কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

হাসান মুস্তাফিজ

 

সমকালীন ছোটগল্প 



স্ট্রোকআপ ওগো জান (মেঘ) অলি

 

"শেষ বয়সে আমি ঘরজামাই থাকব?"

ষাটের একদাগ নিচের বয়সধারী স্বামীর পিএলআর চলছে। সরকারি বাসা অলরেডি অন্যজনের নামে দেওয়া শেষ। ‘অবসরপ্রাপ্ত’ শব্দটায় গৌরব নেই।  বলতে গেলে এটা আসলে অভিজ্ঞতা নামক এক উপার্জনের উপস্ত্রী। গভর্মেন্ট  জবের সুবিধা হল ১৫০ টাকার পানির বিল, প্রায় ৪৫০০ টাকার নিচের বিদ্যুৎ বিল আর ওকেশনালি রং-টং ও অন্যান্য মেরামতের জন্য কিছুটা আর্থিক প্রতিদান। কিন্তু পরের বছরের মার্চের প্রথম মাসে সেই ফেসিলিটিস এই স্বামীটি হারাচ্ছেন। সন্তানদের নিয়ে তেমন চিন্তার কারণ তিনি দেখেন না। সবার  মোটামুটি ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। দুই মেয়ের বিয়ের চিন্তা আর ছোট ছেলেটাকে কোথাও ঢুকিয়ে দেওয়া — ওতেই হবে বোধহয়। অবশ্য ছেলে যদি আরও পড়ে, সেটার ব্যবস্থা করা যাবে।

স্বামী-স্ত্রীর অবশ্য বিকল্প তবে আশাহত চিন্তা। স্ত্রীর মা এখনো বেঁচে আছেন।    থাকেন পূর্ববাড্ডা হিন্দুমন্দির রোডে। সেই ১৯৬৬ সাল, যখন আমেরিকার ABC তে Batman মুভি ব্রডকাস্টিং করা হচ্ছিল, বাংলাদেশ তখন টিন ও মাটির বদলে সিমেন্ট দিয়ে কীভাবে বাড়ির ওয়াল বানায় সেই কায়দা শিখছেন। সেই আমলের  বাড়ি (কিসিঞ্জার এখনো বেঁচে আছে)। একতলার বাড়ির ছাদ টিনের হলেও বাড়িটা বহুদিন টিকেছে। এই বাড়ির মধ্যে মোট মৃত্যু এসেছে ৬ বার, জানাযা দুবার আর মোটে একবার মিলাদ। সেই বাড়ি এখন ভেঙে একটা পাকা ৫ তলা  বিল্ডিং বানানোর চিন্তাভাবনা চলছে। যদিও ড্রেনেজের ব্যবস্থা খুব বিচ্ছিরি। অমন  বিল্ডিং তুললেও বৃষ্টির খেচাখেচিতে পানি ঠিকই জমবে। ফ্যান্টাসি না হলেও এইটা শিওর, বিল্ডিংয়ের এক তলায় পানি জমবেই।

স্বামীর এই প্ল্যান মোটেও ভালো লাগেনি। চাকরি পাওয়ার পর প্রায় ৩৩ বছর ধরে সরকারি বাসায় ফ্যামিলি নিয়ে থেকেছেন। বাসা হয়ত সরকারের, কিন্তু সেই বাসা ছিল তাঁর নামে। মানুষকে বলতেই ভালো লাগত বাসাটা। কেউ এসে বাসা খুঁজলে পাবলিক বলে দিত ‘অমুকের বাসা’। এই পরিতৃপ্তি থেকে তিনি বঞ্চিত  হবেন এই শেষ সময়ে? এই স্বামীটির সাথে আসলে বাইরের খাঁটি প্রকৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। বড়মেয়ে যখন শখ করে বাসার বারান্দায় কামরাঙ্গা গাছ লাগিয়েছিল, আর সেই গাছের ফুলের মধু খেতে চড়ুই আসলে বড়মেয়েটি যখন  আনন্দে গোসলকালীন খোঁপা খুলে ফেলত, উনি তখন ভাবতেন এই গাছে কোনো ফল আসবে কিনা। কড়াভাবে লবণ দিয়ে কামরাঙ্গাভর্তায় উনি জমিদারি আয়েশ খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। গাছে যদিও ফল আসেনি। অবশ্য এসব বহুদূরের কথা। এসব এখনো তাদের জরায়ু অতিক্রম করেনি। স্বামীর আসল অ্যাগোনি সে টাকা কোথার থেকে জোগাড় করবে। স্বামীর ভাইবোনদের ইচ্ছা পৈতৃকসূত্রে পাওয়া কল্যাণপুরের জমিতে বিল্ডিং বানানোর। কিন্তু ক্যালকুলেশনে দেখা গেছে ওনার এতদিনের সেইভ করা টাকার পরিমাণ সবচেয়ে কম। অথচ পড়াশোনার দিক থেকে তিনি তার ভাইবোনের চেয়ে কম না। তাহলে তিনিই কী বেশি সৎ ছিলেন তাঁর চাকরিজীবনে? উনি নিজেকে কাপুরুষ মানেন কিন্তু তিনি  আর যাইহোক অসৎ নন। তবে ওনার এইটুকু কনফিডেন্স আছে যে তাঁর  ভাইবোনেরাও সৎ। কিন্তু তাদের টাকার পরিমাণ আসলেই তাঁকে পীড়া দেয়। দেবে না কেন, বরং পেইন দিচ্ছে এটাই সবচেয়ে বড় কোয়ালিটি। সাধারণ বাংলাদেশি রিটায়ার মানুষদের যদি এমন জেলাসি না থাকে তাহলে তারা কেউ  ‘মুঃ মিজানুর রহমান’ হত না, তারা হত ওয়াল্ডো এমারসন।

এসব সংমিশ্রিত আনসার্টিফাইড পলিটিক্সে জড়াতে তিনি চান না। কিন্তু জড়িয়ে গেছেন। শেষ বয়সটায় তিনি চান পুলকিত সন্তোষ, ঘন দুধের উপর ভাসা সরের যে ওজন থাকে সেইরকম ওজনের তৃপ্তি আর ঋকমুগ্ধতা চান। আপার চাহিদার মধ্যে এইটা তাঁর বেশি দরকার। এরজন্য তিনি সব বিসর্জন দিতে রাজি। ওর  মধ্যে যদি বিলাসিতার জন্য ‘পশুপ্রেমী’ বা ‘বৃক্ষপ্রেমী’ বা যেকোনো প্রেমী হবার  দরকার হয়, তিনি হবেন। স্ত্রীর সাথে এ নিয়ে প্রায় প্রতিসপ্তাহে ঝগড়া হয়, হোক। স্বামীর অবশ্য খারাপ লাগে। মতিঝিল কলোনির যেই বাসায় তিনি নিজ পরিবার নিয়ে থাকেন, সেই একই বাসাতে তিনি তাঁর বাবা-মার পরিবারের  মাধ্যমে গড়ে উঠেছেন। তাঁর ছেলের অবশ্য এই কলোনি থেকে রুচি উঠে গেছে।

 

★★

 

"হ্যাঁ, তবে আমি ঐদিন ব্যথা পেয়েছি।"

লুতপার জন্যও এটা নতুন এক শিহরণ ছিল। সে আগে তার এক্সকে ঠোঁটে চুমু খেয়েছে, কিন্তু তার এইবারের প্রেমিক প্রথম দিল হিকি। ঠোঁটে চুমু খাওয়ার প্রতি তার আকাঙ্ক্ষা কেমন জানি কম। লুতপা খেয়াল করছে এই প্রেমিক বারবার  তার লম্বা চুলগুলো কানের চারপাশ থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। সরানোর সাথে সাথে সে দ্রুত কানের ভিতর জিহ্বা ঢুকিয়ে ঘোরাতে শুরু করলো। লুতপার একই  সাথে অস্বস্তি এবং এক অস্পৃশ্য উত্তেজনা উদ্রেক হতে লাগল। সে শিওর তার এই প্রেমিকও ভার্জিন। কিন্তু সে এত কিছু জানে কেমন করে? প্রেমিকই প্রথম বলল সে এসব পর্ণ দেখে শেখেনি। লুতপার বিশ্বাস হল না। অর্থাৎ, এই প্রেমিকটি ঠ্যালায় পড়ে মিথ্যুক হতে দ্বিধাবোধ করে না। ততক্ষণে ফ্রেঞ্চফ্রাই  আর এক কাপ কোল্ড কফি এসে গেসে। প্রেমিক ওয়েটারকে না বলে নিজেই আরেকটা স্ট্র নিয়ে এল। ফ্রেঞ্চফ্রাইও সে লুতপাকে নিজের থেকে খেতে দিচ্ছে না। লুতপাকে সে খাইয়ে দিচ্ছে। সে প্রথমে ফ্রেঞ্চফ্রাই অর্ধেক খায়, বাকি যেটুকুতে ওর স্যালাইভা লেগে থাকে সেটা প্রেমিকটি খেয়ে ফেলে। লুতপা অবাক হয়। এত ফর্মালিটিস কেন? এত সংকোচই কেন? এসব ভাবার মুহূর্তেই প্রেমিকটি আবার ঠোঁটের দিকে ফ্রেঞ্চফ্রাই এগিয়ে দিল। কিন্তু লুতপা কামড় দিতে যেতেই প্রেমিক মুখ বাড়িয়ে দিল। লুতপা বুঝেছে সে প্রেমিকের ঠোঁট কামড়াচ্ছে,  কিন্তু সে সরে যেতে পারলো না। প্রেমিক এরই মধ্যে হাত ওর কাঁধের পাশ দিয়ে  ঘুরিয়ে পিছনে নিয়ে এসেছে। প্রেমিক চুম্বনের সময়ে তার জিহ্বা দিয়ে বাড়াবাড়ি করছে না। যথেষ্ট সময় দিচ্ছে লুতপাকে। একসময়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের জিহ্বা নিজেদের আলিঙ্গন করল। প্রেমিক ততক্ষণে লুতপার স্তন ধরে ফেলেছে। লুতপার কান্না আসছে। এত আদর শুধু ওর জন্য? এর মোচনও ঘটলো এত দ্রুত? দুদিন আগেও এই প্রেমিক তার কাঁধে হাত দেওয়ার সময়ে পারমিশন নিত, এখন সে নিজেই সব করছে। লুতপা এইবার নিশ্চিত, তার প্রেমিক পর্ণ দেখে।

দুজনই এখন ক্লান্ত। প্রেমিক এখন লুতপার বুকে মুখ ঘষে বিশ্রাম নিচ্ছে। তার শখ হয়েছে লুতপার হার্টবিট শুনবে। লুতপার বলতে হয়নি, নিজেই মুখ ঢুকিয়ে দিয়েছে দুই ঐন্দ্রজালিক মাংসের মাঝে। কদিন পরেই বিজয় দিবস। লুতপার খুব ইচ্ছা সে সন্ধ্যাকালে প্রেমিকের সাথে প্রথমে ধানমন্ডি যাবে, তারপর মতিঝিলের শাপলা চত্বরের লাইটিং আর ফায়ার ওয়ার্কস দেখবে। প্রেমিক রাজি হল। সেও লুতপার মতো এক্সাইটেড।

কিন্তু প্রেমিক আবার বলতে শুরু করল সে এসব রোমান্স পর্ণ দেখে শেখেনি।  লুতপা এতে বিরক্ত হল। সে নিজেকে এমন জাহির করছে কেন? সে যাই বলুক, লুতপা ঠিক করল ব্যাখ্যা শুনবে, যদিও তার পছন্দ হবে না, তবুও সে প্রেমিককে কিছু বলবে না। আজ থেকে ওর পুরো অতীত লুতপা মাফ করে দিল। প্রেমিক তখন বলল সে এ ধরনের রোমান্স শিখেছে জেমস জয়েসের ছোটগল্প পড়ে আর বিলি ওয়াইল্ডারের মুভি দেখে। লুতপা প্রচন্ডরকম আশ্চর্য হল। সিনেমা দেখে কীভাবে এসব সম্ভব?

সেদিনের পর থেকে প্রতি ডেটেই প্রেমিক খালি লুতপাকে বলতো জেমস জয়সের ‘Araby’ গল্পটার কথা। লুতপার কাছে গল্পটা তেমন বিশেষ কিছু লাগে না।  কাহিনিও বর্তমান যুগে খুবই কমন। সে এই গল্পের প্রচুর নাটক দেখেছে। তবুও প্রেমিক খালি সেই গল্পটার কথা বলে। এতে করে লুতপার ধারণা হয়ে গেল তার এই দু’মাসের প্রেমিক বেশি সিরিয়াস। আবার ভোদাইও বটে। যেমন  বিবিসির এবারের শ্রেষ্ঠ একশ নারীর তালিকায় বাংলাদেশের এক প্রাক্তন বেশ্যাকর্মী স্থান করে নিয়েছে। প্রেমিকের শখ সে এই নারীর পা ছুঁয়ে সালাম করবে। লুতপার এটা ভাবলে গা ঘিনঘিন করে। চুম্বনের সময়ে প্রেমিক লুতপার পুরো স্যালাইভা ঠোঁট থেকে চেটে নিলেও লুতপা বরং টিস্যু দিয়ে ওর মুখের স্যালাইভা মুছে ফেলে। সেই টিস্যুতে রক্তাক্ত লিপস্টিকের প্রচ্ছদ তৈরি হয়। প্রেমিক সেটি ফেলতে দেয় না বরং পকেটে রেখে দেয়। লুতপা সেদিন বোঝে তার এই প্রেমিক খুবই  অবসেসিভ। এর সাথে কোনো ফিউচার কল্পনা করা যায় না।

 

★★

 

"ভাই, আমাদের সাথে ‘Man’ শব্দটা যায়?"

মিস. সুরাইয়া রিমু বিবিসির সেই শ্রেষ্ঠ একশ নারীর লিস্টে নাম করে নেওয়ার পর থেকেই আর কারোর সাথে দেখা বা কনট্যাক্ট করেন না। প্রেমিকের এতে  আফসোস হয়। সে লুতপাকে তা জানালেও লুতপা ম্যাসেঞ্জারে এটার রিপ্লাই দেয় না। এই প্রেমিকটির যথেষ্ট সমস্যা আছে। প্রেমিকটির দোষ সে ব্রেন দিয়ে কাউকে ভালোবাসে না, সে হার্ট দিয়ে কাউকে ভালোবাসা না, সে পিনেস দিয়েও কাউকে ভালোবাসে না।

সে ভালোবাসতে চায় রক্ত দিয়ে (অর্ণা সাক্ষী)। এই মোহ তাকে তার জেনারেশন থেকে যেমন স্বকীয় করে তোলে তেমনি তাকে আইরিশ ড্রাঙ্কদের চেয়েও ভয়াবহ মাতাল করে ফেলে। ইদানীং প্রেমিকটির নতুন ম্যাডনেস শুরু হয়েছে। সে হিজড়া দেখলে দূরে হাঁটা দেয় না। বরং সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আর খোশগল্প শুরু করে  দেয়। এই প্রেমিকটিই বোধহয় প্রথম যে হিজড়া দেখলেই আনন্দে হাসে। সম্প্রতি সে খোঁজ পেয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে হিজড়াদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে। প্রেমিকটির এতে সমর্থন আছে। এবারে আমেরিকার সিনেট নির্বাচনে এক ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জয়ী হয়েছে যে হিজড়া। বাংলাদেশে হিজড়াদের জন্য দুটি মাদ্রাসা খোলা হয়ে গেছে। প্রেমিকটি লুতপার সাথে কথা বলা বাদ দিয়ে রাত জেগে হিজড়াদের কুরআন তেলাওয়াত শোনে। গভীর রাতে লুতপাকে কল দিয়ে কান্নাকাটি করে। লুতপা হতভম্ব হয়। সে কীসবে জড়ালো? এখন আর তাকে পছন্দ হয় না। লুতপা মনেপ্রাণে চেষ্টা করে  তার প্রেমিককে ভালোবাসতে। সে একদিন আবেগের ছলে বলেও ফেলেছে সে ভবিষ্যতে প্রেমিকটির স্ত্রী হতে চায়। কিন্তু এখন ভাবলে তার শরীরে প্রচণ্ড ঘেন্না  তৈরি হয়। প্রেমিকের অবশ্য এসব আমলে আসে না। সে লুতপাকে নিয়ে কাপল জোনওয়ালা রেস্টুরেন্টে ঘুরতে যায়। চুম্বনের সময়ে তার প্রি-কাম হয়। সে এগুলো উপভোগ করে কিন্তু সে বেশি উপভোগ করে হিজড়াদের জন্য এইসব স্টেপগুলা।

বিজয় দিবসের দুদিন আগে প্রেমিক জানতে পারল হিজড়াদের এখন থেকে ডেলিভারিম্যান হিসেবে ইউজ করা হবে। প্রেমিক সাথে সাথে সব ধরনের খবরাখবর জেনে সারাদিন বেইলি রোড, মৎস্যভবন রোড, শিল্পকলা একাডেমির চারপাশ ঘোরাঘুরি করে হিজড়া খোঁজে। হিজড়া পেলেই তাদের এসব জানায়।  প্রথম প্রথম তাদের কেউ কিছু বলতো না, তবে একদিম এক হিজড়া গর্জে উঠে বলে বসল, ডেলিভারিম্যান কেন? ডাক্তারি ফর্ম, এনআইডি ফর্ম বা যে কোনো  ফর্মই পূরণ করতে গেলে তাদেরকে সেক্স সেকশনে সবসময় othersএ টিক দিতে হয়। হিজড়াটি তার সব ক্ষোভ ঝাড়লো প্রেমিকটির উপর। এর মধ্যে সে হুট করে প্রেমিকটির শার্টে থুতু দিয়ে বসল। এসব খবর গোপন থাকে না। লুতপা  সেসব জেনে ফেলল। লুতপার মধ্যে সেটা রূপ নিল ঘৃণায়। সে প্রেমিকটির সাথে আর দেখা করে না। বহুভাবে ঘোরাচ্ছে। কিন্তু একসময়ে লুতপা বুঝতে পারে যে  তার প্রেমিকটি হাবাগোবা। সে নিজের জগতের এক ভাঙা কূঁড়েঘরে বন্দি থাকে। তাকে এভাবে ঘৃণা করা যায় না। অর্থাৎ আবার লুতপার ইচ্ছা হল প্রেমিকটিকে   সুযোগ দিতে। কিন্তু সেটা এত সহজে দেবে না।

 

★★

 

"ভাই আমার শরীর ভালো হলে ইন্টারভিউয়ের উত্তর পাঠিয়ে দেব"।

রাহুলের শরীর আগের চেয়েও খারাপ। কোনোমতে সে এক সরকারি হসপিটালের বারান্দায় জায়গা পেয়েছে। প্রেশার উপরেরটা সবসময় থাকছে ১০০ এর নিচে। ডিপ্রেশন বেড়ে গেছে, বুক জ্বালাপোড়া করে, মাথার পিছনে ব্যথা করে।

রাহুল চাইলে তার শর্টফিল্মটা বাণিজ্যিকভাবে ইউজ করতে পারতো। কিন্তু সে পারেনি। তাকে দিয়ে এসব সম্ভব না। পৃথিবীতে বর্তমানে সবাই আসলে ব্যবসায়ী, সে তা হবে না।

 

★★

 

"আমি এই রিলেশনেশিপে হ্যাপি না।"

(নিষ্ক্রিয়তা)।

"তুমি একবারও বলবে না আমাকে থাকতে?"

(নিষ্ক্রিয়তা)।

"ছেলেরাই কিন্তু সবসময় মেয়েদের দেখে রাখে, এটাই নিয়ম"।

লুতপা এই ম্যাসেজ দেওয়ার পর থেকেই প্রেমিকটি রেগে গেছে। তার স্বভাবের সাথে এমন হিংস্র মুড যায় না। লুতপা খুবই অবাক হচ্ছে। সে যখন ঐ ম্যাসেজটি দিয়েছে, প্রেমিকটি উত্তর দিয়েছে "Your choice "। প্রেমিক কি তাকে তটস্থ করতে চাইছে? লুতপা ঠিক করল সে হার মানবে না। তার সবচেয়ে বড়  অস্ত্র আবেগ আর ড্রামাটিক কান্না। সে এটা দিয়েই রাজত্ব করবে। প্রেমিক এদিকে ক্ষেপে জানিয়ে দিল লুতপার যদি সাহস থাকে সে যেন নিজের কণ্ঠ দিয়ে সেটা বাস্তবায়ন করে। লুতপা ফোন দিল।

লুতপার প্রথম যুক্তিই হল প্রেমিকটি বেশি সিরিয়াস লাইফ নিয়ে। তাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো না। শেষে বলল রিলেশনে সবসময় ছেলেরাই সবকিছু করে। মেয়েরা থাকে নিরপেক্ষ।

প্রেমিকটি সব মানতো কিন্তু শেষ কথাটি শুনে তার মনে হল লুতপা জাত মূর্খ। পরে মনে হল না শুধু লুতপা না, বেশিরভাগ এসব স্বপ্নচারী বাংলাদেশি নারীরাই হল মূর্খ। জন্মের মূর্খ, গর্ভপাতের গর্দভ আর সন্নিকটের bitch। সেই সময়েই প্রেমিকটির মনে হল, এদের জন্য হুমায়ুন আজাদ প্রাণ দিলেন? বাংলাদেশে তাহলে এত ফেমিনিজম চর্চার প্রভাব কই? ফেমিনিজম প্রকল্প আসবে শুধু পোশাকে আর পাবলিকলি সিগারেট টানার ক্ষেত্রে? অন্যান্য ক্ষেত্রে ছেলেদেরই সব করতে হবে মেয়েদের জন্য? জৈবিক গঠনে মেয়েরা দুর্বল সেটা মানা যায়, কিন্তু প্রেমিকটির মনে হল সেদিক থেকে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়ে বোধশক্তির দিক থেকে নিজেদের এমন অপদার্থ বানিয়ে রেখেছে। প্রেমিকটির মধ্যে দোটনা সৃষ্টি হল। সে কীভাবে এরকম মূর্খের সাথে ফিউচার পার করবে? লুতপা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও প্রাচীন আমলের পুরোহিতদের মতো বিপর্যস্ত। লুতপা আশা করে তার প্রেমিক তার মতো হোক। যদি এটার জরিপ করা হয় তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ স্টুপিড টিনেজার এবং আধা এডাল্ট মেয়ে এসবই চায়। এতো বিরাট আচমকা লাপাত্তা ইরেকশনের মতো কান্ড। এইসব মেয়েরা কি কখনো শখ করে এমা গোল্ডম্যানের প্রবন্ধ পড়ে না? বিয়ে বা রিলেশনের ক্ষেত্রে সবসময় মনে রাখতে হবে প্রেমিক-প্রেমিকা এবং স্বামী-স্ত্রীদের কখনো এক হওয়া যাবে না। তারা পরিবেশগতভাবে থাকবে আগন্তুক। তাদের সব ধরনের অভ্যাস ও প্রেজুডিস বিশ্বাস হবে ভিন্ন। এতে করে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ মতবিরোধ হবে, পরে সেটা যাবে ইউনিভার্সাল ট্রুথের দিকে। তখন ভালোবাসা যেমন বাড়বে, তেমনি একটা ইকনোমিকাল ইন্স্যুরেন্সও তৈরি হবে। হ্যাঁ, এটার জন্য কষ্ট করতে হবে কিছুটা কিন্তু এইটুকু কি পরস্পরের জন্য কনসিডার করা যায় না? মেয়েরা অর্থখরচের সময়ে চলে ব্রেন দিয়ে আর ভালোবাসার ফলআউটের তারা যুক্তি দেয় পুসি-ফেইস হয়ে।তাহলে কেন প্রাচীনকালের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীদের নারীদের প্রতি যে গর্হিত ভাব বা বর্তমানে রোমান পোলাস্কির মতো ফিল্মমেকারদের শৈল্পিক কাজ ইগনোর করে বাংলাদেশি মেয়েরা তাদের চরিত্র দেখে বিচার করছে? তাহলে বাংলাদেশে কি এখনো মডার্নিজমের কোনো সময়ই আসেনি? তাহলে কোটেশন করে বলতে হয়, এক পুরুষ যদি সেই ইভোলিউশনের থেকে এক নারীকে দেখে ধর্ষণের কামনা করে থাকে, তাহলে এটাও বলা যায়, এত যুগ পরও একজন নারী ঠিকই চায় সে এক এস্টাবলিশড পুরুষের বিশ্বস্ত গোলাম হিসেবে জীবন পার করুক। ম্যান্সট্রুয়েশনের উপরিপাতন দিয়ে নারীরা ভিজুয়াল পোয়েট্রি বানিয়ে যতই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে তাদের স্বাধীনতার বার্তা যতই প্রমোট করুক না কেন, তারা সেই গোলামই।

প্রেমিক তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে লুতপার সাথে আর সম্পর্ক রাখবে না।

পরের দিন লুতপা বহুবার ফোন দিল। প্রেমিক ধরেনি। পরের দিন প্রেমিক ভাবলো সে লুতপার প্রতি একটু উদার হতে পারে। কারণ তারা প্রেমিক-প্রেমিকা হবার আগে ছিল ভালো বন্ধু। সেটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রেমিক লুতপাকে ফোন দিল। কিন্তু লুতপা আবার নিজের ইমোশন দ্বারা নিজেকে ভরাট করে ফেলল। তার সব যুক্তি ছিল সস্তা, ব্যবহার ছিল অমানবিক আর ঢং ছিল ব্ল্যাকজেক ডিলারদের মতো। প্রেমিকও আর পারলো না। সেও লুতপাকে জঘন্য সব কথাবার্তা বলে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। পরে অবশ্য এমন ব্যবহারের জন্য তার মধ্যে অপরাধবোধ জন্মায়।

বিজয় দিবসের দিন প্রেমিকটি টিএসসিতে গিয়ে একটা গোলাপ কিনে পরে সেটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে আসে।

 

★★

 

“আমাকে ওর রিপ্লেসমেন্ট ভাইবো না”।

মেঘের সাথে সবসময় খারাপ ব্যবহার করা হয়। এইবার শুধু ভদ্রভাষার উত্তর —

She isn't real. can't make her real.

 

(এটা এক ধরনের রম্যগল্প। বর্তমানে রম্যগল্প মানেই যে বিভিন্ন শ্রেণির সস্তাকিছু খিস্তি আর হাসির উপমা, তা নয়। লেখক সেই স্টাইলে বিশ্বাসী নয়। একটু  ভাবলেই বোঝা যায় যে, জোকস আর রম্য সবসময়ই নিষ্ঠুর। এককালে  আমেরিকায় রেসিস্ট জোকস বিখ্যাত ছিল, প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের মতো মানুষ এসব জোকস ওয়ান লাইনার হিসেবে ব্যবহার করতেন। লেখকও এখানে নিষ্ঠুরতাকে গুরুত্ব দিয়ে রম্য লিখেছেন। মাথা খাটানোর দায়িত্ব পাঠকদের। আসলে এইসব নিষ্ঠুরতাই বাস্তব জীবনের সবচেয়ে হাস্যকর পরিক্রমা।)

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন