কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

প্রতিমা নাগ

 

সমকালীন ছোটগল্প


অহেতুক

 

একে একে সকলেই নেমে পড়েছে। কামরায় মালতি একা। ট্রেনটা ধরধর করে ছুটে চলেছে। এখনো তিনটে স্টেশন পেরিয়ে তবে রাতুলডি।

মালতি একবার ট্রেনের কামরায় নজর বুলোয়। জানলাগুলো বন্ধ, তবু নীচ থেকে হু-হু করে আসা ঠান্ডা হাওয়া মালতির ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ বিশুকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, মালতির বুকটা ধড়াস্ করে ওঠে। বিশু টলতে টলতে এসে একেবারে তার সামনের সিটটায় বসে পড়ে। মালতি মনে মনে প্রমাদ গোনে ---আজ তার রক্ষা নেই বিশুর হাত থেকে। শালটাকে আরও জড়িয়ে সে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকে।

-তারপর মা-ল-তি... ক্যামন আঁছিস?

বিশুর মুখ থেকে ভড়্ ভড়্ করে আসা দেশী চোলাই-এর গন্ধে মালতির গা গুলিয়ে ওঠে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। কোনো রকমে ঢোঁক গিলে বলে ভা...ভালো!

-তা তো থাকবিকেই, পল্টু তোঁকে দম্মে ভালো রাখেঁছে কেনে! হামিও তুকে ভালোই রাঁখতাম রে... হামি মাসীর লেগে খপরটা পাঠাঁয়ছিলি তুকে বিহা কইরবো... তুই রা টি কাড়লি নাই। কেনে রে, হামি কি এতোঁই খারাপ বটি?

বিশুর কথা কেমন জড়ানে জড়ানো লাগে মালতির। মালতি বেশ জানে বিশুর পেট থেকে মাথা পর্যন্ত এখন মদের নেশা।

-তুঁই যে এ্যমন কইরে হামাকে দাগা দিবি, সিটি বুঝতে লারলি রে মালতি! বিশ্বাস কর কেনে, তুকে হামি খুবেই ভালোটা বাসেছিলি।

মালতি কাঠ হয়ে বিশুর কথা শুনে যায়। সে বিশুকে বলতে পারে না, অনেকদিন আগে সেই ওদের ছোটবেলায়, ওরা যখন স্কুলে ‘সীতা হরণ’ নাটক করেছিলো -  মালতি সীতা, পল্টু রাম, আর বিশু রাবণের পার্ট করেছিলো... সেই তখন থেকেই সে মনে মনে পল্টুর বৌ হবার স্বপ্ন দেখেছিলো। সে রাবণ বিশুকে বিয়ে করত কী করে?

বিশু কিন্তু মালতির প্রত্যাখানের অপমান ভুলতে পারেনি। মালতির জন্যই পল্টু  আর বিশুর ছোটবেলার বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছিলো। আজ ওরা একে অন্যকে এড়িয়ে চলে।

মালতি ভাবে, আজ সেই অপমানের প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পেয়েছে বিশু। এই ছুটন্ত রেলগাড়ির নির্জন কামরায় সে একা, নিরুপায়। বিশু ওর সর্বস্ব কেড়ে নিলেও, সে কিছুই করতে পারবে না।

-কী রে, কিছু বলছিস নাই যে! 

-কী বইলবো? হামি বুঝতে লারলি।

-তা টেরেনে এখন কুথা থেকে?

-দিদির ঘর জাঁয়েছিলি।

-দেখেঁছিস, হামি হলে তুকে ইভাবে একলা ছাঁড়ে দিতি?

-দিদির শরীর খারাপ শুনে দেখতে জাঁয়েছিলি। এদিকে তুমার বন্ধুর জ্বর আসেছে। খবর পায়ে ফিরতে হলো।

-ও!

মালতি আড়চোখে দেখে, বিশু ওর দিকে কেমন ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। যেন ওকে একেবারে উলঙ্গ করে ওর সর্বাঙ্গ দেখে নিচ্ছে। আজ আর তার রক্ষা নেই। যে কোনো মুহূর্তে বিশু ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভয়ে মালতি চোখ বন্ধ করে নেয়।

কিছুক্ষণ নিঃস্তব্ধতা। ট্রেনের গতি আস্তে আস্তে কমে আসছে।  রাতুলডি এসে গেছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় মালতি। ছোট ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বিশুর পর প্ল্যাটফর্মে নামে সে। স্টেশনের ঘড়িতে রাত পৌনে বারোটা। কিন্তু বিপদ এখনও মালতির পেছন ছাড়েনি। বাইরে এসে দেখে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। স্টেশনে  একটাও রিকসা বা ভ্যান কিচ্ছু নেই। মালতি বাড়ি ফিরবে কী করে, বুঝতে পারে না। বিশু এবার মুখ খোলে-

-কী কইরে বাড়ি যাবি মালতি?

-নাই জানি। তুমি কী কইরবে?

-চল, ওয়েটিংরুমে বসি কেনে!

এছাড়া কিছু উপায়ও তো নেই। ভয়টা আবার চাড়া দেয় মালতির মনে। ওয়েটিং  রুমেও তো সে আর বিশু একা। এই দুর্যোগের রাতে হাজার চেঁচালেও কাউকে পাবে না সে সাহায্যের জন্য। তাছাড়া প্ল্যাটফর্মের শেডের নীচে দারুণ ঠান্ডায় তার হাত-পাগুলো জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে।

ওয়েটিংরুমে শাল গায়ে জড়িয়ে যতটা পারে নিজেকে গুটিয়ে বসে পড়ে মালতি একটা বেঞ্চে। অন্যদিকের বেঞ্চে একটা বিড়ি ধরিয়ে বসে বিশু। মালতি বিশুর চোখে চোখ রেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করে। একে সারাদিনের ধকল, তার ওপর এই টেনশন, মালতির মনে হয় আজ না বেরোলেই ভালো হতো দিদির বাড়ি থেকে। রাস্তায় কেউ একজন এই ট্রেনটার সামনে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আর তার জন্য এটা লেট করলো। না হলে তো সে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যেত। যাক্ এখন আর কী করা যাবে! 

এইসব ভাবতে ভাবতে মালতির চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে জানে না। হঠাৎ কারুর উষ্ণ নিঃশ্বাসে এক ঝটকায় তার ঘুম ভেঙে যায়। দেখে  বিশু তার খুব কাছে, প্রায় তার ওপর ঝুঁকে রয়েছে।

-কী… কী হঁয়েছে? মালতির গলা ভীষণভাবে কেঁপে ওঠে।

-কিছু হয় নাই। তুঁই ঠান্ডায় কাঁপছিলি কেনে, তার লাগে হামার চাদরটা তোকে জড়ায় দিলি। লে শুয়ে পড়... ভোর হতে এখন দমে দেরী...

 

   


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন