![]() |
কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৮ |
শুকতারা
কত কথা বলার ছিল তোমায়, অপ্রকাশিত রয়েই থেকে গেল। তুমি কী আদৌ এসেছিলে, না কি আসার ভান করেছিলে! সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিখিয়েছো। শেখা পরিপূর্ণ হয়নি। দিন দিন রিক্ত হচ্ছি। এখন মধুমাস দেখলে কেমন রাগ হয়! বর্ষার জলও আমায় ভেজাতে পারে না। শীতের ওম নিতে হুইলচেয়ারে রোদে যেতে হয়। একটি বাসা দিয়েছিলে, সুন্দর শক্তপোক্ত বাসা। এতদিন ছিল জ্যান্ত। সময়ে ব্যবধানে কেমন ঝুরঝুরে, নুব্জা হয়ে গেছে। হেলান দিয়ে বসে থাকার মতো একটা ঝুলবারান্দা দিয়েছিলে। শ্যাওলা জমে সবুজ। বড় পেছল। প্রকৃতির বেপরোয়া বাস মেনে নিতে হয়।
খড়খড়ি দেওয়া জানলার পাশে অবিরত মুখে মাটি নিয়ে ভোমরা সুন্দর নিটোল বাসা তৈরি করে ফেলেছে। আবার বাচ্চা মুখে করে ওর বানানো মজবুত ঘরে রাখছে। সামনে গেলেই হুল ফুটিয়ে দেবে। কেউ যেন ভেঙে না দেয়!
বাবা, তুমি কী মহাকাশে ঘর বেঁধেছো! উঠোনে দাঁড়িয়ে সারা দিন-রাত প্রতীক্ষা করি। একটা একটা করে দিন যায়। তুমি কি পলাতক! পরতে পরতে যে বেদনা কার কাছে শেয়ার করি বাবা! শুকতারা কি শুনবে আমার চতুষ্কোণের ইতিহাস!
মা আছে। খাঁচায় হাত-পা বেঁধে রাখতে হয়। তা না হলেই ফুরুত্। মুক্ত হতে চায়। ভাত খেতে দিলে, মর্টার বানিয়ে গর্ত করে একগ্লাস জল ঢেলে দেবে। আর বলবে,
-পলেস্তারা খসে যাচ্ছে, ঘূণপোকাগুলো বেরিয়ে আসবে। সাবধান!
মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদি। তুমি তো আমার পনেরো পূর্ণ হওয়ার আগেই চলে গেলে! বাবা! যৌবনা কোনোদিন হতে পারিনি। তোমার শূন্যতা প্রতি মুহূর্তে আমাকে আর মাকে গ্রাস করত। দশ বছরের ছোটবোন অত বুঝতো না। দিদির কাছে বায়না। এটা চাই, ওটা চাই। টিউশানি করে নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালিয়েছি।
কর্পোরেট অফিসে চাকরি করেছি আটত্রিশ বছর। রিটায়ার করার পর শূন্যতা আরও বাড়ছে। ভেতরটা ধূ ধূ করা গড়ের মাঠ। কেউ খেলতে বা ভ্রমণ করতে আসে না। একা পড়ে থাকে।
আর একটি আঁধার ঘরে বোন মাটির পিদিম প্রজ্বলিত করে রাখে সারা দিন-রাত। অসূর্যম্পশ্যা সে। সূর্যের আলো ঢুকতে দেয় না। একটি তানপুরা নিয়ে বসে থাকে স্বামীজীর ছবির সামনে। নিবিষ্টচিত্তে স্বামীজীর গান গায়। একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার সহকর্মী বিবেক আসে না বহুদিন। বিবেককে শিখা ভালবাসে। আসলে ওর উচ্ছলতা ও কাজ করার প্রবণতা বুঝিয়ে দিত বিবেকের প্রতি ওর দুর্বলতা আছে। বিবেক চলে যাওয়ার পর সেই যে অন্ধকার ঘরে ঢুকলো আর বেরোয় না। আহার সীমিত, শীতসায়মকালেও তিনবার স্নান করে। লোকে বলে,
-পেঁচোয় ধরেছে গো... ওঝা ডাকো। বড় অসুখ করেছে। সে নিজেও জানে না তার কী রোগ হল।
আমাদের মনের খবর আর কে রাখে! আমরা তিন নারীই জীবনপুরের পথিক, কোনো দেশেই সাকিন নাই। কে যেন ডানাগুলো নিঃশব্দে ছেঁটে দিয়েছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন