কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

অর্ঘ্য দত্ত বক্সী

 

প্রাতিষ্ঠানিক, প্রতিষ্ঠানবিরোধী না আধা প্রাতিষ্ঠানিক স্থাবর জঙ্গমে হৃদয়কাশে ও ঋত্বিকের পুনর্মূল্যায়ণ

 


The ঋত্বিক ঘটক - প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, রেবেলিয়াসনেস ও আপোষহীন সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক; ... বঞ্চনা, ষড়যন্ত্র, আক্রমণ ও মাত্রাহীন সমালোচনার কথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাড়িয়ে বানানো যে লিটার লিটার করুণরস... তাকে জারিয়ে জারিয়ে অনেকেই ব্যবসা করে নিল।

কিন্তু বিশ্বাস করুন জন্মেই কেউ আমি প্রতিষ্ঠানবিরোধী, আমি প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলে চেঁচায় না! কাঁদে, সাহায্য চায় পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের কাছে আর তবে হ্যাঁ প্রথম ‘মা’-ই বলে ওঠে- সেই মা; যে সম্পর্কই একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিকতার উর্দ্ধে।

ঋত্বিক, বিনয়, জীবনানন্দ, ফালগুনী রায় - এরা, যারা সমসাময়িকে প্রবল রকম নেগেটিভ সমালোচনা ও নির্লজ্জ রূঢ় আক্রমণের শিকার হয়েছেন, বিশেষ করে ঋত্বিক ঘটকের মহামনীষী শিল্পীসত্তাকে কম, বরং এক সাধারণ মানুষের সত্তাকে আমরা সোশ্যাল এক্সচেঞ্জ তত্ত্বের Reward-punishment, cost-profit, comparison level, appreciation-denial/rejection-এর মাপকাঠিতে পুনরায় বিচার করে দেখব।

তাঁর গল্পগুলো তো ‘দেশে'-এ বেরিয়েছিল! একসময় মদ্যপানবিরোধী মিছিলে হেঁটেছিলেন এবং 'মেঘে ঢাকা  তারা' পর্যন্ত চরম মাদকাসক্ত হয়েও পড়েননি। 'নাগরিক' যারা দেখেছেন তারা কেউ বলবেন না যে ওটি প্রতিষ্ঠানবিরোধী ছবি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পকর্মের মতো ওটি মতাদর্শগত ছবি। রিলিজ করেনি। করলে তিনিই হতেন পথিকৃৎ। ফলত ফ্রাস্টট্রেশন। আর তত্ত্ব বলে একটি মানুষ যত বেশি ফ্রাসট্রেটেড হয় তত বেশি সে অ্যাগ্রেসিভ হয়ে ওঠে। ফ্রাসট্রেশনকে ফ্লো অফ করার মাধ্যম ও একমাত্র মাধ্যম হল aggression (frustration-aggression model of Dollard)। যত বেশি আক্রমণাত্মক হয় তত বেশি ব্রেন (frontal temporal lobe) function কমতে থাকে ও এভাবেই দুর্বলতাবশত মদ্যপান নেশায় পরিণত হয়। যাইহোক, নাগরিকের পরের বছর পাঁচেক হল নিজেকে তৈরি করবার পালা। অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ‘অযান্ত্রিক’। দেশে বিদেশে প্রবল প্রশংসা। তবে সঙ্গে সঙ্গে এও শুনতে হল যে ওই লম্বা ওরাওঁ নাচের সিকোয়েন্স, হঠাৎ নিশানওয়ালা পতাকা কি মাঝে মাঝে আদিবাসীদের প্যারালাল এন্ট্রি - এসব শিক্ষিত ক্লাসের কাছে খুব একটা বোধগম্য হয়নি। তবে গাণিতিক শুদ্ধ ছবি বা ছবির মূলধর্ম/গ্রামার মেনে করা ‘ভালো’ ছবি। তাই অ্যাপ্রিসিয়েশন রিওয়ার্ড পেলেন কিন্তু ছবি ফ্লপ।

এই ব্যাপারগুলো মাথায় প্লে করেছিল বলেই পরের ছবি 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' চিলড্রেন্স ফিল্ম-সরল বিতর্কহীন ছবি-ক্যামেরা ও লেন্সের কারুকাজ সমন্বিত অর্থাৎ ফর্মে এক্সপেরিমেন্ট! ছবি তবুও ফ্লপ। কিন্তু ক্লাসের প্রশংসা আবারও। তাই এবার নিজের ড্রিম প্রোজেক্ট ‘মেঘে ঢাকা তারা’ যথাসম্ভব সরলভাবে আবহমান বাঙালির অন্তরাত্মার কাছে আবেদন রাখা ছবি। বাঙালির মেলোড্রামাটিক নেচার, বাঙালির স্ট্রাগল, দেশভাগের যন্ত্রণা, বাঙালির সেন্টি-মেন্টালিটি, আইডেন্টিফিকেশন উইথ ভিকটিম নেচার হাতের তালুর মতো জানা ছিল। তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় চরিত্র নীতার চরিত্রায়ণ প্রসেসে নিজেকে যেন মাদার আর্কিটাইপাল ফোর্সের ফ্রি ফ্লো করার আধার বানিয়ে তুললেন। বাঙালি কমিউনিকেট করল, ছবি হিট, ক্লাসের কাছেও।

তাই এবার অনেক আশা, অনেক বিশ্বাস নিয়ে, অনেক সাহসে বুক বেঁধে জীবনের সবথেকে জটিল ত্রিস্তরীয় বিন্যাসের সিম্বলিক এক্সপেরিমেন্টের ছবি ‘কোমল গান্ধার’। বিতর্কিত বিষয় নিয়ে। ওই সেই বিতর্ক যা তাকে  পার্টির বখাটে ছেলে বানায়। প্রবল ব্যক্তিগত ও কুৎসিত সমালোচনার ঝড়। ছবি চূড়ান্ত ফ্লপ। ক্লাস ও মাস দুজনের কাছেই।

হ্যাঁ, এখান থেকেই ঋত্বিকের তিক্ত, বিরক্ত, মাতালপ্রতিষ্ঠানবিরোধী ও প্রডিগ্যাল হয়ে ওঠার শুরু। Social Theory বলে আমরা সবসময় চাই rewarded হতে। আমরা চাই অ্যাপ্রিসিয়েশন, esteem of others, আমার চাই praise। যেমন বেঁচে থাকতে দরকার money the honey তেমনি সামাজিক জীব হিসাবে শিল্পীর চাই তার কাজের অ্যাপ্রিসিয়েশন, তার পরিশ্রমের Reward, অন্যান্যদের প্রশংসা। নিজেকে একটি শিল্পকর্মে যে যতটা নিংড়ে দিয়ে নিয়োজিত করে তা হল তার cost এবং তার সে যা feedback পায় তা comparison level (CL)-এর থেকে বেশি হলে profit আর কম হলে loss। সাধারণভাবেই যে কাজে profit নেই বা reward পাওয়া যাচ্ছে না সেই ধরনের কাজ না করে শিল্পী conform করতে চায় (আমি আপোষ শব্দটি ব্যবহার করলাম না)। কিন্তু কারও কারও ব্যক্তিত্বটাই এমন হয় যে সে বরাবর হটকে চলতে বা individualistic হতে পছন্দ করে। এ core psychology। ঋত্বিকও হয়তো তেমনি এক ব্যতিক্রম; তিনি conform করতে পারেন না নিজ স্বভাবদোষে আর appreciation, reward, esteem, praise না পেয়ে পেয়ে হয়ে ওঠেন চরম frustrated।

আবার হেজি পেজি রাম শ্যামের শিল্প নয়, ঋত্বিক ঘটকের মতো প্রতিভা যে জানে যে সে যা produce করছে বা service দিচ্ছে তা rare of the rarest অর্থাৎ যত বিরল তার দাম বা reward ততই বেশি হওয়া উচিত কিন্তু বাস্তবে ঘটে চলেছে ঠিক তার ১৮০° উলটো ঘটনা।

ফিরে আসি কথায়, তো ‘সুবর্ণরেখা’ মনে হয় তাই ইচ্ছা করেই বানালেন বা বলা যায় মুখের উপর ছুঁড়ে  মারলেন। সর্বাপেক্ষা বীভৎস ভয়ংকর দুর্বোধ্যতম প্রতিষ্ঠানবিরোধী একটি ছবি ছুঁড়ে মারলেন, যেন অ্যাসিড। তো এবার প্রতিক্রিয়া যাবতীয় গণ্ডি পেরিয়ে উন্মত্ত আক্রমণে পরিণত হল। ও সবাই জানেন সম্ভবত স্থিরই করে ফেলেছিলেন যে আর নয়। টুকটাক ডকুমেন্টারি, একটু আধটু স্ক্রিপ্ট লিখে দেওয়া কি শিক্ষকতা ... আর আর মদ্যপান ও আপাতবিরোধী আবোল তাবোল বকা!

অনেকদিন পর বাংলাদেশ স্বাধীন হল। চিরকালীন স্বপ্নপূরণ... প্রবল আশায় বুক বেঁধে সমুজ্জ্বল আনন্দে  অশক্ত শরীরেও শুধু একা, কোন সহকারী পরিচালকও ভারত থেকে নিয়ে যেতে পারবেন না- এ শর্ত মেনেও আবারও মূলত এপিকধর্মী, কোনো কন্ট্রোভার্সি ছাড়াই তান্ত্রিক ঋত্বিকের মা আবেগ গলে গলে বেরিয়ে আসা তিতাস। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। চূড়ান্ত অসুস্থ, নিজে এডিটিংটুকুও করে আসতে পারলেন না। ফলে অত পোটেনশিয়ালের ছবিও বস্তুত অসংলগ্ন হয়ে পড়ল। সুতরাং মাস বা ক্লাসের সেই একই রিঅ্যাকশান - শুধু denial, Rejection ... শুধু loss আর loss আর lack of appreciation জমে ওঠে ঋত্বিক মানসে। তাই এবার বাংলা সিনেমার সর্বাপেক্ষা aggressive ছবি ‘যুক্তি তক্কে’ ডোন্টকেয়ার প্রতিষ্ঠান বিরোধী- 'তোমার মনে  ভয়, আমার ভয় হারা!' নিজের যাবতীয় হলাহল বিষ উগড়ে দিয়ে চিরকালের মতো মুখে সজোরে লাথি আর চোলাই ছুঁড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পালা।

কিন্তু ফল উলটো। হঠাৎ বেস্ট স্টোরির পুরস্কার। বেশ কিছু টাকা আর তার থেকেও অনেক অনেক বেশি দামি, চির আকাঙ্ক্ষিত সেই অ্যাপ্রিসিয়েশন reward, esteem, profit, praise, acknowledgements।  মনের আমূল পরিবর্তন। দামি পাঞ্জাবি, দামি জহরকোট, সেভিংক্রিম, কম মদ্যপান, সুস্থতার আকাঙ্ক্ষা এসব দেখে নিজের স্ত্রীও অবাক! না আবার কাজ করবেন। এবারে গুছোনো কন্ট্রোভার্সিহীন ছবি। স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ শুরু হল। ততদিনে সিরোসিস ও The End।

তাহলে ঋত্বিককুমার ঘটক, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পোস্টারবয় আদপেই কি প্রতিষ্ঠানিক বিরোধী? নাকি en-vironment পরিস্থিতি তাকে তেমন বানিয়ে তুলল? বাংলা প্রতিষ্ঠানবিরোধীদের ষোলোকলা পূর্ণ অবতার তবে কি একেবারে সাধারণ মানুষের সাধারণ চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলাতে না পেরেই কি হয়ে উঠলেন না, বা তাকে হইয়ে ওঠানো হল না প্রতিষ্ঠানবিরোধী?

এ অতি সরলীকরণ। জানি। তবু তাকে মানুষ মনে করে ভালবাসি। মারী সিটান যা বলেছিলেন, অতিরিক্ত মননশীলতা এদের নষ্ট করে দিয়েছে। 'কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে।' যেমন gifted child যাদের IQ 150 এর বেশি হয় তারাও পড়ে যায় psychological patient এর আওতায়। ঋত্বিক The Gifted লাডলা।

(২)

এবার একটু অন্যান্য প্রতিষ্ঠানবিরোধীদের কথা। বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রথমজীবনে প্রতিষ্ঠানেই ছিলেন, আনন্দবাজারে লিখেছেন। পরে হাংরি, হয়েছেন। আজও গ্রামের বহু ছেলে মেয়েরা যাদের কাছে পৌছায় শুধু আনন্দবাজার ও দেশ পত্রিকা আর জয়ের কবিতার বই, তারা আনন্দবাজারীয় লেখাকেই একমাত্র ভেবে  তদ্রূপ লিখতে লিখতে কলকাতায় এলে তাদেরও চোখ ফোটে। এই ২০২০তেও সমান তালে ঘটে চলে ইতিহাসের পুরাবৃত্তি। তারা আনন্দবাজার থেকে সচেতনভাবে লিটিল ম্যাগে আসে। সুভাষ ঘোষ ও হাংরি, ফাল্গুনীও হাংরি, মলয় রায়চৌধুরীও হাংরি। তবে বাসুদেববাবু আর সুভাষবাবু ধীরে ধীরে কিন্তু অল্টারনেটিভ ক্লাসের একটা অংশের কাছে, যদিও নেহাত কম সংখ্যায় নয়, ক্রমশ্য পপুলার হতে শুরু করেন তাদের জীবিত দশাতেই। মলয়বাবুর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিন ছুতার’ তাকে দেশে বিদেশে বিখ্যাত করে দেয়। এরা সকলেই  মোটামুটি লেখা চালিয়ে যাওয়া, জীবনের ব্যালান্স ধরে রাখা, ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাপ্রিশিয়েশন তাদের জীবৎকালেই যথেষ্ট সংখ্যক ক্লাসের কাছে পেয়ে গেছেন। cost profit তত্ত্বে মোটামুটি ভরাডুবি খাননি।  মলয়বাবু প্রতিষ্ঠানবিরোধী হলেও অনেক বদলেছেন, এবং তিনি অন্যতম কাল্ট ফিগার। আর ফাল্গুনী শুধু ক্লাস বা মাস তো বটেই, কখনো কখনো নিজেদের মধ্যে নিজেরই জন্য অপমানিত হয়েছেন। তাই সম্ভবতঃ সৌন্দর্যারাক্ষসে পরিণত হয়েছেন, যা ইচ্ছে তাই লিখেছেন, সর্বাপেক্ষা কদর্য লিখেছেন, সমকালীন অন্যান্য কবিদের বিচারে ও জীবনেরও ব্যালান্স হারিয়েছেন। শৈলেশ্বরবাবুও হাংরি, জীবিত অবস্থাতেই কাল্ট, তবে তার মতো ছদ্ম প্রাতিষ্ঠানিক খুব কম দেখা যায়, জানি না ‘দেজ’ কী করে ওই সংকলন বের করলো, যেখানে মলয়বাবু, সুবিমল বসাক নেই, কিন্তু শঙ্খ ঘোষ আছেন!

এবার, কিছু প্রাতিষ্ঠানিকদের কথা। না, আধা প্রাতিষ্ঠানিকদের কথা। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। অধিকাংশ  আপামর বাঙালীর কাছে ১৫-২০ বছর আগেও ছিলেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের অপভ্রংশ বা মিসপ্রিন্টিং। এবং অত্যন্ত ভালগার ও শুধুই সেক্সে ভর্তি ও পাঠরুচির বহির্ভূত। যা শুনেছি, অত্যন্ত ধূর্ত মানুষ ছিলেন। সম্ভবতঃ  সবই সচেতনভাবে করেছেন। তত্ত্ব ও তথ্যের বিপুল সমুদ্রের ধারকাছ দিয়েও যাননি। সুনীলও যেতেন না, যদি না তাকে আপামরের বোঝা ঘাড়ে না বইতে হত। কখনো সুনীল তার বিখ্যাততম তিনটি থান ইট  লিখতেন না যদি তাকে শহবাগ হবার ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হত! যদি না তাকে লিখে শান্তিনিকেতনে বাড়ি গাড়ি বানাতে হত। তবুও সন্দীপন মোটামুটিভাবে ক্লাসের কাছে জীবনের প্রথম লেখা থেকে শেষ’দিন পর্যন্ত হাইলি অ্যাকসেপটেড। এ্যাপ্রিশিয়েটেড। অ্যাকাডেমিও পেয়েছেন। (হাংরি সুবিমল বসাকও পেয়েছেন)। সুনীল গাঙ্গুলীই মূল। এখন মাসের হয়ে গেছেন। কিন্তু সারাজীবন প্রায় অলটারনেটিভই থেকেছেন। বলেছেন টলেছেনও অনেক ব্যক্তিগত আক্রমণ করে প্রতিষ্ঠানবিরোধী কথা। পেয়েছেন শুধু অগাধ প্রশংসা তাহলে উনি কি? প্রাতিষ্ঠানিক, আধাপ্রতিষ্ঠানিক, না প্রতিষ্ঠানবিরোধী? না হার্ডকোর চালাক প্রাতিষ্ঠানিক। সুনীল ১৫০ বই লিখেও এই দশকের কাছে মোটামুটি শ্রদ্ধা হারিয়েছেন। আর শঙ্খ ঘোষও হার্ডকোর মেইনস্ক্রীম, তবুও কেন জানি না এখনো অধিকাংশের কাছেই প্রণম্য।

চার্লি চ্যাপলিন। যেদিন থেকে সমাজ শ্রেণীবিভক্ত হয়েছে, যাবতীয় দারিদ্র্য ও বঞ্চনার অসম্ভব আক্রমণাত্মক প্রতিবাদী, তাকেও অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে, যার ফলে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটরে’র পর তিনি এরকম একটা কথা মোটামুটি বলেছিলেন, এ ক্লাউন হ্যাজ নো রাইট টু ইন্টারফেয়ার ইন পলিটিক্স। তারপরেও  আবার ফিরে গেছেন তাতেই। পৃথিবীর প্রথমতম ইন্টারন্যাশানালি সর্বাপেক্ষা পরিচিত মুখ। বলছেন দেখাচ্ছেন ইঙ্গিত দিচ্ছেন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার দিকে। যাবতীয় দুর্নীতি, নোংরামি, বীভৎসতার সর্বকালীন চিরস্থায়ী প্রতিবাদী। আবার সর্বাপেক্ষা ইতিবাচক শিল্পীও বটে। মন খারাপ হলে চ্যাপলিন পড়ো!

দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশানালি পরিচিত মুখ চে গুয়েভারা। আমেরিকার কোলের দেশ কিউবা, সুদূর বন্ধুর আফগানিস্থান নয়, কাস্ত্রো দ্বিতীয় স্থান দিতে চেয়েছিলেন, নেননি, অন্যদেশ, আবার সংগ্রাম, অসম্ভব অসম লড়াইয়ে মৃত্যু। সবাই জানেন। মারাত্মক হাঁপানির রুগী ছিলেন। তাও জানেন। গীতার কর্মযোগী। তবুও সাম্প্রতিক ঘটনা আপনারা বোধহয় ভুলে যাননি, পার্টি থেকে বলা হয় তিনি মার্কসবাদী ছিলেন না। নিজেও তার জীবনে তৎকালীন অন্যতম শক্তিধর কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের নীতির তীব্র সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। অথচ উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমপন্থী সকলের বাড়িতে পোষ্টারে, টিশার্টে, কফি মাগে, মদের গ্লাসে, সর্বত্র, স্টাইল আইকন। হয়তো অজ্ঞাতসারে! অবিশ্বাস্য!

কাফকা। নিজের বন্ধুদের কাছেই তার লেখা অবোধ্য ছিলো। যার ফলে বই পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। যক্ষায় মারা যান। নিজের বাগদত্তাই ছেড়ে চলে যান। কখনো একফোঁটা অ্যাপ্রিশিয়েশন জোটেনি। তাই ওরকম চার্চ বিরোধী আশ্চর্য ঈশ্বরচিন্তা ও দার্শনিকতা ক্যাসলে আরো ভালো বোঝা যায়। কমিউনিষ্ট দেশগুলোয় নিষিদ্ধ ছিলেন। বলা হতো এত হতাশাব্যঞ্জক লেখা আসলে পাগলের প্রলাপ। অথচ সেই দেশগুলোতেই ইয়ং জেনারেশন নিজের প্রিয়তম মোটরসাইকেল বিক্রি করে চড়া দামে ব্ল‍্যাকে কাফকার উপন্যাস কিনেছে। (সূত্র সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল)। আর এখন! চূড়ান্ত হার্ডকোর প্রাতিষ্ঠানিকও যদি তাঁর কুৎসিত সমালোচনা করেন মুহূর্তে এলিয়েন হয়ে যাবেন। ঈশ্বর কাফকা।

ব্রেশট আর গোদার না হলে সুবিমল মিশ্র হতেন না। এমনই শুনেছি। এই গোদার। শূন্যেরর কম বেশি সকলেই দেখেছে। পূর্বসূরীরা তো বটেই। সকলেরই পূজ্য। তবু কি কন্ট্রোভার্সিয়াল আর এক্সপেরিমেন্টাল। নিজে মাও সে তুঙ-এর ভক্ত অথচ নত্রে মিউজিকে গিয়ে নিজেই তার থেকে সরে আসছেন। পিয়ের লো  ফাউতে এত রক্ত কেন’র উত্তর দিচ্ছেন ওতো কেমিক্যাল। আমার মতে স্মার্টেষ্ট ফিল্মমেকার ইন দি ওয়ার্ল্ড।  এডিটিংএর সম্পূর্ণ নতুন ধারা আবিষ্কার করে বলছেন, ওটা প্রোডিউসারের চাপে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বাধ্য হয়ে। অস্কার নিতে না যাওয়ার জন্য কী অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন, কী অকল্পনীয় স্যাটায়ার! অথচ এই আমেরিকাকেই আগাগোড়া তুলোধোনা করে এসেছেন, কখনো এও শুনতে হয়েছে তিনি ইহুদীবিদ্বেষী। একসময় আনন্দবাজারে জাষ্ট তিনচার লাইনে তার সিনেমার অত্যন্ত নোংরা আক্রমণ বেরিয়েছে। আর ‘যুক্তি তক্কো গপ্পে’ ওই কালো ভূতেদের নৃত্যের সিনগুলো কি স্যুররিয়াল? এ প্রশ্নের উত্তরে ঋত্বিক বলেছেন, অত  স্যুররিয়াল ফ্যুররিরাল বুঝি না, বারবার তোমাদের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছি বাংলাদেশেও ভূতের নৃত্যের জন্য তোমরাই দায়ী। কী মনে হয়! অতবড়ো বুনুয়েল ভক্ত ও সাইকোলজির অত গভীর জ্ঞানসম্পন্ন মানুষটি  স্যুররিয়ালিজম বুঝতেন না? এখন এদের নিয়ে দেশে বিদেশে লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা হয়, প্রবলভাবে  অপ্রাতিষ্ঠানিক তকমা লাগিয়ে, বিক্রি করার এও এক পদ্ধতি। যেমন শ্রীজাত বা বিনায়কের লেখা লিটল ম্যাগে রাখাও এক বিক্রি করার পদ্ধতি। আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে এদের নিয়ে আর্টিকেল বেরোয় পাতাভর্তি করে, অথচ যাদের এরা জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করে গেছেন। সুতরাং সব গুলিয়ে যায়। ওই সময় সময়। আর বাজারের চাহিদা ও যোগানের খেলাশুধু জীবিতকালে এরা পাননি বহু আকাঙ্ক্ষিত তাদের  রেয়ার শিল্পকর্মের উপযুক্ত রিওয়ার্ড, পাননি esteem, praise, comparison level (CL)-এ, তাই এরা বড্ড বড্ড কম costএর লোকসানে হয়েছেন দেউলিয়া। মস্তিষ্কবিকৃত। আর যত হয়েছেন, জেদে সেইদিকেই তত ঝুঁকেছেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ কি দস্তয়েভস্কি ও দত্তয়েবক্সিই নয়? 😊

অপারেশন জেরোনিমো। ওসামা হত্যার অপারেশন। বহু কাঙ্ক্ষিত, প্রবল উদ্দাম, উন্মাদনা, আনন্দের মধ্যেও  প্রবল প্রতিবাদ শুধু নামটি নিয়ে। যখন বিদেশীরা আমেরিকা আক্রমণ করতে এলো, তখন রেড ইন্ডিয়ানদের প্রধাননেতা, অসম্ভব ধূর্ত ও ছদ্মবেশী, দীর্ঘদিন নাজেহাল করে রেখেছিলেন। এই লেজেন্ডের সাথে কখনো ওসামাকে এক করা যায় না, বলে তীব্র প্রতিবাদ। পরিবর্তিত নাম নেপচুনস স্পিয়ার। জানি না নামটির অর্থ কী! খায় না মাথায় দেয়! সময়ই একদিন হয়তো দেখাবে অপারেশান ওসামা নিয়ে পৃথিবীতে হয়তো তীব্র  প্রতিবাদ উঠল। সব গুলিয়ে যায়।

আর মৃণাল সেন ও অঞ্জন দত্ত। দেশে মৃণালের মাসের মধ্যে কোন ছবিটা হিট? কিন্তু বিদেশ তাকে আয়াপ্রিসিয়েশনে প্রাইজে সম্মানে ভরিয়ে দিয়েছে। আর সাধারণ বাঙালি সেটা জেনে বলেছে, হ্যাঁ মৃণাল গ্রেট পরিচালক। ব্যাস, ঐ অবধি। কিন্তু ছবি তো ফ্লপ। তাই মৃণাল আরও কম বাজেটে, আরও আরও কম বাজে্টে, নতুন নতুন ছেলেমেয়ে নিয়ে সারভাইবাল স্ট্যাটেজি নিয়েছেন। যেটা মাস ও ক্লাস দু জায়গাতেই ব্যর্থ হয়ে ঋত্বিক পারেননি। ব্যক্তি চরিত্রও ম্যাটারস।

অঞ্জন কিন্তু মাঝারি মানের শিল্পী। তাকে বিখ্যাত করেনি তার থিয়েটার বা মৃণালের নায়ক সত্তা। তাকে জনপ্রিয় করেছে ৯০ এর দশকে সুমনের পর তার গান, যেগুলির অধিকাংশ বিদেশ থেকে চুরি করা। সুমন বা নচিকেতা তার থেকে অনেক বেশী ট্যালেন্টেড বলেনও একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। কন্তু তার স্প্যানটা বিশাল। এই সময়ের অধিকাংশ নতুন পরিচালক তাকে ছবিতে অভিনেতা হিসাবে ব্যবহার করে বাংলা সিনেমার উন্নতি করছেন। কিছু পরিচালনাও তার উন্নত মানের। আসল কথা, এত জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলেও জানতেন তার লিমিটেশান। তাই আপোষ শব্দটা এতবার ব্যবহার করেন আর অসময়ের মতো একটা অ্যালবাম যেখানে 'গ্রামাফোন খেদিয়ে কুকুরে ছানাটা ঠিকঠাক গান বেচে যাচ্ছে’ বলছেন, সেখানে আত্মসমালোচনার মাত্রাটাই প্রাপ্তি। এই দেখুন এক মাঝারি মেধার শিল্পীর কী অসম্ভব জনপ্রিয়তা! মাস ও ক্লাস উভয়ের কাছেই। costএর তুলনায় profit কত বেশি! বেশি, বড্ড বেশি বেশি পান বলেই কী অঞ্জন  বারবার নিজেই নিজেকে আত্ম সমালোচনায় যান? অথবা যুগটাই মধ্য-মেধার! যুগটা অধুনান্তিকের কিনা!  ঘাসেদের যুগ, মহীরূহদের নয়! তবুও কৌশোরের গায়ক অঞ্জনের প্রেমে পড়ে ১৭তে হঠাৎ একদিন একটা  গিটার কিনে বসলাম

বর্তমানে কিন্তু শ্রীজাতের বা বিনায়কের একটি কবিতা ছাপানো একটি লিটিল ম্যাগ সেল করার অন্যতম সস্তা স্ট্যাট্রেজি। নাহলে সুনীলের কোনো অতি অতি জঘন্য বহুবার ছাপা অগ্রন্থিত কবিতা। হে সম্পাদক, লেখকের নাম নয়, লেখা ছাপুন। নামী লেখকেরাও যতদিন স্ট্রাগলিং ততদিন মহৎ সাহিত্য রচনা করেছেন, খুব নাম হয়ে গেলে তাদের লেখাতেও এসেছে শ্লথতা, শিথিলতা, তারল্য। কিন্তু বাজারের তাগিদের সেই অখাদ্যই ছাপিয়ে গেছেন সম্পাদকেরা। হে লিটিল ম্যাগের সম্পাদক, অত্যন্ত সস্তা কাগজে সস্তা মলাটে প্রচুর নতুন লেখককে স্থান করে দিন। হ্যাঁ, খারাপ লেখাই ছাপান। কার মধ্যে প্রতিভা আছে সেটা সেই খারাপ লেখাতেও বেরিয়ে আসে। কবিতার ওয়ার্কশপ, গল্পের ওয়ার্কশপ করুন মফঃসল ঘুরে ঘুরে। এবং তা প্রফিট হবে না জেনেই করুন। অ্যাপ্রিসিয়েশন পাবেন এই অনামী লেখকেরা লেজেন্ড হয়ে উঠলে। আমি শিক্ষক। এই আমার ব্রত। ছাত্রের সাফল্য।

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন