(মসীচিত্র
৩)
মুখোমুখি
এই তো সেই রাস্তা! মোড়ের মাথায় শিবমন্দির, আর কিছুদূর আগাইয়া যাইতেই দেখিলাম গাড়ি সারাইবার গ্যারেজ ও আসবাব-পত্রের শৌখিন দোকান। তাহার পর একটি ছোট ইলেক্ট্রিকের দোকানের পার্শ্বে পঁচাত্তরের তিন হাজরা রোড। দরজায় বেল নাই, কড়া নাড়িলাম। একটি বালক, ইহার বয়স আমি জানি, বারো পূর্ণ করিয়া তেরো চলিতেছে, দরজা খুলিল। আমাকে দেখিয়াই বলিল – “বাবা বাড়ি নাই।”
আমি তাহাকে দেখিয়াই চিনিলাম, কিন্তু সে আমাকে চিনিতে পারে নাই। পারিবেই বা কী করিয়া – বয়সের প্রকোপে যা অদ্ভুত চেহারা হইয়াছে আমার!
বালকটি অবাক হইলেও দেখিলাম শিষ্টাচার বোধ রহিয়াছে, আমাকে বসিতে বলিল। ঘরে একটি বড় খাট ও দেয়ালের দিকে একটি চেয়ার। একটি কাঠের আলমারিও রহিয়াছে। তাহা ছাড়া যাহা চোখে পড়ে তাহা হইল ঘরের দেয়ালে অনেক তাক, সব কয়টাই বইতে ভর্তি। বালকটির কাছে যাইতে বড় ইচ্ছা করিতেছিল তাই খাটেই বসিলাম। সে তখন খাটের উপর গোটা কয়েক বইখাতা লইয়া পড়া করিতেছে। বলিলাম –“কী পড়িতেছ?”
-“বাংলা হইয়া গেল। এবার ইংরাজি পড়িব”।
-“ইংরাজি বই তো দেখিতেছি না…”
-“ইংরাজি স্যার এবং বাবা বলিয়াছে, রোজ ইংরাজি খবরের কাগজ পড়িলে ভালো ইংরাজি শিখিতে পারা যায়।”
এত বলিয়া সেদিনের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’টি আনিয়া খুলিল। দেখিলাম সে কিছু না পড়িয়া সটান খেলার পাতায় চলিয়া গেল। শিরোনামটি ঠিক বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল –“এই যে লিখিয়াছে - আর ও ইউ টি স – ইহার মানে কী?”
আমি দেখিলাম গতকল্য ইস্টবেঙ্গল বনাম জর্জ টেলিগ্রাফের খেলা হইয়াছে। লিখিয়াছে – ইস্টবেঙ্গল রাউটস টেলিগ্রাফ। বলিলাম – “উহার মানে রাউট। রাউট মানে গো-হারান…”
সে এবার দু-এক লাইন পড়িয়া বলিল, “তিন শূন্য গোলে হারিয়াছে…” তাহার পর শেষ লাইনে খেলোয়াড়দের নাম আঙ্গুল বুলাইয়া পড়িয়া কিঞ্চিৎ হাসিয়া কহিল –“সুকুমার সমাজপতি তো গতকাল খেলেই নাই!”
হাসির অর্থ, সে খেলিলে আরও দুই তিন গোল খাওয়াইয়া
দিত!
-“তা এ খেলা তো কাল হইয়াছিল, তুমি এখন খবর
পাইলে?”
বালক গম্ভীর ভাবে বলিল কাল তাহার ‘স্থানীয়
সংবাদ’ শোনা হয় নাই।
-“অ্যাঁ, তুমি আবার সংবাদ শোন নাকি?”
-“প্রথম দিকের আজেবাজে খবর শুনি না, শেষে খেলার খবর বলিলে তাহা শুনি”।
জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমার মা কী করিতেছেন? সে বলিল আজ তাহার মায়ের অনেক কাজ, আজ রাত্তিরে তাহার মামা আসিবে দিল্লী হইতে তাই ভালো ভালো রান্না হইবে। সব জোগাড় করিয়া ইস্কুল যাইবে। মা ইস্কুলে পড়াইয়া থাকেন। ব্রাহ্ম বালিকা ইস্কুল। অনেক দূর। তেত্রিশ নং বাসে যাইতে হয়।
সে আবার বলিল –“মামা দিল্লী হইতে হুশ করিয়া এরোপ্লেনে আসিবে। কাল পোস্টকার্ডে চিঠি আসিয়াছে। আমি কখনো এরোপ্লেনে চড়ি নাই। ট্রেনে অনেকবার চড়িয়াছি”।
বলিলাম –“তোমার ইংরাজি পড়া
হইয়া গেল?”
-
“হ্যাঁ, এবার
অঙ্ক। অঙ্ক ভালো করিয়া না করিলে নাইনে উঠিয়া ‘সায়েন্স’ দিবে না”।
-
“সায়েন্স? সায়েন্স
মানে তুমি জানো?”
-
“মানে কেমিস্ট্রি,
ফিজিক্স আর অঙ্ক”
-
“আর কেমিস্ট্রি
মানে?”
- “আমি কেমিস্ট্রি
দেখিয়াছি। আমার এক মামা একটি পুরানো কাচের গেলাশে কলঘরের শ্যাওলা সাফ করিবার এসিড ঢালিল
এবং তাহাতে ক’টা পেরেক ফেলিতেই বুড়বুড়ি কাটিতে লাগিল। মামা শিখাইয়া দিয়াছে – উহা হাইড্রোজেন গ্যাস। এইরূপ মজাকেই কেমিস্ট্রি বলে”।
-
“বাঃ। কিন্তু
এইটুকু শুধু?”
- “না আরও কিছু
আছে। কল্যাণদা বলিয়াছে – আর এক ক্লাস উপরে ওঠ, দেখিবি কেমিস্ট্রি মুখস্থ করিতে করিতে
পাগল হইয়া গিয়াছিস। কল্যাণদা ইলেভেনে পড়ে, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে।”
-
“আর ফিজিক্স
লইয়া কল্যাণদা কী বলিয়াছে?”
- “ফিজিক্সে মুখস্থ করিবার কিছু নাই, শুধু বুঝিতে হয়। না বুঝিতে পারিলেই গোল্লা।”কেশব নাগের মোটা একটি বই-এর ‘বিবিধ প্রশ্নমালা’ খুলিয়া সে ছোট আকারের একটি অ্যালজেব্রার অঙ্ক ধরিল। প্রথম দিকটা বেশ করিতেছিল, কিন্তু এক জায়গায় অসাবধানে ‘এ’ র স্থানে ‘বি’ লিখিয়া ফেলায় সব গড়বড় হইয়া গেল। এ, বি, এ-স্কোয়ার, বি-কিউব ইত্যাদি বিশ্রী ভাবে একে অন্যের দিকে তাকাইয়া রহিল। আর কিছু করা যাইল না। সে খাতা বন্ধ করিয়া দিল।
বলিলাম –“কী হইল, চেষ্টা করিলে না?”
-“দিদি বলিয়াছে
একটা অঙ্ক শক্ত লাগিলে পরীক্ষায় তাহা লইয়া পড়িয়া থাকিবি না। পরের অঙ্ক করিবি”।
-“কোন দিদি বলিয়াছে?”
-“ছোড়দি। অঙ্কে ভীষণ ভালো। বড়দিদির তো বিবাহ হইয়া গিয়াছে, সে অন্য বাড়িতে থাকে।”
-“তাহা হইলে পরের অঙ্ক করো…”
“পরের অঙ্ক সন্ধ্যাবেলা করিব। এখন খেলিতে যাইব”।
-“অ্যাঁ, এখন! দশটা বাজিতেছে, মা ইস্কুলে বাহির হইবেন, তোমারও তো ইস্কুল এগারোটায়”।
-“হ্যাঁ, মা বাহির হইবার আগে ডাকিবে, তখন আসিব। চান করিয়া, ঢাকা খুলিয়া ভাত-ডাল-তরকারি খাইয়া আমি ইস্কুল চলিয়া যাইব”।
-“এতটুকু সময় কোথায় খেলিতে যাইবে? আর কীই বা খেলিবে?”
-“সামনের বাড়িতে। পেনাল্টি শট মারিব, গড়ান শট”।
-“গড়ান শট কেন?”
-“থঙ্গরাজ বিরাট লম্বা, উহাকে উঁচু দিয়া গোল দেওয়া যায় না। সনৎ শেঠকে দেখিয়াছ? সে ‘উড়ন্ত গোল-কীপার’। কাগজে ছবি দিয়াছিল – হেই লাফাইয়া উড়িয়া গিয়া বল ধরিয়া লয়”।
অবশ্য যাইবার আগে আরেকটি কারণ সে বলিয়া গেল। ও বাড়ির কাজের লোক হরিকাকা বল উঁচু উঠিলেই তাড়া করিয়া আসে, কাচ ভাঙ্গিয়া যাইতে পারে বলিয়া।
বালকটি ছুটিয়া সামনের রাস্তা পার হইয়া গাড়ি-বারান্দা বিশিষ্ট বাড়িটিতে চলিয়া গেল ও দু-তিনটি সমবয়সীর সহিত ছোট রবারের বল লইয়া খেলিতে লাগিল। আমি বাহিরে রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। রাস্তা দিয়া কত আট নম্বর ও তেত্রিশ নম্বর বাস, কত গাড়ি, কত মানুষ চলিয়া যায় তাহা দেখিতেছিলাম। এমন সময় আমি শুনিলাম – মা ডাকিতেছেন –“এই পমপম, পমপম…”
এতকাল পরে এই ডাকনামটি শুনিয়া বড় উতলা হইয়া পড়িলাম… তাহার পর মরীচিকার মতো সব মিলাইয়া গেল।
ঘোর কাটিয়া যাইতে বুঝিলাম, মোবাইল ফোন হাতে আমার বর্তমান বাসস্থানেই বসিয়া আছি। হোয়াটসঅ্যাপ-এ আমার ইস্কুলের সহপাঠি বাসুদেব আমাদের অষ্টম শ্রেণীর একটি হলুদ হইয়া যাওয়া গ্রুপ ফটো পাঠাইয়াছে। সে ছবিতে দ্বিতীয় সারিতে বাম দিকের প্রান্তে যে বালকটি বসিয়া রহিয়াছে, সে আমি। বারো বছর বয়সের ‘আমি’। মনে মনে স্থানকালের সীমা অতিক্রম করিয়া আজ হইতে সাতান্ন বৎসর পূর্বে আমাদের হাজরা রোডের দেড়-কামরা ভাড়াবাড়িতে চলিয়া গিয়াছিলাম বালকটির সহিত দুটা কথা বলিতে।
বালকটির সহিত দেখা হইতে কী যে ভালো লাগিতেছিল, কী বলিব! সে বালকটি কখনো ভাবে নাই, তাহার জীবনে কত তিক্ত-কষায়-অম্ল-মধুর স্বাদ আসিবে, কত চড়াই-উৎরাই, কত ঘাত-প্রতিঘাত এবং আরো কত চরিত্রের আগমন হইবে। সুখশান্তির নীড় সে হাজরা রোডের বাড়িও তাহারা ছাড়িয়া দিয়া অন্যত্র চলিয়া যাইবে।
সেই যে বাবা বলিয়াছিলেন ইংরেজি কাগজ পড়িতে, ইংরেজি কাগজ পড়িবার অভ্যাস তাহার এখনো রহিয়া গিয়াছে। পিতা কিন্তু এক শ্রাবণপ্রাতে মেঘের ওপার হইতে কাহার ডাক শুনিয়া হঠাৎ সকলকে ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। কেমিস্ট্রি বিদ্যার প্রথম পাঠ যিনি দিয়াছিলেন বা যিনি হুশ করিয়া বিমানে কলিকাতা আসিতেন, তাঁহারাও আজ কেহ নাই। আজ আড়াই বৎসর হইল দীর্ঘজীবন অতিবাহিত করিয়া মাতাও চলিয়া গিয়াছেন। ডাকনাম ধরিয়া ডাকিবার আর বিশেষ কেহ নাই।
এতকিছু যে হইবে বা ভবিষ্যতের দিনে যে এমনই হইয়া থাকে, বালকটির সেইরূপ কোনো আগাম চিন্তা ছিল না – ভবিষ্যতের ঘটনা বলিতে কোন দল কলিকাতা ফুটবল লীগ জিতিবে তাহা লইয়া হয়তো কিছু উৎকণ্ঠা রহিয়াছিল, তাহার অধিক কিছু নহে। সে থাকিত তাহার বর্তমানের মুহূর্তগুলিতে – তাহার ঘরের মা-বাবা-দিদি, পাড়ার দাদা, বাছবিচারহীন ছোটবড় সঙ্গীসাথীদের সহিত খেলা, ইস্কুলের পড়া ইত্যাদি লইয়া।
মানুষের জীবন তো এইরূপেই বহিয়া যায়। ইহাতে আশ্চর্য হইবার কীই বা রহিয়াছে! ইস্কুল পাশ করিয়া কলেজে যাইলাম। কলেজে যাহা পড়িয়াছিলাম তাহাই পেশায় পরিণত হইল। তাহার পর কারখানা-ভিত্তিক জীবনে আর পাঁচজনের যা হইয়া থাকে তাহাই হইয়াছে। মোটের উপর সাধারণ – কিছু প্রাপ্তি, কিছু হতাশা, কিছু আনন্দ, কিছু অবসাদ। দিনে দিনে কত কী ঘটিয়াছে, কিছু মুছিয়া যাইলেও তাহাদের বৃত্তান্ত স্মৃতির বাক্সে জমা রহিয়াছে। তবু বালকটির সহিত দেখা করিয়া ফিরিবা মাত্র কোথা হইতে এক অপার বিস্ময় আসিয়া আমাকে ছাইয়া ফেলিল। বালকটি কেমন ছিল আর এতগুলি বছর পার করিয়া আমি কেমন একটা হইয়া গিয়াছি! কৃষ্ণা-দ্বাদশীর পাণ্ডুর আলোকে আমি যেন পলকে অতিক্রান্ত জীবনের প্রান্তরটি দেখিতে পাইলাম। ইহার বিবরণ কি পূর্ব হইতেই কোথাও লিখিত ছিল? না কি সময়ের সহিত আপনা হইতেই এইরূপ হইয়া গিয়াছে? আমার এই গড়পড়তা জীবনের মানচিত্রেও যে এত বিস্ময় লুকাইয়াছিল, তাহা বারো বৎসরের এই বালকটির মুখোমুখি না হইলে কোনোদিন জানিতেই পারিতাম না।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন