কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

রামশরণ শর্মা

 

প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা


(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)




(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)

*অধ্যায় - ৩ / ৬*

*উপজাতি বনাম বর্ণ: (আনুমানিক ১০০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত)*

এইসব কারিগর এবং পার্বত্য উপজাতির লোকেরা রূদ্র-কে তাদের রক্ষাকর্তা জ্ঞানে পুজো করতো। ওয়েবার-এর অভিমত অনুযায়ী, "রূদ্র-শাস্ত্রগ্রন্থ প্রচলিত ছিল পরাজিত আদিবাসী এবং ভ্র্যাত্যদের (Vratyas) বা অব্রাহ্মণ্য আর্যদের মধ্যে গোপন জাতিবিবাদের সময় থেকে, যখন তাদের প্রকাশ্য প্রতিরোধ চূর্ণ করে দেওয়া হয়েছিল।" তিনি পুনরায় নির্দেশিত করেছেন যে, বিভিন্ন ধরনের মিশ্র জাতির স্থাপনা, সেইসব নিম্ন জাতির প্রতিরোধ ব্যতিরেকে হয়নি, যাদের প্রবল ধাক্কায় নিম্ন জাতিতে অধঃপতিত করা হয়েছিল। এটি পরোক্ষ ভাবে এই আভাস দেয় যে, উচ্চতর বর্ণের ক্রমবর্ধমান বিশেষাধিকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রক্রিয়ায়, আর্য উপজাতির নাস্তানাবুদ অংশ এবং পরাজিত আদিবাসী জনসাধারণের মধ্যে বিলক্ষণ মেলামেশার পরিনতি এই হয়েছিল যে রথকার এবং কার্মাকার-দের মতো কিছু আর্যরা একত্রিত হয়েছিল, আর্য দেবতা রূদ্র'র পতাকা তলে। এটি লক্ষ্যনীয় যে, রত্নহবিষ্যি (Ratnahavimsi) অনুষ্ঠানে রূদ্র-কে বর্ণিত করা হয়েছিল গোভিকর্তণা-দের (govikartanas) দেবতা হিসেবে, যাদের সায়ন দ্বারা বিশেষিত করা হয়েছিল কোনো একটি নিম্ন জাতি হিসেবে। ইতিপূর্বে এটি দেখানো হয়েছে যে, রূদ্র-পশুপতি, নিষাদ প্রধাণের দেবতা ছিল। এইভাবে এটি সমস্ত ধরনের সন্দেহের অতীত একটি বিষয় যে, শূদ্রদেরও দেবতারা ছিল, কিছু আর্য-দেবতা এবং কিছু অন্য অনার্য-দেবতা। সেইজন্য সৃষ্টি সম্পর্কিত কাহিনীগুলির মাধ্যমে ব্রাহ্মণদের এই বিবৃতি যে, শূদ্রদের কোনো দেবতা ছিল না, সেটি প্রকৃত অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে না। সৃষ্টি সম্পর্কিত অন্তত একটি কিংবদন্তী, এই অর্থপ্রকাশ করেছে যে, দিন এবং রাত্রি ছিল শূদ্রদের দেবতা। স্পষ্টতই ব্রাহ্মণ্য কিংবদন্তীগুলি দেখিয়েছে যে, শূদ্রদের আরাধনা করার ও বলিদান সম্পাদনের অধিকার, যেগুলি তারা প্রথমদিকে আর্য সদস্যবৃন্দের সাথে ভাগ করে নিতো অথবা আদিবাসী উপজাতির সদস্য হিসেবে স্বাধীনভাবে ভোগ করতো, সেগুলি থেকে তাদের বঞ্চিত করার একটি ইচ্ছাকৃত প্রয়াস জারি ছিল।

বেদকীয় বলিদান অনুষ্ঠানে শূদ্রদের অংশগ্রহণের ব্যপক প্রমাণগুলির বিরুদ্ধ প্রমাণ পেশ করার মাধ্যমে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রতিভারিত (counterbalanced) করা হয়েছে। ক্রমাগতভাবে বিবৃত করা হয়েছে যে, শূদ্রদের বলিদানের কোনো অধিকার নেই, এই যুক্তিতে যে, তাদের জন্ম-হার নিম্ন এবং তারা বলিদান সংক্রান্ত অর্ঘ প্রদান করতে অক্ষম। যজ্ঞ-বেদী তৈরি করার সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি আচার-অনুষ্ঠান (agnikayana), যেটি ছাড়া বৈদিক-বলিদান সম্পাদিত হতে পারতো না, সেটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অগ্নি-কে শূদ্রবর্ণ থেকে আলাদা করার একটি আচার হিসেবে। কিন্ত এই সত্য যে বৈদিক-বলিদান অনুষ্ঠান থেকে শূদ্রদের পৃথক করার এই ধরনের একটি সরাসরি বিবৃতি সংহিতাগুলিতে পাওয়া যায় না, সেটি হয়ত তাদের পরেরদিকের উদ্ভাবন-কে সুপারিশ করে। তবুও, এমনকি সেইসব সাহিত্যেও এমন অসংখ্য সব উল্লেখসমূহ রয়েছে, যেগুলির মধ্যে নিহিত রয়েছে এর মর্মার্থ। অগ্নি-প্রতিষ্ঠার ধর্মানুষ্ঠানের জন্য নির্দেশাবলীসমূহ কেবল প্রথম তিনটি বর্ণের কথা বলেছে এবং সেটি অনুষ্ঠিত করার ঋতু সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে ব্রাহ্মণগুলিতে। এমনকি রথকারদেরও এর বাইরে রাখা হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, অগ্নি মহাবিশ্বের সাথে মিলিত হয়, যে মহাবিশ্ব গঠিত হয়েছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং 'ভিস'-দের নিয়ে। একথাও বলা হয়েছে যে, রাজন্য এবং 'ভিস'-রা জন্ম নিয়েছে বলিদান থেকে, অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের থেকে। পুনরায়, এই বিবৃতি যে কেবলমাত্র প্রথম তিনটি বর্ণের সদস্যরাই বলিদান সম্পাদিত করতে সক্ষম এবং সুতরাং একজন শূদ্রও বলিদান প্রাঙ্গনে প্রবেশ করতে পারবে না, এই বিষয়টি উপরোক্ত বিবৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

শূদ্রদের সাধারণ বৈদিক-বলিদান থেকে বহিষ্করণের সাথে সাথে, কয়েকটি বিশিষ্ট বেদকীয় ধর্মানুষ্ঠান থেকেও তাদের পৃথকীকরণের দৃষ্টান্ত আছে। উদাহরণ স্বরূপ, সোম যজ্ঞ (soma-jagya) বিহিত করা হয়েছে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও রাজন্যদের জন্য। অগ্নিহোত্র (অগ্নিকে উৎসর্গীকৃত নৈবেদ্য) সম্পাদিত হবে একজন আর্য দ্বারা, যিনি ভাষ্যকারদের বক্তব্য অনুযায়ী তিনটি উচ্চতর বর্ণের সদস্য। শূদ্রেরা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে অগ্নিহোত্র-র জন্য প্রয়োজনীয় গাভী-দুগ্ধের দোহন করা থেকে, কারণ তারা 'অসত্য হতে উদ্ভুত' হিসেবে অনুমিত। সেই অনুযায়ী দুগ্ধ দোহনের জন্য ব্যবহৃত মাটির পাত্রটিও প্রস্তুত হতে হবে একজন আর্য দ্বারা। কিন্ত ভজেসনেয়ী এবং যজুর তৈতেরিও সংকলনগুলিতে এই ধরনের কোনও নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ নেই ; এটি উল্লেখিত আছে কেবল মৈত্রেয়ানী(Maitrayani) এবং কপিস্থালা (Kapisthala) সংকলনের সম্পূরক অংশে। কথক সংহিতার (Kathaka Samhita) অনুরূপ রচনাংশটি রয়েছে উচ্চারণভঙ্গী-বিহীন অবস্থায়, যেটি এর পরেরদিকের

সন্নিবিষ্ট হওয়াকে সুপারিশ করে। অধিকন্তু, অপস্তম্বা স্রৌতসূত্র (Apastamba Srautasutra), যেটি এই ধরনের বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো হিসেবে পরিগণিত হয়, সেটি একটি বিকল্প বিধান প্রস্তুত করেছে, যাতে শূদ্রেরা গাভী-দুগ্ধের দোহনের অধিকার প্রাপ্ত হয়ে উঠতে পারে। ভাষ্যকারেরা বিধানটিকে ফাঁদে ফেলার প্রয়াস করেছে, এই ঈঙ্গিত করার মাধ্যমে  যে, তারা সেটি তখনই করতে পারবে যখন তাদের সেই অনুমতি দেওয়া হবে। এই সমস্তকিছুই দেখিয়ে দেয় যে, অগ্নিহোত্র'য় প্রদত্ত গাভী-দুগ্ধের দোহনে শূদ্রদের ওপর নিষেধাজ্ঞাটি সংহিতা'র অকৃত্রিম অংশগুলির অন্তর্ভুক্ত নাও হয়ে থাকতে পারে। এটি হয়ত আরোপিত হয়েছে তৈতেরীয় ব্রাহ্মণ-এর সময়।

কঠোর বিধানগুলি, যেগুলি এমনকি শূদ্রদের সাথে শরীরগত সংযোগ সাধন এবং কোনো বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করেছে, সেগুলি বেদকীয় পর্যায়ের শেষের দিকে আবির্ভূত হতে থাকে। বলিদানের জন্য প্রতিস্থাপিত কোনো ব্যক্তিকে শূদ্রদের সাথে বাক্যালাপ করতে নিষেধ করা হতে থাকে এবং একই শর্ত আরোপিত করা হতে থাকে সেই ব্যক্তির ওপর, যাকে অভিষিক্ত করা হয়েছে (upanita)। শতপথ-ব্রাহ্মণ (Satapatha Brahmana) উপস্থাপিত করেছে যে, প্রভার্গ্য অনুষ্ঠানে (pravargya ceremony), সম্পাদনকারী ব্যক্তিকে, নারী ও শূদ্রদের স্পর্শ পরিহার করতে হবে, কারণ তারা অসত্য। কথক সংহিতা'য় (Kathaka Samhita) এরকম একটি উল্লেখ ব্যতিরেকে, এটি হচ্ছে নারীদের সাথে শূদ্রদের একই বন্ধনীতে রাখার প্রাচীনতম উদাহরণ ---  একটি অনুশীলন, যেটি পরেরদিকের বেদকীয় সাহিত্যে বারংবার পরিলক্ষ্যিত হয়েছে। এটিও প্রদত্ত হয়েছে যে, নিজের সন্তান হেতু ধর্মীয় আচার-আচরণ সম্পাদনকারী কোনো নারীর, ভ্রসালাদের (vrsala) কোনো পুরুষ বা নারীকে স্পর্শ করা চলবে না, যে ভ্রসলাদেরকে পরেরদিকে শূদ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং বর্ণিত করা হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী হিসেবে। শতপথ ব্রাহ্মণে, এমনকি একজন ছুতোরের স্পর্শ-কেও পরিগণিত করা হয়েছিল বলিদান সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে অপবিত্রতা প্রদায়ী একটি আচরণ হিসেবে। কিন্ত অন্য একটি জায়গায়, মধ্যান্দিনা'র ((Madhyandina) সেই রচনাংশের সংশোধিত পাঠ-টি যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে তাকসানেরা আরুনি'র (Aruni) মন্ত্রটিরই পুনরাবৃত্তি করেছে বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে এটি বলতেই হয় যে, শূদ্রদের স্পর্শ এড়ানো সম্পর্কিত এই ধরনের উল্লেখগুলি ঘটেছে হয় শতপথ ব্রাহ্মণগুলিতে অথবা স্রৌতসূত্রসমূহে, যা নির্দেশিত করে যে, শূদ্রদের আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত অপবিত্রতার ধারণাটি, যার সাথে শূদ্রদের সাথে শরীরগত ও দৃষ্টিসংক্রান্ত সংস্পর্শ নিষিদ্ধ করার বিষয়টি বিজড়িত, সেটি আবির্ভূত হয়েছে বেদকীয় পর্যায়ের সমাপ্তির কাছাকাছি সময়ে এবং এমনকি তার পরেও।

পরের দিকের বেদকীয় পর্যায়ে শূদ্রদের ধর্মীয় জীবনের অবস্থা সম্পর্কিত একটি পর্যালোচনা সূচিত করে যে, রথকাররা এবং নিষাদেরা, যারা বৈদিক বলিদানে অংশগ্রহণ করতে পারতো, তাদের অতিরিক্ত, শূদ্র বর্ণেরও নিজস্ব ঈশ্বর ছিল এবং তারা বেশ কয়েকটি বেদকীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারতো। এটি সত্য যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের রীতি-নীতিগুলি অভিপ্রেত ছিল সমাজে শূদ্রদের নিম্ন অবস্থান  সূচিত করার দিকে, কিন্ত সেই অর্থে সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদেরকে পুরোপুরি বঞ্চিত করা হয়নি। তাদের বহিষ্করণের প্রক্রিয়া, যা ইতিমধ্যেই কিছু প্রাচীন মূল পাঠ সম্বলিত পুঁথিতে প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখিত হয়েছিল, সেগুলি বেদকীয় পর্যায় শেষ হওয়ার খুব কাছাকাছি সময়ে আরও জোরদার হয়েছিল। এটি মনে হয় যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পৃথকীকরণ প্রক্রিয়ার বৃদ্ধির সাথে সাথে, ক্রমাগতভাবে উপজাতীয় বলিদান-এর চরিত্র পরিবর্তিত হয়ে চলেছিল, যেটি চালিত হয়েছিল ব্যক্তিগত হওয়ার দিকে এবং পুরোহিতদের জন্য বেশি বেশি পরিমাণ উপহার সংগ্রহ করার দিকে। সময়ের সাথে সাথে বলিদান, উচ্চ বর্ণের বিশেষাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যারা এর আর্থিক সংস্থান করতে সমর্থ ছিল। এটিকে অনুমিত করা যেতে পারে ব্রহদারণ্যক উপনিষদের (Brhadaranyaka Upanisad) একটি রচনাংশে প্রদত্ত শঙ্করের ভাষ্য থেকে, যেখানে তিনি বলেছেন যে, ঈশ্বর বৈশ্যদের সৃষ্টি করেছেন সম্পদ অর্জন করার জন্য, যেটি আসলে আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদিত করার সঙ্গতি। একইভাবে মহাভারতে, যুধিষ্ঠির এই বিবৃতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন যে, বলিদান সম্পাদন সেই সমস্ত মানুষদের দ্বারা সম্ভবপর হতে পারে না যারা গরিব, কারণ সেক্ষেত্রে বিবিধ সামগ্রীর ব্যাপক ভান্ডার থাকা আবশ্যিক। তিনি পুনরায় বলেছেন যে, বলিদান সম্পর্কিত গুণাবলীসমূহ অর্জিত হতে পারে একমাত্র রাজা ও রাজপুত্রদের দ্বারা, এবং তাদের দ্বারা নয় যারা সম্পদ-সর্বস্বান্ত এবং নিরুপায়। এটি পরোক্ষ ভাবে এই অর্থপ্রকাশ করে যে, সাধারণভাবে শূদ্ররা, যারা বলিদান উপলক্ষে উপহার প্রদানের ক্ষেত্রে ছিল দুর্বল বা অসমর্থ, তারা এটি সম্পাদন করতে অক্ষম ছিল। একজন ধনী শূদ্র দ্বারা বলিদানের বিষয়টিকে আপত্তিকর বলে বিবেচিত হয়নি, কারণ ধর্মগ্রন্থে এটি লেখা হয়েছিল যে, তার ঘর থেকে আগুন স্বীকৃত হতে পারে।

এটি বিচারিত হয়েছে যে,"পার্বত্য আদিম অধিবাসী প্রজাদের মুর্তি-পূজার অনুশীলন-কে কেন্দ্র করে, যে একটি ভয়ের অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে ব্রাহ্মণ্য বিশ্বাসের বিশুদ্ধতার বিষয়টি বিপন্নতার সম্মুখীন হয়েছিল, সেটি প্রথমত ব্রাহ্মণদের প্রস্তাবিত করেছিল আর্য সুবিধাভোগী ব্যক্তি এবং ক্রীতদাসতুল্য শ্রেণীর মধ্যে একটি অনতিক্রম্য বেড়াজাল উত্থাপিত করতে। এটি মনে হয় নিতান্তই একটি শিশুসুলভ ব্যাখ্যা।  এটি নিশ্চিতরূপে ভিত্তি করে আছে এমন একটি ধৃষ্টতাপূর্ণ অনুমানের ওপর যে, শূদ্রেরা সৃষ্টি হয়েছে কেবল পরাভূত মানুষদের নিয়ে, যেটি ত্রুটিপূর্ণ। এমনকি ঋগবেদ, অথর্ববেদ এবং পরেরদিকের বেদকীয় সাহিত্যের অন্যান্য অনেক প্রাচীন উল্লেখসমূহ, শূদ্রদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বেড়াজাল উত্থাপিত করার মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্য বিশ্বাসের বিশুদ্ধতাকে রক্ষা করা সম্পর্কিত কোনো ঈঙ্গিত প্রকাশ করেনি। সম্ভবত শূদ্রেরা, যারা নিযুক্ত হয়েছিল পরাভূত আদিম অধিবাসীদের মধ্যে থেকে, তারা বেদকীয় বলিদান থেকে বহির্ভূত হয়েছিল তাদের নানান রকমের ধর্মীয় অনুশীলনের কারণে, কিন্ত সেটি এই অভিব্যক্তির একমাত্র কারণ হতে পারে না। আমরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পৃথকীকরণ প্রক্রিয়ার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছি, যেগুলি শূদ্রদের বহিষ্করণের দিকে চালিত করেছিল।

শূদ্রদের অবস্থান, যেটি বেদকীয় ধর্মানুষ্ঠানসমূহের নানান বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে উত্থাপিত হয়েছে, সেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অপরদিকে, তাদের গবাদিপশুর অধিকারী হওয়া এবং সম্ভবত এক স্বাধীন কৃষক হিসেবে সক্রিয় থাকা ; কিছু রচনাংশে শূদ্রদের গার্হস্থ পরিচারক, কৃষিজাত মজুর এবং কিছু ক্ষেত্রে ক্রীতদাস হিসেবে প্রদর্শিত হওয়া ; রাজনৈতিকভাবে, আমরা শূদ্র-রত্নিন-দের সম্পর্কে জেনেছি,  কিন্ত আর্য ও ক্ষত্রিয়দের দ্বারা শূদ্র এবং বৈশ্যদের ঘেরাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টিরও উল্লেখ আছে। বিশেষ করে, এটি ভাবা অযথার্থ যে, শূদ্রেরা খাদ্য ও বিবাহ সম্পর্কিত সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েছিল : সেক্ষেত্রে যদিও নমশূদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ-কে কেন্দ্র করে এবং শূদ্রদের কিছু নিকৃষ্ট গুণাবলীতে আরোপিত করার মধ্য দিয়ে ঘৃণা উদ্গীরণের কিছু প্রমাণ রয়েছে, কিন্ত এর বেশিরভাগই অধিষ্ঠিত হয়েছে বেদকীয় পর্যায়ের পরে। ধর্ম-সংক্রান্ত দিক থেকে, শূদ্রেরা কিছু বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে অনুমোদিত হয়েছিল, এবং তবুও বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট ধর্মানুষ্ঠান থেকে তথা সাধারণভাবে বেদকীয় বলিদান থেকে বহির্ভূত হয়েছিল। অন্য কথায় বলতে গেলে, কেইথ সঠিক ছিলেন যখন তিনি বলেছেন যে, সংহিতা এবং ব্রাহ্মণগুলিতে,শুদ্রদের অবস্থান ছিল অনির্ধারিত বা দ্ব্যর্থবোধক। শূদ্রদের অবস্থান সম্পর্কিত অসঙ্গতির আংশিক ব্যাখ্যা সম্ভবত উল্লেখসমূহের কালানুক্রমিক অবস্থান দ্বারা নির্ধারিত করা যেতে পারে। সাধারণভাবে ধর্মানুষ্ঠানগুলিতে শূদ্রদের প্রবেশাধিকারের অস্বীকৃতি, যেগুলি অন্য সকল জীব-পরিমন্ডলের জন্য অনুমোদিত ছিল, সেগুলি পাওয়া যায় কেবলমাত্র পরেরদিকের গ্রন্থগুলিতে। একই সাথে তাদের অধিকার এবং শক্তিহীনতাগুলিকেও আমরা পাশাপাশি পেতে পারি। ক্রমবর্ধমান বর্ণ ভেদাভেদের পাশাপাশি ক্ষীয়মান উপজাতীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের বিদ্যমান থাকার বিষয়টির মধ্য দিয়ে সম্ভবত এটি বিবেচনা করা যেতে পারে। আর্য উপজাতির এক সদস্য হিসেবে শূদ্রেরা, নানান ধর্মানুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বেশ কিছু উপজাতীয় অধিকারসমূহকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল, এমনকি তখনও পর্যন্ত, যখন তাদের নিক্ষিপ্ত করা হয়েছিল সেবা-পরিচর্যা প্রদান করার ক্রমে।

এই পর্যায়ে শূদ্রদের অবস্থার একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এই বর্ণের কারিগর অংশটিকে বিশেষ সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছিল, যেমন রথকার ও তাকসান-দের। এটি দেওয়া হয়েছিল সম্ভবত কাঠের-কাজ এবং ধাতব-কাজের কারিগর হিসেবে তাদের বিশিষ্ট অবস্থান-কে কেন্দ্র করে, যাদের যোগদান ব্যতিরেকে আর্যরা প্রসারিত ও উন্নতি লাভ করতে পারতো না। এর আগে দেখানো হয়েছে যে, তাকসানেরা প্রতীয়মান হয়েছে কামার হিসেবে। বেদকীয় সমাজে তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি, প্রাচীন কৃষক সম্প্রদায়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, যেখানে তাদের অবস্থানস্থল ছিল এমনকি রাজার উপদেষ্টাদের অনুরূপ।

এমনকি বস্তুগত সংস্কৃতি (material culture) এবং সামাজিক সংগঠনের (social organisation) মধ্যেও আমরা একটি যোগসূত্র খুঁজে পাই। পি. জি. ডব্লিউ (PGW) প্রত্নতত্ত্ব যে ধরনের বস্তুগত জীবনকে তুলে ধরেছে, সেটি সামাজিক পৃথকীকরণ বিদ্যমান থাকার বিষয়টিকে প্রস্তাবিত করে, কিন্ত একই সাথে সেটি উদ্বৃত্ত উৎপাদনের ক্ষেত্রে সামাজিক অবরোধের বিষয়টিকেও চিহ্নিত করেছে। কারুশিল্প ও কৃষিতে লোহার সরঞ্জাম ব্যবহার সংক্রান্ত খুব সামান্য প্রমাণই আমাদের কাছে আছে, কারণ গঙ্গা অববাহিকায় লোহার যোগান মনে হয় খুবই সীমিত আকারে ছিল এবং কার্বোনাইজেশন মারফত লৌহদন্ভ পাকানোর (hardening) কারিগরিবিদ্যা ছিল অজানিত। পরেরদিকের বেদকীয় সমাজ মনে হয় ক্ষুদ্র আয়তনের অর্থ-সম্বন্ধ-হীন (non-monetary) একটি কৃষক সমাজ ছিল, যেটি গবাদিপশুর প্রতিপালন মারফত প্রবলভাবে সম্পুরণকৃত (supplemented) হয়েছিল। লোহার কুড়াল জাতীয় অস্ত্রের আবিষ্কার না হওয়ায় উপর গঙ্গা অববাহিকায় বনাঞ্চল সাফাই অভিযানের অসুবিধার কারণবশত, সেখানে বৃহৎ আকারের কৃষি-জমির অস্তিত্ব হয়ত ছিল না। সেইজন্য অর্থনীতিতে সাধারণভাবে কৃষিকাজের নিমিত্ত ক্রীতদাস এবং ভাড়াটে মজুরের প্রয়োজন হয়নি ; প্রতিটি পরিবার তাদের জমি ও কৃষিকাজের দেখাশোনা করতো নিজেরাই। অর্থনীতির নিশ্চিতভাবে প্রয়োজন ছিল কারিগর ও মেষপালকদের, কিন্ত তথাপি অধিপতি ও পুরোহিতদের সাথেও তারা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। সাহিত্যসংক্রান্ত প্রমাণগুলি প্রস্তাবিত করে যে, উপজাতীয় উপাদানসমূহ যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী ছিল। একটি অনুবর্তী বর্গের (serving order) নির্মাণ শুরু হয়ে গিয়েছিল, কিন্ত সেটির একটি শ্রেণীতে দানাবাঁধার (crystallisation) জন্য প্রয়োজন ছিল কিছু নিশ্চিত শর্তের, যেগুলির আবির্ভাব হয়েছিল বেদ-পরবর্তী পর্যায়ে। পরেরদিকের বেদকীয় পর্যায়ে, কাঠের লাঙলের-ফলা ভিত্তিক কৃষিকাজ, পুরোহিত ও যোদ্ধাদের জন্য অনুমিত করেছিল কেবল স্বল্প পরিমাণ উদ্বৃত্ত উৎপাদনের, যদিও অপেক্ষাকৃত বিলম্বিত কাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর, লোহার লাঙল ব্যবহার মারফত তারা লাভবান হয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছিল।

বিভিন্ন লেখক দ্বারা স্বীকৃত, বেদ-এর সূচিপত্রে প্রস্তাবিত সেই গবেষণামূলক প্রবন্ধ (thesis) স্বীকার করে নেওয়া সম্ভব না যে প্রথমদিকে, শূদ্রেরা ভূমিদাস-কৃষক ছিল, তাদের জীবন-যাত্রা ছিল নিরাপত্তাহীন এবং ক্রম পর্যায়ে তাদের পুরাতন বিকলতা অপসারিত হতে শুরু করেছিল। সেই সমস্ত আর্যরা, যারা শূদ্র হিসেবে হ্রস্বীকৃত হয়েছিল, তাদের এমনধারা একটি ধারণা, ধোপে টেকে না। অবশ্যই প্রাচীন যুদ্ধকালীন পর্যায়ে, একটি উন্মূলনমূলক কূটনীতি মারফত অনার্যদের বশে আনা হয়েছিল, কিন্ত দেখানোর মতো এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই যে, সেই পর্যায়ে যারা পরাভূত হয়েছিল, তারা বস্তুত বিকলতায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। অপরদিকে, মনে হয় প্রক্রিয়াটি ছিল সম্পুর্ন বিপরীত। যেখানে নাকি শুরুরদিকের উল্লেখসমূহ অঙ্গুলিনির্দেশ করেছে শূদ্রদের সম্প্রদায়গত জীবনের দিকে, সেখানে পরেরদিকের উল্লেখগুলি অঙ্গুলিনির্দেশ করেছে তাদের বহিষ্করণের দিকে, যার পরিণাম এই হয়েছে যে, বেদকীয় পর্যায়ের সমাপ্তির সাথে সাথে বিকলতাগুলি পুরনো উপজাতীয় অধিকারগুলিকে উপহত (overwhelmed) বা মাত করেছে। তারা এত বেশি চিহ্নিতকরণ দ্বারা পৃথকীকৃত হয়েছে এবং সম্ভবত এতটাই উৎপীড়িত হয়েছে যে, সেগুলি উপনিষদ থেকে প্রতিবাদ আবির্ভূত করেছে। ভ্রাহোদরনায়ক উপনিষদে এটি বিবৃত করা হয়েছে যে, এমনকি নমশূদ্র (candalas) এবং পাউলকাস-রা পর্যন্ত (palukasas) এমন ক্ষ্যান্তি দিয়েছে, যেন বিষয়টি আত্মার জগত সদৃশ, যেখানে সমস্ত রকমের ভেদাভেদ অদৃশ্য হয়ে যায়। ছান্দোগ্য উপনিষদ বিবৃত করেছে যে, এমনকি একজন নমশূদ্রও অগ্নিহোত্র বলিদানের আবর্জনাসমূহ পাওয়ার যোগ্য, যার চারপাশে বাচ্চারা, ঠিক এমনভাবে বসে থাকে, যেন মা'র চারপাশে বসে আছে। আমরা জানিনা, নিম্ন বর্গের সমর্থনে লিখিত এই সমস্ত প্রতিবাদসমূহ কতদূর উপজাতীয় ঐক্যের পুরাতন আদর্শ থেকে উদ্ভুত, কিন্ত তার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। বেদকীয় পর্যায়ের পরে এই প্রবণতা, সংস্কারসাধন গতিবিধির মাধ্যমে সম্মুখে অগ্রসরমান হয়েছিল, যখন নাকি এর বিপরীত প্রবণতা, যেটি শূদ্র বর্ণের ওপর বর্ধিত বিকলতা আরোপিত করতে উৎসুক ছিল, সেটি গ্রহসূত্র এবং ধর্মসূত্রগুলির সংকলনকারীদের দ্বারা অব্যাহত রাখা হয়েছিল।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন