কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১ মে, ২০১৯

সুবীর সরকার




উত্তরকথা



(৭৬)


হাট আবহমানের। হাট চিরন্তন। হাটের কোলাহল থেকে সরে এসে হেরম্ব নেমে যাচ্ছে মাঠঘাটের ভিতর। দোলাজমি অতিক্রম করছে সে। অতিক্রমণের নির্দিষ্ট কোন মাপকাঠি না থাকলেও দ্রুতগামী হবার সমূহতর সম্ভাবনা হেরম্বকে তাড়িত করে। একা হতে হতে একসময় সে একাকীত্ব সংশয় ঝড়জল ও ঘামের নোলক ঝোলানো মদিরতায় মেদুর সত্যকথনের পাশে গলা ঝাড়ে। ফাঁকা ফাঁকা পাথারবাড়ির পথ ভাঙতে ভাঙতে কাশিয়াঝোপ ভাবনাবন আল আলি গলিপথ সরাতে সরাতে একসময় জাতীয় সড়কের মসৃণ ঝকঝকে পিচপথে উঠে পড়ে। এইভাবে ঘটনার কালপরিসীমা দ্রুততায় অতিক্রম করতে করতে হেরম্ব হাওয়ার বিরুদ্ধে নিজস্ব এক শোকসংগীত রচনা করতে চায়। যদিও জলাভূমির আবেষ্টনী তাকে আটকে রাখতে চায়। অথচ অবিচল নির্বীকার হেরম্ব জলাভূমির পাশে পাশে, একদা মহিষেরা গা ডুবিয়ে থাকতো যেখানে আশ্চর্যতায় হেঁটে যেতে থাকে। হাটপর্ব অতিক্রান্ত না হলেও আগামীর কোন আসন্ন ঝড়জলক্লান্ত হাটের অভিমুখেই হয়তো অনির্দিষ্ট এই যাত্রাপথ। পথ পথের মতো, পথের টানেই এগিয়ে যাওয়া।সাবলীল হতে পারাটা অসম্ভব তবু হেরম্ব মাদকতাময় হেঁটে যেতেই থাকে। হেঁটে যাবার ভঙ্গীতে আদ্যন্ত এক জীবন ধরা থাকে, তবু নদীতীরবর্তী অঞ্চলগাঁথায় সুরতাললয়হীন ব্যপ্ততায় কবেকার সব হাটবন্দরের প্রচ্ছায়া এসে জড়ো হয়। জমাট বাঁধে, যদিও নদীমাতৃকায় পলিমাটি পীড়িত এক সমাহার এসে যাবতীয় অন্ত্যজ উপকরণের ঢেউভাঙা আবিলতা এসে আবহমানতা লিখে রেখে যায় আর নকশা চাদরের অনবদ্যতা এড়িয়ে দিনের পিঠে দিন যায়, অতিক্রান্ত হয়। যদিও কাদামাটি লেপা জীবনের গভীরে স্পর্শযোগ্য বিভ্রম এসে যুক্ত হতে থাকে আর দ্বিধাদ্বন্দ এড়িয়ে পুনর্বার আকাশ মাটি জলের তীব্র সহাবস্থান নিয়ে সংহত হতে থাকে কত রকমের সব হাট।





(৭৭)


হেরম্ব কি উপকথা মিথ ভেঙে আসা মানুষ? তবে কেন সে হাটে হাটে নদী নালা মাঠে মাঠে ঝোপঝাড়ে ঘুরে বেড়াবে! আত্মপরিচয় খুঁজতে খুঁজতে ক্রমশ সে এক সংকটের আবর্তে জড়িয়ে যাবে। কত কত মানুষ, প্রান্তিক ধানপথ, রোদবৃষ্টির কোরাসের মধ্য দিয়ে তার ধারাবাহিকতা না থাকা ধারাবাহিক আত্মভ্রমণ। একটা পর্বে সে চরাঞ্চল পেরিয়ে যায়। মোল্লাবাড়ির দিকে এগোতে থাকে। চাষাবাদে ব্যস্ত সব মানুষজন তাকে চোখ তুলে দেখলেও দেখার ভিতর ব্যস্ততা বা বিভ্রম থাকে না, যেন চিরচেনা দৃশ্য যে রকমটা কাছেপিঠের সব হাটেই হয়। অভিজ্ঞতার ভিতর দাঁড়িয়ে থাকাটা বড় কথা নয়। অভিজ্ঞতার দিকে ভেসে যাওয়াটাই সারসত্য। ভিতরবাড়ির এগিনা হোক, বাহিরের খোলান হোক সে সব মুখ্য নয়; মেয়ে বউরা ধান ঝাড়ে ঢেকিপাড় দেয় চিড়া কোটে, ধান সেদ্ধ করে গুনগুন বা সমবেত গানও গাইতে থাকে কখনো প্রান্তসীমায় আকাশ ভেঙে নেমে আসা বৃষ্টির মতো এসবই চিরকালীন, প্রদীপ্ত। প্রদীপ্ততার আবেশটুকুও লুপ্ত হয়ে গেলে আর কিছুই ধারে কাছে থাকে না।হেরম্বের যাত্রাপথে কিছুই কি আলোড়ন তোলে না?দ্বিধাহীন নির্বিকার হেঁটে যাওয়াটুকু থাকে তার মসজিদ,বনভূমি,হাইরোড,কবরখানা,চা-বলয়,আদিবাসী পাড়া,পূর্ববঙ্গ কলোনি,বর্মণটাড়ি,পর্যটক,কাঠের বাড়ি,জোড়াশিমুলগাছ সব,সবকিছু সে অতিক্রমণ করতে থাকে দু’দশ একশ দুশ বৎসরের কালখন্ডে সে তার সমগ্র অতিক্রমণটুকু ধরে রাখতে চায়।হেরম্ব কি ক্লান্ত হয় না!খেঁজুরপাতার চাটাই বিছিয়ে তার কি জিরিয়ে নেবার সাধও জাগে না! বিষাদের বিষণ্নতার, অবসর থাকা না থাকার পৌনঃপুনিকতায় মেঘগর্জনসম বর্ষানদীর প্লাবনপর্ব স্মৃতিবিস্মৃতি হয়ে জেগে থাকতে চায়। উপকথা মিথ ভেঙে হেরম্ব কেবল হেঁটে যেতে থাকে বাঁশবাড়ি লাইন, কলাবাগান, পাইকারকুঠি, ধানকল, কামতাপুরের মিছিল ওঠা কোন এক হাটগঞ্জের দিকে।

সমস্ত কিছুর ভেতর হেরম্ব থাকে।থাকা না থাকবার উপকথার শূন্য এক বৃত্ত রচিত হয়। যেন বাস্তব থেকে পরাবাস্তবতার দিকে চলে যাওয়া। যাওয়া বলে কিছু হয় না, হতে পারে না। অনেক অনেক নদী অনেক অনেক মানুষজন মিলে একধরনের যাদুবাস্তবতা তৈরী করে। হেরম্বকে কিঞ্চিত উঠে দাঁড়াতে হয়। দাঁড়াবার ভঙ্গিটা ঠিকঠাক হয় না, এটা সে বুঝতে পারে। আর অতিসত্বর হাঁটা শুরু করে। গন্তব্য ঠিক না থাকলেও আসলে সে কিন্তু একধরনের গন্তব্যই প্রত্যাশা করে। উপকথা ভেঙে ভেঙে মিথের ভিতর আত্মগোপন করা আর ইচ্ছে সত্বেও হয় না। কেবল মাঠঘাট, ঘরবাড়ি,গাছপালা, ঝোপঝাড় এসবের সম্মিলনে জীবন খোঁজবার চেষ্টা। জীবন আদতে কী? আদিঅন্তহীন এক ভ্রমণসংগীত! হেরম্ব হেঁটে যায়, হেঁটে যেতে থাকে। এটা কি আত্মভ্রমণ! জীবনের অর্থ খোঁজার আপ্রাণ প্রয়াস। পুরনো সময় থেকে ঘোড়াদল ছুটে আসে, বিরতিপর্ব শেষ হতেই বিস্তৃতি ফুরিয়ে বিস্তৃতির ঢালেই নেমে যাওয়া। গন্তব্যহীন অফুরান সময়যাত্রায় তালগোল পাকানো পরিপার্শ্বটুকু উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে পারে এমন সম্ভাবনা দুঃখকষ্ট ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে আসে। অগণন পাখি ওড়ে। গান ভাসে বাতাসের ভিতর। উপকথা দুমড়ে মুচড়ে খাবি খাওয়া মাছেদের মতো মৃতপ্রায় হয় আর আকাশ ভেঙে উপচানো আলো তার সময়যাত্রার প্রাথমিকটুকু সীমায়নে বাঁধা পড়ে; তবু মশামাছির দুর্গন্ধময় উপকথায় ধারালো অংশটুকু কখন যে ধারালো বল্লম হয়ে হত্যাকান্ডের মতো উদ্যত হতে চায় সেকথা হেরম্ব জানে না। সে কেবল পারিপার্শ্বিকতায় হাতড়ে বেড়ায় মহামহিম এক জীবনগাথা। স্বপ্নবৃত্তান্তের পর্ব থেকে পর্বান্তরে বৃত্তান্তের হাঁসগুলি মেঠোপথে নেমে আসে, মেঠো ইঁদুরের সাথে এক আবশ্যিক সান্নিধ্যতায়। এরকমভাবে বৃত্ত ভাঙা, বৃত্তরচনার খেলা চলতে থাকে। সমস্ত কিছুর ভেতর হেরম্ব থাকে, তাকে থাকতেই হয়; সে থেকেই যায়।

বদলে যাওয়া নদী কিংবা বদলানো নদীখাত সংযোগসূত্র হিসাবে যুক্ত হতে পারে সংযুক্তির অধঃক্ষেপটুকু দোলাচলে থেকে যায়; এমনটা হয় হতে থা তবু আকাশের নেমে আসা নদীবুকে আশ্চর্য এক সুবর্ণ ক্যানভাস। নদীখাতের উর্বরতায় পলিসঞ্চিত শষ্যহিন্দোল নদী নদী দিয়ে বয়ে যাওয়া আবহমানের ইতিহাস হয়ে কিংবা ইতিহাসের গর্ভ থেকে নতুনতর নবীকৃত স্তরে স্তরে সাজানো আঞ্চলিকতায় ডুবে যেতে চায়। খাত বদলানো নদী হাট ঘাট বদলে দেয়। মানুষের চলাচল থেকে জেগে ওঠা চরাঞ্চল আদি ও অন্তের অদ্ভূত এক সহাবস্থানই রচিত হয় হয়তো। গোপন গানের মতো নিজস্ব মন্ত্রের মতো গতিহীন হয়ে যাওয়া না যাওয়ার প্রাসঙ্গিকতায় আলোআধাঁরি কুয়াশাকুহক কেটে হেঁটে যেতে থাকে খুটুরাম প্রধানী আব্রাহাম মিনজ এতোয়ারী এক্কা জঙ্গলে পাতা কুড়োতে থাকা পুষনী রাভার দল। এক খাত ছেড়ে নতুনতর সদ্যরচিত নদীখাতে নাব্যতায় দাঁড়িয়ে অপলক দেখে যাওয়া নতুন নতুন জনপদ চা-খেত গরু মোষ হাঁস মুরগী উঠোনের কইতর এতসবের সাবলীল গার্হস্থ্যযাপনচিত্র। ছবির মধ্য দিয়ে হাসি হুল্লোড় ও শব্দাবলী গড়িয়ে নামে স্থিরতর না হতে পেরে দৈনন্দিনতায় মিলিয়ে যায়। রহস্যমতার বিন্যাসটুকু জমে যাওয়ার অবকাশই হয়তো পায় না, কেবল সর্টকাটে ঝাড়ঝোপজঙ্গল পেরোয়। নদীর ব্যপ্ততার গড়ানে আবশ্যিক এক ভবিতব্যের অমোঘ সম্ভাবনা স্ফূরিত হতে থাকলেও নদীর দুপাশে তালনারকেলসুপারীর অন্তরঙ্গতায় জনপদটাই প্রাধান্য পেয়ে যেতে থাকে। এরকমভাবে হয় না,হবে না জেনেও সাহেববাড়ির প্রাচীনতায় প্রবীণ কোন গ্রন্থের মতো জাপটে ধরতে চায়। অথবা মাইল মাইল বেতবাঁশবন থেকে অপ্রাকৃত সব সুর ও স্বর ধেয়ে আস্তে চায় সম্ভাবনাকে উস্কে দিতে চেয়ে। সমূহতার ধারাবর্ষণে যুক্ত হতে গিয়ে শেষপর্যন্ত বদলে যাওয়া নদীখাতগুলিই অনিবার্য হয়ে জেগে থাকে দূরবর্তীতায় চেয়ে থেকে থেকে।




(৭৮)


কান্না কি গানের মতো মহিষের দুলুনি সওয়ারী চালের বিষণ্ণ এক গান অনেক  অনেক গানটুকরোর ছড়িয়ে পড়া চারপাশের নৈঃশব্দে। নিশি পাওয়া ভূতগ্রস্থ মতো গান প্রসারিত হয়,আবর্তিত হয়,পাক খায় আর ধুলো ওড়াতে ওড়াতে প্রবল ঢুকে পড়ে জমজমাট হাটের বৃত্তে। হেরম্ব দাঁড়িয়ে থাকে সবজিহাটা ও গরুহাটির সংযোগরেখায়তার সাথে খুটুরাম প্রধানীর দেখা হয়। খানেক কথাবার্তা, মুচকি হাসির বিনিময়ও হয়। বিনিময়পর্ব সমাপ্তীর আগেই ঘটনাস্থলে দলবল সহ এসে পড়ে খড়ম জোতদার তার অতিকায় মাথা কচুপাতের মাথাল কাঁঠালকাঠের সর্পমুখী জোড়া খড়ম সমেত। এখন জোতদারী নেই তবু খড়ম জোতদারের জোতজমি ও পঞ্চায়েতি আছে। আছে কুষাণ লোকগানের দল। হাটগুলোতে জনসংযোগ,লোকসংস্কৃতি ও বিনোদন সবই একযোগে সেরে নেওয়া যায়। দোতারার ডোল ডোল ডোল ডং সুরটুকু আবহবিস্তারকারী উপকরণ হয়ে তীব্রভাবে থেকে যায় গোটা হাটেই; কুশাণের সুর ভাসে,হাটকে জড়িয়ে রাখে,জমজমাটও! এভাবে হাটে হাটে আলোড়ন জাগেহাটের শ্রেণীচরিত্র বিভাজিত হতে গিয়েও নতুন এক কার্যকারণের পাকেচক্রে অস্থির প্রতিপন্ন হয়,হয়ে পড়ে। হাটের পাশে হাট। হাটের মধ্যে কতরকমের হাট। সবজিহাটির কোণাকোণী হেরম্ব ও খুটুরাম দাঁড়িয়ে থাকতে না চাইলেও ঘটনাক্রমের প্রাসঙ্গিকতায় তাদেরকে দাঁড়িয়েই থাকতে হয় যতক্ষণ না জলধোয়া বসুনিয়া গামছাবান্ধা দই শালিধানের চিড়া নদীখাতের খই নিয়ে হাজির না হয়। বিকেলের আকাশ সমস্ত প্রাকৃত রঙ মুছে ফেলতে ফেলতে সমূহ সম্ভাবনার সম্ভাব্যতায় অপরূপ নশ্বরতাময় সকরুণ এক দিনাবসান চিরকালীন জলছবির মহার্ঘ্য ও সংরক্ষণযোগ্য এক স্মৃতিজাগানিয়া মহাজগৎকথার আলিসায় হাটের বিষাদের পরতে পরতে গানের মতো মহামহিম হয়ে উঠতে থাকে।
ঘরের মধ্যে ঘর।ঘরবাড়ির বিন্যাসে অগোছালো এক ভাবভঙ্গী বিন্যাসের সামান্য অদলবদলেই অগোছানোটা অনায়াসেই সুসজ্জিত সাজানো পথঘাটের রূপধারণ করতেই পারে।চরাঞ্চল থেকে রাত্রির খুব মাঝামাঝি থেকে জল ছুঁয়ে পাক খাওয়া বাতাসের অসামান্য মৃদু এক মন্থরতা সমস্ত সংজ্ঞার তীব্র বদল ঘটিয়ে দিয়ে যাবতীয়তাটাকেই সংজ্ঞায়িত করে তোলে।চর কিন্তু চিরস্থায়ী নয়,কোন না কোন চরকে সামগ্রিকতা সহই তলিয়ে যেতে হয়,ডুবেও যেতে হয়।আবার নুতন নামের ধারাবাহিকতাকেই অব্যাহত রাখে।এখানেই তো রহস্য।রহস্যের স্থবিরতাকে সচল করে তুলতে পারলেই পুর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের ডুবে যাওয়া চরের ফিনিক্স পাখির মতো পুনরুথথান।সাদৃশ্য অসাদৃশ্য তখন আর কোন বিতর্কের বিষয় হতে পারে না।বিষয়হীনতাই ঘরের মধ্যে ঘরের ভিতর কেবল অন্তহীন সব ঘরবাড়ি ঢুকিয়ে দেয়।নমোপাড়া যূগীপাড়া ঢুলিপাড়া দিনাজপুর কলোনী বামনপাড়া কাঁসারীপাড়া যাবতীয় সব টুকরোটাকরায় যেন ফেলে আসা এক দেশ হয়ে পুননির্মিত হতে চায়।হতে পারাটা সম্পূর্ণ না হলেও হতে চাওয়াটাই অনায়াসসাধ্য এক যৌথতা এনে ফেলে।যৌথতার শর্তসাপেক্ষ সামর্থের বিচিত্রতরতার ব্যাপ্ত সময়পর্বের ভিতর আবহমানের সব চরাঞ্চল ঘরবাড়ি আমোদপ্রমোদ পাশাখেলা স্মৃতিময়তা নিয়ে অনিশ্চিত ললাটলিখনের মতো জীবনের খন্ডে খন্ডে ভঙ্গ বিভঙ্গের মরমিয়া গানের আবহের নৈকট্যের সারাৎসার হয়ে গন্ডীর ভিতর গন্ডী ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া পেশীময় স্মৃতিময় প্রাবল্যের দোলায় দোলায় ভাসে।ভাসতেই থাকে।ভেসে যায়।এত এত জটজটিলতায় সূর্যোদয় সূর্যাস্ত চাঁদ ও অন্ধকার সবই নিজস্ব অধিকারে মর্যাদায় ঘরবাড়ির বিন্যাসটুকু এলোমেলো করে দিতে থাকে জীবনের জরুরীতম কার্যকারণসূত্রে।
অতিক্রমণের এক পর্বে হেরম্ব পরিচিত অপরিচিত নিসর্গের গমখেত ধান পাট তামাক তালগাছ নারকেলসুপারীর সারি_ এসবের মহামহিম গাম্ভীর্যময় অস্তিত্বের সামনে এসে দাঁড়ায়।তার দাঁড়ানোটা দাঁড়াবার ভঙ্গীটা অতিরাজকীয়।নিসর্গের অতিনিবিড় প্রাণবন্তে স্নিগ্ধতায় শুশ্রূষায় হেরম্ব তার অস্তিত্বের সকল সংকটকাল যেন অতিক্রম করতে থাকে।খুঁজে পেতে থাকে আত্মপরিচয়ের শিকড়বাকড়।প্রকৃতির চিরচেনা দৃশ্যপট অচেনা সব অনুপম মানুষেরা দৃশ্যকেন্দ্রের আধোআঁধারের ঘনঘোরজাত নুতন হতে থাকা মানবশাবকের মহামান্যতাই অর্জন করে ফেলে।অতিক্রমণের পর্ব থেকে পর্বান্তরে যাওয়া আসার শূণ্যশাসিত অংশগুলি থেকে সুর করে যেন পাঠ করে যাওয়া পুরাণপুস্তক আরো আরো পুরাতন হতে থাকা মরজীবন নিসর্গের কিনার ঘেঁষে সদ্য রচিত নিসর্গেরই হাত ধরে নিসর্গকে স্থাপিত করে অনিবার্য নিসর্গগাথার ভিতর।হাট থেকে হাট চরাঞ্চলে ধানবাড়ি গাননাচের হাটের মধ্যে রেখে আসা জলধোয়া বসুনিয়া আব্রাহাম মিনজ খড়ম জোতদারের আধিভৌতিক পৃথিবীর জনপদের সহজিয়া আখ্যানের মরমিয়া আহ্বানের তীব্র অংশগ্রহণ করতে চাওয়া হেরম্বকে কি তবে বনভূমি চা-বাগানের হাট আদিবাসী গ্রাম ময়ূরময়ূরী বাইসন বাঘের ডাক হাতিধরা গান নুড়িপাথরশ্যাওলানদীর সব বন্ধন সম্পর্ক ছিন্ন করে আপাতত অন্য কোন পরিক্রমণের অংশীদার হতে হবে।হেরম্বর তাতে কোন ক্ষয়বৃদ্ধি নেই কারণ তার স্মৃতিকাতরতা নেই;থাকলেও স্মৃতিকাতরতাকে অজস্র স্মৃতির ছায়া উপচ্ছায়ায় সে বিনির্মাণ করে তুলবে ভিন্নরকম কোন স্মৃতিময়তায় মিশ্রিত করে দেবার সহজাত সংক্রমণে।

এই যে জটপাকানো ভূগোল ইতিহাসের ভিতর হেরম্বকে ঢুকে পড়তে হয় একধরণের বাধ্যবাধকতায়,সে ভূগোলবাহিত সময়ের কথক হয়ে উঠতে থাকে একসময়।জীবনের নিজস্ব নিয়মেই এটা ঘটে।এইসব জটপাকানো জটিলতায় হেরম্ব কি দমবন্ধ পরিবেশ পরিস্থিতির অস্বস্তিটুকু এড়িয়ে চলতে চায়;সে কি ইতিহাস ভূগোলের বাইরে খোলা বাতাসের মধ্যে আসবার তাগিদ অনুভব করে।বাধ্যবাধকতার নিঃসঙ্গতায় হেরম্ব ক্লান্ত হয় কিন্তু ক্লান্তি তাকে গ্রাস করতে পারে না,সে আবার বাধ্যবাধকতায় চলে যায়।ইতিহাসের অংশ হয়ে ভূগোলের খণ্ডাংশ হয়ে হেরম্ব নিজের মতোন এক জীবনযাপন বয়ন করতে থাকে।জীবনযাপন্টা জীবনযাপন হয়ে উঠবে কিনা সেই সংশয় গ্রাস করলেও সংশয় থেকে সে আর সংকটের দিকে কিছুতেই চলে যেতে চায় না।এটা কি তবে তার  আত্মগোপন!সে হাট হয়ে ওঠবার গোটাটাই প্রত্যক্ষ করে।হাট থেকে হাটে রাতের বনভূমি অতিক্রম করতে করতে সে প্রতিদিনের প্রতিদিন হয়ে ওঠার পর্ব-পর্বান্তর অগ্রাহ্য করে করে নির্জনতার পথে নির্জন সব সাঁকো ও শালবনের দিকে পা বাড়ায়। সে কি পলায়নের কথা ভাবে; না কি পলায়নটাই তার জন্য পূর্বনির্দিষ্ট। হেরম্ব তার জটপাকানো ইতিহাস ভূগোলের এক জীবনকে জীবনযাপনের ধরাবাঁধার সঙ্গে সংযুক্ত বিযুক্ত করতে থাকে।হয়তো এও এক বাধ্যবাধকতা;তবু সাঁকো হাট নদী নদী দিয়ে সে পুরাণ ইতিহাসের সমস্ত মিথগুলোকে উপেক্ষা করতে করতে অন্য এক মিথ ইতিহাসেরই চমকপ্রদ দৃশ্যায়ন ঘটাতে থাকে।এই পর্বে তার সঙ্গে অফুরন্ত ও জটজটিল সব স্মৃতিকাতরতা কিংবা কাতরতা থেকে চুঁইয়ে পড়া স্মতিরা নিরপেক্ষভাবেই থাকে;নিরুপায় হয়েই অথবা! এভাবেই মিথ হয়ে, পুরাণ হয়ে লোকজীবনের ভেতর ঢুকে পড়তে থাকেন শ্রী হেরম্বচন্দ্র বর্মণ। অবধারিত এক আবহমানতা নিয়েই!








    







     
                                                                                                   




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন