কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল

 


(৩৩)

 

মাসদেড়েক কেটে গেছে মাঝে, সময়ের গতি কখনও মনে হয় দ্রুত, কখনও শ্লথ। ক্ষণিক সুখের মতো কলকাতায় বেশ ক-টাদিন ঠাণ্ডা পড়েছিল এবারে। যাই-যাই করছে যদিও তবু লিপিকাদের পশ্চিমের ব্যালকনিতে অবেলার রোদটি বিশেষ আরামের। এককোণে রট্‌-আয়রনের সরু-লম্বা স্ট্যাণ্ডের ওপরের তাকে রাখা বাবুলের দেওয়া সেই উপহার, রোদ্দুরে চকচক করছে সোনার কেল্লার পাথরে তৈরি ছোটো টব। মাথা তুলে আছে সজীব সতেজ সেই সাক্যুলেন্ট – বাড়বৃদ্ধি ঘটেছে, স্ফীত স্থূল পাতার সবুজের পরিধিতে লালচে আভাস। শক্ত প্রাণ, এতদিন জলটল না পেয়ে দিব্য আছে। লিপিকা এমনিই তাকিয়ে থাকে। আর কোনো গাছ রাখেনি সে, পোষ্য বাড়ানোর ইচ্ছা নেই। কলকাতায় ফিরেই অ্যাকোয়ারিয়াম ফেরৎ নিয়ে এসেছে, অনেকগুলো মাছ মারা গেছে। এঞ্জেলদুটোও খুব প্রিয় ছিল, একটাও নেই। সলমন আছে ঠিকঠাক যদিও লিপিকার মনে হচ্ছে রোগা হয়ে গেছে। নন্দন নামে ছেলেটি নিজে এমন অপ্রস্তুত ছিল, ভীষণ রাগ ও দুঃখ সত্বেও চুপ করেছিল সে। ভেতরে-ভেতরে অপরাধী হয়ে পড়ছিল।

স্বাস্থ্যবান হাসিখুশী বাচ্চার মতো কোলের ওপর রোদ এসে পড়েছে। চোখ বুজে তন্দ্রা আসে, ঢুলে পড়ে, ঘুম আসে না।

দিল্লী গিয়ে বাবুলের চিত্তগত অস্থিরতার কারণ জানা হয়েছে, সমাধান হয়নি। তিনজনে নয়ডা গিয়েছিল মণীষার মেয়েকে দেখতে। শোভনের অসুস্থতা জানিয়ে প্রথমটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিল, সম্ভব হল না। আগে থেকে কথা দেওয়া, না শুনে অসন্তুষ্ট হচ্ছিল মণীষা। লিপিকা বাবুলকে জিজ্ঞেস করেছিল,

--বল্‌ তুই, তোর মতটা আসল। পরশু রাতে মণীষা ফোন করেছিল। ওর হাসব্যাণ্ড এসেছে হলদিয়া থেকে দেখা করবে বলে।

--অ্যাজ ইউ ডিসাইড মা, আনএবল্‌ টেকিং ডিসিশন।

শনিবার সন্ধেয় সোজাসুজি মা-র চোখে চোখ ফেলে বলে, আরও একপ্রস্থ হালকা হয়েছিল ছেলে। বরাবর যেমন ঘটে থাকে – মা যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে।

লিপিকার অসহ্য লাগছিল, ছেলের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়েছিল। ছেলেটা অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত স্ট্রেস নিয়ে ফেলছে। আলগাভাবে বলেছিল,

--দেখো বাবুল মন থেকে বলো। মণীষা রাগ করছে, তবে তোমার আপত্তি হলে বারণ করে দেবো।

--ইটস আপটু ইউ মা, বললাম তো। টুমরো উই মে গো!

--ঠিক আছে।

ছেলের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত পুরোপুরি লিপিকার ওপরে এসে পড়ছে, মন অস্থির অস্থির।

 

শাম্ভবী নামের মেয়েটি অত্যধিক সুন্দর! পোড়ামাটির মতো লালচে গায়ের রঙ, চোখ-নাক-ঠোঁট মুখের আদল অবিশ্বাস্য নিখুঁত। পাতলা চেহারা কিন্তু রোগা নয়, সুঠাম। প্রথম নজরে দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো, কিন্তু লিপিকার মনে হচ্ছিল কী যেন অভাব আছে। মণীষা সুন্দর ছিল কলেজ-জীবনে, কমনীয়, উচ্ছল, অনেকের মধ্যে আলাদা করেই চোখে পড়ত। এখন ফুলে-ফেঁপে একদা-সুন্দরী মধ্যবয়সী ধনী গৃহিণী। মণীষার স্বামী প্রশান্তকে বিয়ের সময়ে একবার দেখেছিল লিপিকা, মনে ছিল না। বলল,

--পিতৃমুখী কন্যা!

--হ্যাঁরে, পুরোটাই।

মণীষা আপ্লুত। শোভন বলে উঠল,

--মূর্তির মতো সুন্দর!

লিপিকা একপলক শাম্ভবীর মুখ দেখল। পাশে বসে বাবুল নিজের পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। অসম্ভব খারাপ লাগছে, কান আগুন হয়ে উঠছে। ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারলে বাঁচত। কষে গালি দিল নিজেকে, কেন আসতে রাজী হল? উলটোদিকের আসনে শাম্ভবী, দৃষ্টির তরঙ্গ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। শাম্ভবীর বাবা দু-একটা প্রশ্ন করছিল বাবুলকে। ভারী কড়া আওয়াজে কর্তৃত্ব, ইগো – ভালো লাগল না লিপিকার। পারিবারিক বিত্ত, নিজের উঁচু-পদ আর কন্যার রূপ ও মেধা নিয়ে উন্নাসিক ভদ্রলোক। মণীষা আন্তরিক হাসিমুখে বলল,

--পাশের ঘরে গিয়ে দু-জনে পরিচয় করে নাও না হর্ষ।

শাম্ভবীর চোখ দেখল লিপিকা, বাবুলকে আলতো ঠেলা দিয়ে ছোট্ট করে বলল,

--ওঠো, যাও।

বাবুলের অদ্ভুত চোখে তাকাল, মা-র আদেশ অমান্য করল না।

ফেরার গাড়িতে নীরব তিনজনেই যেন ‘পাত্রী-দেখা’র ঘটনা না ঘটলে ছিল ভালো। যেমন চলছিল সব ঠিকঠাক ছিল। শোভন বলল,

--কত ঠাণ্ডা পড়ে গেল এরই মধ্যে!

লিপিকা ব্যাগ থেকে শোভনের গরমজামা, টুপি বের করে দিল। বাবুল দেখল, মনে মনে বলল,

--বাবা তুমি খুব লাকি।

 

অবেলার শেষ রোদটা নেশার মতো, আলসেমি ধরেছে লিপিকার, ব্যালকনি থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না।

শাম্ভবীর ফ্ল্যাট থেকে ঘুরে আসার তিনদিন পর মণীষা ফোন করেছিল। বাবুল সেদিন ছুটি নিয়ে বাবা-মাকে দিল্লীট্যুর করিয়েছে, বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী লালকিলা থেকে নিজের পছন্দের দিল্লীহাট। শোভন ভারী খুশী,

--চমৎকার সাজিয়েছে দেখছি শহরটা।

মণীষা লিপিকার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিল – হর্ষকে ওদের পছন্দ হয়েছে, অতএব শুভস্য শীঘ্রম। লিপিকা উদাস,

--এত তাড়াহুড়োর কী আছে রে?

--না-রে বাড়ির বাইরে একলা থাকবে মেয়ে, আমি তো ভয়ে মরে যাই। ঘরবাড়ি ফেলে আর ক-দিন থাকতে পারবো? আর বয়সও যে ধরধর করে বেড়ে যাচ্ছে! বিয়েটা সময়মতো দেওয়া বাপ-মা’র দায়িত্ব কি না বল?

--ছাব্বিশ বললি না? আজকাল এত জলদি কে বিয়ে করে? আচ্ছা আমি ছেলের মত জেনে তোকে জানাচ্ছি।

লিপিকা জানত বাবুল নিজে থেকে বলবে না। কলকাতায় ফিরে আসার আগের দিন খাওয়ার পরে বাবুলকে ডেকে কাছে বসাল। শোভন শুয়েছিল বিছানায়, অল্প ধকলে বিশেষ কাহিল হয়ে পড়েছে। লিপিকা দুশ্চিন্তা চেপে স্বাভাবিক থাকে। জানতে চায়,

--আমাদের বেশ লেগেছে শাম্ভবীকে। শান্ত, ম্যাচিওর, ইন্ট্রোর্ভাট মনে হল—,

--হুঁ-উ।

--তুই তো কথা বললি আলাদা করে?

বাবুল উত্তর দেয় না, গোঁজ হয়ে বসে থাকে। শোভন আস্তে-আস্তে নিজের হাতটা ছেলের পিঠে রাখে, ছোটো-ছোটো আদরের চাপড় মারে। এইতো তিনজনের ছোট্ট ইউনিট, হাসিখুশী খোলামেলা ছেলে তাদের, তার বউ! নতুন মানুষ আসবে, নতুন আরেকটা ইউনিট তৈরী হবে। বাবুল বাবার আদরে গলে যায়, বাবার দিকে ঘুরে হাসে,

--কী হল বাবা?

--মাটির মূর্তির মতো—কী সুন্দর!

--উঁ? হুঁ-উ।

--তুই কী বলিস?

--তোমরা যা ঠিক মনে করবে বাবা, আমি তো বলে দিয়েছি।

--সে আমাদের কালে এমন হত। এই যেমন তোর মা-র ইচ্ছের বিরুদ্ধে আটবছরের বড়ো বুড়োর সঙ্গে তার বাবা—,

লিপিকাকে বিব্রত করার সুযোগ নিয়ে মিটিমিটি হাসে শোভন। লিপিকা ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে বলে,

--বাবুল!

--আমি টাইম চাই মা, আই নিড্‌ মাচ টাইম।

--জানি। প্রাইমা-ফেসীটা বল যাতে মণীষাকে কিছু অন্তত বলতে পারি।

বাবুল থমথমে মুখে নীরব থাকে। লিপিকা টুকটাক হাতের কাজ সারে, সুটকেসে জিনিস ভরে। তার মন বড়ো ভার হয়ে আছে, বাবুলের মত জানা নিতান্ত প্রয়োজন। অনেকক্ষণ পরে বাবুল মুখ খোলে,

--এভাবে হবে না মা।

বাবুল অনুভব করে তার পিঠে শোভনের হাত শিথিল, ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা। সে সামান্য গলা ঝাড়ে, লিপিকার দিকে তাকায়,

--শী ইজ্‌ নট্‌ মাই টাইপ মা।

--বুঝিয়ে বলো।

--ওয়েস্ট বেঙ্গলের বাইরে থাকেনি কোনওদিন। ডোন্ট টেক ইট্‌ আদারওয়াইজ্‌, শী’জ্‌ টিপিক্যালি বেঙ্গলি।

--এটা কোনও কারণ হয়না বাবুল, অ্যাডজাস্ট করে নেবে।

--কত অ্যাডজাস্ট করবো? আমি দু-জনের কথা বলছি। শী ইজ্‌ ভেরি স্টুডিয়াস এন্‌ সিরীয়াস্‌ টাইপ, টু মাচ্‌ ফণ্ড অব লিটরেচর – বেঙ্গলি ইংলিশ বোথ্‌। আমাকে জিজ্ঞেস করল, কোন পোয়েটের লেখা ভালো লাগে? আমার সাফোকেশন হচ্ছিল মা।

লিপিকা বোঝে, কথা না বলে চুপ করে থাকে। নিশ্চিন্ত লাগে যেন মেঘ কেটে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে। হর্ষ মা-র নীরবতার অর্থ ধরতে না পেরে খানিক মরিয়ার মতো বলে,

--তুমি কী ভাবছ আমি জানি! তোমার বন্ধু এন্‌ অল্‌ দ্যাট—কিন্তু শাম্ভবীর পেরেন্টসের মতো আমাকে ফোর্স করবে না আই হোপ্‌!

--কী?

--শী হ্যাজ্‌ সামওয়ান!

--কী?

--হ্যাঁ মা, ওর বাবার ভয়ে সায়লেন্ট আছে। ওর ক্লাসমেট ছিল, ইংলিশ লিটরেচর নিয়ে পড়ে কোথায় একটা কলেজে পার্ট-টাইম পড়াচ্ছে। পি-এচ-ডিতে এনরোল করেছে। বাট্‌ নট্‌ ফ্রম আ রিচ্‌ ব্যাকগ্রাউণ্ড!

--কী বলছিস? দশ-বারো মিনিটে এত কথা বলেছে তোকে?

--হ্যাঁ মা। ও তো ওয়েট করছিলই বলবে বলে। আমার বিষয়ে কিছু জানতেই চায়নি, আমিও বলিনি।

--মাই গড! কিন্তু তোকে কেন রে?

--জানি না। বলল যে আগের দুটো রিস্তা ‘স্প্যাম কল্‌’ করে এণ্ড করে দিয়েছে। ওর বাবাকে প্রচুর ভয় পায় দেখলাম। সবাই কি আর আমার বাবার মতো?

হেসে ফেলল বাবুল, লিপিকাও হেসে ছেলের মাথায় চাঁটি মারল,

--যা শুয়ে পড় গিয়ে।

 

(ক্রমশঃ)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন