কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল




 

(৩৬)  

দেবার্ঘ্য ফিরে গেছে সপ্তাহ ঘুরে এল প্রায়। আবার একটা শুক্রবার, আবার পরপর দু-দিন ছুটি। সপ্তাহটায় বড্ড কাজের চাপ ছিল, ঘুমও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সারাদিন ওয়র্ক ফ্রম হোম নিয়ে কাজ করেছে শ্রুতি, সপ্তাহে দু-একদিন নেওয়ার অনুমতি আছে। প্রায় রোজ অফিস যায় সে। যদিও কারো সঙ্গে অফিস-অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা নেই তবু মানুষের সান্নিধ্যের উষ্ণতা একধরণের স্বস্তি দেয়। পি-জিতে তার ছোট্ট ঘর, চারদিক বন্ধ বিরস ময়লা, রং-চটা দেওয়াল, এককোণে সরু ওয়ার্ড্রোব। ল্যাপটপ ঢেকে, পাততাড়ি গুটিয়ে ঘাড় সোজা করে বসে শ্রুতি। একফালি কাচের জানালার ফাঁক ধরে বিকেলের লালচে আলো দেওয়ালে দাগ কাটছে। ঘরটা রেনোভেট করায় নি বিনীথাম্যাডাম, সম্ভবত সে ছাড়লে করানোর প্ল্যান। তখন রেন্ট বাড়িয়ে দেবে অনেক।

কচুরিপানার মতো চিন্তার ঝাঁক ঠেলে সরিয়ে আনমনে বাইরে তাকাল শ্রুতি। অদূরেই বিশাল রেসিডেন্সিয়াল প্রজেক্টের কনস্ট্রাকশন চলছে। কত একর জমি জুড়ে কংক্রিটের জঙ্গল গজাচ্ছে কে জানে! বিকেল পর্যন্ত শব্দ আর ধুলো-ওড়া, জানালা খোলা যায় না। যেটুকু ঘাস-আগাছা জিন্দা ছিল, শেষ হয়ে আসছে। আচমকা কলকাতায় ঘরের পাশের পেয়ারাগাছটা মনে পড়ল। তাদের বাড়িটা যদি ভাঙা হয়, জমি প্রমোটারকে দিয়ে দেওয়া হবে। বৈধভাবে একটা করে ফ্ল্যাট পাবে তার মামা, মা আর দুই মাসী। বাকি ফ্ল্যাট অন্য লোককে বিক্রি করে লাভ করবে প্রমোটার। পেয়ারাগাছ আর ঘরোয়া ফুলগাছ একটাও আর থাকবে না। সেই উঠোন, সেই টিউবওয়েলের ঠাণ্ডা বা গরম জল অতীত হয়ে যাবে। বাতাসে মিলিয়ে-থাকা একগাদা জীবন্ত স্মৃতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোথাও উড়ে যাবে! আজগুবি ভাবনা মামপির অন্তঃস্থল নাড়িয়ে দেয়, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তবে বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। মা-র প্রতি একটু হলেও সে কৃতজ্ঞতা বোধ করে।

কেন দেব তাগরে? দেব না। তারা মায়েরে একটাদিন রেখেছে? এসে সেবা করেছে?”

প্রতিবেশী কাকিমাকে বলছিল তার মা, কানে এসেছিল।

ওইসব ফ্লাট-টাট বানালেই ভাগ চাইতে আইসা পড়বে। আমার পুরান বাড়িই ভাল।

খুব বিশ্রী লেগেছিল সেদিন মা-র অনৈতিক কথাগুলো, ঘেন্না করছিল। মামার অংশ তালাবন্ধ, তার মা-র ব্যবহারে ভাড়াটে বেশীদিন থাকতেও চায় না। অথচ এই মুহূর্তে স্বার্থপরের মতো ভাবছে অন্তত যতদিন মা আছে কলকাতার পরিবেশ, একান্ত পরিসরটি অন্তত বেঁচে থাকবে। তার ঘরের স্মৃতিমাখা দেওয়ালগুলো ভাঙা হবে না। কাটা পড়বে না দিদিমার পোঁতা পেয়ারাগাছ। নিশ্চিন্ত লাগল, সচেতন হয়ে সজল চোখ মুছে ফেলল শ্রুতি।

বাইরে থেকে আসা রোদটুকু আর নেই। হাত তুলে সে ঘড়ি দেখে, সন্ধে উতরে গেছে খানিক আগে। টী-স্ন্যাক্সের পাট নেই, একমাত্র ব্রেকফাস্টের সঙ্গে চা, কফি বা দুধ পাওয়া যায়। শ্রুতি ওঠে, তার প্রিয় চা-পয়েন্টে যাওয়ার জন্য চটপট রেডি হয়। দোকানের লোকগুলো তাকে চিনে গেছে।

এর মধ্যে ফোন করেনি দেবার্ঘ্য। শ্রুতি শর্ত দিয়েছে আগামী পনেরোদিন কোনও যোগাযোগ করবে না। সম্মতি আদায় করে ফিরেছে ছেলেটা। শ্রুতি বড়ো এককাপ কফি নিয়ে বসে একলাই হাসে। কী ভেবে কান লাল হয়ে ওঠে, দেবার্ঘ্যর ফোনের কলার-টিউন স্পষ্ট বাজতে থাকে।

বিগত শুক্রবার রাতে মুখোমুখি খেতে বসে দু-চারটে কথা হয়েছিল। সহজ হতে পারছিল না শ্রুতি, দেবার্ঘ্যও যা বলতে এসেছে পারছিল না বলতে। মামুলি কথাবার্ত চোলছিল, শ্রুতি এদিককার দ্রষ্টব্যগুলো দেখেছে-টেখেছে কিনা! শ্রুতি পালটা প্রশ্ন করেছিল,

দ্রষ্টব্য? সাইট-সিয়িং?”

হ্যাঁমানে ঐতিহাসিক শহরে ওই যা দেখতে আসে ট্যুরিস্টস্‌--চারমিনার, মিউজিয়াম, ফিল্ম সিটি?”

কিন্তু-কিন্তু ধরণে জানতে চেয়েছিল দেবার্ঘ্য। মাথা নেড়েছিল শ্রুতি, দেখেনি। দেখার আগ্রহ হয়নি তাছাড়া কাজের প্রেশারও। শুকনো হেসেছিল,

চাইলে কাল সকালে ক্যাব নিয়ে দেখে নিতে পারেন।

না না, পরে। হাতে সময় নিয়ে আসবো যখন তখন। কালকের দিনটা আমার জন্য রেখোব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার। রবিবার দুপুরের ফ্লাইট, যদি পারো এসো।

নরম, গভীরভাবে বলেছিল দেবার্ঘ্য, তাকিয়েছিল শ্রুতি। জবাব দিতে পারেনি, মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ফিরে গিয়েছিল। রাতে ঘুম হয়নি ভালো, অচেনা মিশ্র অনুভূতি। নিজের কাছে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেও দোলাচল প্রশমন করতে পারছিল না। শনিবার দেরী করেনি, সময়মতো পৌঁছেছিল দেবার্ঘ্যর হোটেলে। দেবার্ঘ্য স্নান সেরে ফিটফাট, অফিস ফেরত ক্লান্ত চেহারা নেই। হাসিমুখে জানতে চেয়েছিল,

ঘুম হয়েছে? আমার হয়নি!”

নতুন জায়গা যেসেজন্য।

কোনওরকমে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিল শ্রুতি। দেবার্ঘ্য সোজাসুজি তাকিয়েছিল। শ্রুতির চোখমুখ সকালের শুভ্র আলোয় ধোওয়া, ফ্রিলদার হালকা গোলাপী শর্ট-কুর্তি আর অ্যাঙ্কল-লেন্থ জিন্সে সজীব। তার শরীরে দেবার্ঘ্য আলগা বুলিয়েছিল চোখ। হয়ত লক্ষ করেছিল শ্রুতি অথবা করেই নি। বলেছিল,

বেরোই এবারে!”

হুঁঅবিন্যস্ত বারুদ এবারে পেয়েছে সংগঠিত আধার!”

কী?”

হাসে দেবার্ঘ্য,

কিছু না। মনে এল তাই বললাম

পোয়েট্রি? লেখেন?”

সে ওয়ান্স আপ-অন আ টাইমপাস্ট টেন্স। লিখতাম।

মাই গড্‌! আমি কিন্তু একদম কবিতা-টবিতা,”

ছাড়ো তো। চলো কোথায় নিয়ে যাবে।

হিস্টরিক্যাল লেক আছে মানে ড্যামসারাদিন কাটানোর জন্যে ইটস্‌ আ নাইস প্লেস। আমি আগে একবার এসেছিলাম, সেভাবে ঘুরে দেখা হয়নি। একটু দূর আছে অবশ্য।

ক্যাব নিয়ে বেরিয়েছিল ওরা, পেছনের সীটে পাশাপাশি। দেবার্ঘ্য এসেছিল কাছ ঘেঁষে, শ্রুতি ভীষণ আড়ষ্ট, অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে পড়ছিল অর্জুন আর সে কত ঘুরে বেড়িয়েছে কলকাতার এধার-ওধার। কাঁধে হাত, মারপিট, ধাক্কাধাক্কি, এক প্লেটে খাওয়া, এক সিগেরেটে টান মারাকখনও জড়তা আসেনি। উদাস হল শ্রুতি, বিষণ্ণ লাগল। হায়দরাবাদে আসার পর থেকে একদিনও ফোন করেনি অর্জুন, এখানে চাকরি পাওয়া তার ঈর্ষার সৃষ্টি করেছে। আসলে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব বলে কোনও শব্দ হয়না। অন্যমনস্ক শ্রুতি হঠাৎ খেয়াল করল, দেবার্ঘ্যর হাত তার পিঠ দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁ-ঘাড়ের কাছে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। চমকে উঠে তাড়াতাড়ি নিজের বাঁহাত দিয়ে নামিয়ে দিতে গেল, তীব্র বিরাগে ফিশ্‌ফিশ্‌ করল,

এ-কী! হোয়াটস্‌ আপ? এক্সকিউজ মী প্লিজ!”

ছাড়েনি দেবার্ঘ্য, তার হাত ধরে ফেলেছিল। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসেছিল,

নো চান্সেস্‌!”

প্লিজ, এরকম করলে আমিআইল গেট ডাউন। সারাদিন কাটানো আউট অব দ্য কোয়েশ্চেন

ও-কে! এক্সট্রিমলি সরি।

দেবার্ঘ্য সাবধানে হাত নামিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসেছিল। গম্ভীর লেগেছিল তাকে, আড়চোখে দেখছিল শ্রুতি।

হায়দরাবাদ আর সেকেন্দ্রাবাদকে জুড়েছে মুসি নদীর ওপরে বিশাল জলাধার, তাকে কেন্দ্র করে চমৎকার পর্যটনস্থান গড়ে উঠেছে। মূল গেটে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ক্যাব। সহজভাবে শ্রুতি ডেকেছিল,

আগে ব্রেকফাস্ট হয়ে যাক, ও-কে? আসুন, একটু হেঁটে গেলে অনেক ভালো-ভালো ইট-আউটস্‌ আছে।

দ্রুত পা ফেলছিল শ্রুতি, দূরত্ব রেখে শান্তভাবে নিঃশব্দে অনুসরণ করছিল দেবার্ঘ্য। মজা লাগছিল শ্রুতির, অকারণে আলতো হাসি ভেসে গিয়েছিল ন্যাচার‍্যাল পিঙ্ক লিপস্টিক-মাখানো ঠোঁটে। আহা কী বাধ্য ছেলে, ধমক খেয়ে গোঁজ হয়ে আছে, যে শুধু কিনা তারই জন্য উড়ে এসেছে এত দূর! শেষবাক্যটিতে বুকের মধ্যে কী যেন নড়ে-চড়ে উঠল, মায়া হল। চশমাটা ঠিক করে দু-পা পিছিয়ে এসে আলতো আঙুল ঠেকাল দেবার্ঘ্যর বাহুতে,

কী হল? টু স্লো কিন্তুআসুন! আয়্যাম স্টার্ভিং!”

দেবার্ঘ্য তাকাল সংযম রেখে, চোখের ইঙ্গিতে বলল,

আসছি, চলো।

কতরকম দোসা আর উত্তপম পাওয়া যায় এখানে, অথেন্টিক টেস্ট। খেয়ে দেখবেন।

ও-কে।

তারপর! সারাদিন কেটে গেল সময়ের বিরামহীন স্রোতে ভেসে ভেসে। ঘোরাফেরা হল, বোটিং হল, খাওয়া-দাওয়া ইচ্ছেমতো। লেকের আর্দ্রবাতাস কখন মুছে নিল দু-জনের ক্ষোভ, অভিমান, ছোট্ট ছোট্ট অপরাধবোধগুলো পর্যন্ত। ফেরার আগে আবছা অন্ধকারে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আনাড়ির মতো দীর্ঘক্ষণ শ্রুতির ঠোঁটের স্বাদ নিল দেবার্ঘ্য। বিহ্বল হয়ে রইল শ্রুতি, চোখ জলে ভেসে যেতে লাগল। অনুভব করল ভেঙে যাচ্ছে প্রতিরোধগুলো। মা-র অকারণ শাসন, দুর্ব্যবহার, বাবার ব্যক্তিত্বহীনতা, দূরত্ব, বাবুলের প্রতি আশৈশব তীব্র ঈর্ষা অথবা আকর্ষণসমস্ত কিছু তীক্ষ্ণতা হারিয়ে থেঁতলে সমতল হয়ে যাচ্ছে। তার ঠিক পিছনে ছোটো-ছোটো নরম ঘাসে-ঢাকা বিস্তৃত মালভূমির মতো আকার নিয়ে ছেয়ে ফেলছে সম্পূর্ণ নতুন অনুভূতিকেউ আছে তার জন্য।    

কিছুদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না শোভনের শরীর, বারবার একটা না একটা উপসর্গ উপদ্রব করছে। অনিদ্রা, পেটের গোলমাল, হাঁপানির টানের মতো। দুশ্চিন্তায় আছে লিপিকা।

 

(ক্রমশঃ)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন