

তৃষিকা উচ্চ মাধ্যমিকের ফাইনাল পরীক্ষার ছাত্রী। শনিবার দশটায় স্কুল যাবার পথে তার পিঠে একটা কাগুজে ঢিল এসে পড়ল। দেখা গেল, একটা মসৃণ কাঠের ঘনককে লুডোর ছক্কা বানিয়ে ওটাকে ছোঁড়া হয়েছে। অথচ পুরো কাগজটাই সাদা। একি রে বাবা! তৃষিকার হাসি পেল। ঢিলছক্কা সমেত কাগজটা ফেলে দিতে গিয়েও কী মনে করে রেখে দিল।

এদিকে স্কুলে যাবার পথে প্রতিভাসের বাড়ি পেরোবার সময় তৃষিকার পিঠের উসখুসানি ক্রমশ বেড়েই চললো। একপ্রকার অধৈর্য হয়েই একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতিভাসের ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে তৃষিকা সেই সাদা কাগজটাকেই ফেরত পাঠিয়ে দিল।

এরপর সব  চুপচাপ হয়ে গেল। যেন পথ ভুলে কেউ বেপাড়ায় ঢুকে পড়েছিল; বুঝতে পেরে আবার নিজের পথে ফিরে গেছে।  মাঝখানে একটি সাঁতার না জানা প্রাণী জলে খাবি খেয়ে চলেছে।

সন্ধেবেলা টিউশনি পড়ে ফেরার সময় তৃষিকাকে প্রতিভাসের ঘরের পাশ দিয়ে আসতে হয়। শূন্যস্থান পূরণ করে কাগজটা ফেরত দেবার আগেই কি বসন্ত বিদায় নিল? ওর ঘর অন্ধকার, জানলা আংশিক ফাঁক করা। দুঃখিত হলো তৃষিকা। সামনেই দোল; রং পেন্সিল দিয়ে যাহোক কিছু একটা আঁক কেটে দিলেই পারতো! এইসব দিশেহারা ভাবনার মাঝেই হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে আবার সেই পরিচিত কাঠের ঢিল। মাথায় লেগে পাশে পড়তেই সেটা তুলে নিল তৃষিকা। এবার কাগজ ফাঁকা নয়; এক কোণে কালো কালিতে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?)। ধ্যাত্, এ আবার কী?  

তৃষিকা প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পেল না। কিন্তু কিছু একটা করা দরকার। শেষে প্রশ্নচিহ্নের বদলে সবুজ রঙের আরেকটি প্রশ্নচিহ্ন ওই কাগজটায় লিখে টিউশনি পড়ে ফেরার পথে প্রতিভাসের ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে ফেলে দিয়ে তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

উচ্চ মাধ্যমিকের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য তৃষিকা এখন খুব ব্যস্ত। এরই মধ্যে একদিন তৃষিকার বাবা তিমিরবাবু মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। ড্রয়িংরুমে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। চেহারায় ক্লান্তি এবং বিপর্যয়ের ছাপ।  বাবা বললেন, ইনি প্রসূনকুমার মুখার্জি, আমাদের প্রতিবেশী এবং প্রতিভাসের বাবা। আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে ওনার বাড়ি। তোমার সাথে কথা বলবেন। তিমিরবাবু  বললেন, আপনি বরং আগে একটু চা খান। তৃষিকা উঠে দাঁড়াতেই প্রসূনবাবু প্রশ্ন করলেন বললেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ মা? তৃষিকা কিছু বলার আগেই ওর বাবা বলল, মা  নেই তো, ওকেই সব করতে হয়। যা মা, তুই চা করে নিয়ে আয়। প্রসূনবাবু শুনলেন, কোন কথা বললেন না। তৃষিকা চা নিয়ে এলো। প্রসূনবাবু খুব নম্রভাবে বললেন, প্রতিভাস সকালেই হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। ঘাড়ে একটা টিউমার দেখা গেছে। ডাক্তার অবশ্য বলেছেন, চিন্তার কিছু নেই। হসপিটালে যাবার পর এই কাগজটা ওর বালিশের নিচে পাওয়া গেছে। এক কোণে তোমার নাম লেখা। আমি তো এর মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।  কাগজটা চায়ের টেবিলের ওপর রেখে প্রসূনবাবু বিদায় নিলেন। কাগজ তুলে নেয় তৃষিকা। জোড়ায় জোড়ায় প্রশ্নচিহ্নগুলো যেন একঝাঁক পাখি, আকাশ খালি করে সন্ধ্যেবেলা বাসায় ফিরে যাচ্ছে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন