কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

সুবীর সরকার

হেরম্বচরিত



   আদ্যধনী

‘হরসুন্দরীর ঢোল বাজে
কিষানকামলার কোমর ঢোলে
টিয়াবালার মুখের হাসি
ভুরুর ভাঁজে ঘাম নামে
খোকাবাবু বড় হোক
মস্ত আয়ুর পাহাড় হোক
চিকন কালা রে
খুশি ভরা জীবন দে
আমরা নাচি আমরা গাই
হিজড়া হইয়া জীবন কাটাই’

গানে গানে ভরে ওঠে আদ্যনাথ ধনীর বাড়ির এগিনা। তল্লাটের মস্ত মানুষ আদ্যনাথ ধনী। তার বড়বেটার বেটা হয়েছে গেল বুধবার। আদ্যনাথের মনে পুলক। শরীরে দ্রুততা। ধনীর বাড়ির এই সুসংবাদ নদী পুকুর খেত পাথার আল বিল পেরিয়ে দিক দিগরে ছড়িয়ে পড়ে। দূর শহর থেকে দলবল নিয়ে চলে আসে টিয়াসুন্দরী। টিয়াসুন্দরীরা ‘বৃহন্নলা’। লোকে যাদের ‘হিজড়া’ বলে। জীবনের স্বাভাবিকতা থেকে অনেক দূরে যাদের অবস্থান। কিন্তু জনপদগঞ্জহাটে ঘুরে ঘুরে তারা কিন্তু জীবনেরই গল্প বলে চলে। জীবনের গান গায়। জীবনবন্দনা করে। যেমন বেটার বেটা হওয়াটাকে উদযাপন করতে আদ্যনাথের বাড়িতে টিয়াসুন্দরীদের গমনাগমন। ভ্রু’তে  কুঞ্চন এঁকে টিয়াসুন্দরী হরসুন্দরী দুলালী ঘগেন্দ্র হিলহজিল খাটুয়া পরাণেশ্বরী কাচাগুয়ারা নাচ করে। ঢোলক বাজায়। সমবেত জনমন্ডলীর দিকে তাদের তীর্যক হাসি। বিদ্রুপ! উপেক্ষা? অপমানের জীবন তাদের। উপহাসের পাত্র হয়ে প্রতিপল বেঁচে থাকতে হয়। আদ্যনাথের ভাই রুদ্রনাথ টিয়াসুন্দরীর হাত ধরতেই রুদ্রনাথের গাল টিপে দেয় টিয়া। হাসির হুল্লোড় ওঠে। ঢোলের বাজনায় দ্রুততা এলে নাচও কিন্তু শৃঙ্খলা হারায়। হিজড়াদের নাচের ভিতর গানের ভিতর চোখের তারায় তারায় এ এক অন্যরকম হিজড়াপৃথিবী। আদ্যনাথ ধনী হিজড়াদের জন্য নানান উপাচার নিয়ে আসেন। টিয়াসুন্দরীর বৃহন্নলাদল তখন খিস্তি খেউড়ের ভরা সভা রচনা করতে করতে গোল হয়ে উঠোনে নেমে আসে। আদ্যনাথের ঘোড়ারা কেশর ফুলিয়ে সতর্ক হয়।

এভাবে কি হিজড়াপুরাণ রচিত হতে থাকে! হিজড়াদের বৃত্তান্ত থেকে নেমে আস্তে থাকে পাখামেলা ব্রিজ। নদী-পুকুর-সাঁকো-সেতু উজিয়ে তাদের ক্লান্তিহীন চলাচল। মহামিছিলের আবহমানতা। টিয়াসুন্দরীর সাড়ে তিন কুড়ির শরীরের পেশীতে তীব্রতা জাগে। সে তার কুঞ্চিত ত্বকের ভেতরে ফুসফুসের ভেতরে গঞ্জগাওয়ের বাতাস ভরে নিলে তার মস্তিস্কের কোষে কোষে স্মৃতিপরায়নতা জাগে। স্মৃতির তাড়সে টিয়াসুন্দরী তার শৈশবস্মৃতির খুব গভীরে আত্মগত হয়। সে ছিল সতীরাণীর দলে। রাইমোহনের দলে। বড়সড় দল। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি দিনাজপুরের গ্রামে গ্রামে কেবল ঘুরে বেড়ানো। তখন জোতদার জমিদারদের আমল। তারা ছিলেন দরাজ ও দয়ালু। হিজড়াদের মানুষ হিসেবেই দেখতেন। সহানুভুতি ছিল। সম্মান ভালোবাসা জানাতেন। সতীরাণী দলবল নিয়ে তাঁবুতে তাঁবুতে রাত কাটাতো। দিনমান ঘুরে ঘুরে তার  কামাইকাজ। চারটি ঘোড়াও ছিল দলে। ‘মাদারির খেলাও’ দেখাত তার দল। টিয়াসুন্দরী এভাবে বড় হতে লাগলো। দেশ ভাগ হলো বড় যুদ্ধ হলো জমিদারী প্রথার বিলোপ হলো আর ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে পরেই বুড়ি সতীরাণীও চলে গেল। দল বিরাটত্ব হারিয়ে ছোট হলো নতুনেরা যুক্ত হলো ঘোড়া নেই। তাঁবু নেই। বর্ণোজ্জল হিজড়াদের যাপনে ছন্দপতন ঘটে গেছে। তবু বাঁচতে হবে। কার বাঁচতে হয়। চোখ মেললেই আলোকিত এক রূপসজ্জার পৃথিবী। টিয়াসুন্দরী লড়াই জারি রাখে। দিন যায়। সময় গড়ায়। টিয়াসুন্দরী শক্তপোক্ত করে ফেলে তার ছোট দলটিকে টিয়াসুন্দরীর বয়স বাড়ে। দিনদুনিয়ার মানুষজন বলে, ‘ঢোলবাজনা ধরি কায় যায়  রো?’
জবাব আসে, ‘টিয়ারাণী যাছে রো। হিজড়ার ঘর যাছে রো’।

তখন বিকেল অতিক্রান্ত। আজ থেকে যেতে হবে আদ্যনাথ ধনীর বাড়ি। সারা রাত আবার উৎসবের জাক বসবে। নাচাগানা আর চটুল সব কথারঙ্গে মুখরিত হবে গাওগঞ্জ। আকাশমাটির পৃথিবীতে দুলে দুলে গান ধরবে দশ কুড়ি হিজড়ার দল-
  শ্যাম কালা ও রে শ্যাম কালা
  ছাড়িয়া দে মোর শাড়ির আঞ্চল
  যায় বেলা,
  বেলা ডুবিলে হইবে রাতি
  সঙ্গে নাই মোর সঙ্গী সাথী
  দেরী হইলে ডাঙ্গাইবে সোয়ামী রে...

গানকে গতি অথবা গীতিময়তা দিতে নাচ আসে। কাঠি ঢোল বাজে। হিজড়েরা এভাবে জন্মমরণশাসিত এক জীবনকেই বুঝি বন্দনা করে। তাদের লিঙ্গ নেই। যৌনতা নেই। যৌনাচারণ নেই। শোক ও শ্লোকের কুয়াশার আড়ালে হিজড়েরা বুঝি মনে করিয়ে দেয়, ‘জীবন মৃত্যুশাসিত। দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙ্গিলা দালানের মাটি’!

এভাবে হিজড়াপুরাণ রচিত হতে থাকে। হিজড়া হয়ে জন্মানোটা অভিশাপ! জীবন পদে পদে অপমান বহন করে আনে। স্বাভাবিকতার একদম বাইরে ব্যঙ্গবিদ্রুপের এক যাপন বৃহন্নলাকূলের। তবুও বেঁচে থাকবার অতিকায়ত্বে শরীরভরতি আকুতি নিয়েই বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকতে চাওয়া। হিজড়াপুরানের পল্লবিত অংশে হাওড়বাওড়্রের হাওয়া এসে লাগে। নদীজলে সামান্য কি দুলে ওঠে ডিঙি! টিয়াসুন্দরী হিজড়াপুরাণকে মান্যতা দিয়েই একপর্বে তুমুল ‘মিথ’-এ রূপান্তরিত হন। আমরা দেখি শুনশান পড়ে আছে হিজড়াদের পদছাপে ভরা আদ্যনাথ ধনীর নিকানো উঠান। বাহির এগিনা।ভিতরের খোলান।



লালমণি পরিবহণ


তখন জেগে উঠতে থাকে গিয়াসুদ্দিনের পৃথিবী। পাছা আইতের মোরগ ডাকে ইমামসাহেবের বাড়ির খোলানে। সারা রাত মাছ ধরে ডিঙি ঘাটায় রেখে জাল গুটিয়ে মাছ ভরা খলাই নিয়ে বাড়ির পথ ধরে গিয়াসুদ্দিন। শরীরে পানিকাদার আঁশটে গন্ধ। সালাইবিড়ি স্যাঁতসেঁতে। বহুবারের চেষ্টায় বিড়ি ধরায় গিয়াসুদ্দিন। আজ মনটা বেশ খুশীয়াল। বহুদিন পর প্রচুর মাছ পেয়েছে সে। সবই পীরফকিরের দোয়া। গান ধরে গিয়াসুদ্দিন- হাউসের মেলা জোড়া খেলা/ধল্লা নদীর কাছাড়ে/ও রে /গুয়াচাচার নাও ফাইনালে...

গিয়াসুদ্দিন,
পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই; মেদহীন কিন্তু শক্ত চেহারা। ইয়াকুব মাঝির মাইঝা
বেটা
বংশপরম্পরায় মাঝিবংশ। বাপ ইয়াকুব, বাপের বাপ আনসারুদ্দিন; যাদের
দাপ ও তাপ ছিল যথেষ্টই।
সে অবশ্য ইন্ডিয়া পাকিস্তান হবার অনেক আগের
কথা।
বাড়ির দুয়ারে এসে গিয়াসুদ্দিন দ্যাখে শামিমা দাঁড়িয়ে আছে। ঝরিমন চুলায় খড়ি গুঁজছে। মনে আনন্দ হলো তার। সত্যি বিবি হিষাবে শামিমার জুড়ি মেলা
ভার।
বেটি ঝরিমনও হয়েছে আম্মুর মতো শামিমা মাছের খলাই নিল গিয়াসুদ্দিনের
হাত থেকে।
ঝরিমন ও ছোট বিটি আফসানা দৌড়ে এলো বাপজান বাপজানবলতে বলতে। আহা, এই না হলে সুখ! সোনার সংসার! শরীরভরা পুলক নিয়ে গিয়াসুদিন তার পৃথিবীতে ঢুকে গেল। আকাশে আলো ফুটেছে তখন। চারপাশে পাখপাখালি, ধানখেতে হলখল বাতাস।

বেলা গেইছে ভাটিট। আওলিয়ার হাট থেকে বুড়িমারি যাচ্ছে সাইকেল চালিয়ে মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। সবাই চেনে খোরশেদ ভাই নামে। লালমণি পরিবহনের বুড়িমারি কাউন্টারের ম্যানেজার। এছাড়া সীমান্তের টুরিস্টদের কাজকর্মও করতে হয় খোরশেদকে। ইণ্ডিয়ার এক ভাইজান আছে যিনি লেখালেখি করেন, তার কাজও করতে হয়। এই যেমন, ইণ্ডিয়ার ভাইজানের এক বাংলাদেশী কবিবন্ধু খালিদ ভাই আজ এসেছিল বুড়িমারি সীমান্তে। খালিদ ভাইকে সঙ্গ দিতে হলো এরপর ট্রেন ধরিয়েও দিতে হলো খালিদভাইয়ের বাড়ি লালমণিরহাটের আদীতমারীতে। এখন পড়াশোনা করছে রংপুরে। খোরশেদ ভাই ভীষণ ব্যাস্ততায় আছে এখন। কাউণ্টারে ভিড় বাড়ছে, কেননা সামনে এইদ। বেশ চাপ। অনেক রাত হয় আজকাল বাড়ি ফিরতে। আর সীমান্তে বি এস এফ-এর বেশ নজরদারী। ভয় লাগে রাতবিরেতে একা একা যাতায়াত করতে।
ধরলা নদীর ব্রিজে ওঠার মুখেই রেজ্জাক ও পুলিশভাই-এর সঙ্গে দেখা।
ওরা লল-ভাইজান, চল বাহে; আজি আইতত বাউরা বাজারত পালা দেখির যাই। ময়নামতির নাচ দেখি আসি চল কেনে, হামরা অংপুরিয়া মানষি। রঙ্গ-রসত বাঁচি থাকি খোরশেদ রাজি হলো মনে মনে ভাবল- বিবিজানক ফোন করি এল্যা কওয়া খায়, আইতত যেন মোর বাদে ভাত না আন্ধে; মাছ না ভাজে। বিহানতে আসিয়া কাউণ্টারত খোয়া খায়
এইসব ভাবতে ভাবতে বুড়িমারি চলে এলো আজি বুড়িমারিত হাট। মেলা  মানসি। দোতরা ডাঙেয়া কবিরাজ আইচ্চে দেখং মেলা দিন পাছত! খোরশেদ  লালমণি পরিবহনের অফিসে ঢুকতেই ইণ্ডিয়ার চ্যাংরাবান্ধা বর্ডারের কাউণ্টারের বিভাস সাহা, মানে বিভাস ভাইজানের ফোন এলো

গিয়াসুদ্দিন থাকে গিয়াসুদ্দিনের পৃথিবীতে। খোরশেদ আলম থাকে তার ভূবনেই।
গান নাচ হাউর বাউড় আবার কূপির আলোয় বাজারহাটের দেশকালের রঙ্গরস ভরা এক জীবন খেলা করে যায়।
ধরলা নদী দিয়ে গ্যালন গ্যালন পানি। গামছাবান্ধা দই। দোতরা বাজিয়ে গান ধরে খইমুদ্দি পাগেলা। পুলিশ রেজ্জাক আব্দুল সিরাজেরা হাততালি দিয়ে ওঠে। কোথাও শ্যাখের বেটির জনসভা হয়। বাদ্য বাজে। বেগমসাহেবার পদযাত্রায় মাতম ওঠে কোনো কোনো হাটে ছিলকা ঘোরে- বান পানি বরসা/ পল্লিবন্ধু ভরসা...
নীলসায়রের বিলে বাইচের নাও ভাসে।
দেশকাল অতীত বর্তমান বাহিত হয়ে   ধরাছোঁয়ার খেলার মতো দিনকালের ধাঁধাবৃত্তে নতুনতর হয়ে ওঠে। খোরশেদ আলম চা খেতে যায় ফিরোজ-এর মরিচহাটির দোকানে। গিয়াসুদ্দিন ঢাকার বাসে চেপে বসে বউবিটি নিয়ে।

লোকপৃথিবীর ভিতর নিশারাত্তিরের স্তব্ধতা। দূরে কাছের কুকুর শেয়ালেরা সুর  মেলায় রাতচরা পাখিদের গানে। বোধাবোধির সকল সীমা পরিসীমা একাকার করে দিয়ে মানুষ তার বেঁচে থাকাটাকে আদ্যন্ত এক চিরকালীনতার দর্শনের সাথে কেমন যেন মিলিয়েই ফেলতে থাকে! হারিয়েই ফেলতে থাকে কুয়াশা-শিশিরস্নাত গাথাশোলকের  অতিজীবিত ট্রমার চলাচলজাত রাস্তাগুলিতে হেঁটে যাবার অতি আবশ্যক বাধ্যবাধকতায়।









0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন