কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

নিবেদিতা আইচ

 


সমকালীন ছোটগল্প 


অযান্ত্রিক

আন্দ্রেই আজ সকালে চলে গেছে। গত দু'বছরে শুধুমাত্র একবার সে ছুটি নিয়েছিল, সেও শুধু দিন তিনেকের জন্য। শরীর সারাতে সেই ছুটি খুব প্রয়োজন ছিল। আমার মনে আছে, ঠিক তিন দিনের মাথায় ফিরে এসেছিল আন্দ্রেই। ও এমনই ছিল, নিয়মের বাইরে কিচ্ছু করেনি।

ওর মতো সময় ধরে চলতে পারলে বেশ হতো! বনির সময়জ্ঞান নিয়ে কটাক্ষ  করতে গিয়ে মাঝেমাঝে আমি এ কথাটা বলি আর ও প্রতিবারই হেসে ওঠে বলে - তাই বলে ওর মতো রোবট হতে বলো না আমাকে।

আন্দ্রেইয়ের এবারের যাওয়াটা অন্যরকম। ওর সবকিছুতেই আমরা সন্তুষ্ট হলেও ওকে বিদায় দিতে হলো। বেশ কিছুদিন ধরে বুঝতে পারছিলাম মাত্র দু'জনের সংসারে হেল্পিং হ্যান্ড একটা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয় তাছাড়া বনি পড়তে  চলে যাবার পর আলাদা আরেকটা সংসার হয়ে গেছে ওখানে৷ ফলে খরচ দ্বিগুণ হয়েছে আমাদের। প্যান্ডেমিকের এই বাজে সময়টায় এত খরচ আর পোষাচ্ছে না।

আন্দ্রেই দু'দিন ধরে আমাকে বারবার প্রশ্ন করেছে। হ্যাঁ, তোমাকে আর ফিরিয়ে আনা হবে না - এই কথাটা মুখের উপর ওকে বলতে পারিনি। মনে মনে বনির প্রতি খুব বিরক্ত বোধ করেছি। এরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতিগুলো ঠিক ঠিক ও এড়িয়ে যায়। আমি এড়াতে পারি না। আমাকে নিরুত্তর থাকতে দেখে আন্দ্রেই কী ভেবেছে জানি না। তবু চলে যাবার সময়ও ওর বোধহয় ধারণা ছিল, আমরা ওকে আবার ফিরিয়ে আনব।৷ দরজার কাছে গিয়ে সে ফিরে তাকিয়েছে, তারপর ঘাড়টা কাত  করে বলেছে - সি ইয়্যু সুন, রিখি৷

আমি তখনো নিশ্চুপ ছিলাম। মনটা কেমন খারাপ লাগছিল। কিন্তু সেও অল্প সময়ের জন্য। ওকে বিদায় দিয়ে সারাদিন ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতে হলো।

দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ততায় আমি অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠলাম। আন্দ্রেই কীভাবে এতদিক  সামলাতো কে জানে! চব্বিশ ঘন্টায় একবার বিশ্রাম নিতো সে, সেটাও ঘন্টা দুয়েকের বেশি নয় কেমন যন্ত্রের মতো ক্লান্তিহীন!

বনি বলে - যন্ত্রের মতো মানে! হোয়াট ডু ইয়্যু মিন!

ওর মুখভঙ্গি দেখে আমিও হেসে ফেলি। আজ অবশ্য হাসি পাচ্ছে না মোটে। এতদিন একসাথে থাকায় আন্দ্রেইয়ের প্রতি আমার মায়া জমে গেছে।

কাজ করলে এই মন খারাপের ভাবটা কেটে যাবে ভেবে রান্না বসিয়ে দিয়ে কাপড় ধুতে গেলাম। সারা সপ্তাহের কাপড় উইকেন্ডেই ধোয়া হয়। সকালে দেখেছি অনেক কাপড় জমে গেছে। সেসব জড়ো করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, আন্দ্রেই কখন  যেন সব ধুয়ে শুকিয়ে ক্লোজেটে জায়গামতো রেখে গিয়েছে। শেষ দিনটাতেও এক চুল ভুল করেনি ছেলেটা! বুঝতে পারছি, যতটা ভেবেছি, ওকে আমি তারচেয়ে বেশি  মিস করবো।

আজকে রান্নাঘরে ইচ্ছে করে সময় দিলাম অনেক। বেশ কয়েক পদ রান্না করে আলাদা আলাদা বক্সে ভরে ফ্রিজে রাখলাম। বনির ফিরে আসতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। ফিরেই এটা ওটা খেতে চেয়ে আবদার করবে। আবার আমাকে কিচেনে ব্যস্ত থাকতেও দেবে না। তাই ও আসার আগে গুছিয়ে রাখছি সব।

সেদিন বনি ইনবক্সে বলছিল - ভালোই হলো, আমি ফিরে এসে তোমাকে একা পাবো।

আমি অবাক হয়ে বললাম - দোকা কবে হলাম আমি?

বনির বরাবরই এমন হেঁয়ালির স্বভাব। মাঝেমাঝে উদ্ভট সব কথা বলে আমাকে রাগাতে পারলে খুব আনন্দ হয় ওর।

আমি তেতে উঠছি টের পেয়ে সে ঝটপট লিখল - বলছি যে তোমার আন্দ্রেই বিদায় হওয়ায় আমার সুবিধা হলো। ও ব্যাটা অযথা ভীষণ ঘুরঘুর করে।

আমার আন্দ্রেই! এও খোঁচা দেবার জন্যই বলা। তা একদিক দিয়ে ঠিকই বলেছে। বনি যাবার আগে সমস্ত কিছু আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে। সেই অর্থে আন্দ্রেইকে তদারক করার ভারও আমার ওপর ছিল। আর সেও ভীষণ অনুগত ছিল আমার।

সারাদিন কাজের ফাঁকে আন্দ্রেইয়ের কথাই ভাবলাম। ফ্রি হয়ে স্নান সারতে সারতে বিকেল হয়ে গেল। ফ্রিজে লেফটওভার পাস্তা ছিল। সাথে ডিমের ঝুরি নিলাম প্লেটে। এই অবেলায় লাঞ্চ করে ভাবছি রাতে আর কিছু খাবো না।

সারাদিন বনির সাথে একবারও কথা বলার সময় পাইনি। শুধু ভোরবেলা ওর মেসেজটা দেখেছি - আমি আসছি ৭ তারিখেই, ফ্লাইট ক্যান্সেল হবে না।

এটা তো হবারই ছিল। ডোমেস্টিক ফ্লাইটগুলো এখনো বন্ধ হয়নি। কিন্তু যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে বন্ধ হয়ে গেলে খুব একটা অবাক হতাম না।

ব্যালকনিতে বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ফোনটা হাতে নিলাম। বনি অনলাইন একটা সেমিনারে আছে। এখন কথা হলো না তাই। সকাল থেকে আমার মনের মধ্যে খচখচ করছে। আমি যেন যথেষ্ট খুশি হতে পারছি না। এমন নির্লিপ্ত লাগছে কেন আমার? বনি আসছে। গুণে গুণে ঠিক ছ'মাস পর ফিরে আসছে আমার কাছে। এত এত অপেক্ষা দু'জনের!

ইউটিউবে কিশোরকুমার গাইছেন – আর তো নয় বেশিদিন, মিলবো এবার দু'জনে। বনির খুব প্রিয়। ঘরোয়া 'পট্লাক' পার্টিতে কিংবা লিভিংরুমের ছোট্ট আড্ডায় গান গাইবার সুযোগ হলে বনি এ গান গাইবেই।

'ধন্য হবে যে জীবন,

পুণ্য হবে যে মরণ

দুজনার শুভ মিলনে।

আর তো নয় বেশিদিন!'

গানের কথাগুলো সত্যি হতে চলেছে। তবু আমি এমন ঝিমিয়ে পড়েছি কেন? ওর শহরে আগামী সপ্তাহ থেকে লকডাউন। খবরটা জেনে কী দুশ্চিন্তায় ছিলাম আমি, আমরা দু'জনেই। সবকিছু অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনে কারফিউও জারি হতে পারে। আমার শহর এখনো কিছুটা সচল থাকলেও বেশি দেরি নেই দ্বিতীয় দফা লকডাউনের। বনি ফিরলে প্রথম উইকেন্ডে আমাদের একটা ট্যুরের প্ল্যান ছিল। ওর বন্ধুদের ডিনারে ডাকবার ইচ্ছা ছিল। সব আপাতত বাতিল করতে হয়েছে। এই একদিক দিয়ে ভালোই হলো। আমি ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে যাবো আগের মতোই। বনিও বাসায় থাকতে বাধ্য হবে। নিজেরা সময় কাটাবো একসাথে।

রাতে কিছুতেই ঘুম এলো না। একটা রমকম মুভি দেখতে দেখতে মাঝরাতে খিদেও লাগলো আমার। ফ্রিজ থেকে মাফিন বের করতে গিয়ে কেরামেল কেকটার দিকে নজর গেল। দু'দিন আগে আমার জন্মদিন উপলক্ষে আন্দ্রেই ওটা নিজে বানিয়েছে।

সেদিন সকালে দুটো অনলাইন ক্লাস আর একটা মিটিংয়ের পর ল্যাবে যেতে হয়েছিল আমাকে। ঘন্টা তিনেক কাজ করে ফিরে এসে দেখি আন্দ্রেই কেক সাজিয়ে অপেক্ষা করছে। 'হ্যাপি বার্থডে, ডিয়ারেস্ট'। লেখাটা পড়ে প্রথমে ভ্রু কুঁচকে গেলেও ওর টানটান হয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলেছিলাম। এমন নিপাট ভদ্রলোক সে!

কেরামেল কেক কবে শেষ হবে জানি না। মাফিন রেখে ওটাই খেলাম আমি। আর আন্দ্রেইয়ের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আরেকবার।

মুভিটা ভালো লাগছিল না। অগত্যা বিছানায় গেলাম ডায়েরি নিয়ে। আজকের তারিখ বসিয়ে কিছুক্ষণ একটানা লিখলাম।

তারপরই টুপ করে একটা চিরকুট বের হলো ভেতরের পাতা থেকে।

আন্দ্রেই লিখে গেছে - 'ডিয়ারেস্ট রিখি, কখনো এই অবরুদ্ধ দিন শেষ হলে যদি আমার যান্ত্রিক শরীরটা ফেরার উপযুক্ত হয় তবে আবার দেখা হবে আমাদের। টেক মাই লভ অ্যান্ড ডোন্ট মিস মি।'

আজ সকালে ওর ধাতব চোখে যে ছায়া দেখেছি সেটা তবে বিভ্রম নয়! আর সে ছায়া হয়ত আমাকেও ছুঁয়ে গেছে। অথচ আন্দ্রেইকে শুধুমাত্র একটা যন্ত্র ভেবেছিলাম আমরা

আমি জানি ব্যাপারটা বনি শুনলে হেসেই উড়িয়ে দেবে। বলবে - রিখি! সবকিছুতেই মায়া খুঁজতে যেও না তুমি। একটা রোবটকেও প্রেমিক বানিয়ে ছাড়লে।

নাইটস্ট্যান্ডে আমার সাথে আন্দ্রেইয়ের ছবিটা ঝকমক করছে। সেদিন ওর এখানে আসার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে নতুন জামাকাপড় কিনে দিয়েছিলাম। আন্দ্রেই ঝটপট পরে এসে আমার পাশে দাঁড়াতেই বনি ক্যামেরা এনে ছবি তুলেছিল।

আমি ভীষণ মিস করছি ওকে। মাঝেমাঝে এমন ঘুমভোলা রাতে ওর সাথে দীর্ঘক্ষণ গল্প করেছি। কখনো নিশ্চুপ বসে থেকেছি ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেকক্ষণ পর আন্দ্রেই ভারী গলায় বলতো - আই থিংক ইয়্যু আর মিসিং বনি!

আমি সায় দিলে জিজ্ঞেস করতো - মন খারাপ হওয়া কি একেই বলে? ডু আই হ্যাভ অ্যানি বাটন ফর দ্যাট?

নিজের শরীরে সে মন খারাপের বাটন খুঁজে বেড়াতো। আমি ভীষণ অবাক হতাম। কিন্তু ব্যাপারটা ওকে ঠিক গুছিয়ে বলতে পারতাম না।

আজকের ঘুমভোলা রাতে ডায়েরিতে আমি ওর চিঠির উত্তরে লিখলাম-


ডিয়ার আন্দ্রেই,

আই উইল মিস ইয়্যু। আমি জানি কত দ্রুত তুমি সব ভুলে যাবে। কয়েকদিন কিংবা কয়েক ঘন্টার মাঝেই আমাকে, বনিকে তোমার স্মৃতি থেকে মুছে ফেলবে ওরা। তুমি নতুন কোন পরিবারের সদস্য হবে। যেখানেই যাও, আনন্দে থেকো। তোমার সে ক্ষমতা আছে। তুমি এমনকি কষ্ট পেতেও জানো। তুমি মায়া বুনতে জানো। তোমার ধাতব করোটির ভেতর কোনো অলিন্দ বা নিলয়ে তুমি নিজের অজান্তেই অযান্ত্রিক হয়ে গেছো। জানো তো, এখন থেকে তোমার মন খারাপের বাটনটা অন হয়ে গেছে।'

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন