কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ১8




কোডি শহর পৌঁছতে  দুপুর গড়ালো। বাজ জানালো যে আমাদের লজ তখনও ঘণ্টাখানেক দূরে। একটু ধন্দে পড়লাম। তাহলে কি লজটা ঠিক কোডি শহরে নয়? বাজ কিছু ভুল করছে না তো?

'‘Hello, Is this Shoshone Lodge? My name is Madhubani Ghosh (এই জায়গাটা এইদেশে সবসময়ে একটু গোলমেলে। উচ্চারণ নিজের অজান্তে ম্যাডুবাণী ঘোষ হয়ে যায়! শ্রোতার সুবিধার্থে উচ্চারণ! কর্তার ইচ্ছায় কর্ম!)  I have a reservation for the night. I have reached Cody but it seems you are still an hour’s drive away. I am a little confused.’

‘Hi there! (ওরাও মোটামুটি  কি নামে  ডেকে বলব তোমাকে পরিস্থিতিতে থাকে) Yes you do have a reservation with us. We are located very close to Yellowstone National Park East gate. We are indeed an hour west of Cody town. See you soon.’

বুঝলাম এটা বস্টন-প্লিমাউথ কেস। আমি আগে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে গিয়েছি তবে এদিক দিয়ে যাইনি। এদিকে দোকান বাজার কম।তাই বাজকে ভালো করে খাইয়ে দাইয়ে একটা ছোট মুদির দোকান থেকে এক ক্রেট খাবার জল আর দুটো  ঠান্ডা কোকের বোতল কিনলাম। ম্যাকডোনাল্ড থেকে একটা বার্গার কিনে সেটির সদগতি করতে করতে US-14 W, বাফেলো বিল সিনিক হাইওয়ে ধরে চললাম পশ্চিম পানে।

উইলিয়াম ফ্রেডরিক বাফেলো বিল কোডি (William Frederick "Buffalo Bill" Cody) ছিলেন এক দুঃসাহসী বাইসন শিকারী। ১৮৬০ সালে মাত্র চোদ্দ বছর বয়েসে বাফেলো বিল পোনি এক্সপ্রেসে কাজ শুরু করেন। তৎকালীন অশ্বারোহী ডাক বিলিব্যবস্থা। এরপরে বেশ কিছু বছর মিলিটারিতে কাজ করার পর তিনি  ক্যানসাস প্যাসিফিক রেলরোড (Kansas Pacific Railroad) শ্রমিকদের মাংস সরবরাহের বরাত পান। শোনা যায়  ১৮৬৭ থেকে ১৮৬৮ এর ভেতরে  তিনি ৪২৮২টি বাইসন শিকার করে মৃত্যুগন্ধমাখা এই নামটি অর্জন করেন। শিকার করার সময় বাফেলো বিল ছুটন্ত বাইসনের দলের একেবারে সামনের দিকে গিয়ে দলের নেতাদের প্রথমে গুলি করে মারতেন। তার ফলে দলের অন্য বাইশনগুলি বিভ্রান্ত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ত এবং খুব সহজেই তার রাইফেলের নিশানায় চলে আসতো। তার নামেই  কোডি শহর, তার নামেই এই প্রাণজুড়োনো রাস্তা।

আমার বাঁদিকে পড়ল বিশাল বাফেলো বিল রেজার্ভয়ার। শোশোন নদীর জলপুষ্ট  এই নীল নির্জনে  সাঁতরে বেড়ায় বিভিন্ন প্রজাতির ট্রাউট মাছ। জলের ধারে বড়শি ফেলা মানুষ আর বকেরা একই রকম ধৈর্য্যশীল। এই শোশোন নদীকে আগে দুর্গন্ধযুক্ত নদী (Stinking water river) বলে ডাকা হতো। আমি তার ঝকঝকে  নীল জল আর সবুজপাড় শাড়ি দেখে ভাবছি আহা গো... এমন রূপের পুঁটুলিকে কোন পাষণ্ড অমন প্যাঁচাপানা নাম দেয় ? তা জানা গেল শোশোন নদী অতিশয় রূপবতী হলেও পদ্মগন্ধা নন। অনেকগুলি পাহাড়ি ঝর্ণা সালফার ডাই অক্সাইড বয়ে এনে তাকে পচনশীল ডিমের গন্ধযুক্ত করেছে। তাই আশপাশের গাঁয়ের লোক গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে তার নাম দিয়েছিলো দুর্গন্ধযুক্ত নদী (Stinking water river)!

আমাদের এই গ্রামের নামটি কোডি,

আমাদের এই দুর্গন্ধী নদী,

আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে—

তাদের আমি জ্বালাই নিরবধি।

তা জনগণের ইচ্ছায় ১৯০১ সালে এই নদীর নাম পাল্টে নাম রাখা হলো শোশোন (Shoshone )। শোশোন শব্দের অর্থ ঘাসের প্রাচুর্য্য। এখানকার শোশোন উপজাতির মানুষেরা থাকতো ঘাসের তৈরী কুঁড়েঘরে। জীবনযাপনে নির্ভর করতো  হরিণ আর বাইসনের  ওপরে, যারা এই চারণভূমিতে দলে দলে ঘাস খেতে আসত।   এই অঞ্চলে নদী, ঘাস, মানুষ, হরিণ, বাইসন বাঁধা থাকতো এক নৈসর্গিক  গাঁটছড়ায়।

'কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়

পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;

কাঁচা বাতাবীর মতো সবুজ ঘাস- তেমনি সুঘ্রাণ-

হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে!

আমারো ইচ্ছে করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো

গেলাসে-গেলাসে পান করি,

এই ঘাসের শরীর ছানি- চোখে ঘষি,

ঘাসের পাখনায় আমার পালক,

ঘাসের ভিতর ঘাস হ’য়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার

শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।'

তা সেই নদীর পাশ দিয়ে বনের ছায়ায় ছায়ায় পথ চলার পর আমার লজে এসে পৌঁছলাম। পাইন কাঠের গেট দিয়ে ঢুকেই প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। নদীর ধারে পাইনের জঙ্গলে ছোট ছোট এক কামরার কাঠের কেবিন। মাঝখানে একটু বড়োমতো কাঠের একতলা বাড়ির সামনের  দেওয়ালে একটা বিশাল শিংওয়ালা হরিণের খুলির তলায় লেখা  অফিস ডাইনিং রুম এন্ট্রান্স। দরজার বাইরে একটা টেবিলে একটা কালচে বাদামি ল্যাব্রাডর কুকুর উদাস মুখে বসে আছে। আমি বাজকে গাছের ছাওয়ায় রেখে, সারমেয়র ভাবগতিক আন্দাজ করতে করতে দরজা ঠেলে আপিসে ঢুকলাম। ভেতরে সবকিছু পাইন কাঠের তৈরী। একজন ফিটফাট ভদ্রমহিলা কাউন্টার সামলাচ্ছেন আর একটি ছোটছেলে ঘরে খেলা করছে। বুঝলাম লজটি কোনো এক পরিবার দেখাশোনা করে।

‘ Hi, I am Madhubani. Last name is Ghosh. I have a reservation for tonight. I had called you about an hour back.’

আমরা কেমন আপাতবুদ্ধিতে কিছু কিছু জিনিস ধরেই নিই। আমি ধরেই  নিয়েছিলাম যে ইনিই ফোন ধরেছিলেন। চোখের দ্বিধায় বুঝলাম তিনি অন্য কেউ।

ভদ্রমহিলা রেজিস্টার মিলিয়ে সবকিছু বুঝে নিয়ে একটা চাবি হাতে নিয়ে আমাকে বললেন-

'‘Welcome to the Lodge. Let me show you to your cabin. You can park right outside your room. We serve dinner from 6:00 to 8:30 PM’

শুনশান পথে আসতেই বুঝেছিলাম যে এখানে বাইরে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। খাওয়া দাওয়া এই লজেই সারতে হবে। ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের ভেতরেও খাবার পাবার আশা কম যদি না আমি বাফেলো বিলের মতো বাইসন শিকার করি আর রেলরোডের শ্রমিকদের মত আগুনে ঝলসে খাই!

‘Er… I would like to go inside the National Park right now and may not be back in time for dinner. Could I pack something with me to have inside the park?’

ফিটফাট ভদ্রমহিলা একটু থমকালেন। তখন বিকেল ৪টা বাজে...

‘But the kitchen is closed at this time.  Now we just have fresh tomato  soup for starters and mixed berry pie for dessert’.

আমার ইউরেকা মুহূর্ত উপনীত!

‘That sounds perfect. I have a cup flask. I would like to order a cup of soup, a slice of bread and mixed berry pie. I will pick the food up in about half hour.’

ভদ্রমহিলা আমাকে পাশের ২ নম্বর পাইন কেবিনে নিয়ে গেলেন। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে গেল সেই কালচে বাদামি ল্যাব্রাডর। ছোট একতলা কাঠের কেবিন, সামনে এক টুকরো বারান্দায় দুটো চেয়ার পাতা। চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকতেই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। ঘরে পাইনকাঠের রজনের গন্ধ। জানালার পাশে একটা ছোট  সোফা, লেখার  টেবিল, ছোট ফ্রিজ, লাগোয়া ছোট একটা বাথরুম দেওয়ালে বিগহর্ণ শীপ এর ছবি, একটা পরিপাটি বিছানা, একটা আয়না...

হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে এক কাপ গরম চা আর বিস্কুট নিয়ে বারান্দায় বসলাম। আকাশে মেঘ আর রোদের খেলা চলছে। বৃষ্টি নামবে বোধ হয়। পাইনের বনে সরসর করছে বাতাস। চারিদিকে পাইন রজনের গন্ধ। কয়েকটা ছোট ছোট পাখি উড়ছে ইতস্তত। মনের ভেতরে ধুকপুক করছে আসন্ন অরণ্য। আজ অনেক রাত  অবধি থাকব সেখানে। দূরবীন, ফ্লাস্কে গরম টমেটো সুপ্, প্যাকেটে পাঁউরুটি আর মিক্সড বেরি পাই, নিয়ে এবার যেতে হব ... এবার যেতে হবে... এবার যেতে হবে...

‘হৃদয়ে আমার গন্ধের মৃদুভার

তুমি নিয়ে চল ছায়ামারীচের বনে

স্থির গাছ আর বিনীত আকাশ গাঢ়

সহিতে পারিনা হে সখি, অচল মনে।

হারা-মরু-নদী কী দুঃখ অনিবার

ভরসা ফলের পাত হৃদে বড় বাজে

গহন শোকের হাওয়া ঘেরে মরি-মরি

বরষা কখন ঘন মরীচিকা সাজে।

শোশোন  লজ  থেকে বেরিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে আধ ঘন্টাটাক গেলেই ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের পূবদিকের গেট। আমার বাঁ দিকে খানিকটা ঢালু এলাকা পেরিয়ে  বয়ে যাচ্ছে শোশোন নদী। তার পাশটিতে নানা রঙের নুড়ি পাথর জলে ধুয়ে যাচ্ছে বারংবার। খানিক এগিয়ে পড়ল পাহাস্কা টিপি (Pahaska Tepee)। এইটি  ছিল বাফেলো বিল কোডির শিকার বাংলো বা হান্টিং লজ। ১৯০৫ সালে এটি শিকারী পর্যটকদের জন্য খুলেছিলেন বাফেলো বিল। স্থানীয় নেটিভ আমেরিকানরা তার নাম দিয়েছিলো পাহাস্কা বা লম্বা চুলের মানুষ। বোঝাই যাচ্ছে সেনাবাহিনীর বাটিছাঁট থেকে মুক্তি পেয়ে বাফেলো বিল লম্বা চুল রেখেছিলেন। বন্দুক হাতে বাইসন ধাওয়া করে ঘোড়া ছোটালে তেমন এলোকেশই বোধ হয় মানায় ভালো। আর কষ্ট কি শুধু  বাইসনের ? পরবর্তী কালে, পল নিউম্যান পাহাস্কা বাফেলো বিলের ভূমিকায় অভিনয় করে অনেক তরুণীর বিশেষ কষ্টের কারণ হয়েছিলেন।

পথ চলেছি বিকেলবেলা। গাড়িতে রসুন ফোড়ন দেওয়া গরম টমেটো সুপের সুবাস। খানিক এগিয়ে দেখি রাস্তার ধারে মানুষের জটলা। তারা ঝুঁকে  পড়ে নদীর তীরে কিছু দেখছে। দু একজনের হাতে কামানের মত ক্যামেরা যা দিয়ে মঙ্গলগ্রহের বাথরুম পর্যন্ত দেখা যাবে। আমি রাস্তার ধরে বাজকে দাঁড় করিয়ে জটলাভুক্ত হলাম। এক নাকে নথ পড়া তরুণীকে জিজ্ঞেস করলাম

'‘Did you see anything?’

মেয়েটির নথ নাকের পাটায় নয়। সেটি নাকের মধ্যবর্তী অংশে। ক্লিপ করা  নয়। ওই অঞ্চলে সত্যি সত্যি ফুটো করেছে। আমি দেশ গাঁয়ে গরু মোষের নাকে অমন ফুটো করে নারকোল দড়ি গলানো দেখেছি। দেখলাম মেয়েটি ডান ভূরুতেও একটা ধাতব নথ  পরেছে।

'‘There is a grizzly bear on the river bank!’

‘What?’’

ঝুঁকে পড়ে দেখি একটা বাদামী ভাল্লুক নদীর তীরে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন পাথর শোঁকাশুঁকি করছে। আমি তো হাঁ । তখনও তো পার্কেই ঢুকিনি! ভাল্লুকটি নিজের মনে ঘুরতে ঘুরতে ঝোপের আড়ালে চলে গেলো। আমরাও  নিজেদের পথ ধরলাম।

গেটে পৌঁছে আমেরিকা দা  বিউটিফুল' কার্ড দেখাতেই চিচিং ফাঁক। হুঁ হুঁ বাব্বা... এটি হলো  ন্যাশনাল পার্ক! এইখানে নো কেন্দ্র রাজ্য মন কষাকষি। এক সহাস্য তরুণী গেটে টিকিটচেকার।

‘Welcome to Yellowstone National Park. Here is a map of the Park. Enjoy.’

‘Thank you. I will spend the evening inside the park. How late can I stay? What is the best route to take at this time? I am primarily interested in seeing wildlife. I will travel to Gardiner tomorrow near the north entrance.’

মেয়েটি খুব ধৈর্য্য ধরে ম্যাপ দাগিয়ে আমাকে বলে দিলো আজকে আমার কোথায় কোথায় যাওয়া উচিত। কি কি দেখবার সম্ভাবনা সেই পথে।

'The Park is open 24 hrs. You can stay as long as you please. However, please be careful driving at night. You will find lot of wildlife  on the road. We have had some elk and bison hit by rash drivers.’

আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পার্কে ঢুকলাম। পথ চলেছে এক পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে।  ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের পূবদিকে রয়েছে আবসরোকা পর্বতমালা। আবসরোকা শব্দের অর্থ  লম্বা ঠোঁটের পাখির সন্তান। আবসরোকা নেটিভ আমেরিকানদের বলা হতো কাক মানুষ (Crow people)। আগ্নেয় শিলা দিয়ে তৈরী পাহাড় চূড়াগুলি কাকের ঠোঁটের মতো কালো আর তীক্ষ্ণ। বহু বছর আগে এই অঞ্চলে বই তো আগ্নেয়গিরি উৎপন্ন লাভাস্রোত। কোনো কোনো গাছের মাথায় বসে কর্কশ স্বরে ডাকছে বিশাল কালো রাভেন বা দাঁড়কাক। আবসরোকা নেটিভ আমেরিকানরা মনে করতো এই রাভেন যেমন অন্ধকার থেকে আলোয় আসার প্ৰতীক তেমনি বিগড়ে গেলে এই রাভেনই নানারকম গন্ডগোল পাকাতে সিদ্ধহস্ত। রাভেন হলো আলো এবং অন্ধকারের মধ্যবর্তী প্রহরী। একধারে সেই তীক্ষ্ণচঞ্চু কালোপাহাড় আর অন্যদিকে পথের  পাশে ফুটে থাকা বনফুল। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই কঠিন আর কোমলের মধ্যবর্তী পথ দিয়ে এগোচ্ছিলাম।

পেরিয়ে গেলাম সিলভান পাস, সিলভ্যান লেক (Sylvan লেক)। কি যে সুন্দর সবুজে ছাওয়া সেই অঞ্চল। সিলভান শব্দের অর্থ আরণ্যক। তীরবর্তী গাছের ছায়া পড়েছে শান্ত লেকের জলে। আভ্যালাঞ্চ পর্বতশৃঙ্গের (Avalanche peak) খানিক বাদেই এক বিশাল হ্রদের তীরে গিয়ে থামল বাজ। ইয়েলোস্টোন লেকের নীল যেন আকাশে গিয়ে মিশেছে। ১৩৬ বর্গ মাইলের এই হ্রদ ইয়েলোস্টোনের বৃহত্তম জলাশয়। পুরাতত্ত্বজ্ঞরা বলেন হাজার হাজার বছর ধরে এই লেকের পাশে বসবাস করত বিভিন্ন প্রজাতির আদি মানুষ। তারা বাইসন আর হরিণ শিকার করত পাশ্ববর্তী তৃণভূমিতে, মাছ ধরত লেকের জলে, মাটি খুঁড়ে তুলে নিতো কামাস গাছের কন্দ। পশ্চিমি সভ্যতার সঙ্গে এই অঞ্চলের যিনি প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন, তার নাম ছিল জন কোল্টার (John Colter)। জন ছিলেন সেই ক্যাপ্টেন মেরিওয়েদার লুইস আর সেকেন্ড লিউটেনান্ট উইলিয়াম ক্লার্কের দলের লোক। সেই মিসৌরি নদী বাওয়া অভিযানে মাসিক ৫ ডলার বেতনে চাকরি পেয়েছিলেন জন। জন ছিলেন সেই দলের সেরা শিকারী। তাকে প্রায়ই নদীতীরবর্তী জঙ্গলে পাঠানো হতো বাইসন আর এলক শিকার করতে। জন ছিল বিলকুল বেপরোয়া। এই অঞ্চলের জল জঙ্গল ছিল তার নখদর্পনে। ১৮০৬ সালে লুইস আর ক্লার্কের অভিযান শেষ হলে জন আবার এই অঞ্চলে ফিরেছিলেন বিভারের (Beaver) পশম সংগ্রহ করতে। বন্ধুত্ব করেছিলেন আবসরোকা নেটিভ আমেরিকানদের, সেই কাক মানুষদের সঙ্গে। তাদের সহায়তায় কোল্টার এই অঞ্চল খুব ভালো করে চিনেছিলেন। এখানে অনেকটা সময় কাটানোর পর কোল্টার সভ্যতায় ফিরে জানিয়েছিলেন এই অঞ্চলের উষ্ণপ্রস্রবণ, ফুটন্ত  কর্দম আর  গন্ধকের কথা। সকলে হো হো করে হেসে উঠে এই অঞ্চলের নাম দিয়েছিলো কোল্টারের আজগুবি নরক। তবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ  সেই অট্টহাসিকে স্তব্ধ করেছিল বটে।

আমি লেকের ধারে  চুপচাপ হেঁটে বেড়াচ্ছি, বনফুলের রঙে মুগ্ধ হচ্ছি, অনতিদূরে  মাটির তলা থেকে কুন্ডলি পাকিয়ে গন্ধকের ধোঁয়া উঠছে। এমন সময় দেখি এক বাইসন হেলতে দুলতে এদিকপানেই আসছে। যদিও আমি আজকে লালজামা গায়ে দিইনি তবু আর বেশি কথা না বাড়িয়ে বাজের সঙ্গে রওনা দিলাম। এমনি করে চারিদিক দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলাম, ফিসিং ব্রিজ, লেক ভিলেজ। হেইডেন ভ্যালিতে পৌঁছে দেখলাম মানুষের জটলা, কামানের মত ক্যামেরা লেন্স, চাপা উত্তেজনা। এতক্ষণে বাইসন ব্যাপারটা মোটামুটি জলভাত হয়ে গেছে। তারা পথের দুপাশে শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, যুথবদ্ধভাবে, একাকী আমাকে ধন্য এবং রোমাঞ্চিত করেছে। এখানে শুনলাম নেকড়ে দেখা যাচ্ছে।

হেইডেন ভ্যালির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচুর জলাভূমি রয়েছে। সেখানে নানা তৃণভোজী  প্রাণীর ভিড়। আর খাদ্য পিরামিডে তাদের শিকার করতে আসে নেকড়ের দল। আমার পাশে একজন ভদ্রমহিলা সেজব্রাশের ঝোপে একটা কালো নেকড়ে দেখে  খুব উৎফুল্ল হচ্ছিলেন। আমি অপটু চোখে দূরবীণ দিয়েও তাকে দেখতে না পেয়ে মুখ কাঁচুমাঁচু করে চুপচাপ ফেল্টুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভদ্রমহিলার বোধয় আমার মুখ দেখে মায়া হলো। তিনি আমাকে তার শক্তিশালী কামান লেন্স দিয়ে দেখালেন নেকড়েটিকে। কি অসাধারণ রাজকীয় তার রূপ। কালো আর ধূসর তার গায়ের রং। সে মুখটা আকাশের দিকে তুলে টানা সুরে  ডাকছে।

ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লেন্স ফেরত দিতে উনি বললেন

‘He is lonely.’

আমি মুখে কিছু না বলে মুচকি হাসলাম।মনে মনে ভাবলাম-

‘Tell me about it.’

সন্ধ্যা নামছে হেইডেন ভ্যালির জলাশয়ে, সেজব্রাশের  ঝোপে। শীতল হচ্ছে বাতাস, নিভে আসছে আলো। আমি গাড়ির একটা দরজা খুলে, দুটো পা বাইরের দিকে ঝুলিয়ে বসে, চুপচাপ পাউরুটি আর টমেটো সুপ্ খাচ্ছিলাম। মগ ফ্লাস্কের দৌলতে সেটি তখনও বেশ গরম। একটা ফিকে আধো  হাসির মত চাঁদ উঠছে আকাশে। এছাড়া আর অন্য আলো নেই চরাচরে।

'অগভীর রাত -- এখনো হয়নি দূর

জাগরণ চোখ থেকে

বুকের ভিতর অচল সুমুদ্দুর

স্বগৃহে নিলো ডেকে।

 

উদাসিনী, অভিনিবিষ্ট এই রাতে

জ্যোৎস্নায় দিক-দেশ

ভেসে গেছে, যাহা ভেবেছিলে সন্ধ্যাতে

সব ভাবনার শেষ।

 

দেখেছিলে তাকে কোন সে-রাসের মেলা

গঞ্জে ব্রিজের তলে

আজ সেই চোরালণ্ঠন করে খেলা

স্পষ্ট ভাষায় বলে:

 

'ভালোবেসেছিলে তুমি যাকে, সে তো নেই

এ-নতুন কারিগর-'

হঠাৎ হারায় তোমার পথের খেই

স্বর্ণচাঁপার ঘর।'

 

(ক্রমশ)

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন