কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

সুকান্ত দেবনাথ

 

ধারাবাহিক উপন্যাসিকা

অস্তাচল

 


(২)

বাইরে এক অবর্ণনীয় অন্ধকার, কেউ কোথাও নেই। কেউ যে নেই সে যেন অন্ধকার নিজে বলে যাচ্ছে, তুমি অকারণ দরজা খুলে দাঁড়িয়েছ। স্মিতা কিছুক্ষণ সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়েই ঘরের দিকে ফিরে তাকাল। তাহলে এতক্ষণ দরজায় কে ছিল?

-দিদি কি ব্যাস্ত ছিলেন?

ফিরে আবার বাইরের দিকে তাকাল স্মিতা।

-কে তুমি?

-আমি তেমন কেউ নই, আসলে বিকাশদা আমাকে ডেকে ছিলনে, তাই এসেছি।

-কোথা থেকে এসেছ?

-আপনার অয়ার্ডেই থাকি, একটু ভিতরের দিকে, তাই হয়তো চিনতে পারছেন না।

-বিকাশ কেন ডেকেছিল?

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল মেয়েটি, কিছু বলা যেন বারণ আছে কোথাও।

-তুমি পরে এসো, এখন তো বিকাশ নেই।

-বিকাশদা নেই সে তো দেখলাম টি ভিতে।

-তাহলে এসেছ কেন?

মেয়েটি আবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল যেন মাটির পুতুল। স্মিতা আবার বলল

-পরে এসো, এখন সে নেই।

মেয়েটি চুপ করে যেন ভিতরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল। তারপর পিছন ফিরে চলে গেল কোথাও।

স্মিতা তার দিক থেকে ফিরে ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল অগোছালো বিছানার মাঝে যেন তার আর আহ্নিকের ছাপ রয়েছে। আহ্নিক বাথরুম থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝে। সে এবার দরজার দিকে এগিয়ে এলো। আবার মুখোমুখি দেখা হল দু’জনার। যেন দুজনেই দুজনের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইছে। অথচ যা দেওয়ার ছিল সে তো দিয়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। তাই তাদের এই চাওয়া স্থির হল না। বরং তাদের মাঝে একটা চুক্তি হল, অলিখিত শুধু নয়, অস্ফুট। লেখাও নেই এমনকি বলাও হয়নি, শুধু অনুভব করা হয়েছে।

মেয়েটিকে আমি চিনি। আহ্নিক বলল যদিও তার বলার মতো কিছু তেমন নেই। কেননা সে যে মেয়েকে চিনেছে সে মেয়েই বদলে গেছে সময়ের মতো। তাই সে মেয়েদের চেনার ভান থেকে নিজেকে দূরেই রাখতে চেয়েছে বলেই তার ধারণা। যদিও তার ধারণা ঠিক নয়। ধারণা তখনই ঠিক হয় যখন তার প্রয়োগ একটা নির্দিষ্ট উত্তর দেয়, বা নির্দিষ্ট কোনও একদিকে নিয়ে যায়। অথচ আহ্নিক দেখেছে স্মিতাকেও সে যেভাবে চিনেছে সেভাবে বদলে যাওয়া সময় তার কাছে যেন এক চ্যালেঞ্জ তুলে দিয়েছে।

স্মিতার এখন আর কথা বলার মতো কোনও ইচ্ছে ছিল না, তাও সে বলল,

-চেনো বলতে?

-ঝুমুর। কোনও এক প্রাগৈতিহাসিক কালে সে আমাদের পাড়ায় থাকত।

-কিন্তু সে এখানে কী করতে এসেছে?

-মনে হয় উইটনেস।

-কীসের উইটনেস?

দুজনে ঘুরে তাকাল দুজনের দিকে। আর এক নিশ্চুপ তরঙ্গ বয়ে গেল।

আহ্নিক বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বাইরে এসে যখন বাইক স্টার্ট দেবে, দেখে সেই ঝুমুর এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। চোখে এক বিষণ্ণ হাসি। তাহলে সে কি কিছু দেখেছে? যা তাদের পরবর্তী কালে ব্ল্যাকমেল করার মতো। আহ্নিক গাড়িতে বসেও নেমে গেল আবার। তাকিয়ে বলল,

-ঝুমুর না!

-হ্যাঁ, চিনতে পেরেছ?

-এখানে কী কারণে?

-যে কারণে তুমি।

-আমি কেন এসেছি তা তুই কীকরে জানলি?

ঝুমুর চুপ করে তাকিয়ে থাকল আরও কিছুক্ষণ। যেন সে যা কিছু দেখেছে, তা মুখ ফুটে বলার মতো নয়। অথচ, অথচ, অথচ...

আহ্নিক চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ, যেন চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। যেন সময়টা দাঁড়িয়ে পড়েছে তার সামনে। সে কিছুতেই তার মাঝ থেকে বেরোতে পারছে না। ঝুমুর তাকে কোনও এক মুহূর্তের মাঝে পজ করে দিয়েছে। সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছে সে ঝুমুরকে। তখন কত হবে তিনচার বছর বয়স ছিল ঝুমুরের। ঝুমুরের মা তার ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে তাদের পাড়ার শেষ প্রান্তে একটা ঘর তুলেছিল। প্রায় ডোবার উপর ঘর বলতে গেলে। তার বাবাই তাকে সে ঘর তুলতে সাহায্য করেছিল। সে সবই দখলী জমি। সারা দুর্গাপুর জুড়ে এমন প্রচুর দখলী জমি রয়েছে। কোনও জমি সরকারের, তো কোনও জমি কোনও না কোনও কোম্পানির। তেমনই এক জায়গায় তার বাবা ঝুমুরের মাকে একটা ঘর তুলে দেয়। তখন সে জায়গাটার নাম ছিল ফাটা পাইপ। এখন অবশ্য নাম পালটে গিয়েছে। তার মনে আছে তার মা তাকে পাঠিয়ে ছিল, দেখে আয় তো বাবু তোর বাবা কাকে ঘর তুলে দিয়েছে। সে তখন সাইকেল নিয়ে ঘুরে এসে বলেছিল, মা একটা বউ আর তার মেয়ে। মা বলেছিল, বউটা কেমন দেখতে? আহ্নিক সে কথার উত্তর দিতে পারেনি। বলেছিল, মেয়েটা ভারি সুন্দর। একদম পুতুলের মতো।

তার মা আর তেমন কিছু বলেনি। আশ্চর্য এক নিস্তব্ধতায় নিজেকে জড়িয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল বাকি জীবন। অবশ্য জীবন বলতে বিষণ্ণ ভাতের থালা আর কয়েকটা বই যদি হয়। তবে তাই ছিল জীবনের সম্বল। আহ্নিকের মা তার ছেলেকে সাথে করে একদিন বুড়ি হয়ে গেল। তার নিজের যে একটা যৌবন ছিল তা যেন ভুলেই গেল সে। আহ্নিক দেখল সেই ডোবার পারে এক এক করে অনেকগুলো ঘর উঠল। ভরে গেল জায়গাটা। সেখানে যারা যারা থাকত তাদের মোটামুটি সবারই একই রকম জীবনের ধারা। নিজের দেশে উদ্বাস্তু। এখানে আসার আগে তারা কোথায় থাকত? কী করত? মাঠ ময়দান ঘর কেমন ছিল সবই রহস্যে মোড়া। অবশ্য এও হতে পারে, সে সবাইকেই ঝুমুরদের মতো করে বিচার করত।

যাইহোক, সে তো গেল অন্য কথা। মোদ্দা কথা হল দখল যেখানে পার্টি সেখানে। কোনও না কোনও পার্টিতে নাম না লিখিয়ে ওখানে থাকা সম্ভব নয়। যেভাবে সম্ভব নয় জীবনের গহন রহস্য জানা। আহ্নিক দেখেছিল তার বাবার পার্টির পরিচিতি কীভাবে কাজে লেগেছিল। সে প্রতিবারই ঘরে ফিরে দেখেছিল তাদের ঘর একচুল একচুল করে বাড়তে বাড়তে এক সময় তিনতলা হয়ে গেল। তিনতলার ছাদ থেকে তার বাবা একদিন তার মাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাপের ঘর থেকে অনেকদিন কেউ আসেনি কেন?

তার মা কোনও উত্তর করল না। যেমন সে কিছুই কোনোদিন জানতে চায়নি। ঘরে ঢুকে যাওয়ার সময় তার দিকে তাকিয়ে একবার হেসেছিল। অবশ্য ততদিনে ঝুমুর কিছুটা বড় হয়ে গেছে।

যেভাবে এখন সে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। তাহলে কি ঝুমুর তার কাছে কিছু চাইছে? নাকি কিছু দিতে এসেছে তারই মতো?

(ক্রমশ)

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন