রসনায় বাসনায়
শহরটার নাম লক্ষ্ণৌ। বিছানো হয়েছে শাহী দস্তরখান। নবাবের খাস রকাবদার প্লেটের ওপর সাজিয়ে দিয়েছে স্বচ্ছ মুক্তোদানার মতো পুলাওয়ের চাল, তার ওপর বসে খুঁটে খুঁটে দানা খাচ্ছে ‘গোস্ত কি চিড়িয়া’। দেখে আসল নকল চেনা দায়। খানপান কি শওকিন লক্ষ্ণৌয়ের নবাব থেকে রইসজাদা একে অন্যকে টক্কর দেয় দিনরাত। মোগলাই বিরিয়ানিকে দশগোল দিয়ে সেদিনের বাদশা তখন পুলাও। বদসুরত বিরিয়ানির সাথে নবাবি পুলাওয়ের রঙ রূপ স্বাদে কিছুতেই তুলনা হয় না। পুলাও রান্না হত গোস্তের সুরুয়ায়, গোস্ত পাক করার সময় তাতে মেশানো হত কুক্কুট নলি থেকে বের করে আনা সোনা রূপোর বরক আর ডিমের কুসুম দিয়ে তৈরি জলমোতি। এলাহি ব্যাপার! যে কোনো রইস দস্তরখানের ওপর দশ বারো রকমের পুলাও সাজিয়ে রাখা ছিল আম বাত। মির্জা আজিম উশশান এক বিয়ের অনুষ্ঠানে নাকি সত্তর রকম পুলাওয়ের আয়োজন করেছিলেন, নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলীও। মোতি পুলাও, নবরতন কিম্বা আনারদানা, পুলাও মানেই ছিল ওস্তাদির শেষকথা। সাথে ছিল কোরমার বেমিশাল সঙ্গত। নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ যখন কলকাতায় এসে বিরিয়ানির ভেতর ভরে দিচ্ছেন আলু তখন সে খুশবু গড়িয়ে যাচ্ছে বাঙালির হেঁশেল অবধি। নতুন কলকাতার বাবু বিবি সংবাদ থেকে উইকএন্ড ডিনারের টেবিল যত্রতত্র এসে হানা দিচ্ছে লক্ষ্ণৌয়ি বাওর্চিখানার খোশবাই। আর তাতেই দিল দিওয়ানা হয়ে যাচ্ছে সেরাস্তায় খাতা লেখা কিম্বা পায়রা ওড়ানোর আসরে টুকুস উঁকি দেওয়া আম বাঙালির।
এদিকে প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণ ওলোটপালট করেও পাওয়া যাচ্ছে না এইসব গন্ধ সংক্রান্ত নিদান। বাঙালি ততদিনে নাক উঁচু আর্যদের সাথে একটা ভদ্রস্থ রফায় এসে গেছে। বৃহদ্ধর্ম কিম্বা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনেক অংক কষে বাঙালির মাছে ভাতে থাকার ব্যবস্থায় শিলমোহর জোগাড় করে ফেলেছে। কিন্তু তাই বলে নবাবি মাংস কিম্বা শাহী দস্তরখান কোনটার সাথেই বাঙালির তখনো মাখোমাখো ব্যাপারটা জমেনি। বাঙালির জাস্ট-বাঙালি থেকে হিন্দু-বাঙালি হয়ে ওঠার জার্নিতে সে ছেড়েছে অনেককিছু। উত্তরের নিরামিষ ফরমান আর শকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের পৈতেগাছা ধরে বাঙালি ভেসে থেকেছে বৈদিক স্রোতে কিন্তু তারচেয়েও প্রবল চোরাস্রোত তাকে টেনে নিয়ে গেছে মাংস কিম্বা মাছের স্বাদকোরকীয় তৃপ্তিতে।
ঠিক এই কারণেই মাছেভাতে কিম্বা মাংসভাতে বেড়ে ওঠা বাঙালি ব্রাহ্মণ ওদিকের আর্যপাড়ায় ধোপে টেকেনি। অথচ টিকি, চন্দনে জাতে ওঠার কম চেষ্টাও তো বাঙালি করেনি
তবুও হিন্দুত্ব, নিরামিষ আর দেশভক্তির সহজ ফর্মুলার দিনে আরেকবার খাবারের গোড়া থেকে খোঁজ শুরু করলেই বা মন্দ কী? সে তো আমরা প্রতিদিন পায়ে পায়ে পিছিয়ে যাচ্ছি দু দশ বছর। পিছন ফিরতে আমাদের আপত্তি নেই কোনকালেই। বরং পিছনে হাঁটলে একটা রিটেক হওয়ার চান্স থাকে। আমরাও একবার পিছনে হাঁটি না হয় বেদ, উপনিষদের পায়ে পায়ে।
শুরুতেই তবে ফেরা যাক হিন্দু শব্দে। হিন্দু কারা?
যে বা যারা ব্রাহ্মণ্য মতের অনুসারী তারাই হিন্দু। ‘ব্রাহ্মণ্য মত’ অতি সরল। বেদবিহিত আচরণই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। অতএব বেদেই ফেরা যাক আরেকটিবার ঋগবেদ বলেছেন ‘যদদ্যতে তদন্নম্’, যা খাওয়া যায় তাই অন্ন। কিন্তু বেদের সময়ে কী খাওয়া যেত? কী খাওয়া যেত তার উত্তর যেমন ভার্সাটাইল, তেমনি কী পাওয়া যেত সে উত্তর আরও গুরুত্বপূর্ণ। আর্যরা চণ্ডালদের মোটে ভালো চোখে দেখত না। কারণ তারা শ্বন্ মানে কুকুরের মাংস খায়। অথচ ঋগবেদের ঋষি বামদেব বলছেন, অভাবে পড়ে কুকুরের নাড়িভুঁড়ি খেয়ে কাটাতে হয়েছে। এদিকে বেদে অন্ন শব্দটা অর্থ হিসেবে বেশ ব্যাপক। অন্নগন্ধী খাবার পাওয়ার প্রার্থনাও এই বেদেই লেখা আছে। এইখানে একটা ভ্রু কুঁচকানো প্রশ্ন আসে। ‘অন্নগন্ধী’। আজকের দিনে হলে বুঝতাম সিনথেটিক কালার, আর্টিফিসিয়াল অ্যারোমা মেশানো প্যাকেজেড ফুড। তবে এই প্রার্থনা যখন লেখা হচ্ছে তখন ঋগবেদের কাল। ‘অন্নগন্ধী’ শব্দটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ একিউট শর্টেজ অফ ফুড। খাবার নিয়ে নিশ্চয়তা নেই, fussy eater শব্দটা তখন জন্ম নেয়নি। যা পাওয়া যায় তাই ঈশ্বরের দান হিসেবে নেওয়াই দস্তুর। খাবার নিয়ে বাছবিচার চলে না, তাই নিদেন পক্ষে ‘অন্নগন্ধী’ খাবারের প্রার্থনা। বেদজ্ঞানী ব্রাহ্মণ ঊষস্তি চক্রায়ন চন্ডালের এঁটো পচা মাসকলাই খেয়ে বেঁচেছিলেন। সেখানে উঁচু নিচুর হিসেবও মাথায় আসেনি।
আর্যরা যে যাযাবর ছিল, চাষবাসের উপযুক্ত শিক্ষা বা জমি কোনোটাই তাদের যে ছিল না, পশুপালনই যে ছিল তাদের মূল প্রফেশন একথার প্রমাণ বাইরের দেশ থেকে জেনে আসার দরকার নেই, আর্য সাহিত্যেই সে প্রমাণ ভুরিভুরি আছে। শর্যাত মানে পশু পালকদের ভ্রাম্যমাণ ঠিকানাগুলো ছিল গ্রামের একক। বৃত্রের সাথে ইন্দ্রের লড়াইটা আদতেই জমি দখলের লড়াই, জলের অধিকার পাওয়ার লড়াই – সেকথারও প্রমাণ হল যজ্ঞের মন্ত্রগুলি। বেদে ইন্দ্রকে ‘বাজসনি’ মানে অন্নদাতা বলা হয়েছে। ইন্দ্রই অন্নের অধিপতি। তেমনি বলা হল পূষাই অন্ন। পশুপালের দেবতা পূষা। সে পশুর ফার্টিলিটি বাড়ানোই হোক, মড়ক থেকে রক্ষা হোক বা হারানো পশু খুঁজে এনে দেওয়াই হোক সবই এঁর দায়িত্বে। এঁর দায়িত্ব খাবার জোটানোরও, কারণ পশুর মাংস বা দুধই তখন প্রধান খাবার। পশুপালক আর্যদল একজায়গায় ততদিন থাকে যতদিন সেখানে পশুদের খাওয়ার সংস্থান থাকে।
আর এই চারণভূমি দখলের লড়াইয়ে ইন্দ্র বনাম বৃত্রের যুদ্ধের গল্পটা যখন পারস্যের জেন্দা আবেস্তাতেও অপ ওশা বনাম তিশ তারের যুদ্ধের গল্প হয়ে যায়, তখনই নৃতাত্বিক বলেন আর্য আদতে একটি যাযাবর জনগোষ্ঠী, যার একটা দল ঘুরতে ঘুরতে এদেশে এসেছিল এবং থিতু হয়ে গেছিল। তবে যদিও একটি মিথিক্যাল গল্প সে প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়, তাই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রমাণের পাশাপাশি একবার বেদের আমলের সাহিত্যের দিকে তাকালেও দোষ হয় না। ঋগবেদের মন্ত্রগুলোয় ‘দেহি দেহি’ রব। শত্রুদের ভূমি, নারী, পশু ও শস্য আমাদের দাও। অন্ন দাও। কেমন অন্ন? না যে অন্ন শক্তি, বল, বীর্য, পুষ্টি বাড়ায়, যক্ষ্মা নাশ করে। অন্নই যশ, অন্নই শ্রী। একটি অঞ্চলের সমৃদ্ধ, স্থায়ী ভাবে বাস করা গোষ্ঠীর সঙ্গে বাইরে থেকে আসা গোষ্ঠীর বাঁচার লড়াইতে টিকে যাওয়ার প্রাথমিক চাওয়াই হল খাবার যা তাদের পুষ্টি ও শক্তি দেবে, তাদের বংশ বাড়াতে সাহায্য করবে। শত্রুদের নারীর জন্য প্রার্থনাও সেই কারণেই। এই যে অন্নের জন্য এমন হাহাকার তার ছবিটা খানিকটা মিলে যাচ্ছে না দেশভাগের পরে পরেই পূর্ব পশ্চিম দুদিক থেকেই ভেসে আসা জনস্রোতের সাথে? তবে পার্থক্যও আছে। যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত লোকের ছাদের চিন্তা থাকে না। কিন্তু অন্ন? সেটি না পেলে এ তল্লাটের স্থায়ী বাসিন্দাদের সাথে পাল্লা দেবে কীভাবে, আর পাল্লা দিতে না পারলে কীভাবে পাবে চারণভূমির অধিকার? ব্যাপারটা মস্ত এক vicious circle, তাই যেনতেন প্রকারেণ খাবারটি জোটানো চাই, সেখানে বাছবিচার চলে না।
যেহেতু খাবার অনিশ্চিত, তাকে নিশ্চিত করার কোনো ট্রাইড অ্যান্ড টেস্টেড উপায় জানা নেই তাই অদৃশ্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞই একমাত্র উপায় বলে ধরে নিল মানুষ। এমনকি দেবতারাও অন্ন, শ্রী আর যশের কামনায় যজ্ঞ করেছিলেন। সেই যজ্ঞই উত্তরাধিকার হিসেবে পেল মানুষ। যজ্ঞও তো আদতে এক অনুকৃতিমূলক আচরণ ছাড়া আর কিছু নয়। সেই ট্যাবু টোটেম বিশ্বাসী আদিম সমাজ আর যাদুবিদ্যার অনুকরণ ও অনুষঙ্গমূলক আচরণ যেন যজ্ঞের বেদীতে এসে বসল। যা পেতে চাই সেরকম আচরণ করো। এই ছিল ট্যাবু। কোনো পশুর শিকার করতে চাইলে সেই পশুর মতো সাজপোশাক, আচরণ করলে পশু ধরা দেবে। কিম্বা বৃষ্টি নেই, বৃষ্টি পড়ার মতো একটা ব্যাপার করলে বৃষ্টি হবে। সেরকমই যা খেতে চাই, যা পেতে চাই তা যজ্ঞের দেবতাকে দিলে দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে সেটি আমার জন্যও ফিরিয়ে দেবেন এই ছিল বিশ্বাস। আর আগুন তো চোখের সামনেই হবি পুড়িয়ে ফেলে, মানুষদের তাতেই বিশ্বাস জন্মাল আগুন নিজের মুখেই যখন হব্য গ্রহণ করে তখন আগুনে আহুতি দিলে খাবারের আশ্বাসও পাওয়া যাবে। খাবারের জন্য ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, আদিত্য সমেত ছোট বড় সব দেবতাদের উদ্দেশ্যেই যজ্ঞ হল। যজ্ঞের হব্য পশুর মাংস, দুধ, দই, ছানা, মধু, সোমরস ইত্যাদি। ইন্দ্র নাকি পনিদের কাছে দই, ঘোল, ক্ষীর, ছানা ইত্যাদি তৈরির রাস্তাটা শিখে নিয়েছিলেন।
তবে যজ্ঞ যে সবসময় ফল দিত এমন তো নয়। সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হত দেবতা ঠিক খুশি হননি। আর তেমন ঘটনা যাতে না ঘটে তাই যজ্ঞের আয়োজনে বাড়াবাড়ি করে সেই ত্রুটি ঢাকার চেষ্টা ছিল। এক একটি যজ্ঞে প্রচুর পরিমাণে দুধ ছানা দই ক্ষীরের পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যায় পশু হত্যার নিদান ছিল। আর এই সমস্তই পেত যজ্ঞের হোতা, পুরোহিত, জোগাড়ের দল। সেদিক থেকে দেখলে খাবারের সেই আকালের দিনে এই প্রচুর পরিমাণ টাকাপয়সা, সম্পত্তি আর খাবার প্রাপ্তি, এতে তো ব্রাহ্মণের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কাজেই তারা ছিল যজ্ঞের পক্ষে, ইন্দ্রের পক্ষে। ইন্দ্রই সেই শ্রেষ্ঠ দেব যিনি বাজ অর্থাৎ খাবার নিশ্চিত করতে পারেন, বৃত্রকে হারিয়ে জল বয়ে আনতে পারেন। তাঁকে খুশি রাখতে হলে যজ্ঞই রাস্তা।
এই যে ঘুরেফিরে ‘অন্ন’ শব্দের উচ্চারণ, এই শব্দটি আদতে একটি ইন্দো ইউরোপিয়ান শব্দ। ইংরেজি বা জার্মান ভাষায় এর কাছাকাছি শব্দ রয়েছে edible ও essen। ঋগ্বেদের দশম মন্ডলে অন্ন হিসেবে যবের নাম পাওয়া যায়। বলা হল ‘যবই অন্ন’। যব থেকে তৈরি হল পুরোডাশ, খানিকটা নাকি দক্ষিণের ইডলির মতো। দুধের সাথে যব বা ধান জাতীয় শস্য ফুটিয়ে তৈরি হল চরু। অথর্ব বেদের যে অংশ বেদের একেবারে শেষ ধাপে রচনা হল সেখানে ওদন, তন্ডুল, শারিশাকা ইত্যাদি ধান জাতীয় ফসলের নাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। অথর্ব বেদের কুন্তাপোসূক্তে স্ত্রী স্বামীকে ঘরে থাকা পানীয়ের অপশন দিচ্ছে "দই, মন্থ নাকি যবসুরা কোনটি তোমার জন্য আনব প্রিয়?" এ তো সেই সময়ের কথা যখন পরীক্ষিত রাজা, যে সময় দেখানো হচ্ছে স্নান করতে আসা মুনির বউয়ের গলার হার চুরি করে পালাচ্ছে বৌদ্ধভিক্ষু।
আর্যরা সিন্ধুর তীর ছেড়ে যত এগিয়েছে ততই সময়ের সঙ্গে বদলেছে জীবনও। পশুপালন করে পশুর দুধ আর মাংসে যাদের অন্ন সংস্থান হত তারা ধীরে ধীরে প্রাগার্যদের কাছে শিখেছে চাষাবাদ। আর্য আর প্রাগার্য বিয়েশাদী তখন বেশ সচল। অনুলোম, প্রতিলোম বিয়ের নিদান সমাজ স্বীকৃত। মোটামুটি খ্রীষ্ট জন্মের সাত শতক আগে চাষের কাজে লোহার ব্যবহার শুরু হয়। লাঙ্গলের ফলায় কাঠের বদলে লোহা ব্যবহারে চাষ করার সুবিধার সাথে সাথে ফলনও বাড়ে। কিছু সারপ্লাস তৈরি হয়। তবে হ্যাঁ, এই সারপ্লাস আসে তাদেরই হাতে যাদের হাতে জমি প্রচুর। সমাজের সব লোকের কাছে খাবার তখনও সুলভ নয়, খাওয়ার অনিশ্চয়তা ছিলই। এটার সরাসরি মানে হল চিরকালের নিয়মে একদল লোকের হাতে গেল সমাজের সারপ্লাস প্রোডাকশন। অর্থনীতির চোখে এটিই হল "inequality in distribution of wealth..", এবং সেটিই আদতে ক্যাপিটালিস্ট স্ট্রাকচারের উৎসমুখ। ফসলের সারপ্লাস রপ্তানি করে কিছু লোক সৌখিন জিনিসের মালিক হল। নগরায়ন বাড়ল, পাল্টে যাওয়া প্রয়োজনের যোগান হিসেবে তৈরি হল শিল্পী, কারিগর, চাষী, পুরোহিত ইত্যাদি নানান পেশাগত শ্রেণী। বৈশ্য যারা তারা তখন বেশিরভাগই পেশাগতভাবে চাষবাস আর পশু চারনের সাথে যুক্ত। বেদে যে পনিদের কথা বলা হয়েছে তারা এই বৈশ্যশ্রেণীর লোক। এদের কাছেই ইন্দ্র নাকি শিখেছিলেন দই, ঘোল, চরু, ক্ষীর তৈরির প্রসেস কিন্তু এই যে চাষে লোহার ব্যবহার, জমিতে বাড়তি ফলন, রপ্তানি আর মুনাফার সম্ভাবনা এরই ফল হিসেবে ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের সরাসরি আঁচ এসে পড়ল গবাদি পশুর ওপর। বেদের আমলের যজ্ঞগুলো মোটামুটি তিন ভাগের। পশু, সোম আর ইষ্টি। এরমধ্যে প্রথম দুটিতে প্রচুর সংখ্যায় পশু হত্যা হত। যার কারণে চাষের কাজে ব্যবহার হওয়া বলদ, ষাঁড়ের যোগানে টান পড়েছিল স্বাভাবিক ভাবেই। আর সেই কারণে যাদের রুজিতে টান পড়ল তারা বেঁকে বসল যজ্ঞ বিরোধী হয়ে। এই দলে আর্য অনার্য দুপক্ষই সামিল। মনে রাখতে হবে যজ্ঞর পক্ষে যাঁরা সওয়াল করত তাঁরা ইন্দ্রপক্ষীয়, কাজেই অন্য দলটি হল সনাতন বিশ্বাসকে প্রশ্ন তুলে ফেলা ইন্দ্রবিরোধী দল।সমাজের ভেতর সনাতন প্রথার বিরুদ্ধে তলে তলে একটা বিদ্রোহের অবস্থা তৈরি হয়েছিল বোঝা যায়।
এই পরিস্থিতিতে যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণে যাজ্ঞবল্ক নিদান দিলেন "যে ধেনু ও ষাঁড়ের মাংস খাবে তার বিনাশ হবে, সে পাপী... অতএব খাবে না"।
কিন্তু ওই শতপথ ব্রাহ্মণেই অন্য জায়গায় লেখা আছে "এই হল সেরা খাবার, এই মাংস, তাই পশুবদ্ধ যাগ করলে সে পরম অন্নের ভোক্তা হয়"। অতএব রসনা ও রসদ এই দুইয়ের টানাপোড়েনে পড়ে ঋষিঠাকুর যাজ্ঞবল্ক আগের নিদানের সাথেই আরেকটু জুড়ে দিলেন ..."কিন্তু আমি খাব যদি সুস্বাদু হয়"।
ইন্দ্রবিরোধী, যজ্ঞবিরোধী দল তলে তলে সংখ্যায় বাড়ছিল। ইন্দ্র ও তার উদ্দেশ্যে করা যজ্ঞকে অস্বীকার করা আসলে বেদবিরুদ্ধ আচরণ, বেদকেই অস্বীকার করা। দিনে দিনে এই জনতার মুখ তৈরি হল। নিরগ্রন্থ জ্ঞাতপুত্র, মস্কলি গোশাল, অজিত কেশকম্বলী, পূরণ কাশ্যপ, রুদ্রক এঁরা প্রত্যেকে ছিলেন বেদবিরোধী, যজ্ঞবিরোধী, পশুহত্যার বিরোধী। জ্ঞাতপুত্র জৈন ধর্মের প্রথম প্রবক্তা যে ধর্ম সবরকমভাবে জীব হিংসার বিরোধী। অজাতশত্রু যখন বুদ্ধের কাছে গেলেন সন্ন্যাস জীবনের উদ্দেশ্য জানতে ঠিক তখন অজাতশত্রুর মুখেও শোনা গেছে এই প্রতিটি নাম।
বেদবিরোধী বৌদ্ধ ও জৈন দুই মতেরই আসল কথাটি অহিংসা। সেদিক থেকে দেখলে যজ্ঞবিরোধী পশুহত্যা বিরোধী ভাবনা বেদের সনাতন মত থেকে সরে এসে বৈপ্লবিক ভাবনাই। কেননা কিছুদিন আগে অব্দি বেদ বলেছে "ভোজনং মাংসরহিতম্" দুর্ভাগ্য ও অভিশাপের লক্ষণ। আর বৈপ্লবিক ভাবনা বলেই বৌদ্ধ ও জৈনকে সমাজে হেয় করা হচ্ছে শাস্ত্রে বৌদ্ধ ভিক্ষুকে মুনির স্ত্রীর গয়না চোর হিসেবে দেখিয়ে।
এর থেকে ঠিক দুহাজার বছরের মাথায় যখন বৌদ্ধধর্ম তন্ত্রের পাকে পড়ে পানাপুকুর হয়ে দাঁড়িয়েছে, জৈন ধর্ম মিশে গেছে হিন্দুত্বের মেইন স্ট্রিমে তখন নবদ্বীপের আরেক বিপ্লবীর থালায় দেখি বাঙালির মাছহীন মেনু। তিনিও মন্ত্রতন্ত্র, যজ্ঞ, আচার বিচার এবং সনাতন বিধানের বাইরে গিয়ে সর্বজীবে প্রেমের স্ট্র্যাটেজিতে স্টিক করেছিলেন। অদ্বৈত গোঁসাইয়ের ঘরে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবকে কী দেওয়া হল জানিয়েছে চৈতন্য চরিতামৃত-
"...মধ্যে পীত ঘৃতসিক্ত
শাল্যন্নের স্তূপ।
চারিদিকে ব্যঞ্জনডোঙ্গা আর মুদগসুপ
।।
সার্দ্রক বাস্তুক শাক বিবিধ প্রকার।
পটল কুষ্মান্ড বড়ি মানচাকি আর।।
চই মরিচ সূক্ত দিয়ে সব ফলমূলে।
অমৃতনিন্দক পঞ্চবিধ তিক্ত ঝালে।।
কোমল নিম্বপত্র সহ ভাজা বার্তাকী।
পটল ফুলবড়ি ভাজা কুষ্মন্ড
মানচাকি।।
নারিকেল-শস্য ছানা শর্করা মধুর।
মোচাঘন্ট দুগ্ধ কুষমান্ড সকল প্রচুর।।"
এতক্ষণে মাংসহীন খাবারে কেমন যেন বিপ্লবের গন্ধ ছড়িয়ে গেল না? খানিকটা কী কম্যুনিজমের আগাম আঁচও টের পাওয়া গেল? একদলের হাতে সম্পদের পুঁজিকরণ থেকে পশুকে বাঁচিয়ে রেখে আরেকটু বেশি ফসল ফলানোর আমজনতার তাগিদ জিতে গেল? বেদের সনাতন সিস্টেমের বাইরে গিয়ে, ইন্দ্র আর যজ্ঞের বিরোধিতায় এই যে মেনুতে বদল তা যে বেদবিরোধি নয় এমনটি তো আর জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না! সে না যাক। বিপ্লবে বা বিদ্রোহে বাঙালির আপত্তি নেই কোনদিনই। মদ্য, মাংস কিম্বা মাছেও না। তাই বিশেষ বিশেষ তিথি ছাড়া বাঙালি পুরাণকাররাও এতে আপত্তি করেননি। নবাব ওয়াজেদ আলীর পর বিরিয়ানি যদি তার সহি কদরদান মেহেরবানকে খুঁজতে চায় তবে তার দরবারে একটিই নাম, বাঙালি। উত্তরের শান আর বাঙালির জান দুইই এসে মেশে খাবারের থালায়। রাজনীতির চাপে হোক বা সমাজের তাপে, বাঙালি আজ ফিউশনবাদী। শালগ্রাম শিলায় ক্ষীরভোগ দেয়, কালির নামে মাংসে মজে। মোটকথা বাংলার কবি হোক কিম্বা রসনা দুইই ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে। পিসিমার নিরামিষ হেঁশেল থেকে শাহী দস্তরখান অবধি পৌঁছনো আসলে কোন নতুন পথের কথা নয়, এ আসলে আমাদের জার্নি এন্ড রিটার্ন জার্নি – কখনো বেদের আদিতে, কখনো চৈতন্যে।
(এই
লেখার জন্য যাঁদের কাছে ঋণ : সুকুমারী ভট্টাচার্য্য, দীনেশচন্দ্র সেন, আব্দুল
হালিম শরর, চৈতন্য চরিতামৃত)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন