সুভাষচন্দ্র বসু, পরবর্তী
১৯৪৫
(২)
জে
বি পি মুরে, একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এক সাক্ষাৎকারে ‘ইকোনমিক টাইমস’কে বলেন তিনি ১৯৪৭
সালের ১১ই ডিসেম্বর তারিখের একটি রিপোর্ট পেয়েছেন
ন্যাশনাল আর্কাইভ অফ ফ্রান্স থেকে, যেখানে স্পষ্ট বলা আছে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নেতাজি মারা যায়নি, তবে তিনি কোথায়
আছেন, সেটি তাদের অজানা। মুরে ইটি-কে আরও বলেন, ফ্রেঞ্চ সিক্রেট সার্ভিসের একটি রিপোর্টে
পাওয়া গেছে ২৬ সে সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে কন্ট্রোল
কমিশন অফ এলায়েড ফোর্স মাউন্টব্যাটেনকে চিঠিতে বলে সাইগন থেকে ৭ জন ব্যক্তিকে এরেস্ট
করা হয়েছে যার মধ্যে ৩ জন খুব বড় মাপের নেতা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেনস লীগের এবং হিকারি
কিকনের সদস্য। পাঠকের জ্ঞানার্থে বলে রাখি হিকারী কিকন হচ্ছে একটা হাইলি সিক্রেট গ্রুপ
যারা আই এন এ এবং জাপান সরকারের মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। তার মধ্যে একজন ছিলেন লিওন
পুরুচন্ডি যাকে নেতাজি দাদু বলে ডাকতেন এবং সাইগনে তার বাড়ি ছিল ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস
লীগের মুখ্য কার্যালয় এবং জানা যায় সুভাষচন্দ্র বসু ১৭ই আগস্ট থেকে ২১শে আগস্ট পর্যন্ত
ওই বাড়িতে ছিলেন এবং তারপর ইন্দো চায়না বর্ডার দিয়ে পালিয়ে যান। অনেকে মনে করেন এই সময় তিনি মঞ্চুরিয়া হয়ে রাশিয়া
চলে যান এবং সেই বিষয়ের স্বপক্ষে ও কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু মুরে
মনে করেন ঐ তিনজন হাই প্রোফাইল লিডারের মধ্যে একজন ছিলেন নেতাজি এবং বিশেষত তাঁকে এরেস্ট
করে রাশিয়া নিজের হেফাজতে নিয়ে নেয় এবং কূটনৈতিকভাবে নেতাজি এবং স্ট্যালিন-এর সাথে
আগেই যোগসাজস ছিল, তাই অনেকের মতে পুরোটাই
নেতাজির প্রি প্ল্যান রাশিয়ার সঙ্গে ঠিক যেমন জাপানের সঙ্গে প্লেন দুর্ঘটনার ভনিতা
ও সমগ্র বিশ্বকে চমক দেওয়ার একটা প্ল্যান ছিল। ডক্টর ওয়াই এস ইউড়লভা ১৯৯০ সালে কলকাতায়
দাঁড়িয়ে বলেন রাশিয়া নেতাজি সম্পর্কে অনেক
টপ সিক্রেট ডকুমেন্ট রেখে দিয়েছে। মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টে নরেন্দ্র সিন্ডকার নামে
এক ব্যক্তি জানান নেতাজি ১৯৪৫ সালে বেশ কিছুদিন রাশিয়াতে জেলে ছিল এবং স্ট্যালিন তাঁকে
নিয়ে কী করা যায় এই বিষয়েও খুব চিন্তিত ছিলেন। ডক্টর পূরবী রয়ও রাশিয়া গিয়ে এইরকমই
কিছু ঘটনা জানতে পারেন যে ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ স্ট্যালিন এবং মলতভের মধ্যে
কথা হচ্ছে যে নেতাজিকে নিয়ে কী করা যায় এবং তাঁরা লন্ডনে ভারতীয় কনসালটেন্ট কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে কথা বলেন এবং মেনন নেহেরুর হয়ে
সওয়াল করেন। এই ঘটনা একটু প্রচার হতেই ব্রিটিশ নেতাজীকে ওয়ার ক্রিমিনাল ঘোষণা করে
দেয় এবং ভারতবর্ষের জন্য সবথেকে ক্ষতিকারক একটি আইন নিয়ে আসে, যেখানে বলা আছে, সুভাষচন্দ্র দেশে ফিরলে ব্রিটিশ যেকোন সময়ে
ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে এবং
সেই সময় নেহেরু বলেন, সুভাষ যদি দেশে ফেরেন, আমি প্রথম ব্যক্তি হব যে তার বুকে গুলি
করব। নেতাজির ভারতে অফিসিয়ালি না ফেরার এটা
খুবই গুরুত্বপূর্ন কারণ যা পরবর্তী আলোচনায় আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।
যাইহোক,
আমরা ফিরে যাই ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়াতে। শেষ পর্যন্ত স্ট্যালিন কিছু গোপন
চুক্তি এবং জাপানের হাত থেকে চীনকে স্বাধীনতা প্রদানের বিষয়ে নেতাজির সঙ্গে আলোচনা
করে তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন ও বেশ কিছু দিন সেখানে থেকে পুনরায় সংগঠনের
কাজ চালিয়ে যান। সমর গুহ তাঁর এক চিঠিতে গর্বাচেভকে
বলেছেন, আফগানি ট্রাইব ঘিলজাই-এর সাধু হয়ে তিনি ঘুরছেন রাশিয়াতে এবং এই কথা আফগান
গভর্নর খোস্টকে রাশিয়া জানায়। তবে রাশিয়ার
সঙ্গে বিশেষত স্ট্যালিন-এর সঙ্গে যে নেতাজির সুসম্পর্ক ছিল এবং পরবর্তী কালে বহু বছরই
নেতাজি সেখানে থেকেছেন, সাহায্য পেয়েছে্ন, তা পাঠকগণ কিছুটা অর্ধেন্দু সরকারের রিপোর্ট
থেকেই জানতে পারবেন এবং পরবর্তী সাল নিয়ে আলোচনার সময় ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন।
১৯৪৫
সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ নেতাজি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কাজ চালাতে আবার জাপানে ফিরে
আসেন এবং ভারতবাসীর জন্য রেডিওতে তিনটি বক্তৃতার
কথাও আগে উল্লেখ করা হয়েছে ৪৫ এর ডিসেম্বর থেকে ৪৬ এর ফেব্রুয়ারি সময়কালে। জাপান নতি স্বীকার করার পর
তাইপেই চলে যায় চিন সরকারের হাতে এবং বাকি
সমস্ত দ্বীপও চলে যায় অক্ষ শক্তির হাতে। সেই সময়ে চিনে আবার গৃহযুদ্ধ মাথা চাড়া
দিয়ে উঠতে থাকে এবং মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ ঘোষণা করে। শোনা যায়, পরিকল্পনা মাফিক স্ট্যালিন ও মাও দুজনের মধ্যে যোগাযোগ
স্থাপনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিলেন সুভাষচন্দ্র বোস এবং সেই সূত্রে ৪৬ ও ৪৭ সালের বহু সময়ই তিনি রাশিয়াতে কাটান। রাশিয়া
ছাড়াও এই সময়কালে চিনে ইউনান প্রদেশ যেখানে মাও সে তুং এর হেড কোয়াটার ছিল সেখানে
থাকার ও প্রমাণ মেলে। এই সময় তাঁর দেখা হয় হো চি মিনের সঙ্গে, ফরাসি আগ্রাসন রুখতে
বেশ কয়েকবার গোপন বৈঠক করেন তিনি ভিয়েতনাম গিয়ে।
১৯৪৯
সাল নাগাদ তাঁর দাদা সুরেশচন্দ্র বোস এক আন্তজার্তিক সংবাদ মাধ্যমকে জানান, নেতাজি
রেড কন্টিনেন্ট-এ আছেন এবং তাঁর এই মতামতকে সুইস জার্নালিস্ট লিলি অ্যবেগ সমর্থন করেন,
তাঁর কাছে সেইরূপ তথ্য ও প্রমাণ থাকার জন্য।
বলে রাখা ভালো, এই সময় লিলি জাপানে ছিলেন এবং একজন জাপানি আর্মি চিফের থেকে তিনি এই খবর পান। এছাড়াও
১৯৪৯ সালে বোম্বে থেকে বেরোনো একটি ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ব্লিৎস দাবী করে সুভাষচন্দ্র
বসু চিনে আছেন এবং এই ব্যাপারে তাঁদের হাতে
যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ এসেছে। এছাড়াও এই ব্যাপারে
অনেক সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু ব্যক্তির থেকে যাঁরা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে নেতাজি - চিন ও মাও সে তুং
এর যোগসাজস পান। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলেন এস এম গোস্বামী, যিনি বলেছেন নেতাজি
চিনে আছেন এবং মাও এর এডভাইজার হিসেবে কাজ
করছে্ন। এছাড়া তিনি আরো বলেন, নেতাজি ৪-৫ লক্ষের একটা গেরিলা এশিয়ান লিবারেশন আর্মি
বানিয়েছেন, যাদের মূল লক্ষ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সাম্রাজ্যবাদী নাগপাশ থেকে মুক্ত
করা। বিখ্যাত চিনা সাংবাদিক চেন বোদা যিনি প্রথম জীবনে মাও-এর সঙ্গে কাজ করেছেন, তিনিও
একথা লিখেছেন যে মাও সে তুং বলতেন আমি যখনই বিপদে পড়ি এক অদৃশ্য মহামানব এসে আমাকে
সবসময় রক্ষা করেন, সেই মহামানব আর কেউই নন আমাদের নেতাজি। এছাড়াও নেতাজি এবং চিনা
যোগের অন্যতম প্রধান সাক্ষ্য প্রমাণ হলেন মুথুরালিঙ্গম তেভর, যিনি প্রখ্যাত ফরোয়ার্ড
ব্লক নেতা এবং বোস অফ সাউথ নামে পরিচিত, তিনি নেতাজির অন্ধ ভক্ত ছিলেন। তেভর ১৯৫৬ সালে সংবাদ মাধ্যমকে জানান,
১৯৫০ সালে তিনি নেতাজির সঙ্গে দেখা করেন চিনে গিয়ে এবং সেই যাত্রায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন
স্বয়ং সুরেশচন্দ্র বোস। তিনি এও বলেন চিনের কোনো এক অচেনা জায়গায় তিনি নেতাজির সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাটান এবং প্রয়োজনে এর
স্বপক্ষে প্রমাণ দিতেও তিনি প্রস্তুত। সুতরাং উক্ত আলোচনার মধ্যে আমরা নেতাজির তথাকথিত
মরণোত্তর ৫-৬ বছরের কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাই।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন