কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

রামশরণ শর্মা

 

প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা


(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)




(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)

*অধ্যায় - ৩ / ৩*

*উপজাতি বনাম বর্ণ : (আনুমানিক  ১০০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত)*

এটি পুনরায় লক্ষ্যণীয় যে, আয়োগোভা (ayogova), যাকে ভাষ্যকার বর্ণিত  করেছে এক শূদ্র পুরুষ ও বৈশ্য মহিলার পুত্র হিসেবে, তাকে অশ্ব-বলিদান অনুষ্ঠানে এক সন্ধানী কুকুর-এর ভূমিকা পালন করতে হবে। সম্ভবত এটি, প্রহরী হিসেবে কোনো আদিবাসীকে (aboriginal) তালিকাভুক্ত করার প্রচলিত রীতি-কে উল্লেখিত করা হয়েছে। শতপথ-ব্রাহ্মণ, দ্যোগাভা (dyogava) রাজা মারুত্তা অভিক্ষিতা (Maruta Aviksita) দ্বারা অশ্বমেধ বলিদান যজ্ঞ সম্পাদন করার অনন্য ঘটনাটি বিবৃত করেছে, যেখানে বায়ু (maruta) তার দেহরক্ষী, অগ্নি তার গৃহাধ্যক্ষ, এবং সমস্ত দেবতারা ((Visvadevas) তার সভাসদবৃন্দের (sabhasadas) ভূমিকা পালন করেছে। এটি কোনো শূদ্র রাজার ঘটনা বলে মনে হয় না, বরং সম্ভবত এটি একজন অব্রাহ্মণ শাসকের উদাহরণ, যাঁকে একটি ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থার অঙ্গীভূত করা হয়েছে। আয়োগোভার সংজ্ঞা-টি ধর্মশাস্ত্রের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত সঠিক ভাবে প্রদর্শিত হয়ে ওঠেনি এবং আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যে মারুত্তা অভিক্ষিতা একজন নিম্নজাতিভুক্ত রাজা ছিলেন।

অশ্বমেধ বলিদান যজ্ঞে এই শর্ত প্রদত্ত হয়েছিল যে, রথকারা'র গৃহ-টি, অশ্বসমূহ এবং সেগুলির তত্ত্বাবধায়কদের আশ্রয়-স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতে দিতে হবে। এটি দেখিয়ে দেয় যে রথকারা, পরেরদিকের অশ্বমেধ ধর্মানুষ্ঠানগুলিতেও তার রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

অশ্বমেধ বলিদান সম্পাদিত করা হতো সমগ্র চারটি বর্ণকে আয়ত্বের অধীনে নিয়ে আসার করার উদ্দেশ্যে, যেটি দর্শায় যে শাসকেরা সমাজের প্রতিটি অংশের আনুগত্য নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। একই অনুভূতি অর্জিত  হয়েছিল আরেকটি রচনাংশ থেকে, যেখানে রাজসূয় বলিদান যজ্ঞ উপলক্ষে পুরোহিত, রাজাকে জৌলুষ, শক্তি, বংশধর এবং দৃঢ় প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি গুণ অর্জন করার ক্ষেত্রে সফল করে তুলেছিল, যে সমস্ত গুণগুলি যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের সাথেও সম্পর্কিত। একই নিহিতার্থ সম্পন্ন আরেকটি রচনাংশ পাওয়া যায় তৈত্তিরীয় সংহিতায় (Tittiriya Samhita)। এই সংহিতা অনুসারে, রাজন্য দ্বারা ইন্ধন সুলভ (kindling) শ্লোক-সমূহকে ক্রমান্বয়ে তিনবার উচ্চারণ করতে হবে, কারণ যোদ্ধাদের আনুগত্য সহ তাকে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্র নামক তিনটি বর্ণের জনসাধারণের আনুগত্য নিশ্চিত করতে হবে। এই সমস্তকিছুই প্রদর্শিত করে যে, শূদ্রদের আনুগত্যকে, পরবর্তী কয়েকটি উৎপত্তিস্থলে (source) নিশ্চিত বলে ধরে নেওয়া হয়নি। রাজার পক্ষে সমর্থন অদায় করার অপরিহার্যতার এই বিষয়টি, জামিনিয়া ব্রাহ্মণ-এর একটি রচনাংশে পরিলক্ষ্যিত হয়েছে। সেটি আমাদের সূচিত করেছে যে, পাঙ্কালা (Pancala) রাজপুত্র দর্ভ শতানিকি (Darva Sataniki), গায়ত্রী, ত্রিস্তভ, জগতী এবং অনুস্তভ মন্ত্রের উচ্চারণের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রদের মধ্যে ক্রমাগতভাবে সম্মান অর্জন করেছিলেন।

জযু'র সমস্ত সংস্করণসমূহে দৃষ্ট লক্ষণীয় এক রচনাংশে, অগ্নি'র উদ্দেশ্যে একটি প্রার্থনা রয়েছে যার মর্মার্থ, --- "আমাদের পুরোহিত, যোদ্ধা, বৈশ্য এবং শূদ্রদের প্রতিভা প্রদান করুন"। সেই অনুচ্ছেদটি, যার মধ্যে 'ভজসনেয়ী সংহিতা' (Vajasaneyi Samhita) নামক উক্ত রচনাংশটি রয়েছে, সেটি বাসোরধারা'র (vasordhara) প্রতিপাদনের performance) সূত্রসমূহ নিয়ে কারবার (deals with) করে, যেটি রাজা হিসেবে অগ্নি'র পবিত্রকরণ সুলভ একটি সেবামূলক কাজ। এই উপলক্ষ্যে স্থানাপন্ন পুরোহিত (advaryu), ত্যাগী'র (sacrificer) উদ্দেশ্যে আশীর্বাদ অর্পণ করার পার্থিব ও আধ্যাত্মিক মন্ত্রসমূহের পাঠ করতে  থাকেন। এটি পরিষ্কার নয়, কিন্ত অভাবনীয় নাও হতে পারে, যে ধর্মানুষ্ঠানটি বিহিত (prescribed) করা হয়েছে রাজার উদ্দেশ্যে, যিনি অগ্নির কাছে প্রার্থনা করেন, শূদ্র সহ সমস্ত বর্ণের প্রজাদের জীবনে ঔজ্জ্বল্য প্রদান করা হোক।

রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের চরিত্র বলতে যা বোঝায়, তাতে শূদ্রদের অংশগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ের প্রকৃতি ও ব্যাপ্তির কোনো সমরূপতা ছিল না। কিছু ক্ষেত্রে, শূদ্র সহ অন্যান্যদের বর্ণ অনুসারে, সমারোহ অনুষ্ঠানের বিষয় সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত তালিকা (minutiae) অবিরত ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই শূদ্রদের নিম্নতর স্থানটি দেওয়া হয়েছে ; অন্যান্য ক্ষেত্রে শূদ্র সহ অবশিষ্ট বর্ণগুলি, সমারোহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে একই ভাবে এবং আশা করেছে সমরূপ আশীর্বাদ প্রাপ্তির।  যে কোনো অবস্থাতেই, ধর্মশাস্ত্রের তুলনায় পরেরদিকের বেদকীয় পর্যায়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে অন্য তিনটি বর্ণের সদস্যদের সাথে শূদ্রদেরও কিছু অংশ-প্রাপ্তি হয়েছিল।

কিন্ত একই সাথে ছবির অপর প্রান্তও ছিল। ইতিমধ্যেই এই পর্যায়ে, বিশেষ করে এর শেষের দিকে, একটি পরিষ্কার প্রবণতার সূত্রপাত হয়েছিল, শূদ্রদের সাম্প্রদায়গত জীবনে অংশগ্রহণ থেকে ছেঁটে ফেলার। এইভাবে, রাজসূয় বলিদানের 'জলসিঞ্চন অনুষ্ঠানে' (sprinkling ceremony), শূদ্রেরা অংশগ্রহণ করতে পারেনি, অপর তিনটি উচ্চ বর্ণের অংশগ্রহণের সাথে সাদৃশ্য-বিহীন ভাবে। জয়সওয়াল দ্বারা এটি বিতর্কিত হয়েছে এইভাবে যে, 'জন্য' (janya) অথবা 'জন্য-মিত্র' (janya-mitra), যাঁরা এই পাঠ্যাংশে আবির্ভূত হয়েছে রাজাকে জলসিঞ্চিত করার চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে, সে নিজেই ছিল একজন শূদ্র, শত্রুতাপরায়ন (hostile) একটি উপজাতির সদস্য হওয়ায় জন্য। এইরূপ একটি ব্যাখ্যা প্রস্তুত করা হয়েছে, মনেহয় কোনো প্রাধিকার (authority) ছাড়াই। আমাদের মতে, ভ্রাত্য (vratya), যে ভ্রাত্য নামক পার্বত্য উপজাতীয় সম্প্রদায় অথবা পার্বত্য উপজাতীয় গোষ্ঠীর একজন সদস্য ছিল এবং রাজসূয় অথবা সমগোত্রীয় বলিদান-এর সাথে সম্পর্কিত ছিল, কিন্ত একটি পরকীয় (alien) পার্বত্য উপজাতির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, নানান ধার্মিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে সে ব্রাহ্মণ্য সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল। এই বিষয়টির প্রকৃত অর্থ যাই হোক না কেন, এটি পরিষ্কার যে, এই সাহিত্যের কোনো স্থানেই, এর সাথে শূদ্রদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এটিও বলা হয়েছে যে, রাজসূয় বলিদান উপলক্ষে, তিনটি উচ্চ বর্ণ, রাজাকে অনুরোধ করতে পারতো যে, ঈশ্বরের উপাসনার নিমিত্ত একটি উপাসনাস্থল প্রদান করা হোক। যদিও শূদ্রদের বহিষ্করণের বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবেই এই তত্ত্ব অনুসরণ করবে যে, তারা জন্ম নিয়েছে ঈশ্বর ছাড়াই, তবুও এটিকে পুনরায় তাদের রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্ব হ্রাসের একটি ঈঙ্গিত হিসেবেও গ্রহণ করা যেতে পারে।

শতপথ-ব্রাহ্মণ, ক্সাত্র (ksatra - অর্থাত শাসক-প্রধান) দ্বারা ভিস-দের (পার্বত্য উপজাতি সম্প্রদায়) ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত করার জন্য কয়েকটি আচার-অনুষ্ঠানের (rites) ব্যাখ্যা করেছে। এই সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানগুলি সম্ভবত সেই সব প্রক্রিয়াকে নির্দেশিত করে, যার দ্বারা চাষাবাদরত জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর মানুষজনেরা বাধ্য হয় প্রধান-কে অনিয়মিতভাবে প্রদেয় তাদের উপহার সামগ্রী ও শ্রদ্ধার্ঘ সমূহকে নিয়মিত কর (tax)-এ রূপান্তরিত করতে। শূদ্রদের এর বাইরে রাখা হয়েছিল, সম্ভবত এই কারণে যে, তাদের ওপর রাজার নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছিল এবং তারা কোনো কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম ছিল না। আরেকটি রচনাংশ, যেটি ব্রহ্মাকে ক্সাত্র'র ভিস-দের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকার কথা বলেছে এবং শূদ্রদের এর বাইরে রেখেছে, সেটিও একইরকম একটি ধারণা জ্ঞাপন করেছে।

শূদ্রেরা ভজপেয় (vajapeya - অর্থাত শক্তিবর্ধক পানীয়) বলিদানে কবুল ছিল না, যেটি রাজার শক্তি বৃদ্ধির করতে অনুমিত (supposed) ছিল। একটি রচনাংশ অনুযায়ী, এটি  ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের জন্য অবারিত ছিল, কিন্ত অন্য একটি রচনাংশে, বৈশ্যদের এর থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

তৈতরীয় ব্রাহ্মণ-এ বর্ণিত একটি গৌণ অনুষ্ঠানে, শূদ্রদের নাগরিক পদমর্যাদার অভাব থাকার ঈঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। নব এবং পূর্ণ-চন্দ্র দিবস অনুষ্ঠানের (দশপূর্ণমাসা) আচার-আচরণের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এটি বিচারিত হয়েছে যে শূদ্রেরা, যারা তাদের প্রভুর সামনে রয়েছে ও তাঁর আনুকূল্য চাইছে, এবং তারা, যারা অসঙ্গতি প্রকাশ করতে সক্ষম নয়, তাদের সাথেও শূদ্রদের মতন একই রকম ভাবে আচরণ করতে হবে। এটি নির্দেশিত করে যে, শূদ্রেরা তাদের প্রভুর বিরুদ্ধে কথা বলবে, এমন একটি বিষয় প্রত্যাশিত ছিল না এবং তারা ছিল পুরোপুরি ক্রীতদাসতুল্য।

পরের দিকের বেদকীয় রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ হচ্ছে, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের জন্য বিশেষ পদমর্যাদা দাবি করার প্রবণতা, বৈশ্য ও শূদ্রদের সাথে তাদের পার্থক্যকরণের মধ্য দিয়ে। সমাজে ব্রহ্মা (brahma) ও ক্ষ্যাত্র'র (ksatra), প্রভাবশালী দুটি শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠা তথা তাদের পারস্পরিক বৈরিতা ও ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মৈত্রিবন্ধনের বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি কারানোর জন্য ঘোষাল, বেশ কয়েকটি উদাহরণ উদ্ধৃত করেছেন। সংহিতা-সমূহ তথা ব্রাহ্মণগুলিতে দুটি উচ্চতর শ্রেণীর সুরক্ষা প্রদান করা সম্পর্কিত প্রার্থনার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। যদি এই ধরনের উল্লেখসমূহের মনযোগ সহকারে বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে সেগুলি দুটি ফল প্রদান করে বলে মনে হয়। প্রথমত, সেসবের বেশিরভাগই উঠে এসেছে সাহিত্যে, বিশেষ করে শতপথ-ব্রাহ্মণে। দ্বিতীয়ত, প্রথমদিকের উল্লেখগুলি সাধারণভাবে অঙ্গুলিনির্দেশ করে উচ্চতর দুটি বর্ণের সমাহারের (combination) দিকে, কিন্ত পরেরদিকেরগুলি অঙ্গুলিনির্দেশ করে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট (specific) বৈশ্য ও শূদ্রদের বহিষ্করণের দিকে। একই রচনাংশটি একথাও বলেছে যে, যারা ক্ষত্রিয় অথবা পুরোহিত কোনোটাই নয়, তারা অসম্পূর্ণ। রাজসূয় অনুষ্ঠানের পাশা-খেলা থেকে বৈশ্য ও শূদ্রদের বহিষ্করণের দিকে ইতিমধ্যেই মনযোগ আকৃষ্ট করা হয়েছে। একই রাজ্যাভিষেকের বলিদান যজ্ঞ প্রসঙ্গে ঐতরেও ব্রাহ্মণ বিবৃত করেছে যে, ব্রাহ্মণেরা ক্ষত্রিয়দের পূর্ববর্তী অবস্থানে থাকে কিন্ত বৈশ্য ও শূদ্রেরা তাকে অনুসরণ করে। সেইজন্য এটি প্রতীয়মান হয় যে, প্রথমদিকের পাঠ্যাংশগুলিতে বৈশ্যদের-কে শূদ্রদের সমকক্ষ হিসেবে গণ্য করার এবং তাদের জনজীবন থেকে বহিষ্কৃত করার প্রবণতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্ত পরেরদিকের সাহিত্যে সেগুলিকে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত তথা উচ্চারিত করা হয়েছে।

পরের দিকের বেদকীয় পর্যায়ে শূদ্রদের সামাজিক জীবন সম্পর্কিত এই পুনর্বিবেচনাটিকে হয়ত সমাপ্ত করা যেতে পারে ঐতরেও ব্রাহ্মণ-এর একটি রচনাংশের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে, যেটিতে বেদকীয় রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থায় শূদ্রদের অবস্থা পুরোপুরিভাবে ক্রীতদাসসুলভ হয়ে গিয়েছিল, এরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রচনাংশটির নিবিড় সুবিবেচনা করলে এই ধরনের একটি অভিমত সমর্থন করা যায় না। এটি বলা হয়েছে যে, বিস্যান্তরা সৌসাদমনা (Visvantara Sousadmana) নামক একজন রাজা একটি বলিদান সম্পাদিত করেছিলেন শ্যাপর্ণা (Syaparna) যাযকীয় বংশের অংশগ্রহণ ছাড়াই, যাদের বস্তুত পূজাবেদি থেকে অপসারিত করা হয়েছিল। মামলাটি গৃহীত হয়েছিল তাদের বিদ্বান নেতা রামা মার্গাভেয়া (Rama Margaveya) দ্বারা, যিনি পুরোহিতের অপসারণের বিরোধিতা করেছিলেন, এর ভিত্তিতে যে, রাজসূয় বলিদান উপলক্ষে রাজাকে সোমরসের (soma) পরিবর্তে যে খাদ্য গ্রহণ করতে হতো, তিনি সেই খাদ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। বিচার্য রচনাংশটি, তাঁর মতে, বর্ণনা করেছে রাজা দ্বারা গ্রহণ করা হতে পারে এমন বিভিন্ন প্রকার খাদ্য গ্রহণের সম্ভাব্য পরিণাম, এবং সেটি করার মধ্য দিয়ে ঈঙ্গিত করা হয়েছে যে, কী ধরনের সম্পর্ক বজায় ছিল যোদ্ধাদের শাসকীয় বর্ণ এবং অন্য তিনটি বর্ণের মধ্যে। এটি বলা হয়েছে যে, রাজা যদি সোমরস গ্রহণ করেন, যেটি ব্রাহ্মণদের খাদ্য, সেক্ষেত্রে তাঁর বংশধরেরাও ব্রাহ্মণ হবে, তাঁর সমস্ত বিশিষ্ট্য ও গুণ সহ। তারা হবে উপহারসমূহের গ্রহণকর্তা, সোমরসের পানকর্তা, জীবনযাত্রা অন্বেষী এবং পদ থেকে অপসারিত হবে স্বেচ্ছায়। রাজা যদি দধি গ্রহণ করেন, যেটি বৈশ্যদের খাদ্য, তবে তাঁর বংশধরেরা বৈশ্য হবে এবং বৈশ্যদের সমস্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। তারা অন্যের অধীন হবে, ভুক্ত হবে অন্যের দ্বারা এবং স্বেচ্ছায় নীপিড়িত হবে (yathakamapryapyah)। কিন্ত আমরা অনেক বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে আছি সেই সব বর্ণনামূলক ব্যাখ্যানের অপেক্ষায়, যা শূদ্রদের অবস্থাকে বিবৃত করবে। এটি বলা হয়েছে যে, রাজা যদি শূদ্রদের জল, খাদ্য ইত্যাদি গ্রহণ করেন, তবে তিনি শূদ্রদের অনুগ্রহ করবেন এবং তাঁর বংশধরেরা তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হবে। তারা হবে (১) অন্যস্ব প্রেশিয়াহ (anyasya presyah), (২) কামোত্থাপিয়াহ (kamotthapiyah) এবং (৩) যথকামাভাধ্যা (yuthamkamavadhyah)। কেইথ, প্রথম বিশেষণটিকে সঠিকভাবে উপস্থাপিত করেছেন 'অপরের 'ভৃত্য' হিসেবে, যদিও ভৃত্যের জায়গায় 'বার্তাবাহক' হবে আরও বেশি যথার্থ একটি তর্জমা। কিন্ত আমরা কেইথ-এর অন্য দুটি বিশেষণের উপস্থাপনা-কে মেনে নিতে পারি না। দ্বিতীয় বিশেষণ কামোত্থাপিয়াহ, তাঁর দ্বারা উপস্থাপিত হয়েছে, 'অপসারিত করা হবে স্বেচ্ছায়' অর্থে এবং তৃতীয়টি, 'প্রভুর ইচ্ছানুসারে অপসারিত করা হবে', এই অর্থে। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এটি বলা হয়েছে যে, শূদ্রেরা ইচ্ছাধীন প্রজা ছিল, যাদেরকে যে কোনো সময়ে, তাদের ভূসম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া যেতো। কিন্ত এই শব্দ প্রসঙ্গে সায়ন-এর (Sayana's) টিপ্পনি এ কথা বলে যে, শূদ্রেরা কাজ করতে প্রণীত ছিল যে কোনো সময়ে, দিনের বেলায় অথবা রাত্রে, যখন তাদের প্রভূ চাইবেন। তাঁর ব্যাখ্যা যথেষ্ট সম্ভাব্য বলে মনে হয়, কারণ উত্থাপন-এর সুস্পষ্ট অর্থ হচ্ছে জেগে ওঠার ক্রিয়া। প্রাচীন সংস্কৃত-তে বিতাড়ণের অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে আরেকটি শব্দ 'নির্বাসন' (nirvasana) বা নিষ্কাষন (niskasana) দ্বারা। তৃতীয় বিশেষণ 'যথকামাভাধ্যা' শব্দটি কেইথ দ্বারা অনুবাদিত হয়েছে, --- 'নিহত হবে নিজের ইচ্ছায়' --- এই ভাবে। কিন্ত সায়ন, বাক্যটিকে ব্যাখ্যা করেছেন, 'শূদ্রেরা তাদের রাগান্বিত প্রভু দ্বারা প্রহৃত হতে পারে যদি তারা তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করে' --- এই অর্থে। সায়নের ব্যাখ্যা সমর্থিত হয়েছে 'নিরুক্তা' (Nirukta) দ্বারা, যার মধ্যে তিনটি জায়গায় -'বধ'(vadha) বলতে হত্যা করা বুঝিয়েছে এবং পাঁচটি জায়গায় এর মানে বুঝিয়েছে 'আহত' বা 'ক্ষত'। সেইজন্য হগ (Haug) সঠিক ছিলেন, যখন তিনি তৃতীয় বিশেষণটিকে উপস্থাপিত করেছেন 'ইচ্ছানুসারে প্রহার করা হবে', এই হিসেবে।

এমন একটি ভুল ধারণা যে, ঐতরেও ব্রাহ্মণ অনুসারে 'শূদ্রেরা তাদের প্রভু দ্বারা প্রহৃত হতে পারে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী', সেটিকে সার্বিক সঠিক মনে করা এবং সমালোচনাহীন ভাবে স্বীকার করে নেওয়ার বিষয়টি এই স্বাভাবিক উপসিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করেছিল যে, বেদকীয় পর্যায়ে তাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো স্বাধীনতাই ছিল না, যেটি তারা অর্জন করেছিল ধর্মশাস্ত্রের যুগে, যখন সহজ ক্রীতদাসত্বমূলক সম্পর্ক রহিত (abolish) করে দেওয়া হচ্ছিল। এটি স্পষ্ট যে, এই ধরনের একটি চিন্তা গড়ে উঠেছিল 'যথকামাভাধ্যা' শব্দটির একটি সন্দেহজনক ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে থাকার জন্য। তাছাড়া, যদিও ক্ষতিপূরণ সম্ভবত বেঁধে দেওয়া হয়েছিল 'একশত গরু' হিসেবে, কিন্ত বর্ণ অনুসারে এর কোনো পরিবর্তন বা ক্ষতিপূরণের পরিমানের কোনো অবস্থান্তর (variation) করা হয়নি অথবা কোনো একটি বর্ণের মানুষদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মত বিষয়েরও কোনো উল্লেখ নেই।

এমনও মনে হয় যে মানব হত্যার (vairahatya) মতো পাপের ক্ষেত্রে অনুতাপ প্রদর্শন তথা প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ বলিদানের বিধান-ও ছিল, কিন্ত এটিকেও বর্ণ-বিবেচনার বাইরে রাখা হয়েছিল। সেইজন্য এটি প্রতীয়মান হয় যে পরেরদিকের বেদিকীয় সমাজে, বর্ণ বিভেদ এমন তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারন করেনি, যাতে গভীর নাগরিক বৈষম্যের মধ্য দিয়ে ধর্মশাস্ত্রগুলি অধঃপতিত হয়ে পড়ে, যে ধর্মশাস্ত্র অনুসারে শূদ্রেরা সর্বনিম্ন দশটি গরুর ক্ষতিপূরণ প্রদান করার অধিকারী হয়েছিল।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন