কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

সুমী সিকানদার

বিস্মরণ


ডোরবেল বাজতেই মিষ্টি এক মিউজিক শোনা গেল টুং টাং। ঘরের ভেতর যিনি ছিলেন, তিনি এমনিতে দেরি করে ফেলেছেন, আরো দেরি হবে, কে যেন এসেছে!  দরজা খুলতেই যিনি দাঁড়ানো তার মুখ থেকে চমকে গেলেন গৃহকর্তা মাঘের তুমুল  শীতে বাইরে দাঁড়ানো মানুষটি কাঁপছে। সারা শরীর জুড়ে খুব ঠেসে জ্যাকেট হুডী বুট গ্লাভস এসব পরাশুধু সুন্দর পানপাতা মুখটা ঈষৎ লালচে। বনজবা এসেছে।

কিছু বলার আগেই আমি এসে গেছিঘোষণা দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়ানো সে

‘এসে গেছি মানে?’ ঘরের ভেতর থেকে অস্থির কন্ঠ

‘সত্যি চলে এসেছি। এই দেখ হাতে সুটকেস
!’ বলা বাহুল্য তার হাতে বেগুনী ট্রলি  এবং কাঁধে হ্যান্ডব্যাগ।
‘তুমি এভাবে চলে এলে, আমাকে তো বলনি!’ নিরুত্তাপ কণ্ঠ

‘দেখ শুভ্রআমি সারপ্রাইজ দেবার জন্য এটা করিনি, তুমি জানো। এভাবে না এলে আসা হতো না। এখন চলো, আমাকে খেতে দেব্‌ ক্ষিদে পেয়েছে’

‘জবা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কি তোমার ভাইয়ের বাসায় উঠেছ?  বিস্ময় গোপন না করে সরাসরি প্রশ্ন শুভ্রর।
‘আমার হাতে সময়ও নেই
জব-এ যেতে হবে’

জবা সহজ হবার চেষ্টা করছে... ‘তুমি জব-এ যাও
 আমি নিজেই সব গুছিয়ে নিচ্ছি। কোথায় কি আছে আমি সব জানি তো! প্রতিদিনের দেখা ঘর। সন্ধায় সব বলব তখন। না এসে উপায় ছিল না!’
‘প্রশ্নই ওঠে না। তুমি এভাবে আসতে পারো না!’ মুখের কথা শেষ করতে দেয়নি শুভ্র। 
‘তুমি কীভাবে ভাবলে
 যে আমি মেন্টালি রেডি! আমার তো সময় দরকার ছিল!’
‘এটা তো নতুন নয় শুভ্র!’ বনজবা কথা বলতে পারছে না। তার গলা কিসে যেন  চিরে গেছে। 
‘আজ নয় দু’দিন পর তো আসার কথাই ছিল শুভ্র এমন ভাব করছ যে চিনতে পারছ না!’
 
চোখে পানি জমছে জবার
এখনও বসতে বলেনি শুভ্র।
‘তোমার ছেলেকে কী করেছ?’ সরাসরি চোখে তাকায় শুভ্র।
‘ছেলেকে নিয়ে তো তোমার সাথে কোনো মীমাংসা হয়নি। আর সে তার দাদুর বাড়িতেই ভালো থাকবে’
 একটু দম নেয় জবা‘এখন এসব কথা কেন বলছ শুভ্র? এগিয়ে এসে শুভ্রর গালে আঙুল রাখে। ‘কি হয়েছে তোমার?
‘জবা... লিসনএবার আমার কথা মন দিয়ে শোনো। তোমাকে এখন যেতে হবে’
চিবিয়ে চিবিয়ে রায় শোনাচ্ছে শুভ্র।
‘মানে! এখন কোথায় যাব?
‘কোথায় যাবে সেটা তো আমার ব্যাপার নয়
তোমার ভাইয়ের কাছেই যাও বরং’
জবা একদম চুপ। শতাব্দীর নিস্তব্ধতা তাকে পেয়ে বসেছে। জার্নি করে এসে মাথাটাও ধরেছে খুব। শুভ্র কি একটু বসতে বলবে না?
‘আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ট্রেন ধরতে হবে’
শুভ্র জুতো পরছে।
‘আমি তোমার জন্য সংসার ফেলে এসেছি শুভ্র!’ আর কিছু শোনা যাচ্ছে না, জবা কি যেন বিড়বিড় করে।
‘তোমাকে ফিরতে হবে। কারণ আমার এখানে এভাবে তোমাকে রাখা সম্ভব নয়। আর  সত্যি বলতে তোমার জন্য আমার ইদানিং কোনো ফিলিংস কাজ করে না। আমি বার বার একথা বলিনি? বলেছি। তুমি সব সময় ভার্চুয়ালি কাজ করো, বাস্তব বোঝ না’

জবা চারপাশে দেখছে
, এই তো কোণায় নতুন বুকশেলফটা অনলাইনে সেই পছন্দ   করেছিল। শুভ্র কি খুশী! ‘তুমি দূর থেকে সব সাজিয়ে দিচ্ছ বনজ। আসার আগে ভালো কিছু বই আনবে’দেশী ম্যটেরিয়াল দিয়ে পর্দা, কুশন কভার, নকশি কাঁথার  ওয়ালহ্যাঙ্গিং সব বানিয়ে পাঠিয়েছে বনজবা। তাদের ঘর। একবার ঘরটা তার বসেনি। ছেলে নিয়ে কাটিয়ে দেবে মনস্থির করেছিল কিন্তু আচমকা শুভ্র এসেছে জীবনে। অনিবার্য শুভ্র। এই দুরন্ত ভালোলাগাকে ঠেকাতে পারেনি ওরা কেউ। ঠেকাতে চায়ওনি।

‘এখন এসো, আমি দরজা লক করে যাব’
শুভ্র কঠিনকন্ঠ। 
জবা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে,’ কী হয়েছে সোনা? আমি তো তোমার কাছে এসেছি, আমিই তো আসব!’ তোতলাচ্ছে বনজবা। ‘না বলে এসেছি তাই রাগ করেছ? আমি সব বলছি তোমাকে, দশটা মিনিট সময় দাও। আমি তো...’ থেমে গেল বনজবা
না, ড্রইংরুমে কেউ নেই।
শুভ্র বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করছে। ‘প্লিজ জবা! আমি পরে যোগাযোগ করব। এখন এসো!’
 
ধীরে ধীরে বেগুনী ট্রলিটা ঠেলে ঠেলে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো জবা। সে ঘরে মাত্র  দু’পা দিয়েছিলসেখান থেকেই বেড়িয়ে এলোদরজার বাইরে এসে অবাক হয়ে শুভ্রর দিকে চেয়ে রইলোএখন তো তাদের চা বিরতি নেবার কথাপ্রতিদিন এসময় তারা দু’প্রান্তে বসে চা খায়, গল্প করে।

শুভ্র দ্রুততার সাথে দরজা লক করে এবং তারো বেশি দ্রুত গতিতে টুকরো টুকরো বরফে মিলিয়ে গেল
ট্রলি হাতে দরজার পাশে দাঁড়ানো একা বনজবাবড্ড বোকা লাগছে নিজেকেবড্ড বেসাহারা লাগছে।

হাসপাতালে পৌঁছাতেই ব্রাদার ড্রেস চেঞ্জ করে দিলেন। বেড রেডি করাই আছে, আজ  শুভ্রের ডায়ালোসিসের ডেট। তার একটি কিডনি পুরোপুরি অকেজো
বাকিটাও যাবার  পথে। ঢিমালয়ে কাছে আসতে থাকা সাদা ফ্যাকাশে প্রকান্ড দিন তাকে গ্রাস করে রেখেছে। বনজবাকে এখন কাছে টেনে নেওয়া সম্ভব নয় 

শুভ্রর একা জীবনে জবা এক উত্তাল স্রোত, এক দুরন্ত ক্যানভাস। সেই স্রোতকে সে    আজ বাইরের জলন্ত তুষারের মধ্যে ফেলে এসেছে। নিজেকেই আর বিশ্বাস হচ্ছে না নিজের।


সিস্টার স্যালাইন লাগিয়ে দিলেন। চট করে একটু সুঁই ফোটার ব্যথা আজ যেন তার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ল
 কষ্ট আর ধরে রাখতে না পেরে দু’চোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়াচ্ছে শুভ্রর। আহা হলো না সংসার, তার আর বনজের সংসার। অনুচ্চার শব্দে সে রুদ্ধ কন্ঠে ডাকতে লাগল‘জবাআমার বনজবা, আমার...

ক্রমশঃ জমতে থাকা ছেঁড়া ছেঁড়া বরফের বুকে এলোমেলো পা ফেলছে বনজবা। সাথে চলেছে তার কাপড় ভর্তি অবাক ট্রলি। আচ্ছা তার এই বনজবা নামটা কে  রেখেছিল? মা, নাকি বাবা! ছোটবেলায় একবার মা’র হাত ছুটে ভীড়ে হারিয়ে গেছিলো সে
আজ আবার এই কর্কট শীতলে এই বিপন্ন মানসিকতায় নিজেকে ফের  হারিয়ে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে। ‘মা, শীত করছে মা!’ তুষারের সর্বোচ্চ মাইনাস তাকে শীতল করে না ততটাশুভ্রর দেওয়া অপমানে সে প্রবল বেগে কাঁপতে লাগলসে একগুঁয়ের মতো ট্রলি ঠেলতে লাগল

তার আড়াই বছরের বাবাই কি ডেকে উঠলকিছুদিন হলো কথা শিখেছে ছেলে। সারাদিন মাম্মা, মাম্মা। ‘বাবাই কার ছেলে গো?’ ‘মাম্মার ছেলে’
বাবাইয়ের ক্ষুদি ক্ষুদি দাঁত বার করা হাসি চারিদিকে ঝমঝম বাজছে। কী সুন্দর শব্দ বাবাইয়ের হাসিতে! বনজবা একমনে শুনছে ছেলের ডাক... মাম্মা, মাম্মাশুনতে শুনতে তার হাঁটার গতি বাড়ছে। সে কেবল হাঁটছে আরো হাঁটছে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন