কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

বিবেক মিশ্র

 

 

 প্রতিবেশী সাহিত্য

 

বিবেক মিশ্র-র গল্প                  

                        

(অনুবাদ : মিতা দাশ)

 


 

লেখক পরিচিতিঃ জন্ম ১৫ আগস্ট সীতাপুর, উত্তরপ্রদেশ। শিক্ষা - এম এ রাজনীতি বিজ্ঞান, দন্ত বিজ্ঞান, সাংবাদিকতা। প্রকাশিত গ্রন্থগল্প - হনিয়া, তিতলি, বদবু , গুব্বারা, দুর্গা ইত্যাদি। উপন্যাস - ডোমনিক কি বাপাশি, জন্ম জন্মান্তর। স্ক্রিন-প্লে রাইটিং - থার্টি মিনিট। অর্জিত সন্মান - ইন্দু শর্মা কথাসম্মান, রমাকান্ত কাহানী পুরস্কার, যশপাল পুরস্কার, আর্যস্মৃতি সম্মান, শিখর সাহিত্য-সম্মান।    


ঘড়া 

বিশাল বিছানা থেকে উঠে বসে। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা চমকে উঠেছে। বিশাল দ্রুত পায়ে বেডরুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলো। শীতল ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। বিশাল এসেই ঘরের কোণে রাখা কলসটা (ঘড়া) তুলে ড্রয়িংরুম থেকে লনে নিয়ে এলো। শীতল ও বিশালের পেছন পেছন লনে এসে হাজির হল। শীতল যতক্ষণে বিশালকে কিছু বলতো, বিশাল তার বলার আগে সেই বড় রাজস্থানী কলসটা, যার উপরে আঁকা কাঁচা রং চঙে ফুল-পাতা, মাটিতে আছাড় মেরে ভেঙে দিলো।

বিশাল হাঁপিয়ে উঠেছিল। ওর শ্বাস প্রশ্বাসের উঠানামা দেখে শীতল অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মাটির কলস টুকরো টুকরো হয়ে লনে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজ যখন বিশাল ঘরে ফিরেছিল, বেশ খুশি ছিল। আর সে শিতলের খবর জানার জন্য বেশ উৎসুক মনে হচ্ছিল। বিশাল ঘরে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলো –“কী বলল ডাক্তার তোমায়? আমাদের বেবি এখন কেমন আছে? সব নর্মাল তো?”  শীতল বিশালকে আশ্বাসন দেবার জন্য নিজেকে সংযত করে বলল, “হ্যাঁ সব ঠিক আছে। ওজন, ব্লাড প্রেশার। আজ উনি আল্ট্রাসাউন্ডও করলেন। সত্যি বিশাল, এটা একটা আমার দারুন অভিজ্ঞতা হল, নিজের শরীরের ভেতরের নিজের বাচ্চাকে স্ক্রীনে দেখা! ওর ছোট ছোট হাত-পা এমনভাবে ছুঁড়ছিলো যেন সে জানে যে আমরা ওকে দেখছি! কত অদ্ভুত অনুভব নিজের হৃদয়ের আর একটা হৃদয়ের স্পন্দন দেখা, আমি তো আমার চোখের জল থামাতে পারছিলাম না... ব্যস এখন আমি ওকে দেখতে চাই”। 

বিশালের চোখ ও উৎসুকতায় ও কৌতূহলে ভরে গেল। সে শীতলের কাঁধে হাত রেখে ওকে মাঝখানে থামিয়ে প্রশ্ন করল... "কোন সমস্যা তো নেই, সবই তো ঠিক ...কিন্তু যদি আমিও সংগে যেতে পারতাম, ফাইনালি কি বলল ডাক্তার?

শীতল বিশালের কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে বলল - "ডাক্তার বলেছে বেবি এক্কেবারে ঠিক, শুধু খাওয়া দাওয়ার উপর একটু নজর রাখতে হবে আর মৌসুম বদলাচ্ছে তাই একটু ফ্রীজের ঠান্ডা খাবার ও জল খেতে বারণ করেছেন”।

শীতল ঘরের কোণায় রাখা একটা নতুন রাজস্থানী ঘড়ার (কলস) দিকে ইশারা করে বলল - "দেখো হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে আমি এই ঘড়া (কলস) কিনে আনলাম। এখন এই ঘড়ার জল খাব আমি”।

বিশালের চোখ ঘড়ার উপর পড়তেই ওর চোখ জ্বলে উঠল। যেন কেউ ওর চোখে  লঙ্কার গুঁড়ো ফেলে দিয়েছে। ঘরের কোণে রাখা মাটির ঘড়ায় কাঁচা ও পাকা রঙিন রং দিয়ে ফুলপাতা আঁকা ছিল। শীতল বিশালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো - "কি সুন্দর না?"

বিশাল কোনো জবাব দিলো না। শুধু শীতলের দিকে তাকিয়ে দেখলো আবার একবার ঘড়ার দিকে চেয়ে দেখলো, তারপর বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল। ওর পেছন পেছন শীতল বেডরুমের চলে এলো। শীতল বিশালকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি হয়েছে বিশাল?” একটু থেমে বলল বিশাল - "তোমারও বলিহারি,  আজকাল কেউ খাবার জল ঘড়ায় রাখে? সেটা আবার এত বড় ঘড়া! ফ্রিজের জল যদি নাই খাবার ছিল তাহলে একটা সুরাহী নিয়ে আসতে ছোট। এত বড় ঘড়া, তার উপর ফুল-টুল, ফুল-পাতা আঁকা দিয়ে ভরা। এত বড় ঘড়া, তাও আবার রাজস্থানী ঘড়া। এটা সরাও এখান থেকে এক্ষুনি!”

শীতল কোনো কথা না বলে এক দৃষ্টিতে বিশালের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই বিশাল, যে শীতলের প্রত্যেক কথা রাখতো, সবদিক থেকে ওর বেশ খেয়াল রাখতোত। শীতলের চেয়ে বেশি অপেক্ষায় ছিল বাচ্চার জন্মের। সে নিজেই বেডরুমের চারিদিক গোলগাল, ফর্সা-কালো, শ্যামবর্ণ, হাসছে-কাঁদছে এমন অনেক ফটো লাগিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ ঘড়াটা দেখে বিশালের এমন করে চটে যাওয়াটা শীতল বুঝতে পারছে না। ও বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলো।

বিশাল কাপড়-চোপড় চেঞ্জ করে বেডরুমে ঘুমিয়ে পন। তাও আবার এই সময়  যখন সে প্রতি মুহূর্তে নিজের বৌয়ের খেয়াল রাখে, সেখানে এই ভাবে শীতলের সঙ্গে কথা বলাটা ওর মোটেই ভালো ঠেকছে না। কিন্তু এই ঘড়া, তার উপর সাজানো নানান রঙের ফুল ও পাতার বাহার ওর চোখ দুটোয় জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। বিশাল নিজের দুই চোখ বন্ধ করে নিলোদ। কিন্তু এখনও চোখে সেই ঘড়াটা ভাসমা। আর বারবার বিশালকে একটা অন্ধ গভীর কুয়োর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই গভীরেও সে সেই নানান রঙের কারুকার্য করা ঘড়া নোংরা জলে নড়তে চড়তে আর ভাসমান অবস্থায় দেখতে পাচ্ছিল। যেন সে নিজেকে জলে ডোবার থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। আস্তে ধীরে ঘড়াটা হাঁপিয়ে উঠেছে আর চটপট করতে করতে ঘড়ার ভেতর জলের বুদবুদ তৈরি হয়ে হাওয়া বাইরে বেরিয়ে জলকে রাস্তা করে দিলো। এবার ভেতরে জল ঢুকছিল। আর ঘড়া হেরে গিয়ে জলে শেষমেষ ডুবে গেল।

বিশাল সেই ঘড়া, সেই কুয়ো, সেই বিকেলকে ভুলে যেতে চেয়েছিল। সেইদিন নিজের গ্রাম ধ্যান্ডেসায় রাজস্থানে বিকেলে বেলায় নিজের জমিদারির বাড়ি বারান্দায় বেশ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে টহল দিচ্ছিল। জমিদার বাড়ির ভেতরে এক ঘরে কোনো মেয়েমানুষের কান্নার ও চিৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এই কান্নার রোল বিশালের বৌদির। সে গর্ভবতী, গর্ভ ন’মাসের উপরে হয়ে গেছে। আর আজ দুপুরে থেকে ব্যথা উঠেছে। রাজবাড়ির ভেতরের ঘরে ডাক্তার এসে বৌদিকে দেখছিল। ডাক্তার বাইরে এসে বলল, "উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এক্ষুনি। ঘরে প্রসব করানো যাবে না। কেস কমপ্লিকেটেড তাই হাসপাতালে সব সুবিধে থাকবে।" কিন্তু বিশালের দাদা বউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি হননি। বিশাল ডাক্তারকে শহরে ছাড়তে চলে গেল। শহর ওর গ্রাম থেকে কুড়ি-বাইশ কিলোমিটার দূরে।

বিশাল ডাক্তারকে ছেড়ে যখন রাজবাড়িতে ফিরল তখন সূর্য অস্ত হয়েছে, কিন্তু রাজবাড়ির বারান্দার কোনো বাতি জ্বালানো ছিল না। ভেতরের ঘর থেকে বৌদি ও কিছু মহিলাদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। দাদার দুই চাকর ও কিছু মহিলা ও দাই-মা রাজবাড়ির উঠোনে। এ সেই দাই-মা যাকে দাদা ডাক্তারের চলে যাওয়ার পর প্রসব করানোর জন্য ডেকে আনা হয়েছিল। দাদা এখন বৌদির ঘরে। উঠোনের মাঝখানে একটা বড় রাজস্থানী ঘড়া রাখা, তার উপর নানা রঙের কাঁচা-পাকা রং দিয়ে ফুলপাতা আঁকা। আর এদিকে গোটা রাজবাড়ী খাঁ খাঁ করছে। আজ বিশালের মন কাড়েনি সেই ঘড়ায় আঁকা ফুলপাতা।

দাই মা উঠতেই বলল - "মরা মেয়ে জন্ম দিয়েছে বিন্দনী (বৌমা)। " এই কথা বলার পরে সে একটি কালো কাপড় দিয়ে ঘড়ার মুখটা ঢেকে দিলো। বৌদির কান্নার রোল আরো জোরালো হয়ে উঠলো। দাদা ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো আর নিজের খাস চাকরদের ইশারায় আদেশ করল। আর দুই চাকর যেই ঘড়ার  দিকে এগিয়ে গেল, ঘড়াটা কেঁপে উঠল।

মাটির নিষ্প্রাণ ঘড়া। ফুলপাতা আঁকা ঘড়া। বিশাল ভাবল ও ছাড়া আরো কারে চোখে পড়ল কি? শুধু ঘড়াটা নড়ল, নাকি পৃথিবীটাই নড়ল? ঘড়ার দিকে তাকিয়ে সেই মানুষ দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘড়াটা আবার নড়ল আর মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। ঘড়ায় ভরা সাদা গুঁড়ো নুন গোটা মেঝেতে ছড়িয়ে গেল।

দুটো কোমল, ছোটোহাত নুনে মাখানো ঘড়া থেকে ফসকে বাইরে বেরিয়ে এলো। 

বৌদি ঘরের চৌকাঠ ধরে কাঁদছিলো, হঠাৎ চোখ উল্টিয়ে সজোরে বুকফাটা  কান্নায় ভেঙে পড়ল। বিশালের মনে হল যেন এই রাজবাড়ি এই রকম কান্না ও চিৎকারে থরথর করে কাঁপছে। সে ঘড়া থেকে বেরিয়ে আসা সেই দুটি নুন  মাখানো কোমল হাত দুটি টেনে বুকে চেপে নেয় । সে তার হাত দুটি ধরার জন্য এগোতেই অজান্তে ঘরের চৌকাঠে মুখ থুবড়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ল আর মুখ থেকে বিকট একটা চিৎকারে ভরে গেল রাজবাড়ি। যদি উনি স্পষ্টভাবে বলতে পারতেন তো এই কথাই বলতেন, "ওরা আমার মেয়েকে মেরে ফেলল।"

কিন্তু সেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া শব্দগুলিকে একসঙ্গে জোড়া লাগানোর প্রয়াস নিষ্ফল হত। কারণ সেই কান্না আর চিৎকারের অসংখ্য টুকরো গুলি উঠোন ছাপিয়ে ফেলেছে। এখন সেই কান্না ও চিৎকারের কণাটগুলি রাজবাড়ির বাইরে অরণ্যে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু তার কিছু সূক্ষ্কণগুলি এখনো রাজবাড়ির দেয়ালে মাথা ঠুঁকে ঝনঝন করছে।

মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা নুনের কণাগুলো উঠানে দাঁড়ানো লোকেদের চোখে কাঁটার মত  ফুটছিলো। সবাই অন্ধ, কালা, বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যদি এদের মধ্যে কেউ কথা বলছিল তো শুধু সেই দুটি নুন মাখানো কোমল হাত!

বিশালের পা কেঁপে উঠল। সে নিজের দুই চোখ কচলাতে কচলাতে ঘড়ার দিকে এগিয়ে যেতেই দাদা ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিল। দাদার দুই বিশেষ চাকর দুটো সেই কোমল হাতের মুঠো দুটি ঘড়ার ভেতরে ঠেলে দিল আর কালো কাপড় দিয়ে ঘড়ার মুখটা আবার বেঁধে দিল। মহিলারা বৌদিকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। বৌদির জ্ঞান ছিল কী ছিল না বিশালের জানা নেই। বৌদির দাঁতের কপাটি বন্ধ ছিল আর চোখ দুটো উল্টানোই ছিল। হাত পা একদম ঠান্ডা হয়ে এসেছিল।

বিশালের চোখের সামনে অন্ধকার। নিজের পুরো জোর প্রয়োগ করেও সে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পারছে না। সব চেষ্টাই নিষ্ফল। বিশালের চোখের সামনে যে  এমন একটা অঘটন ঘটে গেল যে তার চোখে ভেসে উঠছে বারবার। ওর কানে এখনো বৌদির কান্না ও চিৎকার গুঞ্জয়মান। সে নিজেকে সামলে মাথাটা এক ঝটকা দিয়ে রাজবাড়ির দরজার দিকে ছুটল। সেখান থেকে দাদা ও ওনার দুই  চাকর উঠানের মাঝখানে রাখা সেই ভাঙা ঘড়াটা তুলে দরজা দিয়ে বেরিয়েছিল। যতক্ষণে সে বাইরে বেরুলো দাদা সেই চাকর দুটোকে সঙ্গে নিয়ে জিপে চেপে চলে গেল, আর জিপের পেছনে অনেকটা কালো ধোঁয়া ছেড়ে গেল। সে পাগলের মত সেই কালো ধোঁয়াওয়ালা জিপের পিছনে ছুটতে লাগল। পাগলের মত দৌড়তে দৌড়তে সে দাদার জিপের কাছে পৌঁছলো তখন সে দেখল একটা পুরনো মনহুস কুয়োর কাছে  দাদার জিপ দাঁড়ানো। সেই কুয়াতে একটা নিভু  নিভু প্রদীপ জ্বলছে। যত স্পীডে ওরা কুয়োর কাছে এসেছিল আবার সেই স্পীডেই ফেরত চলে গেল রাজবাড়ির দিকে। কুয়োর চারিদিক এক্কেবারে সুনসান।

বিশাল কুয়োর পাড়ে হাত রেখে হাঁপাচ্ছে। প্রদীপের ঝিলমিল আলোতে সে দেখতে পেল জলের উঠে আসা বুদবুদ। ঘড়াটা ডুবে গিয়েছে।

 

 


1 কমেন্টস্:

  1. কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়া যে পুরুষশাসিত সমাজ ভালো চোখে দেখে না। এই গল্প তার‌ই জ্বলন্ত উদাহরণ। সমাজে একটা নারীর অবস্থান কোথায়? এই গল্প যেন সেই কথাই আমাদের শোনাতে চেয়েছে।

    উত্তরমুছুন