কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

প্রণব চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


হে জীবন, হে মলিনতা  

ঘাটে ফাইনালী যাবার আগে ফুচুকদি তার শেষ ইচ্ছে হিসেবে একগ্লাস ঘোল খেতে চেয়েছিলো। জীবন যেহেতু হরহামেশাই গল্পময়, তাই ফুচুকদি এবং ঘোল ঘিরেও একটা গল্প থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে যদি একহাঁড়ি ঘোল এনে ফুচুকদির জীবনরেখার ওপর ঢেলে দেয়া যায়, তবে গড়াতে গড়াতে সে ঘোল গিয়ে পৌঁছবে তার ছেলেবেলা্‌য়, দাওয়ায় বসা বাবার হাতের ঘোলের গ্লাসের দৃশ্যে। ফুচুকদি তার বাবা-মায়ের ১৩টি সন্তানের শেষটি। আগের নটি কেউ জন্ম নিয়ে, কেউ জন্মের পর অল্প দুয়েকদিন বেঁচে, কেউ দুয়েক বছর বেঁচে হিক্কা তুলতে তুলতে মৃত্যুগাছে লটকে যাওয়ায়, বেঁচে থাকা চারের কণিষ্ঠা ফুচুকদি। এবং সেই জন্মটাও নাসবন্দী মায়ের জড়ায়ু নিংড়ে আকস্মিক পতন। অবাক হয়ে জ্যান্ত ছানাটির জন্মের কথা শুনে, পাড়ার লোকজন একজোট হয়ে স্থানীয় হাসপাতাল আক্রমণের প্রস্তাব নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলো। কারণ, পরিবার-পরিকল্পনার "হাম দো, হামারা দো" প্রকল্পে দালাল ফুচুকের মাকে ধোরে নিয়ে গিয়ে, রীতিমত হাসপাতালের টেবিলে শুইয়ে কিসব কাটাছেঁড়ার পর, তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো কিছু টাকাও। এত কাণ্ডের পরেও বাচ্চা পয়দা হওয়ায় বাবা-মায়ের সাথে এলাকার মানুষেরাও চরম ক্ষীপ্ত হয়ে হাসপাতাল আক্রমণের কথা ভেবেছিলো। কিন্তু সাহস শেষ পর্য্যন্ত তাদের সঙ্গে তেমন সঙ্গত না দেওয়ায়, অল্পকিছু হম্বিতম্বি করেই সবাইকে থামতে হয়।

সবাই খেয়াল না করলেও, লেবার-ওয়ার্ডের ডাক্তারবাবু হাওয়া গরম বুঝতে পেরে, তার কারণ জেনে টেনে নিয়ে, দায়ীত্ব নিয়েই সেবার ফুচুকদির মায়ের জড়ায়ূ চিরকালের জন্য নেই করে দিয়েছিলো। বাচ্চাকে নার্সের কাছে রেখে, মাকে নিয়ে আরেকবার অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়েছিলো সেই পেটকেটে বাচ্চা বার করবার ডাক্তার। আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ কোরে যে কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছিলো, গাঁয়ের লোকেরা মুখে মুখে তার নাম দিয়ে দিয়েছিলো ফুচুক।

অতি রুগ্না রক্তহীনা মা নানাবিধ ধকল হজম করে ফুলফর্মে আবার ফিরে এসেছিলো প্রাত্যহিক কাজের বৃত্তে। শুকনো বুক টানাটানি করেও দু-এক ফোঁটার বেশি দুধ মেলেনি ফুচুকের গোটা ছোটবেলা জুড়ে। কখনও ছাগল, মাঝে সাঝে গরুর দুধ দু-এক চামচ খেয়েই ফুচুক বেড়ে উঠেছিলো আশ্চর্যজনকভাবে। আর বেড়ে ওঠার সাথেই সে জেনেছিলো, বাবার মুড়ো এবং ভুঁড়ির রোগ। অর্থাৎ বায়ুজনিত বিস্ফোরণে সততই মাথায় রক্ত উঠে গিয়ে, বাবা যন্ত্রটি যা-তা সব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। পুরো ঝাপটের দাগ মার সারাগায়ে যত্রতত্র উঁকিঝুকি মারে, যতই দশ হাতি কাপড় টানাটানি কোরে মা তাকে আড়ালের চেষ্টা করে যাক না কেন। মা তাই বাধ্যতই এলাকার দোর্দণ্ডপ্রতাপ কবরেজের পরামর্শ মোতাবেক, ধার দেনা, ছাগল বাছুর বিক্রিটিক্রি ক'রে হলেও প্রতিদিন সকালে বাপ নামক পুরুষসিংহটিকে একগেলাস ঘোল খাওয়ানোর ব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়ে ফেলে নিজে থেকেই। কবরেজ বলে দিয়েছেন, ভুঁড়ি ঠিক থাকলেই মুড়ো অর্থাৎ মাথা ঠাণ্ডা থাকবে। ফুচুকও তাই প্রতিদিন বাবার সেই ঘোলের গেলাসটার দিকে বিস্ময়বিস্ফারিত এবং লোভি চোখ নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও, কোনদিন জানতে পারেনি বস্তুটি কেমন খেতে। কারণ, সেটা উপুড় কোরে খাওয়া শেষ কোরে বাবা তাতে একটু জল ঢেলে ধুয়ে সেটাও খেয়ে নিত। প্রথম প্রথম ফুচুক বায়না করত খাবে বলে, মা দুয়েকটা চরথাপর দিয়ে সে বায়না থামিয়ে দিত। তাতেও না থামলে, ঘরে ঢুকিয়ে শিকল তুলে দিত সে সময়টার জন্য। তারপর ধীরে ধীরে তার মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো, মানুষের বয়স বাবাদের মত হলেই সেটা খাওয়া যায়। ফুচুকও না পাবার অভ্যাসে নিজেকে রপ্ত কোরে নিয়ে ভুলে গিয়েছিলো সেই ঘোল নামক বস্তুটির স্বাদ আস্বাদনের প্রাথমিক রসনা। বরং পর্যায়ক্রমে সে ভুলে যেতে বাধ্য হলো দ্রুতই। কার্‌ণ, ঘোলাসক্ত বাবা মাঠ থেকে এসে যেদিন প্রত্যাশিত ভরাট গ্লাসটি সঠিক জায়গায় না দেখতে পেত, তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হত আমাদের দিকে তাকিয়ে সচিৎকারে বলা-- এই তোদের মা কোথায় রে?...

মা হয়তো ঘোলের পয়সা জোগাড় করতে না পেরে এধারে ওধারে অপরাধীর মতো মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। হাঁকডাক শুনেই বেরিয়ে আসতো কাঁচুমাচু মুখে। আর যায় কোথায়! বাবা তাকে দেখেই পারলে ছুটে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে উঠোনের মাঝামাঝি টেনে নিয়ে এসে, "কোথায় নাঙ মারাতে গিয়েছিলি? আমি যে মাঠ থেকে এসে এখন ঘোলটা খাই, ভুলে গেলি, না!" কথাটা শেষ হতে যেটুকু বাকি, মাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ না দিয়েই, উঠোনে আছাড় মেরে ফেলে, হাতের পাঁচন দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে একসময় নিজেই ক্লান্ত হয়ে শেষ ডায়লগটা দিয়ে থামত "যা মাগী, নাঙ চোদাগে যা, আমিও আজ খানকী বাড়ি গিয়ে ফূর্তি কোরে আসব"।

ফুচুকেরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে মায়ের মার খাওয়ার কষ্ট দেখে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকলেও, বাবাকে থামাতে বা মা-কে মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে কেউই এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেতো না। কাছে গেলেই ওই পাঁচনের বাড়ি তাদের কাঁচা ও কচি শরীরে পড়লে তারা সহ্য করতে পারবে না। মায়ের যেন মার খাওয়া সীজনড শরীর। এত মারটার খাওয়ার পরেও, বাবার শেষ ডায়লগটা শুনে খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠেও সপাটে বাবার দু-পা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতো, "আমাকে আগে মেরে ফেলে, তারপর তুমি যেখানে খুশি কাছে যাবা"। বাবা বহু চেষ্টা করেও সেই পা ছাড়াতে না পেরে, চুলের মুঠি ধরে টানাটানি, আরও কয়েক ঘা পাঁচনের বাড়ি মায়ের পাছায়, পিঠে দেগে দিয়েও যখন নিতান্ত নিরুপায় হয়ে যেত, তখন বলতে বাধ্য হত, "ঠিক আছে, যাব না, যা। কিন্তু আবার যদি নিয়মে ব্যাঘাত দেখি, আমাকে আর সামলাতে পারবি না।"

এসব দেখতে দেখতে বাবার একটা সংলাপ ফুচুকদের মুখস্থ হয়ে গেলেও, তাদের কাছে কিছুতেই তার মানে পরিষ্কার হতো না-- "খানকী বাড়ী গিয়ে ফূর্তি"। তাদের ভাই বোনেরা কিছুতেই বুঝতে পারত না, সেখানে কি বেঁচে থেকেই যাওয়া যায়, নাকি যেতে গেলে মরে যেতে হবে! সে বাড়ি কি কোন ঠাকুর দেবতার নাকি জন্তু জানোয়ারের! সেখানে গিয়ে ফুর্তি করা মানে কী?...  যাকগে, এই ধোলাই পর্ব মিটে গেলে বাবা মাঠে চলে যেত, আর মা ঠিক খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠে, কাঠপাতা ঠুসে ঘরের বাঁধা উনুনে চাল ডাল ফুটিয়ে ফুচুকদের জন্য দুপুরের কিছু খাবার ঠিক বানিয়ে দিত। এসব দিনে সন্ধ্যে পেরিয়ে অন্ধকার জবরদস্ত হয়ে বাড়ীটাকে প্রায় ঢেকে দিলেও, বাবার দেখা পাওয়া যেত না। তার জন্য মায়ের মধ্যেও তেমন কোনও ব্যাকুলতা চোখে পড়ত না। মা তাদের রাতের খাবার খাইয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিত। আর এর কিছু পরেই শোনা যেত কেমন এলোমেলো জড়ানো গলায় কিছু একটা গানটান গাইতে গাইতে বাবা বাড়িতে ফিরছে। উঠোনে দাঁড়িয়েই জড়ানো গলায় বাবা চীৎকার কোরে যা বলতে চেষ্টা করতো-- আমি বাড়ি ফিরছি, আর আলোটা নিয়ে উঠোনে দাঁড়াতে পারছিস না!... জানলার ফাঁক দিয়ে ফুচুক দেখত, একটা টিমটিমে লণ্ঠন নিয়ে মা বেরিয়ে এসে বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত ঘরের দাওয়ায়। সেখানে লণ্ঠনটা রেখে, একটা পাত্রে তুলে রাখা জল দিয়ে বাবার পা দুটো আগে ভালো করে ধুইয়ে দিত। তারপর চোখমুখ, ঘাড়টার ভালো করে ধুইয়ে দিয়ে সোজা বাবার ঘরের দিকে নিয়ে যেত তাকে। দুপুরের সেই দাঙ্গাবাজ বাবা যেন তখন একটা বাচ্চা খোকার মত। মা যা বলছে, তাই করছে। আর আস্তে আস্তে বলছে, "শোন্‌ মাগি, তোকে আমি খুউব ভালোবাসি, তোকে ছেড়ে কোথাও যাব না"। তারপর বাবার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও, সে রাতগুলো্‌য় ফুচুক কোনদিনই মাকে আর সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেনি। ধীরে ধীরে এরপর ফুচুক বড় হয়ে উঠলেও, একটা ব্যাপার তার নজর এড়ায় নি যে, তার জন্মের পর মায়ের আর কোনও সন্তান হয়নি।

নাসবন্দী মায়ের গর্ভ পিছলে হঠাৎ বেরিয়ে আসা এক "আনওয়ান্টেড চাইল্ড" ফুচুকদির জন্ম যেমন বিস্ময়কর রকমের গল্পমুখর, তেমনই গুজগুজফুসফুসে বেতালা তার পরবর্তী কালক্রম। আর এতকিছুর পরেও ফুচুকদির ক্রমেই বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তার বুক পাছা শরীর দেখলে, এলাকার ছেলেবুড়ো প্রায় সবারই ব্রহ্মতালুতে কিলবিল কোরে কৃমি উঠে যেত। মেয়েটাকে দেখলেই তাকে থামিয়ে কথা বলতে বলতে, কৃমির কামড়ে বৃদ্ধদের মুখে কখন ফেনা উঠে যেত, খেয়ালই থাকত না। মেয়েটাও তেমনি। ছেঁড়াফেটা জামাটামা না্ড়াতে নাড়াতে, তিরতির নাচতে নাচতেই দুটো একটা হ্যাঁ হুঁ গুঁজে দিত তেনাদের কথার মধ্যেই। ব্যাস, রসে যেন বোম্বাখাস! কেবল চিপে ধরে আদরের সুযোগ এই হঠাৎ সন্তান ফুচুকদি কাউকেই দিতে চাইত না, শুধু তার বাবা ছাড়া। ছেলে ছোকড়ারা তো আর থেমে থাকতে পারে না, নানাবিধ জ্বালা ও জ্বলুনি কাটাতে কাটাতেই তার মেয়েবেলা এলো, প্রখর হলো অগ্নি।     কবি যতই বলুক, 'কে কার খবর রাখে জনতার সমুদ্র কল্লোলে', খবর এসব ক্ষেত্রে ধর্ষকেরা রাখেই। বাধ্যতই বাপমায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জল সাঁতরে পিছলে বেরোনোর জন্মদাগ বয়ে বেড়ানো এমন এক ফুচুকদিকেও হঠাৎ হারিয়ে যেতে হয়। আবার দিন-তিনেক পর হঠাৎই ক্ষতবিক্ষত শরীর তথাপি প্রাণ আছে, পাওয়া গেলো পাড়ার এক ঝোপের কিনারে। রক্তবুঁদ মাছিসকল তাড়িয়ে ফাড়িয়ে ফুচুকদির বাপই তাকে তুলে নিয়ে এসে উঠোনে শোয়ালো। ধুয়েমুছে মা তাকে ঘরে নিয়ে চট পেতে শোয়ালো মেঝেতে। আর এই হারিয়ে যাওয়া ও ফিরে পাওয়া এপিসোডের ক্যাটাস্ট্রফ গ্রাম-মফঃস্বলের মেয়েদের জীবনে খুবই গতানুগতিক। বিবাহ নামক এক জীবনস্বপ্নের ঘরে ঢ্যাঁড়া পড়ে যায় বাকী জীবনের মতো। ফুচুকদিও তারপর থেকে এর বাড়ি, তার বাড়ি ঘুরে শুধুই কাজের লোক। কখনও সখনও সেসব কাজের সাথে এর বাড়ি তার বাড়ির দুষ্টু ছেলেরা ছাপছোপ্পড় খুদে দেয় আদি সম্ভোগের। বাড়ির বড়োরা এসে প্রথমে নানাবিধ ভালোবাসা, ভয় দেখানো আর সবশেষে "বন থেকে তুলে আনা" এদের মত মেয়েরাই ''ছেলেপিলেকে ভুলিয়ে এসব করিয়ে নেয়'' গোছের ব্র্যাণ্ডেড কথাটথা কানের গোড়ায় ছড়িয়ে দিতে থাকে। অবশেষে, সবকিছু ভুলে যাবার বিনিময়ে দুহাত ভরিয়ে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে মেটানো হয় অঙ্ক। আর এসবের পরেও ফুচুকদিদের মতো মেয়েদের সেসব বাড়ি কাজ করে যেতে হয় পেটের টানে। কাজ না করলে বাড়ির ভাত বন্ধ। কাজ জোটাতে না পারলে বাবার লাথির ভয়ে আগের বোনদুটো কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছে, বাপ-মা কেউই তার খবর জানেনা। কাজের বাড়ির লোকেরা কখনও বলতো, "তোর এক বোন তো খানকি খাতায় নাম লিখিয়েছে, অমুক গলতায় থাকে শুনলাম, তোর বাবু বলছিলো"।

ফুচুকদি এসব কথায় কোনদিন আগ্রহ দেখায়নি, তবে খানকি শব্দটি শুনতে এখন তার আর খারাপ লেগে না। এই গিন্নীই যখন তার ছেলের অপরাধ ঢাকতে ফুচুকের হাতে একমাসের মাইনের থেকেও অনেক বেশি টাকা তুলে দিয়েছিলো, তখন এটাও বলেছিলো-- কত মাগীই তো শরীর বেচে টাকা কামায়, তুই তো আর তা করিস নি! আমি নিজে থেকেই তো এ টাকা তোকে দিলাম। ভালো করে খেয়েদেয়ে গতর বানা, কত মিনসে দেখবি টাকা হাতে নিয়ে তোর বাড়ির পাশে দিনরাত ঘুরঘুর করছে শুধু একবার তোকে শোয়াবে বলে।...  আর এসবকথা শুনে, কাঠগুদামে আটকে থাকা ফুচুকদির তিনরাত্রি তার শরীরজুড়ে অতগুলো মানুষের নিরন্তর চেড়াইফাটাই চালিয়ে যাওয়ার ছবিগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো। মনে মনে বাহবা দিয়েছিলো তার সেই বড়বোনদের, যারা নাকি খানকি খাতায় নাম লিখিয়ে গলতায় তাদের ঠিকানা বানিয়েছে। মনে মনে এই প্রথম ফুচুকদি এক জেদ বসিয়ে নেয় নিজের ভেতর--এ বাড়ির বাবুটিকেও সে তার বুকে চড়াবে আর দেখবে গিন্নী তারপর কি বলে...! সুযোগ এসেও গেলো সিঁড়িভাঙা অঙ্কের নিয়মেই।

খবর এলো গিন্নীর নব্বুইয়ে মা, মত্তভূমি থেকে ফুস হবার সিগন্যাল পেয়ে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে পাখি হুশ হয়ে যাবে। পড়ি মরি গিন্নী হাতের কাছে ছেলেকে পেয়ে, ফিচিত ফিচিত নাক চোখ ভিজিয়ে ছেলের হাত লটকে সোজা বাপের বাড়ি ধাঁ। যাবার আগে ফুচুককে বলে গেলো, তোর বাবুকে আমি না-আসা অব্দি একটু খাইয়ে দাইয়ে রাখিস। তোর বাপকে বোলে এ ক'দিন এখানেই থেকে যাস। রান্না ঘরের পাশের ভাঁড়ার ঘরটায় চট কাঁথা বিছিয়ে রাত কাটিয়ে দিস। টাকা দিয়ে আমি তোকে পুষিয়ে দেবো। মাকে মাচায় চাপিয়েই আমি ফিরে আসবো। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো-- বাবু রাতে একটু নেশাটেশা কোরে ঘরে ফেরে, যেন কোন বিপদ না ঘটে একটু খেয়াল রাখিস। ফুচুক ঘাড় নাড়িয়ে সব কথা যে বুঝতে পেরেছে সেটা জানিয়ে দেয়। গিন্নী ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে যায়। ফুচুক নিজেও তার বাপের কাছে গিয়ে সব কথা বলে, বাড়তি টাকার কথাটাও। বাপ খুশি মনেই রাজি হয়ে যায়।

ফুচুক ফিরে যায় বাবুর বাড়ীর কাজে, সাথে নিয়ে নেয় তার ছেঁড়া কাঁথাকম্বলের পুঁটলিটাও। ভাগ্য তার এমনই সহায়, প্রথম রাত থেকেই ভাঁড়ার ঘরে তাকে আর শুতে হয় না, বাবুর নেশাবুঁদ মেজাজ সরাসরি তার শোয়ার জায়গা করে দেয় নিজের বিছানায় গিন্নীর বদলি হিসেবে। এর পরের গল্প আর না বলাই ভালো, আঁশ খুলে খুলে ফুচুকের শরীরের প্রতি ইঞ্চিতে ওস্তাদ ধোনাইকরের মতো তুলোধোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে টালমাটাল বাবুরাজ। সকালে উঠেই ঘুম থেকে তুলে ফুচুকের হাতে কড়কড়ে কয়েকটা টাকা তুলে দিয়ে তার জন্য নির্দিষ্ট ভাঁড়ার ঘরে পাঠিয়ে দেবার আগে বাবু আস্তে কোরে বলে দেয়, এ কদিন আমার কাছেই রাত কাটাবি। আরও বলে, কাউকে কিছু বলতে যাস না যেন! গিন্নী যেন খবরদার কিছু না জানে! ফুচুক ঘাড় ঝাঁকিয়ে ভাঁড়ার ঘরের টিমটিমে আলোর জগতে ঢুকে বুঝতে পারে, খানকি শব্দের সঠিক অর্থ। একটাই ফুটোয় সে ঢুকিয়ে নিতে পেরেছে বাপ আর তার ছেলে, দুজনকেই। গিন্নীর বালিশে চাদরে মাখামাখি হয়ে গেছে তার নিজের ঘাম, লালা, তলপেট ভাসানো পিছল জলের ঝাঁজগন্ধ।

নেশাগ্রস্ত বাবুর দুহাতের তীব্র থাবা আর দাফনার চাপে দলাপাকানো ফুচুক, পরপর পাঁচরাতের উন্মত্ত উলঙ্গ ছেঁড়াখোঁড়ার শেষে বুঝেছে, তার শরীরটা আর তার নিজের নয়। যে তার ওপর দখলদারী করতে পারবে, শরীর তারই। এই যাত্রাটা শুরু হয়েছে কাঠগুদামের সেই অন্ধকার কিনার থেকেই। যারা তাকে চুরি করে নিয়ে গেছিল, কাজ শেষে হাত পা খুলে নদীতে ভাসিয়ে দিলেই তো সব চুকে যেত। বদরক্ত মাখামাখি শরী্‌র, তারা লোকচোখের সীমানায় ঝোপ দেখে ফেরাতে গেলো কেন? হিসাব মেলে না ফুচুকের। শুধু এটুকু জানে, তিনটে দিন আর রাতজুড়ে বিরতিহীন তার শরীরের উপর নানা মানুষের দাঁত নখের যে মিলিত তাণ্ডব, সেই তাণ্ডবই তার শরীর-বিষয়ক যন্ত্রণাবোধ থেকে তাকে মুক্ত কোরে দিয়েছে।

আপাতত বাবুসঙ্গে নিশিযাপন ঘেঁটে যায় গিন্নীর ফেরার সংবাদে। তড়িঘড়ি বাবু ফিরে ফুচুকদিকে ডেকে গোপনে গুহার ডাক দেয়... "তোর জন্য তিতলীগাছীর কোঠাবাড়ীতে এক ঘর নিয়েছি, ওখানেই থাকবি তুই আমার বাঁধা মেয়েছেলে হয়ে। আর কোনো কাজ তোকে করতে হবে না, লাথী খেয়ে আর বাপের ঘরেও পড়ে থাকতে হবে না তোকে। গিন্নী ফিরলেই আমি তোকে সেখানে রেখে আসব। আমার লোক রাতের দিকে তোর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবে, চেঁচামেচি না কোরে তুই শুধু সাহস কোরে তার সাথে চলে যাবি, ব্যাস।" ফুচুকের চোখদুটো ভিজে ওঠে কথাটা শুনে। তিতলীগাছি, কোঠাবাড়ি কি, কোথা্‌য়, কারা থাকে সেখানে... এসব না জানলেও এমন করে কেউ তার দায়িত্ব নিতে চেয়ে এত ঘনিষ্ঠ হয়ে তার সাথে কথা বলেনি এর আগে। মনে মনে ভাবে, বাবু যা চাইবে, যেভাবে বলবে, তাই করবে সে। 

এরপর বাবু গোটা কয়েক ট্যাবলেট পকেট থেকে বার কোরে একটা ওকে তখুনই খাইয়ে দেয়, বাকী দুটো পরপর দুদিন কোনোরকম ভুল না কোরে খেয়ে নিতে ব'লে। ব্যাস, জ্যাম ক্লীয়ার। গাড়ী ছুটবে হুশ। 

কাঁথাকম্বল গুটিয়ে নিয়ে ফুচুকদি বাড়ী ফিরে স্নানটান কোরে এক'দিনের রোজগারের বাবুর দেয়া টাকা বাবার হাতে তুলে দিয়ে আবারও ফিরে যায় নিজের কাজে। বাপ খুশী হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধোরে বেশ কিছুটা আদর কোরে দেয় ফুচুককে। ফুচুক কেমন নিরাসক্ত হয়ে বাপ-বাবু-বাবুর ছেলের ছোঁয়ায় আর কোন তফাৎ করতে পারে না। মা মারা যাবার পর তার বাপ যে এখন এলাকার মন্দগলীর আশেপাশেই রাতের দিকে ঘুরঘুর করে, সে কথা ও'বাড়ীর গিন্নীই তাকে কায়দাকানুন কোরে একদিন শুনিয়ে দিয়েছে। আপাতত বাবার কাছে ছাড়া পেয়ে সে কাজে চলে যায়। গিন্নী আসছে, তাই কাজও আজ বেশি সেখানে। বড় একটা বাজার পাঠিয়ে বাবু চলে গেছে তার কাজে, ফিরবে সেই রাত্রে। ফুচুক এই ফাঁকে বাবুর শোবার ঘরে ঢুকে বিছানা বালিশ একটু গোছগাছ করে রাখতে গিয়ে টের পায় চাদরে দু এক জায়গায় চটচটে দাগ বেগ কটকট করছে। সেভাবেই রেখে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। এসেই শোনে গিন্নী ছেলেকে নিয়ে ফিরলেন। সবাই গেটের দিকে যায়, সেও যায়।  ছেলে আগে আগে ঢুকতেই ফুচুকের চোখে চোখ পড়ে। কেমন যেন মচমচিয়ে ওঠে সে ছেলের চোখ ও চিবুক। পেছন পেছন গিন্নী ঢুকেই ফুচুকের মুখোমুখি হয়ে সটান দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে-- কিরে, বাবুর কোনও অসুবিধে হয় নি তো! খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করেছে তো!... ফুচুক ঘাড় নাড়িয়ে সব কথাতেই সম্মতি জানায়। গিন্নী ঘরে চলে যেতেই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎই ফুচুকের তলব পড়ে গিন্নীর ঘরে। ফুচুক ঘরে ঢুকতেই গিন্নী ঘরের দরজা ডাঁশা দিয়ে আটকে দেয়, যেন অন্য কেউ এখন ঘরে ঢুকতে না পারে। ফুচুক ঘাড় নীচু কোরে স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর গিন্নী ফুচুকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্ষীপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, রাত্রে এ বাড়ীতে বাবু কাকে নিয়ে এসেছিলো রে? ফুচুক ঘাড় নীচু করেই বলে, জানিনা।

-- জানিস না, না বলবি না?... ফুচুক নিশ্চুপ। গিন্নী চাদরের দাগ দেখিয়ে বলে, এইসব দাগ কী কোরে তৈরি হলো?

-- জানিনা।

-- তুই কোথায় শুয়েছিস এই কয় দিন?

-- বাবুর কাছেই।

-- মানে!

-- বাবু ভাঁড়ার ঘরে আমায় শুতে দেয় নি।

-- এ বিছানায় বাবু তোকে নিয়ে শুয়েছিলো!...  ফুচুক আর কোনও কথা বলে না। এর পরের এপিসোড টিভি সিরিয়াল মাফিক বছর ভর টেনে নেয়া গেলেও, আমরা বরং পরবর্তী কার্যক্রমে নজর লাগাই।

চুলের মুঠি ধরে ঘরের বাইরে বার করে নিয়ে এসে ফুচুকের পাছায় লাথি মারার চেষ্টা করেও গিন্নী নিরত হয়। বেতো পায়ে রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। বরং সচিৎকারে বলে ওঠে-- আর কোনদিন যদি তোকে এ বাড়ির চৌহদ্দিতে কোথাও দেখি, ধরে নিয়ে এসে ছেলের ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দেবো। সারা জীবনের মতো তোর খানকীগিরীর সাধ মিটে যাবে।...  ফুচুক কোনও দিকে আর না তাকিয়ে, ঘাড় নীচু করেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। আসতেই আসতেই কানে বাজে গিন্নীর হেঁড়েল গলায় চেল্লানো-- নোংড়া মেয়েছেলে, আমার ছেলেকে দিয়ে মারিয়েও তোর সাধ মেটেনি! আবার স্বামীকে দিয়েও মারাতে গিয়েছে! ছেনাল মাগী, ডেকে এনে কাজ দিলাম যাতে দুটো খেতে পায়, আর ও' কিনা আমার সব্বনাশ কোরে দেবার ফন্দী এঁটেছে! যা এবার ঘরে গিয়ে তোর বাপকে দিয়ে মারাগে যা...

ফুচুক ঠিকই বুঝেছে, এ শরীরটা আর তার নিজের নয়। তার কোনও ইচ্ছা নেই, অনিচ্ছা নেই, অজুহাত নেই, কোনও আপন-পর নেই, তার কোনও দোষ-নির্দোষ প্রমাণেরও প্রয়োজন নেই... শুধু এক বেঁচে থাকা তাকে বয়ে নিয়ে চলেছে দিনের পর রাত, রাতের পর দিন!

এর পরের ঘটনা খুবই গ্যাদগেদে এবং চিরাচরিত। বাড়ি ফিরে সে তার ঘরের চৌকিতে এসে লেদিয়ে যায়। বাপ সারাদিনের মত চড়তে বেরিয়েছে। মেয়ের রোজগারের টাকা আছে হাতে, তাই নিশ্চিন্ত। রাতে বাপ ঘরে ফেরার আগেই, বাবুর লোক এসে ফুচুককে নিয়ে গিয়ে যেখানে ঢুকিয়ে দিয়ে আসে, দু-একদিনেই সে জেনে গেছে সেটাকেই খানকীপাড়া বলে। তারপর দীর্ঘ বছর এখানে বাবুর বাঁধামাগী হিসেবে কাটাতে কাটাতেই চরম এক অসুস্থতার দিনে, যেদিন ডাক্তার জবাব দিয়ে যায়, তখুনই এ-গলির পরিচিতেরা ডাক্তারবাবুর কথামতো তাকে শেষবারর জন্যে ইচ্ছামত পছন্দের খাবার খাওয়াতে চাইতেই সে ঘোলের কথা বলেছিলো। কিন্তু না, আয়োজন সম্পন্ন হলেও ঘোল পৌঁছনোর আগেই ফুচুকদি পৌঁছে যায় না-বাঁচার অন্য এক দেশে, যেখান থেকে কোনও ফেরা নেই...

 


2 কমেন্টস্: