যেভাবে পদচারণায় পঙক্তির নির্মাণ হয় এই কর্কটক্রান্তিতে
আপাতত কুসুমকুমারের নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি বরাবর তাকাইয়া যাহা দেখিলাম, জলের উপর
আপাতত কুসুমকুমারের নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি বরাবর তাকাইয়া যাহা দেখিলাম, জলের উপর
বাতাস খেলিয়া যাইতেছে। তাই কিঞ্চিৎ মৃদু আলোড়ন। একটি নেড়িকুত্তা
লেজ
কামড়াইতে ব্যর্থ চেষ্টায় ক্রমাগত ঘুরিয়া চলিতেছে। একটি শীতকালীন স্খলিতপত্র
আপনমনে কিছুটা আগাইয়া ঘূর্ণায়মান, স্থির, পুনরায় অগ্রসরমান। ইহা সকলই প্রত্যক্ষ দর্শন সঞ্জাত অভিজ্ঞতা। অপ্রত্যক্ষে
প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত, তবু যতদূর কল্পনা ধাবমান, তাহাতে এক এবং অদ্বিতীয়ম বুড়িদি, যিনি কুসুমের
দূরসম্পর্কিত দিদি, দক্ষিণ গালে হস্ত রাখিয়া শূন্যে কীসব লিখিতেছেন। তাঁহার ললাটে মক্ষি বসিয়া আছে দীর্ঘক্ষণ, তাঁহার
হুঁশ মাত্র নাই। এবং একটি অপ্রশস্ত বিছানার উপর এক শীর্ণকায়া বয়ঃস্থা রমণী
শুইয়া আর্তনাদ করিতেছেন। মুখমণ্ডলীতে বয়স
ছাপ ফেলিলেও সহজেই অনুমান করা যায়, তিনিই কুসুমের মাতৃদেবী!
কুসুমকুমার তেমন কেহ নহে। এক নিতান্ত হেজিপেঁজি হয়ত বা! কুকুরে কামড়ায়নি, তাই সে জলাতঙ্ক রুগী নহে। পোকায় কাটেনি, তাই সে গতিশীল। এবং হয়ত সে শব্দের পর ওজন করা শব্দ বসাইয়া কবিতা লেখায় ব্যাপৃত রাখে নিজেকে। কবির ধর্ম অনুযায়ী সে কবি, সফল বা ব্যর্থ! তবে এইক্ষণে সে একটি কিশোরীর পিছু পিছু এত দূর আসিয়াছে আলপথ বাহিয়া। সাথে সাইকেল থাকিলেও তাহাতে সে আরোহণ করে নাই। এ সমস্তই তাহার শিল্পবোধ বা রুচির পরিচায়ক হইলেও, কিশোরী ঘুরিয়া দাঁড়াইলে সে বিকেল পার হওয়া আকাশে চাঁদ খুঁজিতে লাগিল। কিশোরী শীত শেষের গজিয়ে ওঠা সদ্য পাতার মত তার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করিতে গেলেও, হাসিয়া উঠিল। আর বসন্তের সূচনা হইল।
না, তেমন কিছু আর নহে। আপাতত কুসুমকুমার ফিরিয়া যাইতেছে। আকাশ সোচ্চারে
গুরুগুরু মেঘমন্দ্রিত স্বরে সেই প্রথম বলিয়া উঠিল, চললো ছেলে রণে চললো!
ভাঙা
ন্যাশপাতির মত যে খোলশ পড়িয়া রহিয়াছে, তাহা এক প্রেমিক
সাপের! কুসুমের বিক্ষিপ্ত পদচারণায় ঠোক্কর খাইয়া হিস হিসিয়ে সেও বলিয়া উঠিল, চললো ছেলে রণে চললো! বাহিরের আকাশে তখন সন্ধ্যা নামিয়াছে। কিছুদূর অগ্রবর্তী হবার পর সমবেত
ঘরফেরতা পক্ষীবৃন্দও বলিয়া উঠিল, চললো ছেলে রণে চললো!
তখন সন্ধ্যের আকাশ রাতের আঙিনায় প্রবেশ করেছে, বাইরে যা দু একটা নক্ষত্র আপন গরজেই জ্বলে ওঠে,তারাও
চুপি চুপি সংকেত প্রেরণ করে বলে উঠলো, চললো ছেলে রণে চললো।
ইহারপর যাহা হয়! একটা নদী। একটাই। সে বুড়িদি বা আর্তনাদ সমন্বিত মাতৃকারূপী।
অথবা কিশোরী কন্যাসম হাত বাড়াইল। কুসুমকুমার প্রভূত ইতস্তত ভাব লইয়া পা
রাখিলো জলে। আর কীকারণে যেন নদী উত্তাল! কলম ধুইয়া কালি মিশিতেছে জলে।
কবিতা জন্ম লইতেছে খুব ধীর অথচ উচ্ছ্বাসময়!
এই কাহিনীর সহিত রেললাইনে মাথা দেওয়া ছেলেটির কোনো যোগ নাই। কিন্তু
কাকতালীয় হইলেও সত্য যে ঠিক ওই মাহেন্দ্রক্ষণেই ছেলেটি শুইয়াছিল লাইনে মাথা
রাখিয়া। যেন কিছুই হয় নাই! শরীর ঢাকিয়া
যাইতেছিল রক্তপলাশে।
বুড়িদি তখনও কী যেন শূন্যে লিখিতেছিলেন! মাতৃরূপী আর্তনাদ কিছু আগেই থামিয়াছে। পাতারা অবশ্য উড়িতেছে আপন মনে। ঘর গেরস্থালীর পাখি সব এবার নিশ্চুপ। কারণ প্রার্থনা শুরুর পূর্বে নীরবতাই একমাত্র জরুরী অসুখ!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন