কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধর্ষণ, প্রতিহিংসা ও মৌলবাদী হত্যা সমূহ

 


আমাদের বর্তমান সমাজে এবং পৃথিবীতে যত রকমের মৌলবাদ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং সর্বগ্রাসী মৌলবাদ হল পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র। আদিম সাম্যবাদী সমাজ ও তার পরে পরেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অব্যবহিত পরে পরেই সম্পত্তির অধিকার ও সন্তানের পিতৃপরিচয় নির্ণয়ের দরকার হল যখন, তখন থেকেই নারীকে বেঁধে ফেলা হল এমন একটা শৃঙ্খলে বা শাসনে যেটাকে ঐতিহাসিক ভাবে নামকরণ করা হয়েছে পিতৃতন্ত্র যার অর্থ হল পিতার শাসন, যেখানে পিতাই হল পরিবারে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। সে সময়কার যে সমস্ত নথি পাওয়া যায় পুরাতাত্বিকগত ভাবে তাতে করে এ কথা পরিস্কার হয় যে পিতার শাসন বা পিতার নিয়মই ছিল একটি গোষ্ঠী বা পরিবারের সর্বশেষ কথা প্রাথমিক পর্যায়ের পর সেই সময় যে সব গ্রন্থ তথা সাহিত্য রচনা হয়েছিল সেগুলোর বেশির ভাগই ধর্মগ্রন্থ যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে নারী যদি সমাজ ও পরিবার নির্ধারিত অনুশাসন না মানে তাহলে তাকে নির্ধারিত কিছু কিছু শাস্তি পেতে হবে অবশ্য পিতার অধীনে থাকা অন্যান্য পুরুষদের জন্যও কিছু অনুশাসন বেঁধে দেওয়া থাকত এবং পিতার পরে তার প্রথম পুত্র এবং তার পরে তার প্রথম পুত্র পিতার ক্ষমতার অধিকারী হত মা সন্তানের জন্ম দিলেও সন্তানের ওপর তার কোন অধিকার থাকত না এবং বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের অন্য পরিবারে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত এবং পিতার পরিবারে এবং সম্পত্তিতে তাদের কোন অধিকার স্বীকার করা হত না যেমন কিনা এখনও চলছে কমবেশিকালের বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন সামাজিক তথা পারিবারিক নিয়ম নীতিগুলো বিভিন্ন রকম ভাবে বদলেছে, ঠিক সেই রকম ভাবেই সামাজিক তথা পারিবারিক গোঁড়ামি তথা নারীর ওপর চাপানো অনুশাসনগুলোও একটু একটু করে  বদলেছে মনু ও ইসলামিক যুগের অন্ধকারের পর ব্রিটিশ ভারত ও  স্বাধীন ভারতে এমনিতেই নারীরা রেনাসাঁ ও অন্যান্য কারণে বাইরে বেরিয়ে শিক্ষা ও অন্যান্য অধিকার অর্জনের সুবাদে নিজ নিজ ক্ষেত্রে এমনিতেই   স্বাক্ষর রাখছিল। তার ওপর বিশ্বায়নের দুনিয়াতে এসে অনেক অনেক শিথিল হয়েছে নারীর ওপর পিতৃতন্ত্রের বাঁধন। তার  চাইতেও বড় কথা  বিংশ শতাব্দিতে নারীবাদের উৎপত্তির ঢেউ গিয়ে লাগে পৃথিবীর সব দেশেরই সমাজ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে যার ফলে প্রাচীন সামাজিক ধারাগুলো বিবর্তিত হতে শুরু করে।

সচরাচর যে বিষয়টা নিয়ে আমরা ভাবি না, আলোচনা করি না বা চর্চা করি না সেটা হল এই মানব সভ্যতায় মানুষের লৈঙ্গিক বিভাজনটা মূলত দু রকমেরএকটা সামজিক আর একটা হল জৈবিক বা যাকে  আমরা আরও সহজ করে বলতে পারি শারীরবৃত্তীয় সামাজিক লিঙ্গ বিভাজনটা মানুষের ওপর সমাজ দ্বারা আরোপিত একটা বিভাজন যেটা সমাজ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে কিছু মানুষের চাপিয়ে দেওয়া একটা বিভাজন অন্যদিকে জৈবিক লিঙ্গ বিভাজনটা প্রকৃতি প্রদত্ত, জন্মগত একটা বিভাজন যেটা আসে মানুষের জিনগত এক বিশেষ প্রকারের সমন্বয় থেকে এটা যেহেতু জিনগত ভাবে অর্জিত একটা বিভাজন, তাই এটা অপরিবর্তনীয় (এখন অব্দি বিজ্ঞান যতদুর এগিয়েছে সেই অনুযায়ী ) উল্টো দিকে  সামাজিক লিঙ্গ বিভাজন কিন্তু অপরিবর্তনীয় নয় সামাজিকীকরনের  মাধ্যমেই যেমন এটা আরোপ করা হয়েছে ঐতিহাসিক কোন একটা সময়ে, ঠিক তেমনই সেই সামাজিকীকরনের বার্তা বা বাণী বদলে ফেলে এই বিভাজনটাকেও বদলে ফেলা বা অবলুপ্ত করে ফেলা খুব অনায়াসেই সম্ভব

এটা আজ  বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য যে জৈবিক লিঙ্গ বিভাজনের ফলে যে তফাৎটা নারী ও পুরুষের মধ্যে দেখি আমরা, বস্তুত সেটা তত গুরুত্বপূর্ণও নয় তার মধ্যে কিছু কিছু বিভাজন আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনযোগ্য যেমন বিজ্ঞান এটা দেখিয়েছে যে জন্মগত ভাবে নারী ও পুরুষের জন্মের পর ও শৈশবেও  তেমন কোন শক্তির পার্থক্য থাকে না বললেই চলে নারী ও পুরুষের মধ্যে শক্তি ও আচরণগত  যে প্রভেদ আমরা দেখে থাকি, তা আসলে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে আরোপিত এক তফাৎ আর এই তফাৎটা  দীর্ঘ কয়েক শবা  হাজার বছর চলার ফলে, সেটা  নারী বা পুরুষ দেহের জিনের মধ্যে বেশ খানিকটা পাকাপাকি ভাবে আস্তানা গেঁড়ে বসেছে অভিযোজনের ফলে

নারীবাদ সম্পর্কে আমাদের ঐতিহ্যগত ভাবে সমাজ মানুষের এক ধরণের ঘৃণা-অবজ্ঞা-উন্নাসিকতা আছে অজ্ঞতা প্রসূত কারণেই মূলত তাছাড়া পিতৃতন্ত্র আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকার কারণে নারীবাদের নাম শুনলেই লোকে বুঝে-না বুঝেই একেবারে হাঁ হাঁ করে তেড়ে আসে কিন্তু সত্যিই  কি নারীবাদ একটা খুব ভয়ঙ্কর উচ্ছন্নে যাওয়ার মত কিছু বিষয়? এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলছে, নারীবাদ হচ্ছে এমন এক মতবাদ যা লিঙ্গ নির্বিশেষে নারীপুরুষের  সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমতার কথা বলে কিন্তু কোন পটভূমিকায় নারীবাদের উৎপত্তি সেটা একটু দেখে নেওয়া প্রয়োজন নারীবাদের উৎপত্তির ক্ষেত্রে কয়েকশ বছর আগে ইউরোপের সামাজিক প্রেক্ষাপট মূল ভূমিকা রেখে ছিল সেই সময় নারীর জন্য গৃহ এবং গৃহস্থালীর ব্যাপারগুলো  নির্দ্রিষ্ট করে রাখা ছিল সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ছিল না এবং সামাজিক কর্মকান্ডেও নারীর অংশগ্রহণে  অধিকার ছিল না এই পটভূমিকায় নারী  আন্দোলনকারীরা নারীর আইনগত অধিকার (চুক্তির অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, বৈবাহিক অধিকার, ভোটাধিকার), দৈহিক স্বাধীনতা ও অখণ্ডতার  অধিকার, চলাফেরার স্বাধীনতা, প্রজননের অধিকার (যথেচ্ছ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করার অধিকার, সন্তানের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের অধিকার, উন্নতমানের প্রসূতি চিকিৎসা লাভের অধিকার) অর্জনের জন্য, পারিবারিক সহিংসতা, শারীরিক মানসিক হয়রানি ও নিগ্রহ থেকে নারী ও কিশোরীর নিরাপত্তার জন্য, সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য, কর্মস্থলে নারীর অধিকার, যার মধ্যে মাতৃত্বকালীন ছুটি, সমান মজুরী ও বেতন প্রভৃতি অন্তর্ভূক্ত করা, সকল মানবাধিকার লাভ করার সুযোগ নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দেয়

বলা বাহুল্য নারী আন্দোলনের আছড়ে পড়া ঢেউয়ে উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর সনাতন সামাজিক চিন্তা চেতনা একেবারে ঝড়ের মুখে খড়কুটোর মত উড়ে যেতে শুরু করে সনাতন পিতৃতন্ত্র একেবারে খুব পরিস্কার করে আত্মোপলব্ধি করতে পারে যে তাদের এতদিনের মৌরসী পাট্টা এবার উড়ে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে বসেছে বস্তুত পক্ষে এখন আর আগেকার মত নারীদের দমিয়ে দাবিয়ে রাখা কোন ভাবেই যাবে না বা যাচ্ছে না।  কিন্তু মানসিক ভাবে সনাতন পৌরুষ ও তার অহম ছাড়তে পারে না পিতৃতন্ত্রে দীক্ষিত মানুষজন সে কি নারীই বলুন আর পুরুষই বলুন এইখানে একটা কথা পরিষ্কার করে বলে নেওয়া দরকার, ‘পিতৃতন্ত্রবাপুরুষতন্ত্রবলতে শুধু পুরুষদেরকেই বোঝান হয়, ব্যাপারটা আদৌ তা য় ‘পিতৃতন্ত্র’ বা ‘পুরুষতন্ত্র’ আসলে এক বিশেষ জীবনদর্শন, এক বিশেষ সমাজদর্শন। তাই পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার চৌহদ্দির  মধ্যে যেমন সমাজের অনেক বেশি সংখ্যক পুরুষরা থাকেন, সেইরকমই বেশ কিছু সংখ্যক নারীরাও থাকে। আবার ঊল্টো দিকে নারীবাদের চৌহদ্দিতে যেমন   অনেক সংখ্যক নারীরা থাকেন্‌, তেমনি বেশ কিছু সংখ্যক পুরুষও থাকেন। এখন এ প্রশ্ন উঠতেই পারে নারীদের পক্ষে ক্ষতিকারক হওয়া স্বত্বেও পিতৃতন্ত্রে যে সব নারীরা থাকেন তারা কেন থাকেন? এ নিয়ে একটা বিরাট বিস্তৃত আলোচনা হতেই পারে। অন্তত হওয়ার দাবী রাখে। কিন্তু সেটা এখানে নয়, অন্যত্র কোথাও, অন্য কখন। পাশাপাশি নারীবাদের চৌহদ্দিতে যে সমস্ত  পুরুষরাও থাকেন, তারা মূলত একটা জীবনদর্শনের আত্মোপলব্ধির কারণেই থাকেন, সে কথাটা এখনই এখানে নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়। তাদের হারাবার থাকে অনেক সুযোগ সুবিধে। তবু তারা বুকে আদর্শ আঁকড়ে ধরে নারীবাদী হয়ে  জীবন কাটাতে ভালো বাসেন একজন সত্যিকারের প্রকৃত মানুষের মত।

এই যে এতক্ষণ এতসব কথাবার্তা বললাম, এগুলো কেন বললাম তা নিশ্চয়ই পাঠকরা ভাবছেন। বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য নারীবাদের (যা কিনা শুরু হয়েছিল আরও এক কিম্বা দেড় শতাব্দী আগে পশ্চিমে) ধাক্কায়, একটু একটু করে আমাদের এখানকার নারীদের মননেও ঢেউ উঠেছে, তারা ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে এসেছেন, গন্ডায়  গন্ডায় সন্তান ধারণে স্বামীর সঙ্গে অনৈক্যমত হয়েছেন, নিজেরা চাকরী করছেন , ব্যবসা করছেন, জীবন এবং সমাজের বিভিন্ন দিকে নিজেদের উজ্জল উপস্থিতির স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, এই বিষয়টা কিন্তু এক শ্রেণীর পুরুষের, যারা মূলত জীবনে কোনভাবে ব্যর্থ তাদের পৌরুষে হতাশার পারদ চড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। তারা কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না।

 

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন