পদাবলি ৫
(আমি- আমি
সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার
লেখার পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায় আমাকে পাবেন না। পুরস্কারের বদলে
তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে পদাকে নিয়ে লিখতে। যদি যুগান্তকারী কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত
পদার নাম করে।
পদা— পদাকে
আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন না। গরীব নয়, কিন্তু
গরীব সেজে থাকে। বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয়
পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে
হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে, অসময়ে
হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়।
কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি
জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।
মাদাম তুভোঁ— আদপে
ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে
সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের।
এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে
না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান
করেন।)
মোক্ষদা মাসী হঠাতই আবার দেশে ফিরে গ্যাছে।
হয়ত তাঁর আর কোন বোনপো/বোনঝি’র বে ঠিক হয়েছে। ফলে পদার বে আপাতত মুলতুবি রইল। সে
কিছুটা মুষড়ে পড়েছে বলেই আসছে না কিছুদিন। এদিকে বর্ষাকাল চলে গিয়ে শরৎ এসে গ্যাছে
খাতায় কলমে। কিন্তু বৃষ্টি পিছু ছাড়ছে না। আমি ঘরের
খেয়ে বড় বড় বনের মোষ তাড়াচ্ছি ফুল স্পীডে। তা, যখনই
দু’একবার এই দ্রৌপদীর শাড়ি, থুরি, নিউজ ফিডে চোখ রাখছি, দেখছি
বড় বড় পুজোসংখ্যার বড় বড় লেখক, কবি, প্রবন্ধকার, বড় বড়
মানুষের বড় বড় সাক্ষাৎকার নেওয়ার বড় বড় মানুষজনের বিজ্ঞাপন। তা, আজ এই
গান্ধীবাবার জন্মদিনে মিথ্যে কথা বলি কী করে! খুব হিংসে হচ্ছে বুঝলেন এসব দেখে।
আমি এদিকে এত যে মোষ তাড়াচ্ছি, তার কোন মূল্য
নেই গা? এনারাই সব, অ্যাঁ? এনাদেরই
সব বড় বড়? অ্যাঁ? ইচ্ছে করছে সিলভার পোকা হয়ে এনাদের সব
অক্ষর, আর যত বড় বড় পত্রিকা আছে কুরে কুরে খেয়ে নিই! ইচ্ছে হচ্ছে যত বড় বড়
ওয়েবজিন আছে, তাদের সাইট হ্যাক করে জন্মের তরে বন্ধ করে দিই! দেখুন হিংসে হল
বলেই এত কথা বলতে এলাম এতদিন বাদে। যাইহোক, যত বড়
বড় যা কিছু আছে সব নিপাত যাক এই মুহূর্তে। আমি আবার বনের মোষ তাড়াতে যাই গে। তাও
আবার ইয়া বড় বড়!
কিন্তু সে আর হল কই? পদা হঠাৎ করে এসে বলল, 'ভাই, এ
দুনিয়ায় এত কাশফুল আছে তোর ফেসবুক না দেখলে জান্তুমই না!' আমি ভাবলাম
পুজোর জন্য কিছু বাহানা নিয়ে এসেছে বোধহয়। বললাম, 'জেনেছিস যখন, এবার
বিদেয় হ।' নিস্পৃহতা ওর সহজাত। কিছুই শুনতে পেল না, এমন
ভঙ্গীতে বলে চলল, 'দেখ কাশফুল কাশফুল করছিস তো তোরা! আসলে ওগুলো
বকের পালক পুঁতে ফোটোক দিচ্ছে, সেও বুঝলি না এই ফোটোশপের যুগে!' ' ও আচ্ছা। তাহলে শিউলিগুলো কী?'
'আরে
ওই শিউলিগুলো হল নয়নতারার কালার তুলে দিয়ে।' আমি এরপর আর
কিছু বলার ক্ষমতা দেখাতে পারিনি।
এসবের মধ্যে পুজো এসেই গেল শেষপর্যন্ত। দুনিয়া
পরিষ্কার করে-টরে রাতদুপুরে নিজের কথা খেয়াল হল। নিজেকেও একটু ভদ্রস্থ করে আসব
ভেবে বেরোলাম। তা সে ব্যাটা যে ঘাপটি মেরে ছিল কোথাও, তা তো আর
দেখিনি। ফিরছি যখন, কে যেন পাশ থেকে বলল, 'হ্যাঁ রে, এভাবে
মাথা নীচু করে কেউ? এভাবে গাল পেতে দেয়? ছিছি! তোর থেকে
এটা আশা করিনি! এই যে রাত ন'টার সময় এলি, আর ফিরছিস মাঝরেতে... এতক্ষণ ধরে এই অপমান সহ্য
করলি? ছিঃ!' আমি যেন কানে শুনতেই পাই না, আমি
যেন পদার চেয়েও নিস্পৃহ। ট্রিমড হেয়ার আর পলিশড গাল নিয়ে বাড়ি যেতে যেতে গাইছি... 'এই
পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত পদা বল তো?'
গোপন সূত্রের খবর, পদার মুখ থেকে
উচ্চারিত হলেও ভরসা রাখুন। কাল থেকে আর বর্ষা হবে না। কাল চোখ খুললেই দেখতে পাবেন
নীলাকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের দল। আর মা দুর্গা সেই মেঘের সিঁড়ি বেয়ে, একটা
একটা করে পা ফেলে আমাদের কাছে আসবার জন্য তোড়জোড় করছেন। তিনিও সদলবলে রেডি। আর
আমরাও। তাই আজই বন্ধুদের শারদীয় প্রীতি ও শুভেচ্ছা
জানিয়ে লম্বা ছুটি উপভোগ করার জন্য
প্রস্তুত হলাম।
'পদা
রে! আবার একটা কোশ্ন ছিল।' 'এই সপ্তমীর সকালে আবার কোশ্ন কেন?' 'কোশ্নের
জবাবে কোশ্ন করিস না তো! আচ্ছা বল দেখি, এই যে ড্যাডং ড্যাডং
করে ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে, ওরা কারা আর কেনই বা যাচ্ছে?' 'ও
হরি! এও জানিস না, কলাবউ চান করাতে নিয়ে যাচ্ছে গঙ্গায় পুরোহিত
মশাই।' 'ও আচ্ছা। এবার বল দেখি, এই কলাবউটি কেন
বচ্ছরে একবারই চান করে? ওর গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোয় না? গণেশের কী আক্কেল বল
দেখি! আর বউ খুঁজে পেল না? ছি ছি!' এরপর আবার এক কোশ্ন
করতেই যাচ্ছিলাম, তাকিয়ে দেখি, পদা হাওয়া।
তবে কিছুক্ষণ পরে এসেই আবার শুরু করল — এই পুজোতেও
যারা এফবিতে পড়ে থাকে সারাদিন তাদের মত অভাগা আর কেউ নেই। আর যারা সারাদিন পুজোর
সাজ, অঞ্জলি, খাওয়া, ঘোরা, সেল্ফি
ইত্যাদি পোস্ট করে, তাদের মত হতচ্ছাড়া কেউ হবে না কোনদিন — পদা উবাচ। আমি শুনতে পাইনি যদিও কী সব বলে গেল। তারপর শুনলাম নিজের মনেই
বলে চলেছে মন্ত্র পাঠ করার মতো করে — তোমার দীর্ঘ উ কবে ঘুচবে মাগো? বচ্ছরের
পর বচ্ছর যায়... আমিও বুড়ো হয়ে এলাম প্রায়... ওই দীর্ঘ উউউউউউউ... আমার পেছনে
দুব্বো ঘাস গজিয়ে গেল, আমার উঃ, আমার আঃ... সব
রইল, শুধু ওই ডির্ঘউ... মাগো, এবার অন্তত
মুক্তি দাও!
নবমী কেটে গ্যালো
এভাবেই। 'কাল ঘুম চোখ খুলেই কেউ যদি তোকে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা ইত্যাদি পাঠায়, তুই তাকে কী মেসেজ দিবি
রে পদা?' আমি অত্যন্ত নিরীহ মুখ করে সিরিয়াসলি জানতে চাইলাম। উত্তরে ও কিছুই
বলল না। খানিকক্ষণ পরে বলল, 'ঘুমিয়ে পড় আজ। কাল সকাল থেকে প্রণাম, শুভেচ্ছা আর মিষ্টির ছবি দেখে সারাদিন, সারারাত গদগদ হতে হতে ক্লান্ত হয়ে পড়বি। আজ এনার্জি স্টোর করে রাখ
বরং।' এই প্রথম পদার সঙ্গে সহমত হলাম। বুঝলাম, ত্যাঁদোরটা অতটাও খারাপ না, অতটাও অসহ্য না, যতটা আমি ভাবি। শুভরাত।
দশমীর দিবাভাগে মাদাম
উপস্থিত হইলেন। আজ কিঞ্চিৎ খুশি খুশি লাগিতেছে তাঁহাকে। নিশ্চিত পূজায় অতীব ভালোমন্দ আহারাদি সাঁটিয়াছেন! এক দিব্য
প্রভা বিকশিত হইতেছে তাঁহার বাদামী চামড়া
হইতে। ইহাও কি গোল্ড ফেসিয়ালের ফলস্বরূপ প্রাপ্ত? নিজের কূট চিন্তাকে তৎক্ষণাৎ
ধিক্কার জানাইলাম। ইহার পরে মাদাম নিজ হস্ত তুলিয়া আশীর্বাদের ভঙ্গিমায় আমাদিগকে
উপবেশন করিতে বলিলেন। আর এক হস্তে পূর্ব হইতেই বিরাজিত হইতেছিল এক মিষ্টান্নের
বাক্স। উহা আমাকে দান করিয়া বলিলেন, ‘সুখে থেকো বাছারা!’ আমরা প্রণামে উদ্গত হইলে
উনি হাঁ হাঁ করিয়া পিছিয়া যাইলেন। বলিলেন, ‘প্রতিমা বিসর্জনের আগে বিজয়ার পেন্নাম
করতে নেই, এও জান না তোমরা?’ আমরা সভয়ে পিছাইয়া গেলাম। লাঠি হস্তে গৃহ হইতে নির্গত
হইবার অগ্রে তিনি অবশ্য তাঁহার বাণী ঝাড়িয়া যাইতে ভুলিলেন না। ‘শোন বাছারা! অনেক
মোচ্ছব হল। আজ রাতেও তো কম ফুর্তি হবে না! এরপর আবার তোমাদের নক্কী পুজো... যাই
কর, আর তাই কর, মনে রেখ — উৎসব আসলে এক মিলন মেলা। তোমাদের ফুর্তির সেলফি তোলা বা
পুজোসংখ্যার লেখা নয়। আসল পয়েন্ট থেকে ফোকাস হারিয়ে ফেলেছে বলেই বাঙালির আজ এই
দুরবস্থা!’
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন