কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

শতাব্দী দাশ

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯২


অজানা অক্ষরমালা


মুখ বাড়িয়ে রুদ্রপলাশের বাহার দেখছিল প্রমা। যজ্ঞাগ্নির সে রঙ তার ধোঁয়া-জর্জর-হৃদয় ও ফুসফুসকে নিমেষে শুদ্ধ করল।  স্টেশনটায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন। হকার হাত নেড়ে নেড়ে দেখাচ্ছে লেডিজব্যাগ। মহিলা-কামরার নিত্যযাত্রীরা রঙ্গতামাশা জুড়েছে তার সাথে। হেসে গড়িয়ে পড়ছে এর-ওর  গায়ে, শব্দহীন। প্রমার কানে ইয়ারফোন। জানালার পাশের সিট আর ইয়ারফোনের যুগলবন্দী ঘটলে নিজের চারপাশে কেমন সীমানা টেনে দেওয়া যায় ভিড়ের মধ্যেও !

বসন্ত ঝাঁপিয়ে পড়েছে নাম-না-জানা-স্টেশনে। মুখ বাড়িয়ে  স্টেশনের নাম দেখার চেষ্টা করছিল প্রমা। রাকস্যাকটা নামিয়ে এখানে নেমে পড়লে হয়না? পেপারওয়ালা হাতের বিছানো হ্যাঙারে দৈনিক সংবাদপত্র ঝুলিয়ে আসে। প্রমা ইশারায় তাকে ডাকে।

পশ্চিম মেদিনীপুরে সুবর্ণরেখার ধারে এক গ্রামে চলেছে প্রমা। খননে বৌদ্ধবিহার উঠে এসেছে সেখানে। গ্রন্থাগারের ধ্বংসাবশেষ, বৌদ্ধভিক্ষুদের কুঠুরি। প্রস্তরে উৎকীর্ণ ব্রাহ্মীলিপি আর কিছু কিলোমিটার দূরে, ভাবতেই ইতিহাসের ছাত্রী প্রমা উত্তেজনা বোধ করে। গ্রন্থাগারের আরও কত লিপি, যারা পাথরের মতো পোক্ত আশ্রয় পায়নি, তাদের পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ভাষা অজানা, তা আয়ত্ত করার বদলে অক্ষরমালা পুড়িয়ে দেয় কেন মানুষ?

বাহুতে হ্যাঁচকা টানে সম্বিৎ ফেরে প্রমার। হাততালি আর উগ্র শরীরভাষা। কী চায় ওরা? টাকা? বাহু ধরে টান মারবে তা বলে? বিরক্ত প্রমা ইয়ারফোন খোলে কান থেকে।

বিস্ফারিতচোখে লালশাড়ি আর চড়া সাজগোজে ভূষিত মানুষটি কিন্তু বলছে অন্য কিছু। ‘আবাগির বেটি, শুনতে পাসনা! জানলা দিয়ে মুখ বাড়াতে না করছি তো! জানিস না, কাল রাতে এক মেয়ের মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছে?  জানলার ধারে বসেছিল৷ আমাদের চোখের সামনে উড়ে এলো বাল্বটা!’

একটা সরীসৃপ নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে৷ একা হিল্লি-দিল্লি  করা প্রমা, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি-করা-প্রমা মুহূর্তের জন্য  গুটিয়ে নিজের খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়তে চাইল। অতঃপর ফিসফাস। কানাকানি।

মেয়েটা জংশন শহরে পার্লারে কাজ করতে যেত। কেমন চরিত্র সে মেয়ের? প্রণয়প্রত্যাশী কি মুখ ঝলসালো তার? ইয়ারফোন ছাড়া অসহায় লাগে প্রমার। যেন কথাগুলো তারই উদ্দেশে। একটু আগেই সে নেমে পড়তে চাইছিল অচেনা স্টেশনে। কোথাও যদি পড়ে থাকত তার উচ্ছিষ্ট শরীর, একই প্রশ্ন ধেয়ে আসত না? কেমন মেয়ে সে? একাধিক ব্রেক-আপ-এর পর কেমন মেয়ে বলা যায় তাকে? একা প্রত্ন-সন্ধানী-মেয়েকে  কেমন মেয়ে বলা যায়? রুদ্রপলাশকে আর হোমাগ্নি মনে হয় না৷ যেন অ্যাসিডের ঝাঁঝ, মুখ পুড়িয়ে দেবে। ট্রেন ছাড়ছে না। বৃহন্নলারা বলে, কালকের ঘটনা নিয়ে অবরোধ, তবে উঠে যাবে।

অজানা স্টেশন ফেলে ট্রেন এগিয়ে চলে। যে ঘটনা বিব্রত করে, তার বিরুদ্ধে স্মৃতির কি নিজস্ব প্রতিরোধ নেই? দ্রুত ভুলে যেতে চায় প্রমা। খবর কাগজের ভাঁজ খোলে। অথচ প্রথম পাতাতেই কুয়াশা রাত আর উর্দিপরা কিছু পুরুষ। চিতা নিবে এসেছে। নিকটদূর প্রদেশে ধর্ষিতার চিহ্ন মুছে গেল রাষ্ট্রীয় তৎপরতায়। সত্যি নাকি দুঃস্বপ্ন? প্রমা খবরেরকাগজ ছুঁড়ে ফ্যালে৷ লালশাড়ি ফিরে তাকায়। বর্তমান থেকে পালিয়ে প্রমা অতীতের প্রত্নগহ্বরে ফিরতে চায় দ্রুত। সেখানেও পুড়ে গেছে গ্রন্থাগার। যে ভাষা জানিনা, তার অক্ষরমালা পুড়িয়ে ফেলাই দস্তুর।

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন