কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

অঞ্জন সেনগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস


রূটম্যান




 

(১৪)

 

কানামাছি ভোঁ ভোঁ - পারলে আমাকে ছোঁ

খেলার রীতিটাই এমন! মাত্র একজনেরই চোখ বাঁধা থাকবে! অথচ বাকিরা দিব্বি সবই দেখতে পাবে, বুঝতে পারবে! সত্যিই বড্ড বোকা বানানোর খেলা। একজনকে বা তাদের সমর্থকদের নাজেহাল করার খেলা। এখন খুঁজে মর। অথচ যাকে ছুঁতে হবে, জাপটে ধরতে হবে, তাকে সবাই চেনে। কিন্তু কেউ ব্রহ্মার গোপন কম্মটির হদিশ দিতে নারাজ! কারণ স্বয়ং ব্রহ্মা ভীষণ রাগি! গোল গোল চোখে একবার কটমট করে তাকালে সারা বিশ্ব সংসারের আমজনতার বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যাবে! তাই কে আর নিজের মন্দ চায়? কেউ তাই সাধ করে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে না। পরিবার পরিজন নিয়ে সবাই ঘোর  সংসারী। এমন নিটোল মায়ার বন্ধন থেকে অসময়ে চলে যেতে মন চায় না কারোর। আর তাই অনেকেই মনে মনে বলতে থাকে আমি যা যা জানি তা সঠিক জানি না, যা কিছু দেখেছি তা বোধ হয় ভুল দেখেছি। আর প্রবাদেই তো বলেছে- “জিহ্বা টলতি ধীরস্য/ পাদষ্টলতি হস্তিনঃ/ ভীমস্যাপি রণে ভঙ্গো/ মুনীনাঞ্চ মতিভ্রমঃ”। কাজেই অনেকের মতো আমার দেখা বা শোনায় ভুল হতেই পারে। এসব নিয়ে আমি আর ভাবি না। কিন্তু যাদের দেখায় কোন ভুল নেই তারা তো ড্যাব ড্যাব করে সবই দেখছে! আর সবই সঠিক জায়গায় নোট করে রাখছে! এখন শুধু হুইসেলের ইঙ্গিতের বাকি! ব্যস! তার পরেই দৌড় শুরু হবে।

মাগুর মাছের পর সব মেছুয়াদের মতোই একটা ইয়াব্বড় কাতলার গলায় বটি চালাতেই বেশ কিছু রক্ত ছলকে এসে কৃষ্ণ মেছুয়ার পরনের লুঙ্গি ভিজিয়ে দিল। এমনটা প্রায়শই ঘটে থাকে। প্রথম প্রথম গা’টা  গুলিয়ে উঠত। এখন সবটাই সয়ে গেছে। কারণ নিত্যদিনের বাজার শেষ হলে কৃষ্ণ দেখে তার মাছের ডালিতে একটাও মাছ নেই। সেই সাথে বসার আসনের নীচে রঙ বেরঙের টাকা। এমনটা একেবারেই নতুন নয়। এ ব্যবসায় আদৌ লোকসান নেই। তবে একটাই আফসোস। আর তা হল মেয়েদের আঁচল চাপা মুখ। এমনকি হাসিরও! যেমন তার নাম তেমনই তার মুখের হাসিটি। সার্থক তার নাম। কিন্তু কৃষ্ণ যতই তাকে মুখ থেকে আঁচল সরাতে বলে ততই হাসি মুখ ঢাকে। অনেক মহিলার মতো তারও নাকি মাছের গন্ধে সারা শরীরটা গুলিয়ে ওঠে। অথচ হাসি দিব্বি বুঝতে পারে যে তার উপর কৃষ্ণের সুনজর আছে। আর তার! সে আঙুলে আঁচল পেঁচাতে পেঁচাতে ভাবে ব্যাপারটা মন্দ নয়। কিছু জমি জিরেত তা সামান্য হলেও আছে। তেমনই আছে একটা মুদিখানার দোকান, একটা লোহালক্করের দোকান আর কৃষ্ণের মাছের ব্যবসা। পরিবারের এখনও একটাই হাঁড়ি। কিন্তু ঐ যে আসল কথা হচ্ছে কৃষ্ণে্র সারা শরীরে মাছের একটা আঁশটে গন্ধ! এতেই অন্নপ্রাসনের ভাত বেরিয়ে আসার সামিল। যতই দামি সাবান দিয়ে সারা শরীর ধুয়ে ফেলুক না কেন সে গন্ধ যাবার নয়, তাই হাসির মনটা আজো দোদুল্যমান! হাজার হোক রাতে তো একই বিছানায় শুতে হবে! তখন যদি বমি হয়ে যায়! সেটা বড়ই বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। তাছাড়া ওর বন্ধুরাই বা বলবে কী! একান্ত অপারগ না হলে চট করে কোন মেয়েই কসাই আর মেছুয়াদের বিয়ে করতে চায় না। পয়সা আছে কিন্তু সম্মান নেই। অথচ কৃষ্ণ বড়ই নাছোড়। প্রতিদিনই ওর বন্ধুদের দিয়ে খবর পাঠায়। এটা একটা বিড়ম্বনাই বটে! রাস্তা ঘাটে ওরা এসে কৃষ্ণের বচন শোনায়। সুখ শান্তির গল্প বলে হাসিকে আশ্বস্ত করে। এ বড়ই অস্বস্তিকর অবস্থা। সে প্রায়শই দুঃস্বপ্ন দেখে কৃষ্ণকে নিয়ে। এবং কষ্টিপাথরের মতো রঙ ও বেশ সুঠাম চেহারার কৃষ্ণ ধীরে ধীরে কেমন যেন কুমড়ো পটাশের মতো হয়ে যাচ্ছে! হাঁটতে চলতে অসুবিধা হচ্ছে! একটা ছুঁচোতেও তাড়া করলে সে যেন তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারছে না! কৃষ্ণের হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ার মুহূর্তেই হাসিরও স্বপ্নটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না এই ধরনের স্বপ্ন দেখাটা ভালো, না খারাপ!

এসব কথা কৃষ্ণের কানে যেতে সময় লাগে না। সেও বড় বিড়ম্বনায় পড়ে যায়। একদিকে হাসির অমলিন হাসি আর সান্নিধ্য। আর অন্যদিকে তার মাছের ব্যবসা। এতসব ভাবতে ভাবতে তার মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। শেষে একদিন বাবাকে বলে কৃষ্ণ লোহালক্করের দোকানে বসাই ঠিক করল। আর এর ক’দিন পরেই হাসি বিগলিত হয়ে কৃষ্ণের দোকানে এসে হাজির হয়। এ তো মেঘ না চাইতেই অঝোরে বৃষ্টি শুরু  হল কৃষ্ণে্র মনে! মনে হচ্ছিল এই বৃষ্টি ধারায় তারা দুজনেই ভিজতে ভিজতে আদিগন্ত পাথারে হারিয়ে যাচ্ছে! সে নির্বাক হয়ে নিষ্পলক চোখে হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসি এক ঝলক হেসে উঠতেই কৃষ্ণের হুঁশ ফেরে। সে তাড়াতাড়ি হাসিকে বসায়। আর শুনতে চায় এই ব্যবসাটায় তার কোন রাগ নেই তো! এমন কথায় হাসি তার হাসির ঝরণায় সারা ঘর ভরিয়ে দেয়। কৃষ্ণের মন অনেকটা প্রশমিত হয়ে আসে।

একবার কৃষ্ণের দোকানে একজন সাধু বাবা এসেছিলেন। তিনি নাকি হিমালয় থেকে সোজা তার কাছেই এসেছেন। বলতে গেলে তিনি স্বয়ং শিব শম্ভুর দ্বারা আদিষ্ট হয়ে তার কাছেই এসেছেন। মুহূর্তের মধ্যে এমন কথা শোনার পরে সকলের মতো সেও মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় এক লাফে সাধু বাবার শ্রীচরণে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সাধু বাবা তাকে আশীর্বাদ করে বক্ষলগ্ন করলে কৃষ্ণের শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়। সে শুনতে পায় তার কানের কাছে সাধু বাবা বলছেন- “মেরা বাত শুন বেটা। ইয়ে কই মামুলি বাত নহি। তেরে লিয়ে ম্যায়নে বাবাকো আশীর্বাদ লেকে আয়ি হু। তু বহত ভাগ্যবান হ্যাঁয় ব্যাটা। যিস মিট্টিকো তুনে ছুঁয়েগা উ মিট্টি সোনা হো যায়েগা। তুনে ইতনে ধনবান হোগা কি আজ ইয়ে তেরে কল্পনাকে বাহার। তু শিব শম্ভু কো হর রোজ পুজা পাঠ কর বেটা। পরন্তু বাবাকে আশীর্বাদ যো ম্যায়নে লেকে আয়া, উসকো কভি ঝুটা উপযোগ মত করনা বেটা। তব বাবানে তেরে উপর নারাজ হোগা। বাবানে ফের কৈ্লাশ চলা যায়েগা। জয় শিব শম্ভু!” একটা হুঙ্কার ছেড়ে সাধু বাবা উঠে দাঁড়ান। কোনদিকে না তাকিয়ে তিনি সটান রাস্তায় এসে দাঁড়ান। কিন্তু কৃষ্ণ বাবাকে সেবা করার সুযোগ না পেয়ে আক্ষেপ করতে থাকলে ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার শিষ্য আক্ষেপ করতে মানা করে। আর সে একটা বিধান দিয়ে বলে কৃষ্ণ যেন বাবার প্রণামি হিসেবে একটা দাম ধরে দেয়। সেদিন কৃষ্ণ একেবারে নগদ এক হাজার টাকা বাবার উদ্দেশে তাঁর শিষ্যকে দিয়ে কতটুকু তৃপ্ত হয়েছিল তা না জানা থাকলেও উত্তরোত্তর সত্যিই কৃষ্ণের হাতের স্পর্শে সবই যে পালটে যেতে লাগল তা দিনের আলোর মতো সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে গেল! একেই বলে স্বয়ং শিব শম্ভুর অসীম কৃপা।

যে ছেলেটি মাত্র অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে সে যে এত তাড়াতাড়ি উপরে ওঠার সিঁড়িটি চিনে যাবে তা যেমন জেলার তাবড় তাবড় সুযোগ সন্ধানি নেতারাও বুঝতে পারেনি, ঠিক তেমনই কৃষ্ণ নিজেও ভাবতে পারেনি! যার কথা বলতেই দু’ পায়ে ঠোকাঠুকি লাগে সে কিনা মাইকে কথা বলছে! কতটুকু সঠিক ভাবে রাজনৈতিক কথা বলছে তা বড় কথা নয়। বড় কথা হল সেই ছেলেটি অনেকেরই হাততালি পাচ্ছে! একেবারে গ্রামের চলতি কথাগুলোই সে নিজের মুখে বসিয়ে নিচ্ছে! হঠাৎ করে অতি উৎসাহে কিছু চ্যাংড়া ছেলেরা হাততালিও দিয়ে ফেলছে। আর এটা হল একটা ছোঁয়াচে অসুখের মতো। একজন দিলেই কেউ বুঝুক বা না বুঝুক চারদিকে চটপট করে তালির ঢেউ উথলে ওঠে! শহরের বাবু নেতারা এসব খবর ঠিক রাখেন। তাদের নজর পড়ে গেল এই কালোপানা ছেলেটার উপর। আর দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে একেবারে সঠিক দরজায় টোকা পড়ল। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকল পুরাতন ভৃত্যের দল। অবোধের গো বধে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক তেমনি ওরাও অবিরাম হাততালি দিয়ে চলল অন্যের উৎকর্ষতায়।

কৃষ্ণ সেই শিশুকালে ননী চুরি দিয়েই হাত পাকিয়েছিল। নিজের বাড়ি বাদ দিয়েও অন্য প্রতিবেশিদের  বাড়িতেও মাঝে মাঝে হামলা চালাত সে তার বন্ধুদের নিয়ে। সবাই তার এমন কাজকে বালখিল্যতা ভেবেই ছেড়ে দিত আর হেসে একেবারে লুটিয়ে পড়ত। কিন্তু কেউ ভাবতেও পারেনি যে সেটা ছিল তার হাতেখড়ি। বেশ সাফল্যের সাথেই উত্তীর্ণ হয়েছিল সকলের আদরের কৃষ্ণ।

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই কৃষ্ণ বিস্মিত হয়ে দেখে সবাই নিজের নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাচ্ছেন! সাধু যেমন সজ্জনদের খুব সহজেই চিনতে পারে, দুর্নীতিপরায়নেরাও তাদের সাকরেদদের চিনে নিতে ভুল করে না। এ চুম্বকের এক অদ্ভুত অমোঘ আকর্ষণ! সাধুর আশীর্বাদে সাত্ত্বিক কৃষ্ণ দিন দিন পালটে যেতে লাগল! বাবা ভোলানাথের পুজো না করে সে জল গ্রহণ করে না। তার এমন ভক্তির কথা সারা রাজ্যে ছড়িয়ে যেতে সময় লাগল না। রাজ্যের দেব-দেবীরা প্রীত হলেন তার ভক্তির বহর দেখে! কিন্তু তার দ্বিতীয় সত্ত্বাই ছিল দেখার মতো। হুহুঙ্কারে ভরা! ক্ষুধার্ত্ত হিংস্র জন্তুও সেই হুঙ্কারের কাছে একেবারেই মৃয়মাণ! সারা রাজ্যবাসী না হলেও অন্তত রাঢ়াঞ্চল সব সময় একেবারে সিঁটিয়ে যেতে লাগল!  বলা তো যায় না কখন কে কোথায় চিরদিনের মতোই হারিয়ে যায়! তাদের খোঁজ মানুষ তো ছাড় দেবা ন জানন্তি! প্রায় প্রতিদিনই একবার করে কৃষ্ণের বাঁশি বেজে উঠত। একটিই মাত্র গানের কলি ছিল তাতে- “আমি ভয় করব না ভয় করব না/ দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না-“। কৃষ্ণ তখন হাত জোড় করে মনে মনে বলত- ঐ শুনি যেন তব অভয় বাণী রে! তোমার অভয় আমার মাথায় সব সময় ছাতার মতো কাজ করে। আর তাতেই আমার শরীরে কোন বাইরের তাপ লাগে না। আমি তখন নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের মতো শান্ত হয়ে থাকি। হে কান্ডারিনী, দেহি তবপদপল্লব মুদারম।

ফোনটা এসেছিল রোজকার পুজোটা শেষ হওয়ার ঠিক পরেই। কৃষ্ণের চোখের ইশারায় কলটা রিসিভ করেছিল সাইকেল হোসেন। কৃষ্ণের ছায়া সঙ্গী বলা যেতে পারে। ওপারের ফোনটা যে করেছিল সে প্রথমে নিজের সঠিক নামটা না বলে কৃষ্ণকে চাইছিল। সাইকেল হোসেন অপরিচিতকে একটু বাজিয়ে নেওয়ার জন্য বলল- “এখন তো দাদাকে দেওয়া যাবে না। বরং আপনি যা বলার তা আমাকে বললে আমি এখনই দাদাকে বলে দেব। আমি দাদারই লোক”।

লোকটি তবুও নিজের সঠিক নাম না বলে একটা মনগড়া নাম বলে দিল। ওদিকে সাইকেল হোসেনও কম যায় না। সেও দাদাকে লাইনটা দেবে না, আবার ওদিকে লোকটাও বড়ই নাছোড়। সে সরাসরি দাদার সাথেই যা বলার বলবে। কোন ভায়া তার একেবারেই পছন্দ নয়। তবু হোসেনের একগুয়েমির কাছে হেরে গিয়ে লোকটি বলে- “ঠিক আছে, আপনি দাদাকে বলুন আমি একটা ব্যবসার কথা বলব। উনি যেন কাইন্ডলি আমার সাথে একবার কথা বলেন”।

ব্যাপারটা অনেক্ষণ ধরেই কৃষ্ণে্র কানে আসছিল। এবার সে প্রায় সাইকেল হোসেনের হাত থেকে রিসিভারটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল- “তোর এত কথা বলার তো প্রয়োজন নেই। আমি তো তোর কাছেই আছি, নাকি! হ্যাঁ, কে বলছেন?”

ওপার থেকে একটা অচেনা গলা বলল- “স্যার, সালাম ওয়ালেকুম। আমাকে আপনি চিনবেন না। তবে আমি কিন্তু আপনাকে খুব ভাল করেই চিনি এবং বহুবার আপনার বক্তব্যও শুনেছি। অসাধারণ বলেন আপনি। একেবারে মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়”।

কৃষ্ণ অপরিচিত কন্ঠটিকে থামিয়ে দিয়ে বলল- “এবার আসল কথায় আসুন। কেন ফোন করেছেন সেই মোদ্দা কথাটা বলুন। আমার সময়ের কিন্তু খুব দাম। অনেকেই লাইনে আছে। আজো তাদের সাথে দ্যাখা করা তো দূরের কথা, সামান্য কথাটুকুও বলতে পারিনি”।

-“হ্যাঁ স্যার, তা তো বটেই। আমি স্যার একটু আপনার কৃপা ভিক্ষা করছি। পাব তো স্যার?” লোকটির গলা থেকে যেন একরাশ আকুতি ঝরে পড়ে।

কৃষ্ণের মোটা ভূরু যুগল কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে যায়। সে এক লহমা ভেবে নিয়ে বলে- “আপনি যদি প্রয়োজনটা বলতেন তাহলে আমার পক্ষে বুঝতে সুবিধা হত যে আমি আদৌ আপনার কোন উপকার করতে পারব কিনা! তা নাহলে আপনারও সময় নষ্ট এবং আমারও”।

লোকটি এবার কোন রকম ভনিতা না করেই বলে- “আমি স্যার ব্যবসা করি। একটু যদি লাইন ক্লিয়ার পাই তাহলে গরিবের ব্যবসাটা টিকে থাকবে। আর টিকে না থাকলে প্রচুর অর্থ দন্ড যাবে স্যার। আর কোনদিন হয়তো উঠে দাঁড়াতেই পারব না”।

-“ব্যবসাটা কিসের শুনি?” কৃষ্ণ জানতে চায়।

-“তেমন কিছু একটা নয় স্যার। ধরুন ঐ চারপায়ের ব্যবসা। গরিব মানুষ এর চেয়ে আর বেশি কীই বা করতে পারি স্যার”। লোকটির গলা শুনে মনে হল তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।

-“তাহলে এতদিন কীভাবে লাইন ক্লিয়ার পেতেন? আজই বা পাচ্ছেন না কেন!” কৃষ্ণ জানতে চায়।

-“দশ জায়গায় প্রণামি দিতে দিতে আমি তো একেবারে ক্লান্ত আর সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছি স্যার। তাই ভাবছি দশ থানে দক্ষিণা না দিয়ে বরং এক থানে দেওয়াই ভাল নয় কি স্যার?”

-“আপনার বর্তমান রুটটা বলবেন কি?” কৃষ্ণ নির্লিপ্ত গলায় জানতে চায়।

-“ঐতো স্যার, বিহার-উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান-হরিয়ানা-পাঞ্জাব থেকে মাল আসে মুরারই-লোহাপুর রামপুরহাট-সাঁইথিয়া লাভপুর-ইলামবাজার এসব হাটে। আর কিছু মাল আসে বালুরঘাট আর পাইকর হাটে। আর বাকিটা কিনি ন্যাজাট-মছলন্দপুর-বসিরহাট থেকে। কিন্তু স্যার, রাস্তায় আমাদের ট্রাকগুলো ধরে পুলিশে খুব বেশি দর হাঁকে। রুটম্যানদের কথা শোনা তো দূরের কথা আমাদের লোকেরাও ওদের সাথে পেরে উঠে না। তাই যদি আপনি একবার ওদের সাথে কথা বলে হিসেবটা অবলাদের সংখ্যা হিসেবে না হয়ে গাড়ি হিসেবে হয় তাহলে আমিও বাঁচি, ওরাও বাঁচে। আমি সৎ উপায়ে ব্যবসা করতে চাই স্যার। কাউকেই ঠকাব না। এটাও তো ওদের প্রাপ্য স্যার, তাই না! তা নাহলে ওদের সংসারই বা চলবে কীভাবে বলুন!”

-“এসব বড়ই হ্যাপার কাজ। সব জেলা যে আমার কথা শুনবে তাও নয়। যদিও সব জেলাতে আমরাই রয়েছি। কোন পুলিশই আর আমাদের কথার বাইরে যেতে পারবে না। এছাড়াও এসব কথা তো আর চাপা থাকবে না। একেবারে উপরে চলে যাবে। কাজেই এ কাজটা অত সহজ নয়। অতএব অনেককেই যে সন্তুষ্ট করতে হবে তা নিশ্চয়ই আপনাকে আর বলে বোঝাতে হবে না”। এতক্ষণ পরে কৃষ্ণ তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে।

লোকটি বুঝতে পারে যে রাঘব বোয়াল এবার টোপ গিলতে শুরু করেছে। এই বিশাল মাছটিকে আমার ব্যবসায়ী ছিপে গেঁথে তুলতে পারলে আর এ পথে ব্যবসা করতে ভবিষ্যতে কোন অসুবিধাই হবে না। লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় কৃষ্ণ আবার বলে- “আমি যতটুকু করার তা করব যাতে আপনার ভবিষ্যতে ব্যবসা করতে আর কোন অসুবিধা না হয়। এর পরে আপনি আর আমাকে ফোন করবেন না। বাদবাকি সব কথা বলবে আমার ছায়াসঙ্গি সাইকেল হোসেন। ও যা বলবে সেটাই ধরে নেবেন আমারই কথা। বুঝতেই তো পারছেন চারদিকে হাজার হাজার ক্যামেরার লেন্স আমাকে ধরে রয়েছে। যদিও আমার জেলায় আমার বিরুদ্ধে ট্যাঁ ফু করার ক্ষমতা কারোর নেই। কিন্তু রাজ্যে তো আরো জেলা রয়েছে। এছাড়াও আমাকে যে সব রাজ্য নেতা-নেত্রীরা সুনজরে দেখেন তা আবার অনেকেরই পছন্দ নয়। কাজেই আমাকেও চারদিকে সামলে চলতে হয়। আশাকরি ব্যাপারটা আপনার কাছে ক্লিয়ার!”  কৃষ্ণ ফোনটা হোসেনকে দিয়ে ইশারায় বলে লোকটির সাথে কথা বলার জন্য। আর একটা কাগজে লেখে ‘ছয় কোটি তিন মাস পর পর দিতে হবে’। অর্থাৎ বছরে চব্বিশ কোটি। তা নাহলে চারপায়ের ব্যবসা করা যাবে না। কাগজটি এগিয়ে দেয় হোসেনের দিকে। হোসেন গড় গড় করে তা পড়ে শোনায়। কৃষ্ণ বুঝতে পারে যে এমন শর্তে লোকটি নিশ্চয়ই রাজি হবে না। কিন্তু কি আশ্চর্য! লোকটি সাথে সাথে রাজি হয়ে যায়! কৃষ্ণ গালে হাত দিয়ে ভাবে এই চারপায়ের ব্যবসায় এত কোটি কোটি টাকার খেলা জড়িয়ে আছে তা তো আগে কখনও তার ভাবনাতেই আসেনি! কিম আশ্চর্যম! কিম আশ্চর্যম! অত্যধিক আনন্দে কৃষ্ণের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে!

-“বুঝলি হোসেন, আমি একটা জিনিস ভাবছিলাম। তা হল, তুই ব্যাঙ্কে একটা নতুন বই বানা। আর এর পরে এই খাতে যা আসবে সবটাই আগে ঐ অ্যাকাউন্টে ফেলবি। তার পর আমি যেখানে যেখানে বলব সেখানে মাল পৌছে দিবি। ভাগ হবে চারটি। সবটাই নিজের হাতে করবি। তোর বাঁ হাত যেন জানতে না পারে যে ডান হাত কি করছে! এ ক্ষেত্রে একটা চরম গোপনীয়তা মেনে চলতে হবে। বাকিটা আমি সামলে নেব”। কৃষ্ণ হাত বাড়ালে হোসেন তার হাতে একটা পানের খিলি গুঁজে দেয়।

সাইকেল হোসেন হঠাৎ বলে- “দাদা, বেশ ক’দিন ধরে আমার ডান হাতের পাতা বেশ চুলকাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কেন এমনটা হচ্ছে! এখন বুঝতে পারছি আমার নানি যে বলত ডান হাত চুলকোলে টাকা আসে তা একেবারে মিথ্যা না।“

হোসেনের কথায় হাসতে হাসতে কৃষ্ণ বলে- “এর পর দেখবি তোর বাঁ হাতে্র পাতা চুলকোচ্ছে আর তুই ব্যাগ ভর্তি করে টাকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌছে দিচ্ছিস। তখন কতটা রাগ হবে বলত। মেহনতের টাকা বারো ভূত খেলে কার না রাগ হবে বল!” কৃষ্ণের গলায় একরাশ আফসোস ঝরে পড়ে।

সাইকেল হোসেন একটু ভেবে বলে- “তাহলে দাদা, ফালতু আমরা ওদের কেন টাকা দেব। বরং আপনি টাকাগুলোকে অন্য কাজে লাগান”।

কৃষ্ণের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে যায়। সে বলে- “নারে সাইকেল তার কোন উপায় নেই। যাদের না দিলে চলবে না তাদের দিতেই হবে। তাছাড়া সব সময় মনে রাখবি উপরে টিকি বেঁধে রাখতে হয়। বলা যায় না কখন হাওয়া খারাপ হয়ে আসবে। তখন তো এরাই দেখবে। তবে আমি একটা জিনিস ভেবেছি। কেমন আমদানি হচ্ছে তা দেখে নিয়ে বেশ কয়েকটা ডাম্পার কিনব ভেবেছি। এই ব্যবসাটা বেশ লাভের। অনেক জমিও কিনব। এর পর তোর বাড়িটাও নতুন করে দেব ভেবেছি। আমার পুরনো বাড়ির পাশে আর একটা নতুন দোতলা বানাব। নিচের তলায় পার্টির লোকেরা আসবে। মিটিং-এর জন্যও বেশ বড় একটা ঘর থাকবে। এসব প্ল্যান আমার মাথায় আছে। সবটাই বাবা মহেশ্বরের কৃপা”।

একটু নীরবতার পরে সাইকেল হোসেন বেশ কাঁচুমাচু মুখ করে বলে- “দাদা, একটা কথা বলব?”

কৃষ্ণ কিছু একটা ভাবছিল। সে হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলে- “বল শুনি”।

-“বলছিলাম কি আমার মাইনে তো আপনার অজানা নয়। প্রায় নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আপনার অনুগ্রহ আমার সাথে আছে বলেই আজো সংসারটা চলছে। তাই বলছিলাম, জানেন তো আমার বউটা বাড়িতে বসে বসে একেবারে হেঁদিয়ে মরল। ওকে যদি একটা কোথাও ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলে আমার সংসারটা বেঁচে যাবে। ছেলে-মেয়েদের পড়ার পেছনেই অর্ধেক টাকা প্রায় শেষ হয়ে যায়”।

-“এসব আর নতুন করে বলার নেই। সবই আমার জানা। তোর বউ একটা দুটো পাশ থাকলে ওকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিতাম। কিন্তু তা তো হবার নয়। আমার মেয়েটা টেট পাস না করলেও ওর একটা হিল্লে করতে হবে। সেই সাথে দু’জন আত্মীয়েরও চাকরীর ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের আমলে যদি না করতে পারি তাহলে আর কবে হবে বল। তবে কথা দিলাম তোর বউয়েরও একটা ব্যবস্থা করে দেব। একটা সুযোগ এলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুই এসব নিয়ে আর ভাবিস না”। কৃষ্ণ অন্যমনস্ক ভাবে ওয়াশ রুমের দিকে চলে যায়।

সত্যিই সাইকেল হোসেনকে আর অর্থের মতো নগন্য ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি। একে একে স্ত্রীর চাকরি যেমন হয়েছে তেমনি একটা ঝা-চকচকে বাড়িও হয়েছে। এখন আর তার চাকরির মাস মাহিনায় হাতই দিতে হয় না। সবই দাদার মহিমা। নিজে মুসলিম হলেও মাঝে মাঝেই সে দাদার সাথে জয় শিব শম্ভু বলে ধুঁয়ো তোলে। তবে মাঝে মধ্যে আল্লার নামও নেয়।

বাতাসে একটা কথা অনেকদিন থেকেই ভাসছিল যে ক্যামেরার লেন্স নাকি এবার রাঢ় ভুমির দিকে ঘুরতে চলেছে। সাইকেল হোসেন প্রথমে বিরোধীদের এসব উটকো খবরকে একেবারেই পাত্তা দেয়নি। কেনই বা দেবে শুনি। সে কার ছায়াসঙ্গী তা কারোর জানতে বাকি নেই। কিন্তু সেই গুজবটা যখন ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হবে হবে করছে তখন হোসেন বলল- “দাদা, ঘটনা শুনেছেন তো?”

দাদার ভূরু যুগল কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে গেল। সে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে বলল- “তুই কিসের কথা বলছিস বলতো সাইকেল? এখন তো আকাশ-বাতাস সবই শিক্ষাময়! গুপ্তধন তো এখন সেখানেই চাপা রয়েছে। সবার নজর এখন শুধু একদিকেই রয়েছে”।

-“আরে দাদা, সে তো আর নতুন নয়। গ্রামে-গঞ্জে সবাই জানে। কিন্তু আমি বলছি চারপায়ের কথা। হাটে-ঘাটে তো এখন লোকে এটাই আলোচনা করছে। আমাকে দেখে থেমে গেলেও আমার কিন্তু এই ব্যাপারটা মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না”। হোসেনের গলা যেন শুকিয়ে আসে। মুখে আর কথা সরে না।

কৃষ্ণর ভূরু যুগল এখনও কুঞ্চিত হয়েই রয়েছে। তবু সে হোসেনকে সাহস দিয়ে বলে- “আরে তুই এত দীর্ঘ বছর আমার সাথে কাজ করেও কেন যে এতটা ভীতু রয়ে গেলি তা কিন্তু বুঝতে পারছি না! হিন্দিতে ‘বেতাব বাদশা’ বলে একটা কথা আছে জানিস তো? আর একটা কহবৎ আছে হিন্দিতে। তাহল, হাতি চলে বাজার অর কুত্তা ভুকে হাজার। আর তুই হলি সেই বেতাব বাদশা আর সেই হাতির সঙ্গী। তোর গলায় এ কথা মানায় না রে সাইকেল। এর পরে আর ডরফুকের মতো কথা বলবি না। তোর সাথে একটা বন্দুক আছে এটা ভুলে যাস কেন! তেমন দেখলে আগে চালিয়ে দিবি। বাকিটা আমি সামলে নেব। আমি কিন্তু আজ বর্ধমান জেলা অফিসে যাব। তুই বরং বাড়ি থেকে একেবারে তৈরি হয়ে চলে আয়”।

হোসেন বাড়ি গেল বটে কিন্তু ওর মনটা খচখচ করতে থাকে। হাটে-বাজারে যে দাদাকে নিয়ে এত আলোচনা তা কি শুধুই বিরোধীদের কুৎসা! সে তো সবই জানে। অথচ দাদা কিছুতেই এসবকে একেবারেই পাত্তা দিতে চায় না। দাদাকে ফাঁসানোর জন্য যে কোন সময় হানা হতেই পারে। এসব ভাবতে ভাবতেই হোসেন বাড়ি গিয়ে দেখল স্ত্রী অফিস চলে গেছে কিন্তু কারা যেন বাড়ি এসে একটা চিঠি দিয়ে গেছে। হোসেন কাগজটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারে যে এটা একেবারেই কোন মামুলি চিঠি নয়। এটা একটা সমন। হোসেনের শরীরটা কেমন যেন অবশ মনে হয়। সে দাদাকে ফোন করবে কিনা ভাবে। তার পর মনে হয়, না থাক। আর কিছু পরেই তো দাদার সাথে বের হতে হবে। তখন না হয় চিঠিটা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলা যাবে। সাইকেল হোসেন চিঠিটা জামার পকেটে রেখে দেয়।

গাড়িতে বসে কৃষ্ণ চিঠিটা পড়ল বটে কিন্তু খুব একটা বুঝতে পারল না। এমন কঠিন ইংরেজী ওকে কেউ ক্লাস এইটে পড়ায়নি। কিন্তু চিঠিটা যে একেবারে মামুলি প্রেম পত্র নয় তা বোঝার মতো ক্ষমতা কৃষ্ণের আছে। সে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে পেছনের সিটে সাইকেলের পাশে বসে এখন যা যা করণীয় তা বিস্তারিত আলোচনা করল। এবং সেই মোতাবেক গাড়ি বর্ধমানে জেলা দপ্তরে পৌছানোর আগেই একটু বাসস্ট্যান্ড ছুঁয়ে গেল। আর তার পর থেকে সাইকেল হোসেনকে স্বশরীরে কোথাও পাওয়া গেল না। শুধু দাদার একটা ফোন গেল নির্দিষ্ট অফিসারের কাছে যে হোসেন আজ থেকে অফিসিয়ালি অন লিভে রয়েছে। এমনটাই যেন তাকে দেখান হয়। ক’জন অফিসার এই রাজ্যে আছেন যিনি দাদার কথার অবাধ্য হবেন। ফলে হোসেন এখন থেকে ছুটিতে কিন্তু সে কোথায় তা কেউ জানেনা। এমনকি আল্লা ন জানন্তি!

খবরটা তখন বাতাসে যেন ছুটে বেড়াচ্ছে। কাজেই দাদার কানে যেতেও দেরি হল না যে হোসেন এখন এরেস্টেড। ছেলেটা যে বেশ বিশ্বস্ত সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ঐ দিল্লি ব্যাটাদের নিত্যদিনের প্রবল চাপ সে কতটা নিতে পারবে বা তার নার্ভ কতদিন নর্মাল থাকবে সে ব্যাপারে দাদা নিশ্চিত নয়। ফলে তার ভুলে যাওয়া বিভিন্ন অসুখগুলো একে একে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। এসব ঝামেলার মধ্যেই দাদার স্ত্রী বিয়োগ হল। এতদিন যিনি তার পুরো সংসারটা নিজের হাতে সামলাচ্ছিলেন আজ তাকে ছাড়া কীভাবে চলবে এসব প্রতিনিয়তই দাদাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। বড় বেশি একা হয়ে গেল একমাত্র মেয়েটা। এসব সামলে উঠতে না উঠতেই উড়ে এল ভালোবাসার চিঠি। দাদা আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

দাদারা জানেন যে উডবার্নের একটা দুটো কেবিন সব সময় অসাধারণ লোকদের জন্য খালি থাকেই। ওখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ! ব্যবস্থাপনায় কোন খামতি নেই! যে হারে ধকল যাচ্ছে তাতে দিব্বি এখানে সপ্তাহ খানেক খেয়ে গড়িয়ে কাটিয়ে নেওয়া যাবে। লিখিয়ে নেওয়া যাবে পুরো একমাসের ছুটি। এখান থেকে বেরিয়েই একবার একটা লম্বা প্রণাম ঠুকে আসতে হবে কালিঘাটের মন্দিরে। সর্বংসহা মা তুমিই একমাত্র আমাকে রক্ষা করতে পার। তোমার উপর থেকে আমার বিশ্বাসে আজো কোন রকম চির ধরেনি। তুমি আছ বলেই আমরা অনুগতেরা সবাই তোমার সাথেই আছি। আজো আমাদের মনে কোন দোলাচল গড়ে ওঠেনি। কেউ যদি মনে মনে ভেবেও থাকে তাহলে তা আমার ভয়ে কবুল করবে না। কবিগুরুর গ্রামে আজ চারদিকে উন্নয়ণ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ শহুরে বাবুদের তা মোটেই নজরে পড়ছে না! একমাত্র তুমিই আমাদের মনোবেদনাটা সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পার। তোমাকে আমার কোটি কোটি প্রণাম। আমি জানি তোমার বরাভয় সব সময় আমার সাথেই রয়েছে। আর তাই তো আজো চরাম-চরাম করে বাদ্যি বাজাতে পারছি। তুমি আছ বলেই আজো আমি ঘরবন্দি থেকেও তোমার শ্রীচরণে রাশি রাশি আসনের মহার্ঘ উপহার দিতে পারছি। ওরা জানে না যে আমাকে যতই কারাগারে বন্দি করে রাখুক না কেন আমি সেখান থেকেই ঠিক রিমোটে কংস বধ করবই। এবারও তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। পঞ্চায়েতে এবারও পাঞ্চজন্য আমিই বাজাব। এ তো আমার এক চুটকির খেল। এ তো তুমি জানই।

আমি শুনেছি তুমি শুধু আমার জন্যই মাঠে ময়দানে বক্তৃতা করছ। কাঁপিয়ে দিচ্ছ আকাশ-বাতাস। এছাড়াও শুনেছি অভিনব কায়দায় রাজ্যের ছাত্র-যুব শক্তিকে লেলিয়ে দিয়েছ দিল্লির বিরুদ্ধে। এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। এবার ওরা শুনুক আমাদের গর্জন। রাজ্যের যুব সমাজ যখন ক্ষেপে যাবে তখন পৃথিবীর কোন শাসকের রক্ত চোখকে ওরা তোয়াক্কা করবে না। সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে। ওরাই তো ক্ষুদিরামের দেশের আসল সোনার ছেলে। ওরাও যে আমাকে এত ভালোবাসে তা আগে জানতাম না মা!

মাগো, দিদিগো, দীর্ঘদিন ধরে একটা সুপ্ত কথা কাউকে বলতে পারিনি। আসলে সেভাবে ভাবতেও পারিনি। অথচ আজ আমি চার দেয়ালের খুপরিতে কর্মহীন হয়ে বিশ্রামে রয়েছি। আর তাই ভাববার সময়ও পেয়েছি। আসলে কথাটা ছোট হলেও এর গভীরতা অনেক। এ কাজ সবার দ্বারা সম্ভব না। তুমিই এ ব্যাপারে একমেবাদ্বিতীয়ম মা! তুমি তো জান আমি ঠিক তোমার মতই কোনদিন মিথ্যা কথা বলতে পারি না। তাই আজো একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছি। জানি না কতদিন তা সম্ভব হবে। তোমার অফুরন্ত ভালোবাসা যে সব সময় আমার উপর শ্রাবণের ধারার মতো অনবরত বর্ষিত হচ্ছে তা সঠিকভাবে উপলদ্ধি করলাম যেদিন তুমি আমাকে নিয়ে লিখলে সেই বিখ্যাত শব্দবন্ধগুলো- ‘হাম্বা-হাম্বা-গাম্বা-গাম্বা-শাম্বা-শাম্বা! কী যে অসাধারণ তোমার ভাবাবেগ তা বর্ণনা করার মতো বুদ্ধি আমার নেই। তবে এটা বুঝতে পেরেছি যে তুমি এই বিখ্যাত কবিতাটি আমাকে নিয়েই লিখেছ। এখন আমি যে খুপরিতে রয়েছি তার চারদিকে শুধু তুমি আর তুমি ময়! এ আমার চরম উপলদ্ধি মা! ভুল হলে এই অধমকে ক্ষমা কোরো। আজো প্রতি রাতে হাম্বারা শিং উঁচিয়ে আমাকে তাড়া করে আসে মা। বুঝতে পারি তারা ধেয়ে আসছে মানে আমাকে গুঁতোতে নয় বরং তারা আমাকে ভালোবেসেই আসছে। ঠিক সেই মুহূর্তে নিজেকে শ্রীকৃষ্ণ বলে মনে হয়। আমার চারদিকে অজস্র গৌ-গাবৌ-গাবঃ! ওরা আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমি ওদের বাঁশির ধুন শোনাচ্ছি। এ কথা কাউকেই বলতে পারিনি। এই প্রথম শুধু তোমাকেই বললাম। এই দুঃস্বপ্ন কবে কাটবে মা তুমি বলতে পার! এর মধ্যে ফিশ্চুলাটা এমনভাবে টাটাচ্ছে যে মনে হচ্ছে এমন জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই মা, কোন লাভ নেই! তুমি একবার কাউকে দিয়ে যদি কয়েকটা ঘুমের ওষুধ পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর তাহলে আমি একটু দুঃস্বপ্নের হাত থেকে বাঁচতে পারি। বহুদিন ভালো করে ঘুম হয়নি মা। আমাকে একটু ঘুম পারিয়ে দেবে তুমি। আমি একটু ঘুমোতে চাই মা। শুধু ঘুমোতে চাই।

(ক্রমশ)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন