কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১৩৩

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

রোমেনা আফরোজ

 

মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ

 


বর্তমানে পুঁজিবাদ শুধু একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয়, বরং এটি একধরনের আদর্শও। আপাতদৃষ্টিতে  পুঁজিবাদকে স্বাভাবিক বলে মনে হলেও এর আদর্শ মানুষের স্বভাব থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এর কোনো অংশই প্রাকৃতিক নয়। এটি ইতিহাস, অর্থনীতি এবং সাংস্কৃতিক পণ্য। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শত শত বছর ধরে বিভিন্ন কৌশলে আমাদের পৃথিবীকে তৈরি করা হয়েছে। একথা দৃশ্যমান পৃথিবী সম্পর্কে বলা গেলেও অদৃশ্যজগত অর্থাৎ মানুষের চিন্তা-ভাবনা এবং আবেগ সম্পর্কেও কি একই কথা বলা যায়?

মূলত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষের পরিচয় এবং জীবনকে প্রভাবিত করেছে। এমনকি এই সর্বব্যাপী শক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের মন এবং অন্তর্নিহিত বিশ্বাসকে। সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে সেসব সূক্ষ্ম অথচ গভীর উপায়গুলোকে উন্মোচন করা হচ্ছে, যেখানে পুঁজিবাদ আমাদের জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া (Cognitive processes), মানসিক প্রতিক্রিয়া (emotional responses) এবং আচরণগত দিকগুলিকে (behavioral patterns) আকার দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেছে।

একটু খেয়াল করলে দেখবেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ লিঙ্গ পক্ষপাত প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ পুঁজিবাদ জাতি, লিঙ্গ এবং প্রতিযোগিতা সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে প্রচার করে। এলিট শ্রেণির মানুষজন ব্যক্তিগত পছন্দ এবং কৃতিত্বের উপর বেশি জোর দেয়, বলে, যে-সকল সমাজ বাজার অর্থনীতির দিকে ঝোঁকে, তারা লালন-পালন করে ব্যক্তিত্ববাদকে। যখন এই ব্যবস্থা ব্যক্তিকে অন্যদের প্রতিযোগী হিসেবে দেখতে প্ররোচিত করে, তখন তৈরি হয় বৈষম্য। এতে আত্মকেন্দ্রিকতা (self-centeredness) বৃদ্ধি পায়, হ্রাস পায় পরার্থপরতা (Altruism)। এক কথায়, পুঁজিবাদী সামাজিক শ্রেণি শুধু সমাজকে নয়, আত্ম-ধারণাকেও (self-perception) প্রভাবিত করতে পারে।

উদারবাদী মতাদর্শ, যা বর্ণবাদকে প্রকট করে তোলে, তা জাতিকে রূপান্তরিত করে পণ্যে। এক্ষেত্রে চকচকে বিজ্ঞাপনগুলো নতুন নতুন পণ্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে বিমোহিত করে। পুঁজিবাদী লক্ষ্য বাস্তবায়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পদের নিরাপদ আশ্রয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় এবং কর্পোরেশনগুলো সবসময় পৃষ্ঠপোষকতার জন্য প্রস্তুত থাকে।

পুঁজিবাদের তথাকথিত ‘অদৃশ্য হাত (invisible hand)’ মুনাফা এবং বাজারের বাইরে নির্দিষ্ট কিছু মতাদর্শকেও অনুপ্রাণিত করে, যেমন- ব্যক্তিবাদ (individualism), বস্তুবাদ (Materialism ) এবং প্রতিযোগিতা (competition) ইত্যাদি, যেগুলো আমাদের সামাজিক কাঠামোতে অনুপ্রবেশ করে ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক উপাদানে পরিণত হয়েছে।  ফলস্বরূপ, পুঁজিবাদের প্রভাব অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে বহুদূর।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা হোক বা না হোক মনোবিজ্ঞান কিছুটা হলেও সমাজের মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে কিছু মাত্রায় সর্বজনীন হিসেবে তুলেও ধরা হয়। তারপরেও মূলধারার মনোবিজ্ঞান পুঁজিবাদের প্রভাবকে উপেক্ষা করেছে। এমনকি বিভিন্ন চাপের মুখে মনোবিজ্ঞানীরা আমেরিকান রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য পুঁজিবাদের বিশ্লেষণ এড়াতেও প্রস্তুত ছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। লর্ড ব্রাইস (James Bryce-  British academic, jurist, historian, and Liberal politician) বলেছেন: ‘রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভিত্তি মনোবিজ্ঞানের মধ্যেই নিহিত। যদিও এখানে মনোবিজ্ঞানের পর্যালোচনা সীমিত’। অক্সফোর্ডের ইতিহাসবিদ জি.বি.গ্রান্ডি (G. B. Grundy- Oxford don and historian) ১৯১৭ সালে ‘রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞান: একটি বিজ্ঞান যা এখনো আছে’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এরপর থেকে দুই বিষয় প্রাতিষ্ঠানিক উপশাখা হিসেবে কাজ করতে আরম্ভ করে। পরবর্তীতে মনোবিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত হয়েছে রাজনীতির ইতিহাস।

মনোবিজ্ঞানে পুঁজিবাদের প্রভাবের কারণ তারা একসাথে বিকশিত হয়েছে। যেহেতু এই অবহেলিত শক্তি বিশ্বজুড়ে মন গঠনকারী উপাদান হিসেবে কাজ করেছে, তাই মনস্তাত্ত্বিকদের পুঁজিবাদের প্রভাবের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শুধু মনস্তাত্ত্বিক নয়, সচেতন মানুষদেরও এই বিষয় সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। সেই প্রচেষ্টা থেকে মনোবিজ্ঞানের উপর পুঁজিবাদের যে-গভীর প্রভাব পড়েছে বা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকে আকার দেওয়ার জন্য যেভাবে মনস্তত্ত্বকে ব্যবহার করা হয়েছে, তা নিয়ে অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা করবো।

(১)

মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ বা সচেতনতা (Consciousness) তৈরির জন্য শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি উপাদান। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকে আমেরিকান ব্যবসায় জগতের টাইটান জন ডি রকফেলার (John D. Rockfeller) মানুষের সচেতনতাকে অকার্যকর করার জন্য, স্বাধীন এবং প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থাকে (যা চিন্তাভাবনা এবং ব্যক্তিবাদ উৎসাহিত করে) সরিয়ে, এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেছেন, যা অভিন্ন পাঠ্যক্রম এবং রোট মেমোরাইজেশনের (Rote memorization) মাধ্যমে অনুগত এবং বাধ্য নাগরিক তৈরি করছে। এরা মূলত কারখানার কাজের জন্য উপযুক্ত।

শিল্পবিপ্লবের পর থেকে যেভাবে সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে, তাতে মনে হতে পারে, এটা জনহিতকর উদ্যোগ। কিন্তু রকফেলার শিক্ষাব্যবস্থাকে আকার দেওয়ার মাধ্যমে মূলত একটি কর্মীবাহিনী প্রস্তুত করতে চেয়েছেন। সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না। মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রমশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, যাতে সাধারণ মানুষ ক্ষমতার পেছনে না ছুটে ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর চিন্তাশীল ব্যক্তিরা সামাজিক কাঠামো বা মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়। এতে সামাজিক পরম্পরা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির বিপরীতে পুঁজিবাদী সংস্কৃতি তৈরি করা সহজ হবে।

এ পর্যায়ে আমরা মন কি, মন কোন্ পদ্ধতিতে কাজ করে, মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলবো। এতে মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো সহজে বোধগম্য হবে।

মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ (Psychological Manipulation) হলো এমন এক সামাজিক প্রভাব, যার লক্ষ্য প্রতারণামূলক বা গোপন কৌশল এবং অপমানের মাধ্যমে অন্যদের আচরণ বা অনুভূতি পরিবর্তন করা। Kevin William Grant (Registered Psychotherapist-Canada) বলেন, মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ হলো, ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনা, আবেগ, বিশ্বাস এবং আচরণকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশলের ইচ্ছাকৃত ব্যবহার। আর মন হলো বুদ্ধি এবং বিবেকবোধের এক সমষ্টিগত রূপ, যা চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা এবং কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মনের তিনটি অংশ। সচেতন অংশে চিন্তাভাবনা,  কাজকর্ম ও বিবেকের অবস্থান, অবচেতন অংশে স্বয়ংক্রিয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অবস্থান এবং অচেতন অংশে মানুষের অতীত এবং স্মৃতির অবকাশ কেন্দ্র।

মানুষের মনের ৯৫% অবচেতন মনের অবস্থান, বাকি ৫% সচেতন মন।  অবচেতন মন সচেতন মনের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী হওয়ায় মানুষকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। জীবন ধারণের জন্য যে-সকল উপাদান প্রয়োজন, সেসবের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা একান্ত জরুরি। অন্যথায় ব্যক্তির আসক্তি নেশায় পরিণত হতে পারে।

সাধারণত মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয় স্নায়ু দ্বারা। স্নায়ু থেকে সংকেত শরীরের বিভিন্ন অংশে গমন করে। কিন্তু যারা অসচেতন তারা শরীর অর্থাৎ অনুভূতি দ্বারাও পরিচালিত হতে পারে। Lisa Firestone (Clinical psychologist, Writer) বলেন, মানুষের আবেগ তার জীবনকে লক্ষ লক্ষ ভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

যদি কোনো ব্যক্তি একনাগাড়ে কিছুদিন ফাস্টফুড খায়, তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, কিছুদিন পর উক্ত ব্যক্তি খাদ্যের বাইরে চিন্তা করতে ব্যর্থ হবে। কারণ নেতিবাচক অনুভূতি মারাত্মকভাবে আসক্তি তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অভ্যাস ব্যক্তির অবচেতন মনে একটা প্যাটার্ন তৈরি করে এবং সচেতন মনকে কাজ করতে বাধা দেয়। এতে মানুষের নিয়ন্ত্রণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। তাই যারা (সাধারণ জনগণ) অনুভূতিকে বেশি প্রধান্য দেয়, তাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। এই নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব কলা-কৌশল ব্যবহার করা হয়, তা মূলত অদৃশ্য। যারা এই কৌশল পরিচালনা করেন, তারাই একটা দেশের প্রকৃত শক্তি।

(২)

মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণে এডওয়ার্ড বানেস (Edward Bernays-American propaganda and marketing pioneer) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি ছিলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ভাগ্নে। তিনি কাজ করতেন পর্দার আড়াল থেকে। তিনি বিজ্ঞাপন, আধুনিক প্রচার এবং জনসংযোগের ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগামী ছিলেন। তাঁকে জনসংযোগ শাখার (Public Relation) অন্যতম জনক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তিনি তাঁর মামার অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রণের অত্যন্ত সফল কৌশল প্রস্তুত করেছেন।

যদিও বার্নেস দুই দশকের আগে গত হয়েছেন, তারপরেও বর্তমান আমেরিকায় যে ‘ব্র্যান্ড’ এবং ‘ভোক্তা সংস্কৃতি’ বিদ্যমান, তা বুঝতে হলে তাঁর দর্শন এবং নিয়ন্ত্রণপদ্ধতিকে বুঝতে হবে। মূলত বার্নেস আমেরিকানদের দৈনন্দিন জীবন পাল্টে দিয়েছেন। তারা ব্রেকফাস্টে কী খাবে, নারীদের ধূমপান ইত্যাদি অনেক পরিবর্তনের পেছনে তিনি কলকাঠি নেড়েছেন। তিনি গর্ব করে বলতেন, নাৎসি প্রোপাগনিস্ট জোসেফ গোয়েবলস (Joseph Goebbels- Nazi politician and Propaganda Minister) তাঁর বই পড়ে রাজনীতিতে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেছেন।

এডওয়ার্ড বার্নেস তাঁর ‘প্রোপাগান্ডা’ বইয়ে বলেছেন, আমাদের মনকে বিভিন্নভাবে ঢালাই করা হয় (সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশন), রুচি তৈরি করা হয় (বিজ্ঞাপন), আমাদের ধারণাগুলো (বিভিন্ন মতবাদ) প্রস্তাব করা হয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি কাজ, সামাজিক আচরণ, রাজনীতি, ব্যবসা, এমনকি নৈতিক চিন্তাভাবনা পর্যন্ত অল্পকিছু সংখ্যক ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়)Propaganda edward bernays-Chapter-1)।

এখন আমরা বার্নেসের জীবন এবং তাঁর মনস্তাত্ত্বিক কৌশল নিয়ে জানবো। তিনি ১৮৯১ সালে ভিয়েনাতে জন্মগ্রহণ করেন। একবছর বয়সে তাঁর পরিবার চলে যায় আমেরিকায়। সেখানে তিনি কৃষি নিয়ে পড়াশোনা করলেও ক্যারিয়ার শুরু করেন জার্নালিজম দিয়ে। ১৯১২ সালের দিকে যখন তিনি চিকিৎসা পর্যালোচনার সহসম্পাদক, তখন একটি বিতর্কিত নাটকের ইতিবাচক পর্যালোচনা লিখেন। এটি একটি প্রচারমূলক নাটক, যা যৌনতার পক্ষে কাজ করছিল। এরকম পর্যালোচনা কতটা কার্যকর তিনি তা’ই দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রতিভা উজ্জ্বল হতে শুরু করে যখন তিনি নাটকের সমর্থন কামনা করেন জন ডি রকফেলার, ফ্রাঙ্কলিন এবং এলেনর রুজভেল্টের কাছে। একসময় তিনি Creative press agent  হিসেবে বিভিন্ন নাটকের প্রচারণা আরম্ভ করেন। এ সময় এক অনুষ্ঠানের প্রচারণার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন একজন অভিনেত্রীর যৌন উত্তেজক ছবি। এতিমদের চ্যারিটির জন্য প্রচার করেন সংগতিমূলক নাটক। বস্তুত এসব কাজের মধ্যে দিয়ে বার্নেস তাঁর দক্ষতা তৈরি করছিলেন, যা একসময় পাবলিক রিলেশন (জনসাধারণের সাথে সম্পর্ক রক্ষাকারী)  কমিটির মনোযোগ আকর্ষণ করে, তখন আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে। সিপিআই (The  Committee on Public Information) একাজ করার সময় তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের পক্ষে আমেরিকান জনগণের সমর্থন জোগাড় করেছেন। তিনি দেখেছেন, জনগণের মানসিকতাকে সহজে নিয়ন্ত্রণ  করা যায়। তাই তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেন পাবলিক রিলেশন কনসাল্টেন্ট হিসেবে ।মনস্তাত্ত্বিক কৌশলগুলোকে পরীক্ষা করার জন্য তিনি সংগ্রহ করেন সিগমন্ড ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব (Psychoanalytic theory)। তিনি ১৯১৯ সালের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সিপিআই-এর কার্যক্রম বোঝাতে ব্যবহার করেন ‘প্রোপাগান্ডা’ শব্দটি।

(৩)

জেনারেল ইলেকট্রিক, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল এবং আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির মতো নির্মাতা থেকে সিবিএসের মতো মিডিয়া আউটলেট, এমনকি ক্যালভিন কুলিজের মতো রাজনীতিবিদরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বার্নেসের ক্লায়েন্টের তালিকায়।

১৯২০ সালে Beech-nut packing company তাদের  বিক্রি বাড়ানোর জন্য বার্নেসকে নিয়োগ করেন। তিনি খুব দ্রুত অনুধাবন করেন, বেকনের দামে কোনো সমস্যা নেই। মূলত আমেরিকানদের মাইন্ডসেটের কারণে বিক্রি বাড়ছে না। তখন সকালের নাস্তাতে হালকা খাবার গ্রহণকে অধিক স্বাস্থ্যকর বলে গণ্য করা হতো। এই সমস্যার সমাধানে তিনি পাঁচহাজার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। তারা তাঁকে একটা ডিম এবং বেকনের নাস্তাকে অধিক স্বাস্থ্যকর বলে বিবৃতি লিখে দেন। এই বিবৃতি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে বেকনের বিক্রি হুহু করে বেড়ে যায়।

১৯২৮ সালে জর্জ ওয়াশিংটন হিল (Lucky Strike এর প্রেসিডেন্ট) ধূমপানের ক্ষেত্রে নারীদের মধ্যে যে-ট্যাবু ছিল, তা ভাঙার জন্য এডওয়ার্ড বার্নেসের সাহায্যপ্রার্থী হন। তখন নারীদের কারণে সম্ভাব্য সিগারেটের বাজারের অর্ধেক হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। কারণ নারীদের জনসমুখে, এমনকি বাড়িতেও ধূমপানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ছিল।

এই সমস্যার সমাধানে এডওয়ার্ড বার্নেস ইস্টার সানডে’কে বেছে নিয়েছিলেন। প্রতি বছর এদিনে নিউইয়র্ক সিটিতে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হতো। সেই অনুষ্ঠানে বার্নেস কয়েকজন নারীকে স্কার্টের নিচে সিগারেটের প্যাকেট বহন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।  তিনি বলেছিলেন, তাঁর সংকেত পাবার পর যেন তারা  সিগারেট জ্বালায় এবং প্যারেডে হাঁটতে থাকে। তাঁর নির্দেশমত কাজ সম্পাদিত হলে খবরটি প্রচারিত হয় বিশ্বব্যাপী। এতে নারীদের ধূমপানের বিষয়টি মানুষজনের গোচরে আসে। যারা নারীমুক্তি চেয়েছিল, অবিলম্বে তাদের হাতে সিগারেট দেখা  যায়। তখন থেকে  চলচ্চিত্র তারকা, গায়ক এবং বিজ্ঞাপনে নারীর ধূমপানের বিষয়টি প্রচার পায়। যদিও মিডিয়া বিষয়টিকে নারীমুক্তির নামে প্রচার করেছিল, কিন্তু মূল ঘটনাটি তামাক কোম্পানির পণ্য বিক্রি করার চক্রান্ত ছাড়া কিছুই নয়।

এরপর থেকে জনসমুখে নারীদের ধূমপান করা সহজ হয়ে গেলেও দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা দেখা দেয়। নারীদের কাছে লাকী স্ট্রাইকের সবুজ প্যাকেটকে ফ্যাশনবিরুদ্ধ মনে হত, তাই প্রত্যাশার মতো বিক্রি বাড়ছিল না। কিন্তু প্যাকেট পরিবর্তন করা ছিল অনেক খরচের ব্যাপার। এজন্য বার্নেস ফ্যাশন ডিজাইনারদের বললেন, লাকী স্ট্রাইকের সবুজ রঙ সেই মৌসুমের পোষাকে ব্যবহার করতে। একটি নাচের অনুষ্ঠানে সমাজের বিখ্যাত লোকেরা একই রঙের পোষাক পরিধান করে। সেসব ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দেখা যায়, সবুজ রঙ মোটেও সেকেলে নয়।

বার্নেস শুধু বিভিন্ন পণ্যের বিক্রি বাড়াতেই সহায়তা করেননি, তিনি রাজনীতিতেও কাজ করেছেন। ১৯৪২ সালে প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজের (Calvin Coolidge) নিষ্প্রাণ পাবলিক ইমেজকে পরিবর্তন করে তাকে পুনরায় নির্বাচনের নেতৃত্ব দেন তিনি। এটিকে বিবেচনা করা হয় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণার প্রথমদিকের কৌশল।

আপাতদৃষ্টিতে মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণকে নেতিবাচক বলে মনে হলেও, তা সবসময় নেতিবাচক নয়। যেমন-আমাদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং ডাক্তারের মতো লোকেরা অযাচিত অভ্যাস এবং আচরণকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে থাকে। সাধারণত সামাজিক প্রভাব তখনি নিরীহ বলে বিবেচিত হয়, যখন এটি প্রভাবিতদের গ্রহণ এবং প্রত্যাখ্যান করার অধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখে।

শুধু যে রাজনীতিতেই বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহার করা হয় তা নয়, পারিবারিক ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগ আছে। সেসব নিয়ে অন্য কোনো প্রবন্ধে আলোচনা করবো।

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন