কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

 


লাল-নীল-পেন্সিল

 

(১৩)

 

কোনওদিনই এত ভোরে ঘুম ভাঙেনা হর্ষর। শুতে রাত প্রায় একটা বেজেছিল আর শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। এঘরে এ-সি নেই, জানালা দিয়ে প্রচুর ঠাণ্ডা বাতাস এসেছে রাতভর। অদূরে কোথাও একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঘড়ি দেখে অবাক হল, মোটে সোয়া ছ’টা। ঘুমের মধ্যে ছেঁড়া-ছেঁড়া স্বপ্ন দেখেছে, দু-একবার অদিতির মুখও যেন। বিছানায় বসে স্বপ্ন মনে আনার চেষ্টা করল। গোছাতে পারল না, কোনও আকার নেই। স্বপ্নের পরিণাম নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সে উঠে পড়ে। ঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুমে যেতে গিয়ে দেখে লিপিকা অতি নীচুস্বরে প্রায় ফিসফিস করে মোবাইল ফোনে কথা বলছে। তার পায়ের শব্দে তাকিয়ে মাথা নেড়ে আবার ফোনে মন দেয়। হর্ষ বাথরুম থেকে পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে মা-বাবার ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে বাবা। ডাক্তারের পরামর্শে হালকা ডোজে ঘুমের ওষুধ খায়। হর্ষ লিভিংরুমে এসে লিপিকার সামনে দাঁড়াল। লিপিকা ফোন রেখে মাথা নীচু করে বসে আছে। বলে,

--চা খাবি তো?

--আমি করে নিচ্ছি। কী হয়েছে মা?

--মা চলে গেছে ভোর চারটে নাগাদ। কৌশিক ফোন করে বলল—।

লিপিকার গলা ধরে আসে, নাইটির হাতায় চোখ মোছে। হর্ষ পাশে বসে মায়ের পিঠে হাত রেখে বলে,

--যাবে না? চলো।

--তুই যাবি? অফিস নেই?

--আজ ছুটি নিয়েছিলাম। বেরোতাম— তোমাদের নিয়ে ।

--ভালো। তোর বাবার কাছে থাক, সময় করে তাকে নিয়ে বেরোস— বাজারে-টাজারে যেতে পারিস। আমি যাই।

--একা যাবে?

--একাই তো যাই বাবুল— ন’মাসে-ছমাসে গেলে।

--হুঁ। পৌঁছে দিয়ে আসি?

লিপিকা সহসা রেগে ওঠে, চাপা গলায় ঝাঁঝিয়ে বলে,

--না গেলে হচ্ছে না, না? বারণ করছি না তোকে?

--কেন মা?

--শেষ গেছি দুমাস আগে। যেতে ইচ্ছে করত না। মা ছিল বলে তাই! আর যাব না। দিদি কবে বন্ধ করে দিয়েছে আসা-যাওয়া।

লিপিকা মুখ ঢেকে গুমড়ে কাঁদতে থাকে। হর্ষ মায়ের রাগের কারণ ধরতে না পেরে নিঃশব্দে কিচেনে যেতে গিয়ে দেখে শোভন সামনে। মুখ ভেজা-ভেজা, মাথার চুলও। লিপিকার দিকে চেয়ে অবাক গলায় বলে,

--আজ আমি চা করব?

--না, যাচ্ছি।

লিপিকা সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে সোজা রান্নাঘরের দিকে যায়। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখে, আকাশে ক্রমশঃ কালো ভারী মেঘেরা ভীড় করছে। 

কতকালের পুরনো বাসিন্দা তারা। গেট পর্যন্ত বহু লোকের ভীড়। খাট-ফুল-খই জোগাড়যন্ত্র সারা হয়েছে। ছোটো জামাই কৌশিক ভ্রূ তুলে তাকাল। গুরুত্ব না দিয়ে লিপিকা মাথা নীচু করে বাড়ির ভেতরে গেল। মায়ের মৃতদেহের পাশে আত্মীয় ও প্রতিবেশী ঘিরে আছে।

গায়ত্রীর বয়সী পাড়ার এক মহিলা, ‘লিপু আইছস? তর মায় মইরা শান্তি পাইল” বলে কেঁদে ফেললেন। দাদা মায়ের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। বৌদিও হয়ত আছে কোনওদিকে। লিপিকার চোখে পড়ল না। দেবিকাকেও দেখতে পেল না। শেষরাত থেকে জানালার কাছে শুকনোমুখে দাঁড়িয়ে মামপি, একবারের জন্যেও বসেনি। লিপিকার সঙ্গে চোখাচুখি হল, মামপি মুখ ঘুরিয়ে নিল। লিপিকা সাবধানে শিবতোষের পাশে এসে জিজ্ঞেস করল,

--কখন এলি দাদা?

--ঘন্টাখানেক আগে।

--বৌদি?

--আছে ভেতরে।

শিবতোষের মুখ বেজার, বিষণ্ণ। পরিস্থিতি অনুযায়ী চাপার চেষ্টা করলেও গন্‌গনে রাগের আঁচ টের পেল লিপিকা। ফিসফিস করে বলে,

--কি হয়েছে?

--পারলে মেরে আমি ওর মুখ ফাটিয়ে দিতাম। বোন বলে পরিচয় দিতে—।

দাঁতে ঘষে অসমাপ্ত বাক্য গিলে ফেলে শিবতোষ। লিপিকা চোখের জল মোছে। আস্তে-সুস্থে মায়ের কাছে গিয়ে বসে। গায়ত্রীর বার্ধক্যপীড়িত রেখাঙ্কিত মুখে চিরপ্রশান্তি। বুক পর্যন্ত নতুন থান দিয়ে ঢাকা। তারই অংশ টেনে কেউ ঘোমটার মতো করে দিয়েছে। ছোটো কাকিমা এসে ছোটো পেতলের থালায় চন্দনবাটা, তুলসীকাঠি, কয়েকটা তুলসীপাতা তার হাতে দিয়ে নরম করে বলে,

--তুই এসে পড়েছিস যখন, পরিয়ে দে।

--কী করে হল কাকিমনি? আগে কিছু জানতে পারিনি।

--আমিও তো শেষ খবর পেয়ে এলাম রে মা।  

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে লিপিকা, বড়ো কষ্ট হচ্ছে। দুমাসেরও বেশী হয়েছে মাকে দেখতে আসেনি। অসুস্থ ছিল সেই খবর জানত না। এই মুহূর্তে কাউকে দোষারোপ করতে মন চাইছে না। কাকিমার হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে কোলের ওপরে রাখে। আদর করে মুছে দেয় মা-র কপাল, ঠাণ্ডা বরফ হয়ে আছে। দরজার কাছে এসে কে একজন বলে,

--এবারে তাড়াতাড়ি করতে হবে। আকাশের অবস্থা ভালো নয়।

শিবতোষের বৌ মিতালী আর কাজের লোকটি দুখানা থালা ভর্তি কাগজের গেলাসে চা নিয়ে ঢুকল। পেছনে ঢলঢলে নাইটি-পরা আলুথালু থপথপে দেবিকা। লিপিকাকে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

--এইত্ত সাইজাগুইজা আইসা পড়ছে মায়ের আরেক সুসন্তান! একঘন্টা আগে এসছেন একজন! যত ঝামেলা আমার কান্ধে ফালাইয়া সোহাগ দেখানো হচ্ছে? তা তোর বর কই? ছেলে কই? এখানে আসতে তাদের মান যায়? ছেলে যে কলকাতায় আসছে, সেই খবর পাই নাই ভেবেছিস? কেন আইছিস তোরা আমি কি বুঝি না?

দেবিকা বলতেই থাকে, থামে না। লিপিকা মাথা তোলে না, চন্দন শুকিয়ে যায় থালায়। মিতালী শিবতোষের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে মামপির পায়ে আর সাড় নেই। নিজেকে প্রায় টেনে সরায় জানালা থেকে, লোকজন কাটিয়ে দেবিকার পাশে গিয়ে কড়াসুরে বলে,

--তোমাকে সিন-ক্রিয়েট করতে বারণ করেছিলাম।

--মেরে তোর মুখ ভাইঙ্গা দেব।

 --দিও, পরে। এখন ওইঘরে চলো।

মামপি যথেষ্ট বলিষ্ঠ। প্রায় টানতে টানতে দেবিকাকে নিয়ে ঘরে বন্ধ করে বাইরে থেকে ল্যাচ টেনে দেয়। গলা ফাটিয়ে হাউহাউ করে চেঁচিয়ে কাঁদে দেবিকা। লিপিকা চন্দন পরাতে পরাতে শিউরে ওঠে।

আকাশ কালো করে মুষলধার বৃষ্টি নেমেছে। হর্ষর চিন্তা হয় মায়ের জন্যে। একা ফিরবে, ঠিকমতো ক্যাব পেলে হয়। শোভনকে নিয়ে সকালে বৃষ্টি নামার আগে গাড়িতে একচক্কর ঘুরিয়ে এনেছে। শোভনের আচ্ছন্নভাব খানিক কেটেছে। ছেলেকে বলে,

--বাবুল আজ কি খাবি বল? আমি রান্না করি, খেয়ে দ্যাখ।

--তুমি তো আগেও রান্না করতে, আমি জানি বাবা। আজ বাদ দাও। আগে দেখি ফ্রিজে কী রাখা। বাকিটা হোম ডেলিভারি— অর্ডার করে আনিয়ে নিচ্ছি।

খাওয়ার পরে শোভনের ঘরে বসে হর্ষ। হাসিমুখে বলে,

--এবারে ঘুমিয়ে নাও, আমি যাই। বিকেলে চা করে দেব— আমিও পারি।

--বোস না। আজ ঘুম পাচ্ছে না। আচ্ছা বেটু তুই কি আর ক-দিন থাকতে পারিস না?

--হবে না বাবা। কাজের চাপ আছে, তুমি তো বোঝই। বরং তুমি আর মা চল আমার সঙ্গে। কিছুদিন থেকে আসবে।

--যাব। আসলে আমাকে নিয়ে তোর মা বড়ো চিন্তা করে। দ্যাখ না, গাড়ি চালাতে দিতেও চায় না। ভয় পায়। আমি আগে চালাতাম না?

--সেটা আমি মা-কে বলব। বাবা, তোমাকে যে ড্রইংখাতা কালার বক্স দিলাম, করেছ কিছু?

-দাঁড়া দেখাচ্ছি।

শোভন মিটিমিটি হাসে। চাদর সরিয়ে মাথার বালিশের নীচ থেকে খাতা বের করে আবার যথাসম্ভব পরিপাটি করে ঢাকা দিয়ে দেয়। হর্ষ হাসে। জানে, অগোছালো দেখলে তার মা অসন্তোষ প্রকাশ করে। বলে না কিছু, মুখ দেখলেই বোঝা যায়। শোভন বড়ো সাইজের খাতা ছেলের হাতে দেয়। ভালো খাতা, দুটো পাতার মাঝে মাঝে ট্রেসিং পেপার দেওয়া। হর্ষ পাতা উলটে প্রথম পাতা দেখে। সরাসরি রঙপেন্সিল দিয়ে স্কেচ করা। একটা অ্যাসবেস্টসের ছাউনি-দেওয়া লম্বাটে আকারের একতলা বাড়ির নক্সা। বড়ো জানালা। চারধারে গাছে ঘেরা। গাছের তলায় ছোটো-ছোটো বাঁশের চালাঘর মতো। হর্ষ ছবি ইত্যাদি তেমন না বুঝলেও ভাবে, উৎকৃষ্ট না হলেও মন্দ হয়নি। খানিক অবাক হয়ে জানতে চায়,

--কোথাকার ছবি বাবা? নাইস।

--এটা একটা হোটেল। এখন আছে বা নেই কে জানে!

হর্ষ পরের দুএকটা পাতা উলটে দেখে আর আঁকা হয়নি। খাতা বন্ধ করে শোভনের হাতে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে দেখে, সেই অদ্ভুত হারিয়ে যাওয়ার দৃষ্টি। একভাবে তাকিয়ে আছে কোথাও। জানালার বাইরে বৃষ্টি থেমে চাপ-ধরা একরকমের ধোঁয়াশা তৈরি হয়ে আছে।

 (ক্রমশঃ)   

 

 

              

 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন