কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

শুভ্র মৈত্র

নীরবতা


তারপরেও সব ঠিকঠাক চলছে, জানিস? যেমন ইস্কুলের ঘন্টা পড়ত নিয়ম মেনে, যেমন পেছনের সারিতে বসা মেয়েরা তৈরি করত খুনসুটি আর কথকতার আবছা মায়াজাল, যেমন বাঁচিয়ে রাখতো নিজেদের, ম্যাডামের দৃষ্টি থেকে -- সব একই রকম। অঙ্কে একশো পাওয়ার স্বপ্ন দেখতি না তুই, যেমন তোর গা ঘেঁষাঘেঁষি করা  মেয়েগুলো কেউ দেখতো নাআসলে তুই তো পারতি না কিছু। অঙ্ক, ইংরেজি —  কিচ্ছু না। এবারেও পাস করবি কিনা সেই চিন্তাটাও আসত একেবারে পরীক্ষা এলেই। বরং সারাদিন গেরস্থালি, মুখঝামটা আর দারিদ্র্যের সাথে এক্কাদোক্কার মাঝে ইস্কুলটাই ছিল আরামের জায়গা, অবশ্য যে ক’দিন আসতে পারতি।  
  
স্যার, ম্যাডামরা কেউ চিনতো না। ঐ হাজার মুখের ভীড়ে চেনার কথাও নয়।  পড়াশোনা বা খেলার মাঠ এমনকি ফাংশান— কোথাও ছিলি না তো! কিচ্ছু পারতি না তুই। যেমন তোর অনেক বন্ধুই পারত না। ছবি বলতে তো সেই ক্লাস নাইনে পড়তে গ্রামের স্টুডিওতে গিয়ে তোলা সাদা–কালোটাই সম্বল। সেটাই দেখতি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আর ইদানীং যখন বিয়ের কথা শুনতে হতো প্রায়ই, তখনও তো ছবি তোলার কথা ভাবেনি কেউ। এসব লাগে না গ্রামে। ঠিক চোখে পড়ে যায় হাভাতে মানুষগুলোর।

ইস্কুলের ঐ ছেলেটার চোখেও তো পড়েছিলি তুই। তোর চোখও আটকেছিল ওই সদ্য গজিয়ে ওঠা গোঁফের রেখায়। সেদিন যখন ইস্কুল ফেরতা পথ আটকেছিল ও, ভয় পেয়েছিল তুই! কিসের ভয়? এতদিন ধরে লুকিয়ে রাখা তোকে কেউ দেখে ফেলার ভয়? ঐ ক্ষয়াটে শরীরটার কী ছিল আড়াল করার? আসলে নিজেকেই দেখতে  চাইছিলি না তুই। আসলে সাহস ছিল না, তুই যে পারতি না কিছু!

আর সেদিন, ঈদের খুশির রঙে সবাই যখন সেজেছিল খুব, তোকে ঐ ছেলেটার সাথে দেখে ফেলল সবাই। আর তারপরেই এত অশান্ত হয়ে উঠলো তোর ওই ছোট্ট জগৎটা— চিৎকার করে উঠলি তুই। এতদিনের সব না পারাকে ঘেন্নায় ছুঁড়ে ফেলে গায়ে কেরোসিন ঢাললি। দাউদাউ আগুন ঐ ঘুপচি ঘরে, পারলি তুই! পোড়া  শরীরটার সবটা ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলি তোর বাবা-মা, গ্রাম আর ইস্কুলের উপর। নানা অছিলায় তোর শরীরে হাত দেওয়া গ্রামের কাকারা কেউ ছোঁয়নি তোকে সেদিন। পুড়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলি যে!

এই মুহূর্তে গোটা ইস্কুল চিনে ফেলল তোকে। ঐ সাদা কালো ছবিটাই পেপারেও ছাপল। কত মানুষ দেখল তোকে। শোকসভা, গম্ভীর নীরবতা -- সব হলো তোর জন্যই। কিছুই না পারা তুই একদিনের জন্য চুপ করিয়ে দিলি সব কোলাহল।

তারপরেও সব ঠিকঠাক চলছে আবার। যেমন ইস্কুলের ঘন্টা পড়লো নিয়ম মেনে...


3 কমেন্টস্:

  1. খুব মরমী ও মর্মস্পর্ষী । প্রান্তীক লোকজীবনের গাঁথা ।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব মরমী ও মর্মস্পর্ষী । প্রান্তীক লোকজীবনের গাঁথা ।

    উত্তরমুছুন
  3. "কিছুই না পারা তুই একদিনের জন্য চুপ করিয়ে দিলি সব কোলাহল।" ভালো লাগল।

    উত্তরমুছুন