ধারাবাহিক
উপন্যাস
ছেঁড়া শিকড়ের অন্তরাখ্যান
(৫)
দেশ দেশ, আমার দেশ – দেশ কি কেউ ছাড়তে চায়?
কনকপ্রভা রান্নাঘর থেকে গলা তুলে ডাকলেন,
“জিয়ল মাছ আনছনি? থল্যা অই জাগাত থোও, কলপারে। হাত-পাও ধুইয়া
আস।”
পিঁড়ে পেতে বাটিভর্তি মুড়ি দিলেন। উনুনে কড়াইতে দুধ ফুটছিল।
দু-হাতা ঢেলে দিলেন। কৌটো থেকে আখের গুড় একডেলা। কালীকিঙ্কর আঙুল দিয়ে গুড়ের দু-একটা
পিঁপড়ে সরাতে সরাতে নাক কুঁচকে বললেন,
“পিপরা দেহি। পাকঘরে কী কাম কর রাইতদিন? কৌটাখান ঢাকন যায় না?”
কনকপ্রভা কটকট করে তাকালেন। চাপাস্বরে বললেন,
“আইয়া বইয়া থাইক্য। দ্যাখবানে কী কাম করি।”
কালীকিঙ্কর চুপ করে রইলেন। আজকাল তাঁর বেশ খুঁত-ধরা অভ্যাস হয়েছে।
কনকপ্রভা আঁচল দিয়ে উনুন থেকে কড়াই নামিয়ে চায়ের জল বসালেন। কালীকিঙ্কর আড়চোখে দেখলেন।
তাঁর এখন ভারি তাড়া। বাসা থেকে মাইলটাক হেঁটে তাঁর ছোট্ট ডিসপেনসারি ‘আয়ুর্বেদালয়’।
একখানা ঘর নামমাত্র ভাড়ায় নিয়েছেন। ঘরে গোটাদুই পুরনো কাঠের আলমারিতে ওষুধের শিশি-বোতল।
দুটো চেয়ার, একটা সরু বেঞ্চ, একটা টেবিল। সকাল দশটা থেকে বেলা বারোটা, বিকেল পাঁচটা
থেকে সাতটা রোগী দেখার সময়। প্রথম দু-বছর নিজেই ডাক্তার, কমপাউন্ডার, ওষুধ-বিক্রেতা
ছিলেন। বছরদেড়েক হল একজন সহকারী রেখেছেন। ওই বাংলা থেকে-আসা পরিচিতদের সুপারিশে পসার
খানিক বেড়েছে। কাছাকাছি গরীরগুর্বো এলাকা থেকেও মানুষ আসছে। রোগীর চাপ কম থাকলে সন্ধের
পর ডিসপেন্সারির দরজায় তালা ঝুলিয়ে, শেকল তুলে বের হন। সহকারী কানাইকে ছুটি দিয়ে দেন।
মিনিটদশ হেঁটে গেলে হেদুয়ার পুকুর। সেখানে ক-জন বয়স্য আসেন। এঁরা তাঁরই মতো ওপার থেকে
এক-কাপড়ে চলে এসেছেন। পরিবার নিয়ে মাথা গুঁজে আছেন ভাড়াবাড়িতে। দুঃখ-দুর্দশার গল্প
ভাগাভাগি হয়।
উমাচরণ ঘোষের ছোটোখাট পাটের ব্যবসা ছিল। আক্ষেপ করেন,
“স্বাধীনতা! স্বাধীন হইছি! আমরা হইলাম গিয়া উদ্বাস্তু। ভিটা
হইতে উৎখাত হওয়া দ্যাশের জঞ্জাল। জমির থে’ ঘাসপাতা তুইল্যা ফালাইলে গরু-ছাগল খাইয়া
বাচে। আমরা হেয়ারও অধম। কাউর মাথাব্যথা দেহেন আমগ লাইগ্যা? ওইপারে ঘরবাড়ি আছিল। সামাইন্য
ধানজমি আছিল। সম্বচ্ছর খাওনের চিন্তা আছিল না। মেলা চিরা, মুরি, খই। আকালের কালেও পরিবার-মাইয়া-পোলারে
ফ্যানাভাত দিছি। অহন শুকনা শুকনা শক্ত আটার রুটি। দাত নাই, গলাত বাইজ্যা যায়।”
হাকুচ ময়লা ধুতির খুঁটে চোখ-মুখ মোছেন হরনাথ ভট্টাচার্য। বয়স
এঁদের চেয়ে বেশী। লেখাপড়া খুব বেশী জানেন না। পুরোহিতের কাজ করতেন। এখন দুটি কামরার
ভাড়াঘরে ন-দশজন কোনওরকমে দিন কাটাচ্ছেন। প্রথম এসে শেয়ালদা’ স্টেশনে ছিলেন। তাঁর অবস্থা
সবচেয়ে খারাপ। দুঃখদিন যেন শেষ হয় না।
“শিয়ালদহ প্যাটফরম থে’ তুইল্যা উল্টাডাঙা রিপুজি ক্যাম্পে নিল।
দুইমাস মন লয় আছিলাম। মেলা লোক। ছত্তিশজাত এক লগে। টিনের ঘর দিছে ছাগলের ঘরের মতন ছুটো
ছুটো। ছানের জাগা নাই। দুইতিনডা পায়খানা একমাইল গিয়া। হেইগুলার সামনে ব্যাবাক মাইনষের
লাইন। কত বুড়া কাপরে-চোপরে হাইগ্যা দিছে। রাজাবাজারের এক ফেমিলি, আমগ গ্যাতি আত্মীয়।
হেরা দ্যাশভাগের আগেই আইছে। কয়, কাকা, মহিলাগ আমার বাসাত নিয়া যাই। ইয়ার চে’ ভালা থাকব। আপনের জাগা-বাসা
অইলে যাইব’নে। বড়পোলায় কারে জানি ধইরা
হাতিবাগান বাজারে কাম নিছে। মাল তুলে, নামায়। বাসাও জুগার করছে। ছাওয়ালডার খাটনি দেইখ্যা
চক্ষে জল আসে। কী করুম? নাতিডা ভাদাইম্যা হইছে। বামুনের পোলা, ইশকুল-টিশকুল নাই। প্যাট
না ভরলে অইন্য চিন্তা ক্যামনে করব! এরে বাইচ্যা থাকা কয়?”
কালীকিঙ্কর এসব শোনেন, সমস্বর বিলাপ বুকে বেঁধে। নিজের কথা প্রকাশ
করতে ইচ্ছে করেনা। তাঁর অবস্থা তুলনায় উন্নত। তবু মাসের শেষে সম্বল বলতে স্ত্রীর মাটির
ভাঁড়ে জমানো খুচরো পয়সা। বেশীদিনের কথাও তো নয়। বছরপাঁচেক হল সব ছেড়ে এসেছেন। আয়ুর্বেদ
চিকিৎসক হিসেবে যথেষ্ট পসার-প্রতিপত্তি ছিল। শহরাঞ্চলে দোতলা দালান। ভাইদের দু-তিনটি
ছেলে কাছে থেকে লেখাপড়া করত। জ্ঞাতিদের মিলমিশ ছিল। সংসারে সাহায্যকারী পরিবারটিকেও
বাগানের একপাশে ঘর দিয়েছিলেন। আয় যেমন ছিল, ব্যয়ও করেছেন। হিসাব করে চলতে শেখা হয়নি।
এখানে এসে কনকপ্রভা খিটখিটে হয়ে গেছেন। তাঁর ভ্রূতেও সর্বদা বিরক্তির ভাঁজ। আকাশে তাকিয়ে
পুরোনো সময় মনে পড়ে। সেই তো একই আকাশ! চোখের সামনে পুকুরের জলে হাওয়ার ঠেলায় ছোটো ছোটো
ঢেউ ওঠে। চারদিক গাছে ঘেরা বলে অন্ধকার ঘন দেখায়। পাখিদের ডাকাডাকি কমে আসে। তাদের
ঘুমের সময়। ‘কই গ্যাল গিয়া সকল দিনগুলা—!’ কালীকিঙ্কর বুকের মধ্যে থেকে ছোট্ট নিঃশ্বাস বাতাসে উড়িয়ে
দেন। আচমকা কাঁধে হাত পড়ে। তিনি চমকে ওঠেন। কুমুদরঞ্জনের খরখরে স্বর বলে,
“কী ভাবেন কালীবাবু?”
“অ আপনে! ডরাইয়া দিলেন। বসেন।”
“ফেরত যাবেন?”
“কই আর যামু?”
কালীকিঙ্কর ম্লান হেসে জবাব দেন। কুমুদরঞ্জন ফর্সা, খুব রোগা,
বেঁটেখাট অকৃতদার মানুষ। ভাইদের সংসারে থাকেন। পোশাকের মলিন ছাপ তাঁর মুখে কখনও ফোটে
না। বলেন,
“কলকাতা শহরে গরম য্যান বেশী লাগে। ভাদ্রমাস শ্যাষ হতে আসল, এখনও
গরম কমে না। ঘামাইতে ঘামাইতে রক্ত জল হয়ে যাবে।”
“হ।”
“আমি ছিলাম ইচ্ছামতী নদীর ওইপাড়ে, ওই বঙ্গে। নদীর চরে ঘর। কেমন
বাতাস, কী শান্তি। চারবছর হইল ভিটা ছেড়ে এসে পড়ছি। থাকনের উপায় নাই। মেরে খেদাইয়া দিচ্ছে।
কুনো জেলারে ছাড়ান দিল না। যারা থেকে গ্যাছে, তাদের থে’ খবর পান? না। গতবচ্ছর ফেব্রুয়ারি
মাসে কী হল? শুনছেন খবর? ঘোষমশয়?”
“হ, শুনছি।”
“উর্দুরে বলছে রাষ্ট্রভাষা? উর্দুভাষা শেখা লাগব বাংগালিদের।
ভাষার লাইগ্যা মিত্যু! হাঃ কেও শুনছে আগে?”
“শান্তি নাই। পুনরায় দাঙ্গা লাগব, দেইখেন।”
কুমুদরঞ্জন আন্দোলনের গল্প করেন। ওপারের বাঙালিরা কেমন মার খাচ্ছে
সেই কাহিনি শোনান। রক্তপাত, অত্যাচার, খুনোখুনির বিবরণ দেন। কালীকিঙ্কর উঠে পড়েন,
“ইসে, আপনেরা বসেন। আমি বোঝলেন, অহন যাই। রাইত অইতাছে। পনরমিনিট
হাটন লাগব।”
সমস্ত খবর রাখেন তিনি। আর শুনতে ইচ্ছে করে না। আসলে আজকাল কিছু
ভালো লাগে না। একই আলোচনা, ফেলে-আসা সময়ের জন্য কাতরানি। পড়ে-থাকা বাস্তুভিটার জন্য
হাহাকার। চলতে চলতে ভাবেন, তাঁর চকমেলানো দোতলা বাড়িটা কেমন আছে? দখল হয়ে গেছে? কোনও
অছিলায় একবার ঘুরে দেখে আসা যায়, কিন্তু মন সায় দেয় না। আনমনে পথ হাঁটেন কালীকিঙ্কর।
এই শহরে গাড়িঘোড়া অনেক বেশী। সতর্ক না থাকলে ধাক্কা খেতে হয়। গত অক্টোবরে ট্রাম চাপা
পড়ে মারা গেলেন একজন নামী কবি। দিবুর কাছে নামটা শুনেছেন। ওপারে থাকতে তার মাস্টারমশাই
ছিলেন। তিনি কবিরাজ, বাস্তববাদী। কবিতার খবর রাখেন না। কিন্তু খবরটা তাঁকে বিস্মিত
করেছিল। ট্রামের মতো শ্লথগমন যান কী করে মৃত্যুর কারণ হতে পারে? মানসিক উদ্বেগ ঝেড়ে
ফেলে কালীকিঙ্কর সাবধানে গতি বাড়ান। চারপাশ ইলেকট্রিক আলোতে ঝলমল করছে। সন্ধেটা অন্যরকম
এখানে। তাঁর বাড়িতে ইলেকট্রিক কানেকশন ছিল না। পেছনে পুকুর ছিল, আম, জাম, পেয়ারা গাছ,
কলাবাগান ছিল। সন্ধে নামলে ফুরফুর করে হাওয়া দিত। একতলায় তাঁর ঘরে হ্যাজাক জ্বলত, তিনি
রোগী দেখতে বসতেন। বাইরে অপেক্ষা করত আরও মানুষ। রোজ স্মৃতির বোঝা বয়ে কালীকিঙ্কর তাঁর
বাসাবাড়ির দরজায় কড়া নাড়েন। ঘোমটা বাঁহাতে মাথার ওপর খানিক টেনে কনকপ্রভা দরজা খুলে
দেন। তেতো গলায় বলেন,
“এত রাইত করলা?”
কালীকিঙ্কর অধিকাংশ দিন উত্তর দেন না। কথা বললেই আজকাল স্বামী-স্ত্রীতে
বেজায় খিটিমিটি লাগে।
কালীকিঙ্কর যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সেখানে একতলা-দোতলা মিলিয়ে ছ-ঘর ভাড়াটে। বাড়িওয়ালা থাকে অন্য কোথায়। ছোটো-ছোটো দু-তিনখানা করে ঘর প্রতি ভাড়াটের ভাগে। উঠানে কল, চৌবাচ্চা। জলের কোনও অভাব নেই। চাতালের শেষে বাথরুম, পাকা পায়খানা। বাড়ির অদূরে ছেলেদের মেস, হৈচৈ শোনা যায়। কালীকিঙ্করের মতো আর তিনঘর ভাড়াটে দেশ ছেড়ে এসেছেন। দু-ঘর হিন্দুস্থানী, গ্রামসুবাদে পরস্পরের ভাই-বেরাদর। হিন্দুস্থানী ভাষা এবাড়ির কেউ বোঝে না। পুববাংলার ভাষাও হিন্দীভাষীরা বুঝতে পারে না। ফলে পরস্পরকে এড়িয়ে চলে। দুপুরের খাওয়া সেরে ভাড়াটে বউ-মেয়েরা মাঝখানের চাতালে এসে বসে। গল্প করে, বড়ি দেয়, আচার মাখে, সেলাই করে। কনকপ্রভাও একএকদিন এসে বসেন। ছবি নামে অল্পবয়সী বউটি সপ্তাহে তিনদিন একটা দর্জিখানায় কাজ করে। নানান গল্প শোনায়, আর হেসে কুটিপাটি হয়।
“জানেন নি মাসিমা, পাশের বাড়িত বাইট্যা জামাই আইছে না? মুটকি
মাইয়াডার বিয়া দিল যে বৈশাখ মাসে? তত্ব আইল, ভিয়ান বইল, নবৎ দিল?”
“কী অইছে?”
ছবি বলতে গিয়ে হাসতে শুরু করে।
“কাইল দুফরে ছাদে উটছি কাপড় নামাইতে। ব্যাডা দেহি দারাইয়া ফুকফুক
ছিগারেট টানে। আমারে দেইখ্যা কুতিকুতি চক্ষুদুইডা ঘুরায়, ডাকে। আমি মাথার কাপর ফালাই,
আগাইয়া গিয়া কই, কী কবেন ক’ন! হালার পুত দেহি ডরাইয়া গ্যাছে গা! পাছে-পাছে হের হোদলকুতকুত
বউডা আইছে। চিকন গলায় জামাইরে কয়, ‘অগো শুনচ, ওদের সঙ্গে কতা বোলুনি কো। পারবে নিকো।’ আমরা নাকি ব্যাবাক বাংগালদ্যাশের
লোক তাগ দ্যাশে ঝাটাইয়া আইছি। আমরা ঝগরাইট্যা। মাইয়ালোকরা পুরুষের লগে-লগে ছিরা চটি
ফটফটাইয়া রাস্তায় ঘুরি।”
“অ কপাল! তুমি কী কইলা?”
“আমি গেছিলাম খালিপা। কইলাম, ছিরা চটিখান দ্যাখবেন নাকি? আইন্যা
দেই? তক্ষনই দুইও-জন দুপদুপাইয়া গ্যাল গিয়া।”
ছবির ভালোমানুষ শাশুড়ি ধমক দিয়ে বউকে থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা
করে। বাকি সকলে প্রাণ খুলে হাসতে থাকে। শুধু কনকপ্রভার মুখ অন্ধকার হয়ে থাকে। তিনি
নিজে রাস্তায় বের হন খুব কম। এইরকম কথা তাঁর ছোটোমেয়ে সুলেখা এসে কতবার বলেছে। কালীকিঙ্করও
বলেছেন একদিন,
“আইজ একজন রুগী কইল, কবরেজমশয়, কলকাতার বড় পূজাগুলা দ্যাখছেন?
দেইখ্যা আইবেন। রাজবাড়িগুলা যে যাইব তারে প্যাট ভইরা খাওন দেয়। সারি দিয়া কাংগালভুজন
করায়। কইলাম, শুনেন আমাগ বাড়িত, নিজেগ বাড়িত বিরাট পূজা অইত। কত লোক প্রসাদ নিত রোজ—। শুইন্যা মুখ ভ্যাটকায়।
কয় কী, তাই ত, পূর্ববঙ্গের বেবাক লোক ত জমিদার আছিল! অহন কাংগাল অইয়া ক্যাম্পে ঢুকে।
আমগ জমি কাইরা ঘর বান্ধে।”
কালীকিঙ্কর উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। স্বর থরথর করে কাঁপছিল। কনকপ্রভা
বলেছিলেন,
“তুমি কী কইলা?”
“কিছু কই নাই।”
কনকপ্রভা জানেন, এই অপমান নির্বাক হয়ে হজম করার মানুষ কালীকিঙ্কর
আগে ছিলেন না। রাশভারী মানুষ, তাঁর রাগ দমকা আগুনের মতো। জ্বলে উঠলে নিবত না সহজে।
কনকপ্রভার স্বামীর জন্য বড় কষ্ট হয়। আটবছর বয়সে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছেন। আজীবন ধূমধাম
করে দোল, রাস, দুর্গোৎসব হতে দেখেছেন। অপমানের ভাষা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন না।
এবাড়ির মেয়ে-বৌরা দল বেঁধে ম্যাটিনি শো-তে সিনেমা দেখতে যায়।
কাছাকাছি বেশ ক-টি সিনেমা, থিয়েটার হল। তাঁকেও ডাকে, তিনি যাননি একদিনও। বসে-বসে পাড়
থেকে সুতো বের করে পুরোনো কাপড় জুড়ে কাঁথা সেলাই করেন। মনের কথা নিঃশব্দে ছুঁচের ফোঁড়ের
সঙ্গে চলতে থাকে। তাঁর হাতের কাজ চমৎকার। দেশে থাকতে ক্রোশের কাজ-করা আসন, বালিশঢাকায়
বাড়ি সাজাতেন। বই পড়তে ভালোবাসতেন। এখন কিছু ভালো লাগেনা। পরিবারে রূপের খ্যাতি ছিল।
সচ্ছল সংসারের গৃহিনী ছিলেন। বাটনা-করা, মাছ-কাটা, উনান-ধরানো, কখনও করতে হয়নি। এখন
একজন ঠিকে-ঝি আসে বস্তি থেকে। যেমন-তেমন করে বাসন ক-খানা ধুয়ে, উনান লেপে, ঘর মুছে
দিয়ে যায়। ফি-মাসেই ওপারের দেশ থেকে কেউ-না-কেউ এসে হাজির হয়। তাঁদের বাসাটি স্টেশনের
বেশ কাছে, ফলে সুবিধা বেশী। শহর ইলেকট্রিক আলোয় ঝলমল করে। অল্প হেঁটে গিয়ে বাস-ট্রাম,
দোকান। অতএব অতিথিরা থেকে যায় দু-কামরার বাসাতে ঠাসাঠাসি করে।
সারাদিনের পরিশ্রমে ভীষণ ক্লান্ত লাগে। সকলের অগোচরে চোখে জল
ভরে ওঠে। চিরদিন পরিচ্ছন্নতা তাঁর বাতিকের মতো। বারোভূতের বাসাবাড়ি স্বাভাবিকভাবেই
অগোছালো, অপরিষ্কার। সারাদিন পড়শিদের উঁচু গলার চেঁচামিচি। রাত নিশুত হলে বারোটার ঘন্টা
বাজে আশেপাশের কোনও বড়ো বাড়ির ঘড়িতে। শুতে যাওয়ার আগে, কনকপ্রভা রান্নাঘর ধুয়ে-মুছে,
উনান সাজিয়ে, নালির মুখ কাগজ কেটে আঠা দিয়ে বন্ধ করে দেন। না হলে আরশোলা, ইঁদুর ঢুকে
তছনছ করে।
তেরোবছর বয়স থেকে আটটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। কোন জৈবিক কারণে
পাঁচটি সন্তানই বাঁচেনি। তাঁর চিকিৎসক স্বামী প্রত্যেকবার ব্যর্থ হয়েছেন। জীবিত সন্তানদের
মধ্যে বড়ো মেয়ে সুমতির শ্বশুরকুল দেশভাগের পরপর আসাম চলে গেছে। এক-আধখানা চিঠি আসে,
দেখা হয়না ক-বছর হল। ছোটো মেয়ে সুলেখা মাইলদুয়েক দূরে থাকে। জামাই একটা ছাপাখানায় কী
কাজ করে। তিনটে ছোটো বাচ্চা নিয়ে সংসারে অভাব। কালীকিঙ্কর সাহায্য না করলে তাদের চলত
না। স্ত্রীকে না জানিয়ে কালীকিঙ্কর গ্রাম-সম্পর্কিত দুঃস্থ আত্মীয়কেও বিপদ-আপদে দেখেন।
কনকপ্রভা বুঝেও কিছু বলেন না। মাঝরাতে হঠাৎ বুকের ভেতর ব্যথার মণ্ড পাকিয়ে ওঠে। যত
আবেগ, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, শোক-দুঃখ শক্তখোলায় ঢুকিয়ে বন্ধ করে গিলে ফেলেছেন। কাউকে বুঝতে
দেন না। এইসব ভাঙাচোরা দিনে নীরবতা তাঁর আভিজাত্যের একমাত্র আশ্রয়। বিকেলের আলোয় নদীর
চড়ার বালির মতো গায়ের রঙ এখন কুয়াশায় মলিন। প্রতিমার মতো মুখের আদল শীর্ন। টিকোল নাক
আরও তীক্ষ্ণ। শুধু ছিলেকাটা নাকচাবিতে রোদ পড়লে এখনও আলো ঠিকরায়।
দুই মেয়ের মাঝখানে দিবু – দিবাকর, তাঁদের শিবরাত্রির সলতে। বরাবরের
ভালো ছাত্র। যা সম্ভাবনা ছিল, সমস্ত মুখ থুবড়ে পড়েছে। নির্মূল করে দিয়েছে দেশভাগ। কিছুদিন
আগে পর্যন্ত ছেলে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে যুক্ত ছিল। দেশগঠনের বড়ো বড়ো কথা কনকপ্রভা
মোটেই ভাবেন না, বুঝতেও চান না। তাঁর স্বপ্ন পায়ের তলায় একফালি শক্ত জমি, নিটোল পরিপাটি
সংসার। আপাতত মাসকয়েক হল দিবাকর হুগলীর মোটর-কম্পানিতে কাজ ধরেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
তিনি ছেলেকে বাঁধতে চান। কালীকিঙ্করকে বলেছেন পাত্রী সন্ধান করতে – স্বদেশ, স্বজাতির
ফর্সা, সুন্দরী মেয়ে। কালীকিঙ্করের চেম্বারে দু-একজন আসে, যারা পাত্র-পাত্রী মিলিয়ে
দেয়। ঘটকালি করে।
গত পনেরোদিন জমজমাট চাঁদের হাট ছিল তারাসুন্দরীর সংসার। রমলা এসেছিল ছেলেকে নিয়ে। চলে গেছে তাও সপ্তাহ ঘুরতে এল। ভাগ্নের টানে মধুসূদন এসে থেকে গেল ক-দিন। প্রতিবেশীদের কোলে-কোলে ঘুরল শিশু। এখন আবার সব শান্ত, আগের মতো। ভারী দুরন্ত হয়েছে ছোট্ট ছেলে। তিনি ডাকেন গোপাল। সারাদিন খটর-খটর করে দৌড়েছে, এটা-সেটা ফেলে পালিয়ে গেছে। ধরে ফেললে খলখল হাসিতে বাড়ি ভরে দিয়েছে। তারাসুন্দরী ধীরেন্দ্রনাথকে একখানা মোহর দিলেন নাতির মুখ দেখতে। কীভাবে কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে এনেছিলেন, তিনিই একমাত্র জানেন। পুজো করতে বসলে নাতি কোলে এসে বসবে। তিনি সুর করে শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম শোনালে নিজের আঙুল চুষতে চুষতে কোলেই ঘুমিয়ে পড়বে। সংসারের কাজ সেরে মা আর মেয়েরা বিশ্রাম করতে গেলে সে ঘুম ভেঙে উঠে দিদিমার দুপা-র ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আধোগলায় বলবে,
"দিম্মা, গুংগি গুংগি গুংগি!"
ভারি শরীর ভরপেট। ভাতঘুম ছেড়ে তারাসুন্দরী হাঁটু ভাঁজ করে নাতিকে
বসিয়ে দোলাবেন,
"ঘুংগি লো ঘুংগি / কীলো ঘুংগি?
দা-খান দে / দা দিয়া কী করবা?
পাতা কাটমু / পাতা কাইট্যা কী করবা?
বৌরে দিমু / বৌ কই?
জল আনতে গেছে / জল কই?
ডাহুক খাইছে / ডাহুক কই?
বনে গেছে / বন কই?
পুইরা গেছে!
আমার গোপাল অহন কিয়ের মইধ্যে পরে? সোনায় পরে, না ছাইতে পরে?"
রমলা টেনে নামাবে ছেলেকে। জোর করে চেপে ধরে বলবে,
"আর না। এবার তুমি ঘুমাবে, দিম্মাও ঘুমাবে।"
গোপাল শুতে চায় না, সে আবার এই খেলা খেলবে। রমলা তখন তাকে থাবড়ে
থাবড়ে ছড়া বলে ঘুম পাড়াবে। অমলা বলে,
"ছোড়দির কথাগুলা অনেক চেঞ্জ হইয়া গেছে, না মা?"
রমলা খুশী হয়ে যায়,
"ওদের বাড়িতে শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়েছে। তোদের দাদাবাবু
বলে, আমাদের ভাষা বিশ্রী, জিভের ব্যায়াম!"
"ঈঃ কইলেই হয়? তুমি প্রতিবাদ করলা না?"
"বলে কী, তোমরা বলো 'ছাল-নাই কুত্তার বাঘা ডাক'। আমরা শুদ্ধভাষায়
বলি, 'রোঁয়া-ওঠা কুকুরের ভৌভৌ ডাক'। কোনটা ভালো?"
অমলা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। রমলা হাসিমুখে বোনের দিকে
তাকিয়ে হাসে। ছোট্ট মেয়ে নিঃশব্দে কখন বিয়ে হওয়ার মতো বড়ো হয়ে গেছে। স্নেহে তার চোখ
ভিজে যায়। তারাসুন্দরী রমলার গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। কিছু বলেন না। রমলা মা-র মুখের দিকে
তাকিয়ে বলে,
"চিন্তা কোর না মা।"
তারাসুন্দরী চোখ বুজে ভাবেন, গলার স্বরটাও যেন এক। দু-বোন পিঠোপিঠি
ছিল বলেই কি? রমলা বলে,
"মা, যাওয়ার আগে একটা ভালো স্টুডিয়ো থেকে অমুর একটা ফটো
তুলিয়ে দেব। আজকাল নাকি পাত্রপক্ষ মেয়ের ফটো দেখতে চায়।"
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন