পিকনিক
সবাই পিকনিকে গিয়ে নিজের নিজের গল্প কবিতা লিখে ফেলেছে। আমার কিছু হচ্ছে না। কিচ্ছু দেখতে
পাচ্ছি না। মানচিত্র আমায় ভুলে গেছে।
কারণ আমি তো এটা জানি, লোকে হরিদ্বার বৃন্দাবন গোয়া
যেখানেই ঘুরতে যাক না কেন ফোর জি কানেকশনের দৌলতে ট্রেনের টিকিট কাটার আগে স্পট থেকে
একবার একঝলক ঝট করে ঘুরে আসে।
ফাইব জি নিয়ে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন তবে সে কানেকশন বাজারে আসতে
আরো বছর দুই তিন। সমুদ্রের তলা দিয়ে বড় বড় কেবল লাইন কীভাবে
এঁকেবেঁকে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে গিয়ে ভূঁইফোঁড় হয়ে উঠেছে, সে গল্পর জ্ঞান
আমার নেই। নেট খুলে যে সার্চ করব
তাতেও দৃষ্টিশক্তি বেশিক্ষণ সাহায্য করবে না। জোম্যাটো বলে হালফিল একটা অ্যাপস্ বের হয়েছে, সেটাকে ইন্সটল করে নিলেও
অর্ধেক গল্প রেডি হয়ে যায়। যেখানে ঘুরতে যাব পছন্দসই কোন কোন হোটেল রেস্টুরেন্ট আছে জানা যাবে সব। কিন্তু সেখানেও আমি গাড্ডু মেরেছ। মুড়ি ছাড়া কিছুই
সহ্য হয় না। সঙ্গে কয়েকটা বাতাসা
নিয়ে নি কিংবা স্বাদ বদল করতে মাঝেমাঝে কিশমিশ। মন্দ লাগে না। পিকনিকের অ্যাসাইনমেন্ট পেলে তাই এড়িয়ে যাই।
পিকনিকে গিয়ে খাবি না তো কী হয়েছে? কিন্তু বলতে যাবি না কাউকে, যা দেবে সব
নিয়ে নিবি, তারপর আমাকে পাস করে দিবি। বলেছিল অলক্তিকা।
কী করব! ভাবি বডি ওয়েট কমাব, কিন্তু খিদে পেলে কিচ্ছু মনে থাকে না।
তালে আমি কী খাব রে? পাল্টা প্রশ্ন আমার। খালি পেট মানেই তো...
আরে গল্প লিখবি, গল্প! দেদার উপকরণ ছড়িয়ে। দেখবি আর লিখবি। অজয় নদ, দু’ধারের জঙ্গল, গ্রামের মানুষ আর গগনচুম্বী
দেউল। লোকে বলে বটে ইছাই ঘোষ কিন্তু সত্যি যে কী, কেউ জানে না।
অশোক বলল, একসেট পেন আর সাদা কাগজ নেওয়া হচ্ছে সঙ্গে, যে লিখবে না পিকনিকে
তার খাওয়া বন্ধ।
আমার দিকে তাকিয়ে অঞ্জনের হ্যা হ্যা হাসি।
পুরনো বন্ধু গীতালি ওসকালো, আরে অত ঘাবড়াচ্ছো কেন? অ্যাওয়ার্ড তো আর কেউ
দিচ্ছে না, যা হোক তা হোক করে একটা লিখে দিলেই হবে।
সোয়েটারের পকেটে কাগজে মোড়ানো অল্প মুড়ি নিয়ে এসেছিলাম, ২৪শে ডিসেম্বরের
কুয়াশা কুয়াশা সকালে মিইয়ে ন্যাতা। কনকনে হাওয়ার মধ্যে বসে গোগ্রাসে লুচি গিলছে
সব। শেষ হলেই
নিজের নিজের লেখা নিয়ে বসে পড়বে।
ঋতুপর্ণা গপ্পোও করছে আবার হাতও চালাচ্ছে। আঠাশ মিনিটে দুটো কবিতা নেমে গেল। ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করে পার্থদা বেসমেন্ট নিয়ে
চিন্তাভাবনা করছেন। কৃষ্ণেন্দু
বণিক তো পুরো একটা গল্পের সিরিজ রেডি করেই নিয়ে এসেছেন। সবার লেখা শেষ হয়ে গেলে প্রথম উনিই শোনানো শুরু
করবেন।
আমার কী হবে? ফ্যাকাশে অজয় মিচকি হাসছে। পেট্রলের গন্ধ উড়িয়ে বালি ভর্তি ট্রাক নদীগর্ভ
থেকে উঠে আসছে ধীর লয়ে, জলের ধারে বসে বুদ্ধ ভিজে বালির ওপরে দেউল মন্দিরের চূড়ো
গড়ছে। নিঃশব্দে বক উড়ে যায়। ঠিক করলাম যে যা লিখছে
লিখুক, পুরো গল্প না পেলে আমি কিচ্ছু লিখব না। শুধু গল্প নিয়ে ভাবব।
হঠাৎ ঋজু চ্যাঁচালো, আমার লেখা শেষ, বেশিক্ষণ ফেলে রাখলে স্মৃতিভ্রমের
সম্ভাবনা!
বিভ্রান্ত চোখে দেখলাম কুলুকুলু শব্দে অজয় পরিপূর্ণ। চৌষট্টি দাঁড়ের পাঁচ ছখানা তরণী উত্তর পূর্ব মুখে ধীর গতিতে ভেসে চলেছে।
রেশমি কাপড় নুন আর মরিচ বোঝাই। সুন্দর সমতল শষ্যক্ষেত্র। বাঙালি মিস্ত্রীর হাতে তৈরি
নীলবর্ণে রঞ্জিত মধুকর ডিঙা।
সেকালের নিয়ম অনুসারে অজয়ের বাঁপাশে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ইছাই ঘোষের গড়বন্দী বাটী। গোপ বংশীয় সামন্ত রাজা।
ঈশ্বর ঘোষ। ক্ষুদ্র হলেও নামমাত্র অধীনতা স্বীকার করে প্রত্যন্ত প্রদেশ স্বাধীনভাবেই শাসন
করছেন। গড়ের মধ্যে রাজধানীর সুরক্ষার
জন্য ১০২৬টি লৌহ ও পিত্তলের কামান।
জামরুক বন্দুক। সেনভূমের
রাজা কর্ণসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসব ব্যবহার হয়েছিল। এখন কর্ণসেন নেই। বন্দুকবাজও সংখ্যায় কম। কিন্তু যুদ্ধ
আসন্ন। কর্ণের উপযুক্ত পুত্র লাউসেন পঞ্চাশ হাজার সেনা নিয়ে এগিয়ে আসছে। ওদিকে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে সুলতান মাহমুদ
দিল্লী লুণ্ঠনে ব্যস্ত। কাজ শেষ হয়ে গেলেই ঘজনী ফিরে যাবে।
কী করবেন রাজা ঈশ্বর ঘোষ? ত্রিষষ্ঠীগড় রক্ষা করার
জন্য কার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবেন? একমাত্র ভরসা মা শ্যামারূপা। দৈব সহায় না হলে অজয়ের জল অচিরেই রক্তে লাল হয়ে
যাবে। মহারাজ ইছাই চন্ডীর বরপুত্র। শত্রুপক্ষ ধর্ম উপাসক। সুকুমার সেন বলছেন, এ যুদ্ধে ধর্ম উপাসকের সঙ্গে চন্ডী উপাসকের শক্তি
পরীক্ষা হলো। ধর্মের পূজকরা হাতে তামার তাগা পরেন। ওটাই ওঁদের পৈতে। লাউসেন কি ওসব পরতেন ? ইছাইরা ছিলেন ধনী
গোয়ালা। দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে রাজবাটীর
পাশে দেবী শ্যামারূপার পুজো প্রচলন করেছিলেন। কালীবাবু বলছেন, এইসব গোপ বা সদগোপ জাতিরাই সেকালে রাঢ় বাংলার প্রাচীন অধিবাসী
ছিলেন। কপটতা জানতেন না।
নাঃ, এইভাবে কি গল্প লেখা হয়? এরকম টুকরো তথ্য দিয়ে? সঙ্গে নিয়ে আসা মোটা ডায়রীর
পাতা খুলে পর্ণা রবীন্দ্রসংগীত শুরু করে দিয়েছে। বনে যদি ফুটল কুসুম। কবি লেখকদের রিক্রিয়েশন হচ্ছে। রিক্রিয়েশন পিরিয়ড ওভার হয়ে গেলেই লাঞ্চ টাইম। আমার কপালে আজ অবধারিত
হরিমটর। গল্প লেখার
জন্য যে কাগজ দেওয়া হয়েছিল, বাতাসের ছোঁয়ায় তার কোণা উড়ছে, নতুন পেনও ঢাকা বন্ধ। আড়চোখে একবার অশোক আর একবার অলক্তিকার দিকে
তাকালাম। কালীবাবু লিখছেন, দেশাত্মবোধের অভাব সেযুগেও পরিলক্ষিত হতো, এযুগেও। বৃদ্ধ বয়সে বিদ্যার অভাবে এই শেষ বয়সে কলা
দেখাইলাম। পাঠক মার্জনা করিবেন।
কালীবাবু মানে কালীপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়। তাঁর সম্পর্কে বিশদ তথ্য কিছুই জানা যায় না। এমনকি তাঁর ছবিও। তবে তাঁর ছাত্র তাঁর মুখ উজ্জ্বল করেছেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও গবেষক ডঃ রাখালদাস
বন্দোপাধ্যায়।
খেয়ে উঠে প্রণবদা ছুটলেন টিউকলে মুখ ধুতে। ড্রামের ময়লা জলে কেউ হাত ধোয়?
ছ্যাঃ! সুলেখাদির তুলতুলে গরিমা। নরম আঙুলে হজমোলা বাড়িয়ে ধরলেন। সবকটাই অলক্তিকার জন্য রেখে নিলাম।
লোহার রেলিং ঘেরা পোড়া মাটির দেউল, কংক্রীটের দেবীমন্দির সন্ধ্যা নামার
অপেক্ষায়। যুদ্ধে ইছাইয়ের মৃত্যুর পর দেবী
একা হয়ে গিয়েছেন। গড়ের পরিখা দেখার জন্য ছুটল
গীতালি। ঘন আগাছায় ভর্তি।
পাগড়ি সুরঞ্জিত, শিরোপর শোভিত
শোভন সাজুয়া গায় ...
রাজা শিকারে বের হয়েছেন। তাঁর পরিচ্ছদ।
উইংগারের ভেতরে বসে চ্যাঁচা্চ্ছে পর্ণা, কানে
মোবাইল, এদের সঙ্গে কেউ কোনোদিন পিকনিক করতে আসে? অ্যাই অঞ্জন কি বলেছিলাম তোমাকে?
চারটের মধ্যে ফিরতে হবে বলেছিলাম না?
ভালো লাগল।
উত্তরমুছুন