![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
ধাতব
আকাশ
আমার স্বামীর প্রতি আমার চরম বিতৃষ্ণার কারণ তার কৃপণতা আর পরম মাতৃভক্তি। বিয়ের পর-পর প্রেম প্রবল ছিল বলে তখন অতটা অসহ্য লাগতো না এখন যেমন লাগে। প্রতিদিন অফিস থেকে এসে তার একমাত্র লুঙ্গিখানা এবং স্যান্ডেল গেঞ্জি পরে মনোযোগে পেপার পড়তো সে, আর আমার বাবার বাড়ি যাবার সময় মিষ্টি বা ফলফলাদি কিনে নিতে বললেই চেহারায় ফুটতো বিরক্তি। আমার কাপড়জামা, শাড়ি কিনতে গেলে তো মহাবিপদ একেবারে। সে যেসব কাপড় পছন্দ করতো আমার জন্য, সেগুলো কমদামি আর আমার অপছন্দের, আর আমি কোনোটা পছন্দ করলে, বেশি দামের বলে সে ভ্রƒ কুঁচকে থাকতো। তার ভ্রƒ ততক্ষণ সোজা হতো না যতক্ষণ না আমি তার পছন্দের কাপড়ই শেষমেশ কিনতাম। প্রথম দিকে তাকে খুশি করতে চেষ্টা করলেও, পরে তার উপরে এতই করুণা হতো যে দোকান থেকে কিছু না-কিনেই ফিরে আসতাম।
এভাবেই বিয়ের প্রায় দু’বছরের মধ্যেই আমার স্বামীর প্রতি
আমার শ্রদ্ধাবোধ প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে আসে এবং তাকে এবং তার কৃপণ পরিবারের সব
সদস্যদের মানবেতর প্রাণী মনে হতে শুরু করে। ঠিক সেময়েই আমি প্রেগন্যান্ট হই।
স্বামী, শ্বশুরবাড়ি, সন্তান গর্ভে আসা, সব মিলিয়ে প্রবল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হই
গর্ভধারণের অল্প সময়ের মধ্যেই। হঠাৎ হঠাৎ হাইমাউ কাঁদতে শুরু করি। স্বামী বা
শাশুড়ি কারণ জানতে চাইলে আমি শুধু বলি যে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। শাশুড়ি
ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে তার একমাত্র পুত্রবধূকে নিয়ে, তাও আবার অন্তঃস্বত্বা। খাবারদাবার, বাজারসদাই সবকিছুতেই কৃপণ হলেও নিয়মিত আমার
জন্য দু’গ্লাস দুধ এবং দুটা ডিম রেখে যায় আমার রুমে।
আমার স্বামীর
আজব মাতৃভক্তি প্রায়ই আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিত। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় আমার জ্বর
হলে সে নার্ভাসভাবে বেশকিছুসময় পায়চারি করে। মা’কে ডাকে। তিনিও এসে আমার মাথায়
পানি ঢালেন। আমার স্বামী তার মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘নীনাকে কি আম্মা ডাক্তারের কাছে লইয়া যামু? জ্বর তো ১০৩-এর নীচে নামতেছে না।’ শাশুড়ি
জবাব দেন, ‘না, মাত্র তো জ্বর আইল গায়ে। তিনটা দিন পার হোক
অন্তত।’ রাগ আমার বাড়তেই থাকে। মাঝরাতে জ্বর তীব্র হয়। জামালের মুখে তখন থুথু দিতে
মন চায়।
তার পরদিন আমার জ্বরের কথা শুনে আমার মা এসে আমাকে নিয়ে যায়। জামালও আসে আমার সাথে। জ্বর বেশি হলে আম্মা আর জামাল দুইজনেই পানি ঢালে। রাত নয়টার দিকে বাবা বাড়ির কাছের এমবিবিএস ডাক্তার নিয়ে আসে। সে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে পরামর্শ দেয়। ডাক্তার চলে গেলে আম্মা-আব্বা জামালের সাথে পরামর্শ করে। জামাল বলে, ‘আর দুই-তিনদিন দেখি না, ভাইরাস জ্বর-ও তো হইতে পারে।’ রাত পৌনে এগারটায় জ্বর কমলে জামাল বুঝিয়ে বলে আমাকে সে এখন বাসায় নিয়ে যেতে চায়। কারণ বুড়া মা একা থাকে, ডাকাতি-টাকাতিও হতে পারে। আমি জ্বরের মধ্যে খিস্তি শুরু করি, ‘যাও, মা’র আঁচলের তলে ঢুইকা থাকো। আমার এখানে আর দরকার নাই।’ এরপরই বাথরুমে গিয়ে বমি করে আসি। বমি করার সময় জামাল এসে জড়িয়ে ধরে। শেষ হলে আমি বলি, ‘তোর সংসার করার রুচি আমার নাই।’ কিছুসময় গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সে বের হয়ে যায়। সে চলে গেলে আমি আর আমার মা দুজনে মিলে তার ছেলে হাতের মুঠোবন্দি রাখার কলাকৌশল, তার অভিনয়প্রতিভা, এই নিয়ে জামালের মাকে ইচ্ছামতো গালিগালাজ করি।
রাতে জ্বর খুব বাড়লে,
মা
সারা শরীরে স্পঞ্জ করে দেয়, মাথায় পানি
ঢালে। আমার দুচোখ বেয়ে পানি পড়ে আর আম্মা জামাল এবং জামালের মাকে গালিগালাজ করে।
সকালে জামাল আমাকে দেখতে এলে আবারও তার মাকে গালি দেই। আমার মাথায় স্পর্শ করলে তার
হাত ঝাটকা মেরে সরিয়ে দেই। সে আম্মার সাথে কিছুসময় কথাবার্তা বলে অফিসে চলে যায়।
আমার ডিপ্রেশন তীব্র হয়। সে রাতে সে আমার কাছেই থাকে, আর যায় না। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে বেশ ভোরে
অফিসে চলে যায়। আমি প্রায় সুনিশ্চিত থাকি যে এখন তার মায়ের কাছে হাজিরা দিতে
যাচ্ছে। মাকে একা ফেলে বউয়ের কাছে রাত কাটিয়ে মস্ত অপরাধ করে ফেলেছে সে। সকালে
আমার সাথে নাস্তাও করে যায় নাই। আম্মা সকালে আমার নাস্তা নিয়ে এলে আমি কেঁদে ফেলি, ‘আম্মা,
এই
হারামজাদি বেটির পোলার সংসার তো আমার পক্ষে করা মনে হয় সম্ভব হইব না।’আম্মাও সায়
দেয়, ‘পারবি কেমনে? বেটি কত্ত বড় পলিটিশিয়ান! তার ছেলেবউয়ের
বাচ্চা হবে, তার উপর এইভাবে
জ্বরে পুইড়া যাইতেছে, অথচ তার পোলা এক
রাইত শ্বশুরবাড়ি আইসা থাকলে তার মাথা খারাপ হইয়া যায়।’
সেদিন দুপুরে জ্বর কমে আসে আমার। কিন্তু বমি কমে না। যা খাই তা-ই বমি করি। অফিস থেকে দুই-তিনবার ফোন করে সে। আমি কথা না বলে রেখে দেই। তারপর আম্মা ধরে। আম্মার কাছে আমার শরীরের খোঁজখবর নেয়। বিকালে বারান্দায় বসি। বারান্দার পাশেই দু’টো নারিকেল গাছ। সবুজ ডাব ঝুলে আছে। বারান্দায় বসে থাকতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এক সময় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি। আত্মহত্যা করে ফেলবার ইচ্ছা হয়।
সন্ধ্যায় জামাল আসে। আমার জন্য প্রচুর আঙুর, ডাব,
পেঁপে, কিনে নিয়ে আসে। আমার বিছানার পাশে বসে কপালে
হাত দেয়। সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে থাকি। ‘সোনা আমার, লক্ষ্মীবউ আমার,’ নানাভাবে পটাতে চেষ্টা করে, আমি কোনো কথাই বলি না। রাতে টেবিলে থেকে ভাত
এনে মেখে আমাকে খাইয়ে দেয়। শুরুতে আমি না-না করলেও একসময় পটে যাই। ভাত খাওয়ার
খানিক পরই আবার বমি করি। জামাল এরপর রান্নাঘরে গিয়ে আম্মার কাজের-মেয়ের সাহায্যে
চমৎকার একটি পুডিং বানিয়ে নিয়ে আসে। সে রাতটা দারুণ কাটাই আমরা। পরদিন অফিস থেকে
কয়েকবার ফোন করে সে। কিন্তুপরে রাত প্রায় আটটা বাজলেও সে ফেরে না। মোবাইলে ফোন করে
জানি তার মায়েরও সর্দিজ্বর হয়েছে বলে তার পক্ষে আজকে আমার এখানে আসা সম্ভব না। আমি
আম্মাকে ডেকে বলি, ‘আমার শাশুড়ি
শাঁকচুন্নির কাণ্ড দেখছো? আমার কাছে আইসা
দুইটাদিন ছিল, সহ্য হইল না
বেটির।’ মোবাইলে জামালকে ফোন করে ইচ্ছামতো ঝাড়ি।
বাচ্চা জন্মের পর আমি ক্রনিক ডিপ্রেশনের রোগী হয়ে যাই।
শাশুড়ি, বাড়ির কর্তৃত্ব অন্যকে দেয়া পছন্দ করে না। সমস্ত রান্নাবান্না, টেবিলের খাবার দেয়া, সব সে নিজ হাতে করে। বাসার কাজের-মেয়েও তার ভীষণ অনুগত। আমার বাচ্চার যখন বয়স তিন মাস, সেসময় একদিন কাজের-মেয়েকে আমি বলি বাথরুমে গরমপানি দিতে আর আমার মেয়ে অহনাকে এসে গোসল করানোর পর কোলে নিতে। সানন্দা-র পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে অহনাকে নিয়ে খেলি। দেখি প্রায় দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে অথচ বাথরুমে গরমপানি দেয় নাই। রাগে মাথায় আগুন ধরে যায়। সে পুরাদস্তুর আমার শাশুড়ির চামচা। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি সে তখনও পেঁয়াজ কাটছে আর শাশুড়ি ভাতের মাড় গালছে। কাজের-মেয়ের কান ধরে টেনে দুই গালে দুই চড় বসাই। ‘হারামজাদি, এত শয়তান হইছস ক্যান? দুই ঘণ্টা আগে পানি দিতে কইছি বাথরুমে, বাচ্চার গোসল করামু কি বেলা চারটার পরে?’ আমার শাশুড়ি তখন খেঁিকয়ে ওঠে, “কাজের-মেয়ের গায়ে হাত তুললা ক্যান? কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে কাজের-মেয়ে পিটায় শুনছো? আমার শরীরটা খারাপ বইলা মাছ-তরকারি সব সে একা কাটতেছে। এগুলা তুমি চোখে দেখ না?’ মেজাজ আমার সপ্তমে চড়ে। ‘আপনে হইছেন সব কিছুর মূল। আপনের আস্কারায় এই ফকিন্নির বাচ্চা কাজের-ছেমড়ি এত শয়তানি করার সাহস পায়। রাজনীতি ছাড়া তো আর-কিছু বোঝেন না। পোলারে সান্দায়া রাখেন কাপড়ের তলে আর আমার ফ্যামিলি নিয়া কথা কন।’ শাশুড়ি আর একটি কথা না বলে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমিও আমার রুমে চলে যাই। শাশুড়ির সাথে এর আগেও আমার ঝগড়া হয়েছে, কিন্তু এত খারাপ কথা কখনও বলি নাই তাকে। মনে মনে শপথ করি এর পর যতই ঝগড়া হোক-না কেন, মুখ দিয়ে আর খারাপ কথা উচ্চারণ করবো না।
সন্ধ্যায় জামাল এসে ঘরে ঢুকে আমার দিকে তাকায় না একবারও। কাপড় বদলে ঘরে চলে যায়। আমি অনুমান করি আমার শাশুড়ি টেলিফোনে ছেলেকে আমার বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা বলেছে যতটা সম্ভব। জামাল ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করে, আমার মা’রে গালিগালাজ করলি ক্যান তুই?’ আমি বলি, ‘তোর মা যে কাজের-ছেমড়িরে শিখায়া দেয় আমার লগে বেয়াদবি করতে? এখন তোর কাছে লাগাইছে আমার নামে? শয়তান বেটির রাজনীতি আর বন্ধ হইবো না কোনোদিন।’
জামাল এসে আমার গালে চড় মারে আর আমিও মারতে চেষ্টা করি। সে
মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আমি গালি দেই। সে আমার চুলের মুঠি ধরে ধাক্কা দিয়ে ওয়ারড্রোবের
উপর ফেলে দেয় আমাকে। আমি কোনোমতে উঠে এসে চেষ্টা করি তার গলা চেপে ধরতে। চড় মারি।
সে তখন আমার নাকে, চোখের নীচে ঘুসি
মেরে চলে। আমার নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরতে থাকে। নাক মুছতে গিয়ে রক্ত দেখে আমি
নিজেই ভয় পাই। ড্রইংরুমে গিয়ে আম্মাকে ফোন করে বলি, ‘আমার মাইরা রক্ত বাইর কইরা ফেলছে, তোমরা আইসা নিয়া যাও আমারে।’
আমার শাশুড়ি,
এত
যে মারামারি, ধস্তাধস্তির
শব্দ শুনলো, একবারও উঁকি দেয়
নাই। আমাদের রুমে আমার নাকে-মুখে রক্ত দেখে সে চিৎকার শুরু করে দেয়। ছেলেকে বকে, ‘অমানুষের বাচ্চা, তুই এইটা কী করলি! এইটা কী করলি!’ ভদ্রমহিলা
বরফ, পানি, স্যাভলন ক্রিম নিয়ে আসে আমার জন্য। আমি বলি, ‘নাটক কম করেন, হলিউডে সিনেমা করলে অস্কার অ্যাওয়ার্ড পাইতেন।’ জামাল তার
মায়ের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি আমার রুমে গিয়ে বিছানায় পড়ে হাউমাউ কাঁদি।
একঘন্টা পর আম্মা-আব্বা দু’জনেই ভূতের গলিতে আমার বাসার এসে পৌঁছায়। দু’জনেই আমার
চেহারা দেখে শাশুড়িকে বলে, ‘আপনাদের তো এখনই
পুলিস দিয়া অ্যারেস্ট করানো দরকার।’ জামাল তখনও তার মায়ের রুমে দরজা বন্ধ করে আছে।
আমার শাশুড়ি তখন ছেলের সাফাই গায়,
‘আপনার
মেয়ে আগে আমার ছেলের গায়ে হাতে তুলছে।’ আমার কণ্ঠ তখন আবার সপ্তমে, ‘আপনে সবকিছুর মূলে। আপনে লাগাইছেন আমার নামে, এরপরে ঘটছে এইসব।’ শাশুড়ি তখন বিলাপ করে, ‘হায় হায়রে! এই পোলা জন্ম দিয়া কত বেইজ্জত
হইতে হইলো গো!’ আম্মা অহনাকে কোলে নিয়ে
আমার দু’চারটা কাপড় গুছিয়ে আমাদের নিয়ে বের হয়ে আসে বাসা থেকে। আব্বা ট্যাক্সি
ক্যাবে উঠে বলে, ‘এই ছেলের সংসার
আর করা লাগবে না। কাল-পরশু উকিলের সাথে কথা বইলা ডিভোর্স লেটার পাঠায়া দিমু।’
বাবার বাড়ি আসার পর সাতআটদিন ও-বাড়ির সবাই নিশ্চুপ। বাচ্চার কথা ভেবে আমার ডিভোর্সের ব্যাপারে বাবা-মা দ্বিধাগ্রস্ত। অহনার দিকে তাকিয়ে আমিও ডিভোর্সের কথা ভাবতে পারি না; তাছাড়া জামালও তো ধৈর্য্যশীল মানুষ, দোষ একটাই, মায়ের কথায় ওঠবস করে। তবে ডিভোর্স না হলেও, জামাল এবং তার মাকে শিক্ষা দেয়াটা জরুরি। অষ্টম দিনের মাথায় জামাল আমাকে মেসেজ পাঠায়, ‘মিসিং ইউ আ লট’। আমি জবাব দেই না। ফোন করলে কেটে দেই। আমার চাচাশ্বশুর আম্মা-আব্বাকে ফোন করে। তারপর পারিবারিক সালিশ বসে। শুরুতে আব্বা-আম্মা জামাল এবং জামালের মা’কে অনেক আজেবাজে কথা শোনায়। আমার শাশুড়িও আমার মেলা দোষত্র“টির কথা বলে। জামাল তখন মূর্তিবৎ মৃতবাক। তারপর আমি আর আম্মা দু’জনে মিলে আমার শাশুড়িকে ঝাড়ি। তবে আমার শাশুড়ির স্বর কোমল ছিল শেষদিকে।
হাতিরপুলে ফিরে এলেও শাশুড়ির সাথে বাক্যবিনিময় ক্রমে কমে যেতে থাকে। জামালকে আমি অনেক করে বোঝাতে চেষ্টা করি শাশুড়ির সাথে মিলে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না; আলাদা বাসা নিতে মেলা ঝগড়া করি। কিন্তু মাকে ছেড়ে থাকতে রাজি না সে। এমনিতে আমার সাথে ভালোই থাকে, কিন্তু আমার বাবার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে একটা রাতও থাকতে চায় না। আমরা সবাই মিলে জোর করলেও রাত দশটা-এগারটার মধ্যে বের হয়ে যায়। আর এটিই হয়ে ওঠে আমাদের দাম্পত্যকলহের চিরকালীন ইশ্যু। এবং, তার মাকে (নিয়ে) কোনো বাজে কথা বললেই সে গায়ে পর্যন্ত হাত তোলে। মাঝে মাঝে আমিও। একটা চাকরি-বাকরিতে ঢোকা আমার জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। আমার বড়মামার প্রভাবশালী এক বন্ধুর তদবিরে একটা এনজিওতে কাজ জোটে। কুমিল্লায় পোস্টিং হয়। অহনার, তার দাদির সাথে সর্ম্পক খুবই ভালো। আমি কুমিল্লা গেলে তার দাদিই অহনাকে রেখে দিতে চায়। বলে, ‘তুমি চাকরি করবা কুমিল্লাতে, অহনাকে কে দেখবে?’ নানাকিছু ভেবে আমিও অহনাকে ঢাকাতেই রেখে যাই। বাসে পুরো পথ জামাল চাকরি-বাকরির খুঁটিনাটি বোঝাতে চেষ্টা করে, ‘মফস্বল এলাকায় সাবধানে চলাফেরা করবা, যতটা সম্ভব ডিপ্লোমেসি করে চলবা, কলিগদের কাউকে বিশ্বাস করবা না...’ জামাল যেভাবে নিজের বিবেচনাবোধ খুইয়ে দিনরাত মায়ের কথায় ওঠাবসা করে তাতে তাকে আমার একজন ব্যক্তিত্বহীন, কৃপণ এবং করুণার যোগ্য মানুষ মনে হয়। আকাশ, ধানখেত, খাল, নদী, কচুরিপানা। আর তার লাগাতার বকবক।
অফিস-শেষে বিকালে ধর্মসাগর দিঘির পাড়ে হাঁটছিলাম। আমার চেয়ে ছোট হবে এমন কিছু ছেলে টিজ করছিল। ভ্রূক্ষেপ না করে পাশে পার্কের ভিতর হাঁটি। পার্ক থেকে বের হয়ে রিকশা নিতে গিয়ে দেখা হয় ইশতিয়াকের সাথে, আমার ইউনিভারসিটির ক্লাসমেট সোহেলের বন্ধু; আমার পাশেই সেও রিকশা ঠিক করছে। মাঝেমধ্যে হাকিম চত্বরে আড্ডা দিতে আসত সে, ঢাকা মেডিকেলের ফজলে রাব্বী হল থেকে। তার শান্ত বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চোখজোড়া আকর্ষণ করতো আমাকে। কিন্তু আমার বা আমার গ্রুপের অন্য কোন মেয়ের প্রতি আগ্রহ সে দেখায় নাই। আড্ডাতেও খুবএকটা আসতো না। তার প্রতি আমার মুগ্ধতা যতই থাক, আমার প্রতি তার ঐশী নির্লিপ্তি আমার স্বপ্নের সীমানা সংকুচিত করে রাখতো।
ইশতিয়াকই প্রথম জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কুমিল্লায় থাকো?
অনেকদিন
পর দেখা।’
আমি বললাম,
‘এনজিওতে
চাকরি করি, অল্প কয়দিন আগে
আসছি। তোমারও পোস্টিং এখানে?’
সে বলল, ‘হ্যাঁ, এখন কুমিল্লা মেডিকেলে আছি, স্টেডিয়ামের কাছে বাসা।’
আমি বলি,
‘আমার
বাসা আদালত পাড়ায়।’
আমার বিয়ে,
বাচ্চা, সংসারের কথা জানালাম। সে বিয়ে করে নাই এখনও।
এর কিছুদিন পর থেকেই কুমিল্লা জুড়ে আমার বন্ধু একজনই, ইশতিয়াক। অফিসে কলিগ যে-দু’চারজন আছে তারা
কথায় আর চিন্তায় অনেক বেশি গ্রাম্য,
একেবারেই
মেশবার অনুপযুক্ত।
তাকে একসময় খুলে বলি আমার দুর্বিষহ দাম্পত্য জীবনের কথা।
ইশতিয়াক এখন আগের চেয়ে অনেক প্রগল্ভ। অফিসের পর দু’জনে বাতাসে ভেসে বেড়াই
ধর্মসাগর-পারে, রিকশায় অথবা
চড়–ই পাখির ডানায় ভর করে। শাশুড়ির ভণ্ডামি,
জামালের
মা-মা ন্যাকামি, এমন বহু
অপছন্দের দৃশ্য থেকে দূরে থাকি এবং সত্যিকার অর্থে আমি আমার নিজের জীবন যাপন করি
এখন। অহনার সাথে ফোনে কথা বলি। জীবন আমার কাছে আর মেঘলা, ধোঁয়াটে, বোরিং আর অসহ্য না,
টিনের
চালে ঝিকমিক ছলকে-পড়া রোদ আলোকিত রাখে আমাকে। জামালের সাথে ফোনে কথা বলতেও বিরক্তি
লাগে। ছুটিতেও ঢাকা যেতে চাই না। যদিও ইশতিয়াক অনুরোধ করে যেতে। না হলে বেশি
বাড়াবাড়ি করলে ধরা পড়ে যাব আমরা। জামাল সপ্তাহান্তে অহনাকে নিয়ে চলে আসে। অহনার
সাথে সময় ভালোই কাটে, কিন্তু অসহ্য
লাগে জামালের প্রেম।
কিছুদিন পর ইশতিয়াককে বলি, ‘আমি তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে পারবো না আর। আমার জামাইটা যখন কানের কাছে প্রেমের ঘ্যানঘ্যান করে, মনে হয় কানে কেউ বিষ ঢালতেছে। এভাবে তো চলতে পারে না। চলো বিয়ে করে ফেলি।’
আমার এই কথা শুনে স্থির তাকিয়ে থাকে ইশতিয়াক। ‘এত অস্থির
হো’য়ো না, চেষ্টা করো শান্ত থাকতে।
অহনাকে কী করবা? যদি তোমার
স্বামী তাকে তোমার কাছে না দেয়?’
আমি বলি,
‘অহনাকে
দেবে আমার কাছে। আমি তার মা তো। আর না দিলে কোর্টে মামলা করবো।’
ইশতিয়াক আবারও বোঝাতে চেষ্টা করে, ‘পাগলামি কোনো না, সোনা,
বিপদে
পড়বা। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করো।’
ইশতিয়াককে কেমন অচেনা লাগে তখন।
রাতে অহনা ফোন করে। আমি কবে ঢাকা যাবো জিজ্ঞাসা করে। জবাব
দিয়ে যাই নিস্পৃহ। তাকে দেখতেও, এমনকি, আমি ঢাকা যাবার তাগিদ বোধ করি না।
দু’দিন পর অফিস-শেষে রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত ইশতিয়াকের সাথে সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরি। বাসায় গিয়ে দেখি জামাল আমার তালাবদ্ধ দরজার সামনে সিঁড়িতে বসে আছে। ক্লান্ত বিরক্ত চেহারা।
আমি জিজ্ঞাসা করি,
‘কখন
আসছো?’
-
বিকালে।
-
ফোন
দাও নাই কেন?
-
আমি
দেখতে চাইছি কত রাতে তুমি বাসায় ফেরো।
-
ও!
গোয়েন্দাগিরি?
-
সব
খবরই পাইছি আমি তোমার। প্রেমিক ইশতিয়াকের সাথে কাটায়ে আসছো এতক্ষণ?
-
তোমাকে
কে বলছে এইসব?
ঘরে ঢুকে জামাল বলে,
‘আকাশে
চাঁদ উঠলে কি লুকাইয়া রাখা যায়? কুমিল্লা থেকে
লোকজন ফোন কইরা কইরা জানাইছে। ঐ বদমাইশ,
লুইচ্চা, মাগিবাজ ডাক্তার আর তোমার প্রেম এখন
কুমিল্লা শহরের সবচেয়ে হিট কাহিনী।’
আমি চিৎকার করে উঠি,
‘একদম
মুখ সেলাই কইরা দিমু। শালা মেরুদণ্ডহীন প্রাণী, নিশ্চয়ই মা পরামর্শ দিয়া দিছে আমারে আজেবাজে কথা কইয়া চাপে
রাখতে?’
‘চুপ র্ক, রাস্তার মাগি! আমার মায়ের মতো পবিত্র
মানুষরে নিয়া বাজে কথা বলবি না, খবরদার!’
আমি জামালের মুখে থুথু মেরে বলি, ‘তোর মতো মাগির সংসার দুনিয়ার কোনো
মেয়েমানুষই করবে না।’
সে চড় মারে,
চুলের
মুঠি ধরে দেয়ালে ধাক্কা দেয়। আমি উঠে গিয়ে তার সারা গায়ে খামচে রক্তাক্ত করি।
আবারও সে মারে, একনাগাড়ে মেরে
চলে। আমি তারস্বরে চিৎকার করি। পড়োশিরা এসে দরজা ধাক্কা দিলে আমার সংবিৎ ফেরে আর
আমি থেমে যাই।
পাশের বাড়ির ভাবি এসে বলে, ‘সব ঠিক আছে তো?’
আমি বলি,
‘হ্যাঁ, আমার জ্বর তো, একটু মাথা গরম হয়ে গেছিল, ভাবি। সরি।’
জামাল সুযোগ পেয়ে ঝাল ঝাড়তে শুরু করে, ‘জ্বর নিয়াও, ভাবি, অফিস থিকা ফিরে
সে রাত নয়টায়।’
আমি বলি,
‘না
ভাবি, অফিসে তো আমি অ্যাডমিন
দেখি, কাজের চাপে রাত
নয়টা-দশটা বেজে যায় ফিরতে-ফিরতে।’ আমাকে অপ্রস্তুত দেখে পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি ঘরে
চলে যায়। যাবার আগে বলে যায়, ‘ভাবি, শরীরটা যেহেতু খারাপ, ঘুমের ওষুধ খায়া ঘুমায়া পড়েন।’
ভাবি চলে গেলে জামালকে বলি, ‘তোর কপালে খারাপি আছে। কালকে সকালের মধ্যে তুই ঢাকা ফিরা না
গেলে নারী নির্যাতন মামলা করুম।’ সেও ইচ্ছামতো খিস্তিখেউড় করে পরেদিন সকালে ঢাকা
ফিরে যায়।
সে বাসা থেকে বের হলেই ইশতিয়াফকে ফোন করে কাঁদি, ‘এই শয়তানের সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
প্লিজ, তুমি বাঁচাও আমারে।’
জামাল আমাকে ভয়ঙ্কর মারধর করেছে ব’লে ইশতিয়াকের সহানুভূতি পাবার চেষ্টা করি। সেদিন
সন্ধ্যায় ইশতিয়াকের বাসায় গিয়ে তার বুকে মাথা গুঁজে কাঁদি।
ইশতিয়াকের সুর অন্যরকম মনে হয় : ‘প্লিজ, তোমার স্বামীর মানসিক অবস্থাটা চিন্তা করো।
লোকটা হয়তো সুইসাইডও করতে পারে। তার সাথে ভালো বিহেভ করো। আমার মধ্যে কেমন যেন
গিল্টি ফিলিংস্ হইতেছে।’
আমি বলি,
‘দেখো, তারে ভালবাসা কোনোভাবেই সম্ভব না আর। তুমিও
আর ভণ্ডামি কইরো না।’
ইশতিয়াক বলে,
‘তোমার
হাজব্যান্ডের কথা শুনে আমার মধ্যে আসলেই অপরাধ বোধ তৈরি হইছে।’
আমার ভীষণ কান্না পায়;
ইশতিয়াককে
বকাঝকা করতে ইচ্ছা হয়। শরীর খারাপ লাগছে বলে উঠে পড়ি।
জামাল দু’দিন পরই আবার ফিরে আসে কুমিল্লায়। বাসায় ঢুকেই অনুনয় করে, ‘ডিভোর্স কইরো না, প্লিজ। অহনার কথা ভাবো একবার।’ তার সাথে একটা কথাও না বলে বাথরুমে গোসল করতে ঢুকে যাই। গোসল-শেষে রান্নাঘরে বুয়াকে চা দিতে বলে বারান্দার চেয়ারে গিয়ে বসি। জামাল এসে বসে পাশে, অনুনয় করে আবারও, ‘অহনার কথা ভাবো প্লিজ, দয়া করো।’ হাউমাউ কাঁদি, ‘জামাল, আমার সুইসাইড করতে মন চায় শুধু, এক মুহূর্ত আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না।’
পরদিন অফিসে গিয়ে ইশতিয়াককে মোবাইলে বার বার ফোন করি। সে
রিসিভ করে না। অফিসে ব’লে ইশতিয়াকের অফিসে,
মানে
হাসপাতালে চলে যাই। সে রাউন্ডে গেছে শুনে নার্সকে দিয়ে খবর পাঠাই, মোবাইলে ফোন করি। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা
করার পর সে আসে।
ঢুকেই আমাকে বলে,
‘কেন
পাগলামি করতেছো? তোমারে তো আমি
বলছি আমি একজন কাওয়ার্ড মানুষ। তোমার জামাইর অবস্থা দেইখা চরম অপরাধবোধে ভুগতেছি।
প্লিজ মাফ করে দাও আমারে।’
‘তোমার মুখে থুতু
দিতে মন চায়,’ বলে বের হয়ে আসি
হাসপাতাল থেকে।
অফিসে ফিরে দেখি জামাল বসে আছে আমার টেবিলের সামনে। তার
পাশেই বসে আছে আমার কলিগ রুবিনা এবং শিহাব। অনুমান করি ওরাই ইশতিয়াকের কথা জামালকে
জানিয়েছে। আমাকে দেখে জামাল জিজ্ঞাসা করে,
‘কী
ব্যাপার, অফিস থিকা কই গিয়া ছিলা
এতক্ষণ? অফিসের কাজ?’ আমি বলি, ‘না, ব্যক্তিগত কাজ।’
সে বেশ বাহাদুরের ভঙ্গিতে ‘ব্যক্তিগত কাজ নাকি হাসপাতালে রোগীটোগি দেখতে গেছ?’ বললে,
শিহাব, রুবিনা দু’জনের মুখেই হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
দ্রুত ঐ রুম থেকে বের হয়ে রেহানার রুমে যাই। সে অফিসে নাই, ফিল্ড ইনভেস্টিগেশনে গেছে। ম্যানেজারের রুমে
গিয়ে বলি, ‘আজকে আমি অসুস্থ, বাসায় চলে যাব।’ তারপর গিয়ে জামালকে বলি, ‘আমার শরীর খারাপ লাগতেছে, বাসায় চলো।’ রিকশায় কোনো কথাই বলি না
জামালের সাথে, দারুণ মাথাব্যথা
শুরু হয়, চোখ বন্ধ করে রাখি।
রিকশাতে সে চিৎকার করে, ‘কিসের টানে কুমিল্লা পইড়া আছো আমি বুঝি তো।’ আমার শরীরে
জ্বর বাড়ছে যেন, বাসায় ঢুকে
বিছানায় শুয়ে পড়ি।
জামাল একটানা বলে যায়,
‘এই
চাকরি আর করা লাগবো না, আমার সাথে সংসার
করতে হইলে চাকরি করতে পারবা না।’
আমি জবাব দেই,
‘তোর
মতো মাগির সংসার আমি তো আমি করমু না এমনিতেই।’
‘করবি কেমনে? সারা কুমিল্লা শহরের লোকজন তোর বেলেল্লাপনার
খবর জানে। তোর অফিসের অনেকেই তো এখন কথাই কয় না তোর লগে। নিজের মেয়ের পর্যন্ত
খোঁজ খবর নেস না তুই!’ চিৎকার করে জামাল বলে যাচ্ছে।
আমার মাথার কাছে টেবিলে রাখা তালাটা হাতে তুলে নিই। ছুঁড়ে মারি তার মাথা বরাবর। আমাকে অবাক করে দিয়ে তালা ঠিকঠিক তার মাথায় গিয়ে লাগে। কপাল ফেটে দরদর রক্ত গড়ায়। কপালে হাত দিয়ে সে চিৎকার করে, ‘মাগি, তুই আমারে মাইরা ফেলছস!’ তারপর এসে আমার পেটে বুকে লাথি মারে। এক হাতে কপাল ধ’রে থেকে আরেক হাতে আমার গলা চেপে ধরে। আমার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। আমি তার পেটে লাথি মারি। সে ছিটকে পড়ে। দেখি রক্তে মুখ, গলা ভেসে গেছে। সে নিচে পড়ে গেলে তার বুকের উপর বসে গলা চেপে ধরি আমার সর্বশক্তি দিয়ে। নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত চেপে ধরে রাখি। ও নিথর হয়ে গেলেও, গালে চড় ঘুসি লাথি মেরে চলি। ইশতিয়াক, জামাল, নাকি নাকি নিজেরই প্রতি এই ঘৃণা আমার, আমি জানি না। একসময় আমার শরীরে প্রবল ক্লান্তি ও অবসন্নতা ভর করে। কোনোকিছু চিন্তা করার সাধ্য থাকে না আর। বিছানায় মরার মতো পড়ে থাকি অনেকক্ষণ। তারপর উঠে ইশতিয়াককে ফোন করি। ফোনে সে ‘হ্যালো’ বলার পরই চিৎকার করে কাঁদি, ‘তুই হারামির জন্য আমার জামাইরে আমি খুন করছি। আমার ফাঁসি হইবো, আমার মেয়ের কী হইবো বল তুই? তোরে আমি জানটা দিয়া ভালবাসছি আর তুই রাজ্যের ভণ্ডামি করলি আমার সাথে, শালা দুইনম্বর।’ ইশতিয়াক ওপার থেকে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু আমার কান্নায় তার কোনো কথাই বোঝা যায় না। একসময় ফোনের লাইন কেটে যায়। আমি আবারও চেষ্টা করি। কিন্তু লাইন আর ঢোকে না। সম্ভবত ফোন বন্ধ করে দেয় সে। মা’কে ফোন করি। আম্মা সব শুনে কাঁদতে থাকে। আমার বাবাকে জানায়। বাবাও হাউমাউ কাঁদে। আম্মা এসে ফোন ধরে বলে, ‘জামালের শরীরের রক্তটক্ত ধুয়ে তুই সিলিং ফ্যানে শাড়ি দিয়ে একটা ফাঁস বানায়ে রাখ। মাথা ঠাণ্ডা রাখ। তোর বাচ্চার জন্য তোর বাঁচতে হইব। তুই অপেক্ষা কর, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমরা আইসা পড়মু।’
বালতিতে পানি এনে জামালের মুখ মাথা ধুয়ে ফেলতে চেষ্টা করি। তার কপাল, গাল, চোখে জমাটবাঁধা রক্ত মুছতে গিয়ে প্রবল কান্নায় জড়িয়ে ধরি জামালের মৃতদেহ। তার বুকের উপর মাথা রেখে পড়ে থাকি বেশ কিছুসময়। তারপর উঠে আলনা থেকে আমার একটা ওড়না খুলে ভিজিয়ে যতœ করে মুছে দেই তার মুখ-মাথায় লেগে থাকা রক্ত; এত কোমলভাবে, যেন নইলে ব্যথা পাবে। তারপর ওড়নাটা ফেলে আসি বাথরুমে ট্যাপের নীচে। সিলিং ফ্যানে ফাঁস বানাতে চেষ্টা করি। কিন্তু হয় না । সোফায় গা এলিয়ে পড়ে থাকি। ঘণ্টাতিনেক পর আব্বা-আম্মা ফোন করে বলে ‘দরজা খোল’। আমি দরজা খুললে ঘরে ঢুকেই তারা আমাকে জড়িয়ে ধরে নিচুস্বরে কাঁদতে লাগে। আম্মা গিয়ে জামালের লাশের হাত পা সোজা করে চোখ বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করে। এর আগে আমিও সে-চেষ্টা করেছি। পারি নাই। আব্বা-আম্মা তড়িঘড়ি ড্রয়িংরুমের সিলিং ফ্যানে দড়ি বাঁধতে চেষ্টা করে। পরে তারা জামালের গলায় আরেক টুকরা দঁড়ি দিয়ে ফাঁস দেয়, চেষ্টা করে যেন দড়ির দাগ গলায় বসে যায়। সে-চেষ্টাও সফল হয় না।
রাত দুটোর দিকে আমরা পাড়াপড়োশিকে খবর দেই। কিছুসময়ের মধ্যে পুরো ফ্ল্যাটের এবং আশপাশের বাড়ির মেলা লোক এসে জড়ো হয়। কান্নাকাটি করি। বলি, ‘গত সন্ধ্যায় বাবা-মা এখানে বেড়াতে আসছে। জামালের সাথে রাতে আমার খুব ঝগড়া হইছে। রাতে সে ড্রয়িংরুমে ঘুমায় এবং গলায় ফাঁস দেয়। লোকজন এলে আমি ওড়না দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখি। মাঝেমধ্যে ফুঁপিয়ে উঠি। আমার শাশুড়িকে সংবাদ দেই, আমার আব্বা কুমিল্লায় তাঁর এক প্রভাবশালী বন্ধুর সহায়তায় গোসল শেষ করান। সকাল ন’টার মধ্যেই লাশ নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হই। আম্মা আমার খালাত ননদকে জানায় জামালের আত্মহত্যার খবর। তাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করে কীভাবে ঝগড়া হল।
আমার শাশুড়ি ছেলের লাশ দেখে চিৎকার করে খানিক পর-পর অজ্ঞান
হয়ে পড়ে। আমাকে আমার মা, খালা, মামা সবাই চারপাশে ঘিরে রেখেছে। আমার শাশুড়ি
জ্ঞান ফিরে এলে কয়েকবার বলে, ‘আমার পোলা
আত্মহত্যা করতে পারে না। আমার পোলায় তো ভীতু একটা মানুষ আছিল গো!’ আমি ঘোমটা দিয়ে মুখের উপর ওড়না চেপে খাটের এক
পাশে বসে থাকি। মামা হাতে একটা তসবি দিয়ে যায়। আমার খালাত ননদ আমার কাছে নানা কিছু
জানতে চায়। কারো কোনো কথার জবাবই দেই না আমি। আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা দাফনের
জন্য গ্রামে লাশ নিয়ে যায়। লাশ মাইক্রোবাসে তোলার আগে শেষবারের মতো আমাকে দেখানোর
জন্য নিয়ে আসে। জড়পদার্থের মতো চিন্তাশক্তিহীন আমি এগিয়ে যাই নিচে গ্যারেজের দিকে।
কাফনে মোড়ানো জামালের সাদা রক্তহীন মুখটা দেখে শেষবারের মতো একবার তার কপালে চুমু
খেতে মন চায়। কান্নায় ভেঙে পড়ি তার লাশের উপর। মাইক্রোবাস রওনা হয়ে যায়।
অহনা এবং আমাকে আব্বা-আম্মা বাড়ি নিয়ে যায়। আমার গা ঘেঁষে
থাকে অহনা সারাক্ষণ। আম্মা-আব্বা বেশ উত্তেজিত। খানিক পর-পরই আম্মা কোরআন শরীফ বের
করে পড়ছে। সবকিছুই, এমনকি অহনাকেও
আমার চোখের সামনে ঘটে-যাওয়া ছায়াবাজির অংশ মনে হয়।
পরদিন সকালে সব দৈনিকে প্রকাশিত হয় নানা সংবাদ :
“পরকীয়া প্রেমের
বলি ব্যাংক কর্মকর্তা, ডাক্তার প্রেমিক
পলাতক”
“আত্মহত্যা নাকি হত্যাকাণ্ড? মহিলা এনজিও কর্মী আর ডাক্তারের প্রেমের বলি” ইত্যাদি।
পত্রিকা দেখে আম্মাআব্বা বিলাপ করে, আমাকে পালিয়ে যেতে বলে। দুপুর এগারোটায়
পুলিশ আসে আমাকে থানায় নিয়ে যেতে। সাথে আসে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল। একটু আড়ালে নিয়ে
আব্বা ফিসফিস করে বলে, ‘কিছুতেই স্বীকার
করবি না তুই।’ টিভি চ্যানেলগুলোকে বলে দেই,
‘আমি
কোনো কথা বলবো না।’ তবুও পুলিশের গাড়িতে ওঠার সময় টিভি চ্যানেলের এবং
ফটোসাংবাদিকের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলতে থাকে।
থানায় পুলিশরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে জামালের আত্মহত্যা আর ইশতিয়াকের সাথে আমার সম্পর্ক বিষয়ে। মিথ্যা কথা বলতে গিয়ে খানিক পরই আটকে যাই কথার প্যাঁচে। স্বীকার করে ফেলি সব। দারোগা, ওসি এবং সিনিয়র পুলিশ অফিসাররা বার বার জানতে চায় ইশতিয়াক আমাকে এই খুনে প্ররোচিত করেছে কিনা। আমি প্রত্যেকবারই বলি ইশতিয়াক জড়িত ছিল না। তবু তাকে অ্যারেস্ট করে তারা। আমার আব্বা-আম্মাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে।
তারপর সাত দিনের রিমান্ডে। সব প্রশ্নেরই আমি সত্য জবাব দেই।
তার পরও আমাকে বার বার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ইশতিয়াকের জড়িত থাকার ব্যাপারে চাপ
দেওয়া হয়। পুরাটা সময়ই আমি শান্ত থাকি। থানা কিংবা জেলখানার পরিবেশ, সাংবাদিকদের ভিড়, আদালতে মানুষের ভিড়, গালি,
অশ্লীল
ঈঙ্গিত, সবকিছুই একসময় গা-সওয়া
হয়ে যায়। আমার উকিল আমাকে বার বার শিখিয়ে দেয় আমি যেন বলি, আমার স্বামী যখন আমার গলা টিপে ধরে, আমি তখন আত্মরক্ষার জন্য তাকে খুন করতে
বাধ্য হই। কোর্টে বিচারকের সামনে আমি উকিলের শিখিয়ে দেওয়া কথাই বলি। তখন আমার
বিপক্ষের উকিল উচ্চৈঃস্বরে, রগরগে বর্ণনা করে কীভাবে এক যৌনকাতর মহিলা তার
প্রেমের পথ নিষ্কণ্টক করতে স্বামীকে হত্যা করেছে; আর চারপাশে
সাংবাদিকদের ফ্লাশলাইটগুলি জ্বলে উঠে আমার
অভিব্যক্তি ধারণ করতে।
আম্মা-আব্বা জেলখানায় দেখতে আসে আমাকে। আমার হাতে কোরআন শরীফ, তসবি দেয়। অহনা আম্মার কোলে ছোট্ট একটা পুতুলের মতো। আম্মা অহনাকে বুকে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদে, ‘সব শেষ করে দিলি। এই বাচ্চার বর্তমান ভবিষ্যৎ সব ধ্বংস করে দিলি।’ আমি আম্মাকে বলি, ‘তোমাদেরও তো মানসম্মান সব গেল।’ আরও কাঁদে আম্মা, আব্বা চোখ মোছে। আম্মা বলে, ‘তবু যদি তুই বাঁচতি। তোর শাশুড়ির হাত পায়ে ধরতেছি অহনার দিকে তাকায়ে যেন কেস তুলে নেয়। কিন্তু তোর শাশুড়ি মাফ করলে বা কেস তুললেও পেপারওয়ালারা তো ছাড়বে না।’ আম্মা জানায় ইশতিয়াক জামিন পেয়েছে।
আমি বলি,
‘তোমরা
মাইনা নিতে চেষ্টা করো। আমার ফাঁসি বা যাবজ্জীবন যা-ই হোক, আমার শাশুড়িরে বুঝাইয়া বা তোমরা টাকাপয়সা
দিয়া অহনাকে বিদেশ পাঠাইয়া দিয়ো। বিদেশে থাকলে সে হয়তো ভালো থাকবে।’
এরপর আব্বা-আম্মা একদিন এসে জানায় অহনাকে তার দাদি ও
অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরা এসে নিয়ে গেছে। সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে আম্মা ভীষণ কাঁদে।
আমি তাকে বলি, ‘অহনার দাদি
মেয়েটাকে জান দিয়া ভালবাসে। চিন্তা কইরো না। ভালো থাকবে সে।’
হাজতের অন্য মহিলাদের গল্প শুনি। কেউ কাঁদে, কেউ অন্যকে নির্যাতন করে। খুনি, চোর,
মাদক-ব্যবসায়ী, কত নানা অভিযোগ এদের বিরুদ্ধে। কিন্তু
কাউকেই অপরাধী মনে হয় না আমার। সবাই এখানে একেক জন শিশু, যেন ঘটনাচক্রে অপরাধী হয়ে গেছে।
রাতে স্বপ্নে দেখি। দাদির বাড়িতে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে খুব। তারই মধ্যে ছেলেমেয়েরা আম কুড়াচ্ছে। আমি দৌড়ে ঘর থেকে বের হই। কড়কড় বাজ পড়ে। দাদি টেনে ঘরে নিয়ে যায়। দাদির বুকে ঢুকে থাকি। ঘুম ভেঙে যায়। ইশতিয়াককে দেখতে ইচ্ছা করে। জামাল মাটির নীচে শুয়ে আছে। জীবনকে কী যে ভালবাসতো লোকটা। তাকেও, ভালবাসি যে, এই প্রথম তা মনে হয়। কিন্তু অনুতাপও হয় না কোনো। একসময় ঘুমিয়ে পড়ি প্যান্ডোরার বাক্সের ঢাকনির মতো ধাতব আকাশটার নিচে। ঢাকনিটা খুলবে? কে?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন