কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ

 

মালঙ্গী পাড়ের বৃত্তান্ত...




রোজনামচা কোলাহল থেকে দূরে অনেকখানি সবুজ, অনেকখানি নির্জনতাকে  সাক্ষ্য করি – নিসর্গের কাছে হাঁটু গেড়ে উদাত্ত হয়ে বলতে ইচ্ছে করে ‘অসাধারণ’। আলতো পরশ রেখে যায় অরণ্যভূমের বেবাক হাতছানি। ক্ষীণকায়া মালঙ্গীর নদীজল ও সবুজ গাছেদের গরিমা। চেনা টান আছে বলেই ইঙ্গিতময় হাতছানি গড়ে রাখে আমার এই মালঙ্গীপাড়ের মায়া সফর। তরাইয়ের জঙ্গল যতটা গভীর, নিবিড়ও। কতবার যে ছুটে ছুটে চলে আসি উত্তরবঙ্গের অফুরন্ত সবুজের বিস্তারে, চা-বাগানের সবজে সোহাগ আঁকা মধুর পথে, নদীসমুহের  জালবোনা অরণ্যভূমে। মালঙ্গী নদীর লাবণ্যঘেঁষা প্রকৃতিসম্ভার। জঙ্গলের নিজস্ব ঠমক ও চিরহরিৎ, পাখির ঠোঁটে সারাক্ষণ রঙিন কূজন, মালঙ্গী নদীজলে আনন্দ খোঁজার বাড়তি কৌতুহল, বন-আবাস, বৃংহণ, ঝিঁঝিঁ ডাক, লতাগুল্মের বুনো গন্ধ, শ্বাপদের আনাগোনা – এসবই আমার ডায়েরির পাতায় টুকে রাখার কিছু প্রেরণা ও প্রয়াসমাত্র।    

দু’দন্ড জিরেন নিই মালঙ্গী বন-আবাসে। রোজনামচা যাপন ছেড়ে চমৎকার বিশ্রাম। জলের বাহার খেলছে মালঙ্গী নদীতে। দু’দিনের নিশিযাপন। সূর্যটা জঙ্গলের শেষে ডুব দেয়। গাছে গাছে ফিরে আসে কোলাহলমুখর পাখির ঝাঁক। ডানা ঝাপটায়। হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে জঙ্গুলে বাতাবরণের মৌতাত নিচ্ছি তারিয়ে তারিয়ে। ক্রমে যে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে টের পাইনি। পা ঝুলিয়ে বসে আছি বনআবাসের হাতার কিছুটা বাইরে হাতিতে চড়ার জন্য সিমেন্টের সিঁড়িতে। বেশ লাগছে। এমন মনমৌজিতে বুঁদ হয়ে কাটাবো বলেই তো আসা দু’দিনের এই অরণ্যছায়ায়। সন্ধ্যে আরও খানিকটা গড়াতেই বনআবাসের দায়িত্বে থাকা চৌকিদার হাজির হয়ে ধমক দিয়ে ঘরে তৎক্ষণাৎ ফেরত পাঠালেন। ভয়ও  দেখালেন গন্ডার, হাতি, বাইসন প্রভৃতি বৃহৎ আকারের তৃণভোজী প্রাণিরা বনআবাসের হাতায় কখনও কখনও চলে আসে। তামাম জঙ্গলই ওদের নিশ্চিন্ত বিচরণভূমি। বনআবাসটি যথেষ্ট নিরাপদ হলেও সন্ধ্যেরাতে এখানে থাকা ঠিক  নয়। আমি কেবল নিরিবিলিটুকু উপভোগ করছিলাম। চৌকিদারের কথা শুনে শিরদাঁড়া চুঁইয়ে বয়ে গেল অপ্রাকৃত শিরশিরানি। সন্ত্রস্থ হয়ে ঘরে ফিরে আসি।   

ঘরের ব্যালকনিতে কফিমগ নিয়ে আয়াস করে বসি। সান্ধ্য-কুয়াশার আবছায়ায় মালঙ্গীর পরিশীলিত বাগিচা। ফাঁকা দোলনা, শূন্য বেঞ্চ, টালি বিছানো পথ,  তদারকী করে গোছানো মখমলি সবুজ ঘাসের লন, সব কেমন মায়াবী হয়ে আছে। সুদূরে ওই মালঙ্গী নদী, গাছের ফাঁক গলে চেনা দৃশ্যময়তায়। নেশাতুর জঙ্গল পরিবহ। অরণ্যযাপনের সহজিয়া সফরে সাবেকি বিস্ময়ের ঘোর লেপটে থাকে পর্যটনবিলাসী মনে।

৩১ নম্বর জাতীয়সড়ক চলে গেছে আলিপুরদুয়ারের দিকে। সকালে আসার সময়ে, এ পথে এক চমক জমে ছিল। এই দেখো, এখন সেকথা লিখতে গিয়ে ‘চমক’ শব্দটা ব্যাবহার করলাম বটে, কিন্তু সেই মুহূর্তে সেটা ছিল আলটপকা  এক অভিজ্ঞতা। এক চাপা উৎকন্ঠা আর রোমাঞ্চের জগাখিচুড়ি আর কী। আসলে হয়েছিল কী, নাগরাকাটা পেরিয়ে বানারহাট রোড। সেখানেই জাতীয়সড়ক অবরোধ করে রেখেছিল এক পেল্লাই মাকনা হাতি। এই মাকনা হাতিরা রেগে গেলে কিন্তু বেজায় ভয়ানক। জাতীয়সড়কে গাড়িদের অপেক্ষা চলছে সার দিয়েদূরাগত গাড়িগুলো জমতে থাকছে। গাড়ি ঘোরানোর জায়গা নেই। গজপতির ভ্রূক্ষেপ নেই। সে এক কান্ড বটে। ড্রাইভারদের জটলায় কানাঘুষো শুনলাম, গতরাতে কাছের বস্তিতে হাতিদের একপ্রস্থ তান্ডব হয়ে গেছে। গাঁয়ের মানুষ ক্যানেস্তারা পিটিয়ে, পটকা ফাটিয়ে তখনকার মতো তাদের ভাগায়। এইসব এলাকায় হাতিরা খাবারের সন্ধানে খেতখামার বা বনবস্তিতে ঢুকে পড়ে। খানিক তছনছ চালিয়ে শান্ত হয়ে ফিরেও যায়। হাতিরা দল বেঁধে রাস্তা পারাপার করে যখন তখন।

লালি, টুন্‌, শাল, খয়ের, বয়েরা, গামার, শিশু এসব গাছপালা নিয়েই জলদাপাড়ার রাজত্ব শুরু। মাদারিহাট থেকে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের সঙ্গে চিলাপাতা ও খয়েরবাড়ি বেড়ানো সুবিধাজনক। দক্ষিণ খয়েরবাড়ি ‘টাইগার অ্যান্ড লেপার্ড রেসক্যু সেন্টার’। মূলত রয়ালবেঙ্গল টাইগার ও লেপার্ডের জন্যই খ্যাত। সার্কাস থেকে বন্যপ্রাণীদের খেলা দেখানো বন্ধ হওয়ার পর বনদপ্তর কিছু প্রাণীকে জঙ্গলে ছেড়ে দেয়কিছু বন্যপ্রাণীকে এখানে চিকিৎসা ও পূনর্বাসনের  জন্য এই পার্কটি তৈরি করে পর্যটকদের কাছে খুলে দেয়। জলদাপাড়া থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার, মাদারিহাট থেকে ১২ কিলোমিটার, ফলে এদিকে আসা পর্যটকরা এই পার্কটি ভ্রমণ তালিকায় রাখেন। খয়েরবাড়ি অরণ্য চিরে বয়ে গেছে বুড়িতোর্সা নদী। তাতে নৌবিহারের ব্যাবস্থাও মজুদ। ব্যাটারিচালিত গাড়ি খয়েরবাড়ি জঙ্গল পরিদর্শন করায়। শুধুমাত্র পার্কটি বেড়িয়েই কেটে যাবে সময়। ব্যবস্থা আছে মাদলের দ্রিম্‌ দ্রিম্‌ তালে আদিবাসী নাচ দেখার। বুড়িতোর্সা নদীর পাশে একলা সকাল।



তোর্সা নদীর সেতুর এপারে জলদাপাড়া ওপারে চিলাপাতা। তুখোর জঙ্গল দুটোই। তোর্সার নুড়ি বিছানো জলরেখা পেরিয়ে বন্যপ্রাণীদের সাবেক যাওয়া আসা আকছার। দূরে নীল দিগন্তে গা এলিয়ে সবুজ ভুটান পাহাড়। সেখান থেকে  ফুন্টসলিং প্রবেশপথ টপকে ভুটান রাজ্যের ঠিকানা। আমাদের গন্তব্য ওপথে নয়, খানিক এসে বরদাবাড়ি। সামনেই বায়ুসেনার ঘাঁটি। এখান থেকে পথটা ভাগ হয়ে একটা চলে গেছে গুয়াহাটি। অন্য পথটি পৌঁছে দিল মালঙ্গী বনআবাসের একেবারে দোরগোড়ায়। দুপুরে খেয়েদেয়ে একটু জিরিয়ে বেরোব খয়েরবাড়ি, কাল সকালে যাব চিলাপাতা জঙ্গলে আর দুপুরের পর জলদাপাড়া অভয়ারণ্য।  এখানে একটা ব্যাপার আছে। জলদাপাড়া জঙ্গল সাফারির যে নির্ঘন্ট, তার প্রথম অগ্রাধিকার জলদাপাড়া অরণ্যের সেরা ঠিকানা হলং বনআবাসের আবাসিকদের। দ্বিতীয় মাদারিহাট লজের আবাসিকদের জন্য বরাদ্দ। আর সবার শেষে সে সুযোগ মেলে মালঙ্গী লজের পর্যটকদের। হাতে গোনা ওই কটি তো জিপ ও হাতি। পর্যটক বেশি থাকলে, বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। মালঙ্গী বনআবাসের ম্যানেজার আশ্বস্ত করেছিলেন, গন্ডার কিন্তু মালঙ্গীর জঙ্গল থেকেও দেখা অসম্ভব কিছু নয়। আমরা এসেছি এক শৃঙ্গী গন্ডার দেখার অভিলাষে। মালঙ্গী নদীপাড়ে পূর্ণবয়স্ক গন্ডাররা শাবক নিয়ে চলে আসে।

ঈষৎ হলদে রঙ গাছেদের ঝরাপাতার গায়ে। অমল তরুছায়ায় ভোর ভুলিয়ে দিচ্ছে পাখিডাক। ঝিরঝিরে একটা হাওয়া বইছিল। নিপাট বুনো গন্ধের নির্যাস, ভোরের লুকোচুরি মেখে অরণ্য। রোদের ধার নেই তেমন যে কুয়াশা উবে যাবে। মালঙ্গী নদী-জঙ্গল-কুয়াশা-বনজ গন্ধ মৌতাতে সূক্ষ্ম এক একটি অধ্যায়। গাছেরা  চুপিসারে কথা বলছে। জলদাপাড়া হলং-এর দিকে না গিয়ে ভিন্নপথে মেঠোপথ  ধরে জিপ সাফারিতে এলাম নজরমিনার। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে চোখ মেলে পরখ করতে থাকি অরণ্যের বানজারা রূপ। আলোড়িত  পাতাদের আকস্মিক ছায়ায় জলা পেরিয়ে এক গন্ডার দম্পতি কিছুটা কাছে এল। অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপরই ওই জলায় চুপ্পুস কাদায় শরীর ডুবিয়ে দিল। আমাদের অনুসন্ধানী চোখ ও মন সচল রইল ওই তুখোর মুহূর্তকে আগলে  রেখে। ছায়ারোদের নিরালায় সে এক অকাতর দৃশ্য। যথেচ্ছ তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে উঠল ময়ূর। লাজুক মোড়ক সরিয়ে একটু একটু করে প্রকাশিত হতে থাকল মালঙ্গী জঙ্গলের মুগ্ধ মনস্কতা।

দুপুরে বনআবাসের সেই চমৎকার ব্যালকনিতে চেয়ারে পা মুড়ে বসি। সঙ্গের ডায়েরিতে লিখে ফেলি আস্ত একটি কবিতা – নাম রাখি ‘তরাই’...

 

     দু’দন্ড জিরেন নিই অরণ্যপথে

     শুষে নিই মেদিনী ও রোদ্দুর

     অরণ্যের ভাঁজে ছায়া

     একফালি রোদের আরাম

     তিরতির বয়ে যাচ্ছে মালঙ্গী

     নজরমিনারে বিশ্রাম

     প্রতিটি সাঁকো যখন জরুরী ছিল

     পেরোতে পারিনি ছোটো নদী কতবার

 

     গুমোট অরণ্যে পথ যত উদোম হয়

     অদ্ভুত অচেনা আনন্দ

     তুমি তো অরণ্যই দেখোনি কখনও

     বৃংহণ, ঝিঁঝিঁ স্বর, শ্বাপদ, বনজ ঘ্রাণ

     অচেনা সবই তোমার কাছে

 

     নতুন গল্প নেই কোনও

     হারাতে চেয়েছি পথ – তরাইয়ের অরণ্যে...     


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন