কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

মৌলীনাথ গোস্বামী

 

সমকালীন ছোটগল্প 


টুকুনের শীতকাল


বড্ড শীত করছে একটা লোকের। করারই তো কথা। সময়টা যে ডিসেম্বরের শেষ আর লোকটার বয়স ছিয়াত্তর। পায়ে টার্কিশ টাওয়েলের মোজা পরা। মাথায় মাঙ্কিটুপি। উলিকটের ফুলগেঞ্জি আছে ফুল সোয়েটারের তলায়, তবু কাঁপুনি কমে না। হটব্যাগও লেপের তলায় নিয়ে শুতে হয় রাতে। কাঁপুনি তাও কমে না। কোথা থেকে যে এত শীত আসে বুঝে উঠতে পারে না। শুধু বোঝে দাঁতে দাঁত চেপে এই শীতটা পার করতে হবে। কাঁপা কাঁপা হাতে ছোট্ট ফ্লাস্ক থেকে গরম জল গ্লাসে ঢেলে চুমুক দেয়। বেশি খেতে পারে না। আতঙ্ক হয়, যদি পেচ্ছাপ পায়! এই কনকনে রাতে বাথরুম যাওয়া মানুষটার কাছে বিভীষিকা; বস্তুত যত বয়স বাড়ছে, ততই শীতকাল কাছে আসতে থাকলে ভয় পায় মানুষটা। শ্বাস নিতে কষ্ট হয় শীতের ঠেলায়। সাঁইসাঁই করে নিঃস্বাস নেয় লেপের ভেতর থেকে। ভালো করে নিতে পারে না। কেবলই মনে হয় এই শীত পার করতে পারবে তো! এটাই শেষ শীত নয় তো! গ্রীষ্মকালের দিকে তাকিয়ে, অধীর হয়ে দিন গোনে, বয়সে আর শীতে জড়, স্থবির হয়ে যাওয়া মানুষটা; অথচ একটা সময় ছিল যখন গ্রীষ্মকাল দু'চক্ষে দেখতে পারত না! শীতকাল ছিল তার স-ব-থে-কে প্রিয়...

এই ছিয়াত্তর বছরের মানুষটার নাম টুকুন...

-কী আশ্চর্য! বুড়ো মানুষের নাম টুকুন হয় না কি! হয়ত হয় না, কারণ ওই নামে মানুষটাকে আর কেউ ডাকে না। সেই ডাকার কণ্ঠগুলো কবেই ধূসর হয়ে মুছে গেছে স্মৃতি থেকে। তাছাড়া, টুকুন মানেই কি ছোট্ট একটা ছেলে, যার বয়স বাড়ে না? অবশ্য, ডাকনামের বয়স হয় না। ডাকনাম বৃদ্ধ হয় না। কেবল যার  শরীর জুড়ে এই নামটা সে-ই দুধের দাঁত-পড়া শৈশব থেকে লেগে থাকে, সেই শরীরটা কেমন যেন গোঁয়ারের মতো ছোটবেলাকে ছাড়িয়ে, একদিন বুড়ো হয়ে যায়। লেপের ভেতর শুয়ে শুয়ে থরথর করে কাঁপছিল টুকুন নামের বৃদ্ধ, একটা অশীতিপর লোক, যে এখন শিশুর মতোই অসহায়!

এখন আর চট্ করে ঘুম আসে না টুকুনের। ঘুমেরও বয়স হয়েছে। শূন্যের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে। অনিদ্রা। মনে করার চেষ্টা করেছিল সেইসব শীতকালের কথা, যখন ডিসেম্বর মাসে লেপের গরম খোঁদলের আদরে, ঘু...ম নেমে আসত টুকুন নামের ছোট্ট একটা ছেলের চোখে... ধনেপাতা দিয়ে মাখা বেগুনপোড়া দিয়ে রুটি খেয়ে, কলপাড়ে যেত হাত ধুতে। জল ঠেকাতে ভয় করত। ঠাণ্ডা জলের তোড়, হাজার ছুঁচের ফলা নিয়ে হাতের চেটোর ওপর নেমে এসে, পায়ের হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিত! গোটা শরীরে তখন বিজিবিজি কাঁপন ধরত! ঠি ঠি করে কাঁপতে কাঁপতে ঝপ করে লাল-লেপের ভেতরে ঢুকে লেপের দু'পাশ ভালো করে গুঁজে ফেলত সে। লম্বা লাল পাটিসাপ্টার মতন দেখাত ওকে। লেপের ভেতর ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। নিথর জমে থাকা স্মৃতির কুয়াশা ছিঁড়ে, আবছা আবছা মনে পড়ে বৃদ্ধ টুকুনের, সেই অন্ধকার ছিল, লালকমল আর নীলকমলের গল্পের রাক্ষসপুরীর মতো রোমাঞ্চকর... গা ছমছম করত! গহীন আঁধারে প্রাণভোমরার সন্ধানে বেরলে, অলীক জোনাকিরা ছোট্ট ছোট্ট পিদিম জ্বালিয়ে আলোপথ বিছিয়ে দিত... সে-ই পিদিমের ওড়াউড়ি ঢেউয়ে ভেসে, নরম ঘুমবুড়ি নামত চোখের পাতায়...

সমস্যা হত সকালে। ঘুমবুড়ি কিছুতেই লেপের ওম ছেড়ে যেতে চাইত না। চোখের পাতায় এঁটুলির মতো চিটে থাকত, আর মাঘভোরের কুয়াশা, চোখের পাতায় পিচুটি হয়ে জমে যেত। সে এক বিষম ভয়ের কাণ্ড। কলের কনকনে ঠাণ্ডা জল দিয়ে পিচুটি ছাড়ানো। নাবালক পলক খসে আসত হাতে। মুঠির মধ্যে খসে যাওয়া পলক বন্ধ করে, তারপর খুলে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিত টুকুন! - আর মনে মনে ইচ্ছে বলত-

"দুপুরে যেন গরম ভাতের সঙ্গে এট্টুস ঘি পড়ে পাতে...

-অথবা ফুলকফি দিয়ে যেন খিচুড়ি হয়, সঙ্গে বিট গাজর মটরশুঁটি। এগুলোর জন্য শীতকালটা খু-ব পছন্দের ছিল টুকুনের। কত কী খাওয়া যেত! এখন আগের মতোই শীত আছে, সবজি আছে, মটরশুঁটির কচুরি আছে - কিন্তু খাবার ইচ্ছেটা আর বেঁচে নেই...

শীতকালে একটা জিনিসে ভীষণ আপত্তি ছিল টুকুনের, সেটা মাঙ্কিটুপি। বাঁদর সাজতে মোটেই ভালো লাগত না তার। দু'চক্ষে দেখতে পারত না! কেউ পরিয়ে দিলে, টা-ন মেরে খুলে ফেলত! দ্বিতীয় শৈশবে পৌঁছে আর ওটা খুলে ফেলে না সে। এখন মাঙ্কিটুপির সাথে মিতালি হয়ে গেছে আজীবনের জন্য। সে এখন টুকুনের সবসময়ের সাথী। বৃদ্ধ টুকুনের যেন অস্পষ্ট মনে পড়ছিল, একটা সবুজ ডোরাকাটা ফ্লানেলের গরম পাজামা ছিল ওর। ওটা পরতে খুব ভালোবাসত সে। নিজেকে বেশ বড়ো আর বিজ্ঞ মনে হত; তবে শীতে ওর সব থেকে প্রিয়বন্ধু ছিল, দিনের বেলার রোদ্দুর। সেই কোন সকালে ছাদে টুপ্ করে নেমে এসে, মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকত বিশাল রোদ্দুরটা। শুয়ে শুয়ে, নারকোল আর সুপুরিগাছের পাতাদের সঙ্গে কাটাকুটি খেলত। সেই রোদটা, এখন আর মনে হয় ছাদে উঠতে পারে না। রোদেরও তো বয়স হয়েছে। রোদটা এখন এসে, ঘরের জানলার বাইরে দেওয়াল ঘেঁষে মোড়ায় বসে ঝিমোয়। কেমন যেন জড়োসড়ো হয়ে গেছে, মনে মনে ভাবে বুড়ো মানুষটা। অনেকটা তারই মতন। সেই তেজও নেই রোদ্দুরের গায়ে। ছোটবেলায় এক বালতি জল কেমন নিমেষে গরম করে দিত চনমনে রোদ্দুরটা! সর্ষেরতেল গায়ে মেখে দলাইমলাই করে, ছাদে গামছা পরে দাঁড়িয়ে সেই গরম জলে স্নান করত টুকুন। নারকোলগাছ থেকে চড়াইয়ের দল নেমে এসে, গড়িয়ে যাওয়া চানজল ঠুকরে খেত। এখন আর জল গরম হয় না ছাদে, চড়াইগুলোকেও আর দেখা যায় না। রোদ্দুর মরে আসছে সময়ের ক্ষয়ে যাওয়া মাদুরের বুকে...

লেপের ভেতর কোনখান দিয়ে একটা ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে মনে হল। দু'-পাশ আরও গুটিয়ে নিল বুড়ো। একদম সে-ই ছোটবেলার পাটিসাপ্টা। মনে পড়ে গেল, শীতে নতুন গুড় দিয়ে বানিয়ে দিত মা। মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করল মানুষটা। ধূসর অস্পষ্ট একটা আকৃতি ছাড়া আর কিছু ভেসে উঠল না। কেবল একটা অনুভব নিজের আশেপাশে টের পেল। একটা ঘ্রাণ। একটা নিরাপত্তার আশ্বাস। এই বৃদ্ধ মানুষটারও মা ছিল, যে ‘টুকুন’ বলে ডাকত... মমির মতো  স্থির হয়ে শুয়ে, মানুষটা অবাক হয়ে ভাবছিল, ওর ডাকনাম টুকুন! ছিয়াত্তর বছর আগেও সে টুকুন ছিল, আজও টুকুন। ফারাকটা এই যে, দীর্ঘদিন এই নামে আর কেউ ডাকে না... আর কেউ কোনদিন ডাকবে না... ছোট্ট টুকুনের জন্য, মাতৃহারা বৃদ্ধ টুকুনের ভীষণ মায়া হল। না-ফুরানো মাঘমাসের তীব্র শীতল রাতে, শৈশব স্রেফ একটা বিশ্বাস হয়ে রয়ে গেছে, জলজ্যান্ত প্রমাণ নেই! এত বছর বাদে, থাকে না! অস্ফুটে নিজেই নিজের ছেলেবেলাকে ডাকল মানুষটা -

‘টু কু ন...’

-ঘড়ঘড় করে কে যেন বুকের কাছে সাড়া দিল, অথবা দেওয়ার চেষ্টা করল...

দু'চোখে ঘুম ঘনিয়ে আসছে...

কুয়াশা...

হিম পড়ছে...

মা ডাকছে, ‘শুতে আয় টুকুন...’

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন