নিরুদ্দেশ
যাত্রা ও শহীদ কাদরী
সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি শহীদ কাদরী। এদেশের কবিতার ভূমিতল যাদের মননে, বৈদগ্ধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো, শহীদ কাদরী তাদের অন্যতম। পঞ্চাশ উত্তর বাংলা কবিতা ধারায় আধুনিক মানসিকতার জীবনবোধ, বিশ্বনাগরিকবোধ ও জীবনের সুখদুঃখ, তির্যকতা, প্রকরণগত উদ্ভাবনা, শ্লেষ, দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের কুট কৌশল এসব কিছুর সংমিশ্রণ এবং এক বিশিষ্ট শিল্পবোধ ও কাব্যভঙ্গি তার কবিতাকে অনন্য করে তুলেছে কাব্যরসিক পাঠকের কাছে। তিনি নাগরিক-জীবন-সম্পর্কিত শব্দ চয়নের মাধ্যমে বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করেছিলেন। আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক অভিব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় কপ্রে তিনি নির্মাণ করেছিলেন কবিতার রূপ। দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ববোধ এবং প্রকৃতি ও নগর জীবনের অভিব্যক্তি তার কবিতার ভাষা, ভঙ্গি ও বক্তব্যেকে বৈশিষ্ট্যায়িত করেছে। শহর এবং তার সভ্যতার বিকারকে তিনি ব্যবহার করেছেন তার কাব্যে। তার কবিতায় অনুভূতির গভীরতা, চিন্তার সুক্ষ্ণতা ও রূপগত পরিচর্যার পরিচয় সুস্পষ্ট।
“আপনারা
জানেন
ঈশ্বরের
পুত্র যিশু বলেছেন...
ইউরপিডিস
কিংবা সফোক্লিস কী বলেছেন...
মিশেল
ফুকো কী বলেছেন,
দেরিদ্দা
কী বলেছেন
কী
বলেছেন পিকাসো
কিংবা
পল এলুয়ার!
এই
গ্রহের মহাপুরুষেরা কে কী বলেছেন
আপনারা
সবাই জানেন। এখানে বক্তৃতা আমার উদ্দেশ্য
নয়।
আমি এক নগন্য মানুষ, আমি
শুধু
বলি; জলে প’ড়ে যাওয়া ঐ পিঁপড়েটাকে ডাঙায় তুলে দিন”
[আপনারা
জানেন - ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’]
এই হচ্ছে বিরলপ্রজ ক্ষণজন্মা প্রিয় কবি শহীদ কাদরীর মানোজাগতিক গঠন। তার মন ও মস্তিষ্কের সৌন্দর্যের প্রতিফলন। যিনি তার কবিতার প্রতিটি শব্দের ভাঁজ খুলে পরখ করে নেন বাক্যের প্রাঞ্জলতা, শব্দের সৌন্দর্য ও তাৎপর্য। তিনি এমন এক অতৃপ্ত শিল্পীর জীবন কাটিয়েছেন যেখানে তার বিশ্বাস ছিল আপাতদৃষ্টিতে মানুষ যে জীবন অতিবাহিত করে তা তার সত্যিকার জীবন নয়। এর বাইরেও রয়েছে আলাদা এক জীবন সত্তা আর সেই জীবনকে খোঁজার জন্যই আমাদের এই অতৃপ্তি। আর এ কারনের কবি শহীদ কাদরী বেঁছে নিয়েছিলেন এক বোহেমিয়ান জীবন আর সেখান থেকেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন জীবনের প্রকৃত রস।
“এক
নক্ষত্রছুট কালো রাত্রিতে
উতরোল
এটলান্টিকের উপকূলে দাঁড়িয়ে
অস্ফুটে
তুমি বলেছিলে ;
দ্যাখো,
কী ভায়াবহ সৌন্দর্য ।
আমি
দেখেছিলাম,
মধ্য-সমুদ্রে
দাউদাউ আগুনলাগা
একটি
জাহাজ ক্রমশ যাচ্ছে ডুবে
কবিরাও
এভাবে তীব্র সুন্দর সৃষ্টি করতে করতে
পরিণত
হন হাঙরের সুখাদ্যে
মিশে
যান জলের লবণে,
কুয়াশায়,
ও রাত্রির অন্তহীন শরীরে । “
[কবি
-‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’]
‘কবি’ কবিতাটির মাধ্যমে শহীদ কাদরী আসলে বলতে চেয়েছেন ? তিনি কি একজন কবির অন্তরজ্বালার কথা, কবির হৃদয়ের গভীরে যে অন্তরগত বোধ ও সৌন্দর্য থাকে সে কথা বোঝাতে চেয়েছেন? নাকি কবিতার মাধ্যমে যে একজন কবি নিরন্তন জ্বলে জ্বলে এক অপার্থিব সৌন্দর্য সৃষ্টি করে চলেছেন এবং তা অকাতরে বিলিয়ে বিলিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করছেন, সে কথাই বলতে চেয়েছেন? ধরে নিতে পারি তিনি তার নিজের জীবনের পরিনামের কথাই হয়তো বলেছেন। যিনি শেষ জীবনে পরিণত হয়েছিলেন একরকম হাঙরের খাদ্যেই , মিশে গিয়েছেন জলের লবণে বা রাতের গহীনে, কুয়াশায়...। এখানেই কবি শহীদ কাদরীর কবিতার মুন্সিয়ানা যা তার কবিতাকে প্রতিনিয়ত করে তুলেছে নতুন ও আধুনিক। আর তাই জীবনের- সমাজের নানা মাত্রিক স্তরকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যক্ষ করার নিরন্তন প্রচেষ্টা তার কবিতার পঙত্তিতে পঙত্তিতে অনিবার্য রুপে ছড়ানো রয়েছে । যদিও এ কথাটি সত্যি যে তার কবিতার সংখ্যা, সংখ্যার বিচারে সামান্য কিন্তু তার কবিতার বাঙময় জীবনদর্শন অসামান্য এবং সম্পূর্ণ, দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট ও নিঃসংশয়, পর্যবেক্ষণ তীক্ষ্ণ, সূক্ষ্ম, প্রকাশ অনবদ্য।
এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যময় ধরন ও ভিন্নভঙ্গি, শহীদ কাদরীর কবিতাকে পাঠকপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের নান্দনিক কৌশলময় প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনুভবের গভীরতা, শৈল্পিক সুক্ষতা, উপমা ও চিত্রকল্পের নন্দিত বিন্যাস তাকে এক অনন্য মৌলিক কবিতে পরিণত হতে সাহায্য করেছে ।তিনি লিখেছেন খুব অল্পই, দেড় শতাধিকের মতো । বলা হয় তার কবিতার সংখ্যা ১২৬টি আর কবিতার বই সর্বসাকুল্যে ৪টি, তবে তিনি আরেকটি কবিতার বই প্রকাশ করবেন বলে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন বলে শোনা যায়। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন তবে ১৯৫৫ সালে তার প্রথম কবিতা ‘জলকন্যার জন্য’ ছাপা হয় চতুরঙ্গ পত্রিকায়। একই বছর পূর্বাশা পত্রিকায় ছাপা হয় ‘গোধূলির গান’ কবিতাটি। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এই ছয়বছর সম্পূর্ণভাবে কবিতা থেকে বিযুক্ত হয়ে কবি শহীদ কাদরী অন্য এক জগতের শিল্পীত কারিগর হিসেবে ছিলেন ।এই ছয় বছর তিনি একটি কবিতাও লেখেননি।
পঞ্চাশের দশকে তিরিশের উত্তরাধিকার এবং সমাজমনস্কতার মিশেলে এ ভূখণ্ডের কবিতায় এক ভিন্নমাত্রার অথচ স্বতন্ত্র চরিত্র দেখা দিয়েছিলো। এসব কবিতার মধ্যে নাগরিক অভিরুচির যে লক্ষণগুলো ফুটে উঠেছিলো সেখানে জীবনের বাস্তব প্রচ্ছদ সমগ্র অবয়বে ধরা পড়েনি। কলোনিয়াল সমাজের অপুষ্ট মধ্যবিত্তের চারপাশের বিবর্ণ গতিহীন ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং এক স্বপ্নাচ্ছন্ন অনুভূতিলোক সৃষ্টি করাই ছিল সেসময়কার কবিতার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।“রাত্রে
চাঁদ এলে
লোকগুলো
বদলে যায়
দেয়ালে
অদ্ভুত আকৃতির ছায়া পড়ে
যেন
সারি সারি মুখোশ দুলছে কোন
অদৃশ্য
সুতো থেকে
আর
হাওয়া ওঠে ধাতুময় শহরের কোন সংগোপন ফাটল
কিংবা
হ্যাঁ-খোলা তামাটে মুখ থেকে হাওয়া ওঠে, হাওয়া ওঠে
সমস্ত
শহরময় মিনার চুড়োয় হাওয়া ওঠে”
[ইন্দ্রজাল
-‘উত্তরাধিকার’]
কবি শহীদ কাদরীর অত্যন্ত আধুনিক ও ভিন্নমাত্রার কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে আমি বারবার অভিভূত হয়েছি সমুহ বিস্ময়ে। তার কবিতার আধুনিকতা, কাব্যশক্তি, উম্মুল ভাবনা, বাকভঙ্গির বিশিষ্টতা, গভীর জীবনবোধ, অন্তর্গত বিষাদ ও বৈরাগ্য আমাকে বারবারই তার কবিতার কাছে টেনে নিয়ে গেছে আর ভাবতে বাধ্য করেছে তার কবিতার বিষয়ের নতুনত্ব নিয়ে। শহীদ কাদরীর কবিতা পড়ে তৃপ্ত হওয়া কঠিন। একটি কবিতা পড়লেই অন্য কবিতা সম্পর্কে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে চোখ ও মন। শহীদ কাদরীর কবিতা মানেই সতত আধুনিক ও সর্বদা অনন্যই বটে।
“চারদিকে
বিস্ফোরণ করছে টেবিল,
গর্জে
উঠছে টাইপ রাইটার,
চঞ্চল,
মসৃণ হাতে বিশ্বস্ত সেক্রেটারীরা
ডিক্টেশন
নিতে গিয়ে ভুলে গেছে শব্দ-চিহ্ন,
জরুরী
চিঠির মাঝামাঝি
জাহাঁবাজ
ব্যাপারীর দীপ্ত জিহ্বা
হেমন্তের
পাতার মতো ঝ’রে গেছে
বর্ণমালাহীন
শূন্যতায়”
[স্কিৎসোফ্রেনিয়া
– ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’]
কী বিস্ময়কর এই বর্ণনা, কী বিচিত্র, ভীষণ সব চিত্রকল্প ! চারিদিকে বিস্ফোরণ করছে টেবিল? গর্জে উঠছে টাইপরাইটার, হেমন্তের পাতার মতো ঝ’রে গেছে বর্ণমালাহীন শূন্যতায়! শহীদ কাদরীর কবিতার আদ্যন্ত পাঠ থেকে তার চেতনার এক ধরনের রূপান্তর আমরা দেখতে পাই। এই রূপান্তর নিঃসন্দেহে চরম শূন্যতার, আশ্রয়হীনতার, অথচ অবক্ষয়ের অন্ধকার থেকে একটা ইতিবাচক বোধের দিকে ধাবমান।
“টাকাগুলো
কবে পাবো? সামনের শীতে?
আসন্ন
গ্রীষ্মে নয়?
তবে
আর কবে! বৈশাখের ঝড়ের মতো
বিরূপ
বাতাসে ঝরে পড়ছে অঝোরে মণি মানিক্যের মতো মুল্যবান চুলগুলো আমার এদিকে –
অদিকে!
এখনি মনি-অর্ডার না যদি পাঠাও সে সময়,
হে
কাল, হে শিল্প,
তবে
কবে?
আর কবে?
যখন
পড়বে দাঁত, নড়বে দেহের ভিৎ?”
[টাকাগুলো
কবে পাবো – ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’]
“শহরের
ভেতরে কোথাও হে রুগ্ন গোলাপদল,
শীতল,
কালো, ময়লা সৌরভের প্রিয়তমা,
অস্পৃশ্য
বাগানের ভাঙাচোরা অনিদ্র চোখের অপ্সরা,
দিকভ্রান্তের
ঝলক তোমরা, নিশীথসূর্য আমার!
যখন
রুদ্ধ হয় সব রাস্তা, রেস্তোরাঁ, সুহৃদের দ্বার,
দিগন্ত
রাঙিয়ে ওঠে একমাত্র কেতন, - তোমাদেরই উন্মুক্ত অন্তর্বাস,
-অদ্ভুত
আহ্বান যেন অস্থির অলৌকিক আজান”।
[আলোকিত
গণিকাবৃন্দ - ‘উত্তরাধিকার’]
‘আলোকিত গণিকাবৃন্দ’ এমন নির্মম, প্রেমাশক্তিময়, উজ্জ্বল শব্দ এর আগে কেউ কি কখনো শুনেছে ? এভাবে কেউ কি কখনো কোন গণিকাকে বলেছে ‘অস্পৃশ্য বাগানের ভাঙাচোরা অনিদ্র চোখের অপ্সরা’। ‘কানাকড়ির মুল্যে যা দিলে জীবনের ত্রিকুলে তা নেই’ বা ‘ভ্রাম্যমাণেরে ফিরিয়ে দিলে ঘরের আঘ্রাণ’ – এমন উপমা, এমন সম্মান গণিকাদের জন্য কে কখন দিয়েছে আমার জানা নেই!
এভাবেই শহীদ কাদরী হয়ে ওঠেন আত্মভুক চেতনার বহুকৌণিক রূপকার। উনিশ শতকের পন্থাবিমুখ ফরাসি কবিতা এবং দুই বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় কবিতার তার কবিতায় আমরা দেখতে পাই। সে কারনেই সমাজ, সময় ও ইতিহাসপ্রবাহ কখনো কখনো বস্তুনিষ্ঠ অনিবার্যতায় একটি জীবনবলয়ের সামগ্রিক গতিবিধিকে করে দিতে পারে আমূল পরিবর্তিত।আর জাতীয় জীবনে সংগঠিত ঘটনাপুঞ্জ সমাজ ও জীবননিহিত প্রাসঙ্গিকতা চৈতন্যে সঞ্চার করে উজ্জীবনের প্রাণময় গতিবেগ। জীবনের অভিঘাত, আন্দোলন, প্রতিবাদ, রক্তক্ষরণ ও প্রতিরোধের প্রচণ্ডতায় নিতান্ত আত্মমগ্ন ব্যক্তিকেও কখনো কখনো করে তোলে সচকিত, উদ্দীপ্ত। ১৯৪৭-১৯৭০ সাল ,এই সময়কাল অব্ধি বাঙালি জাতির আর্থসামাজিক রাজনৈতিক জীবনে যে আলোছায়ার দোদুল্যমানতা পরিব্যাপ্ত ছিল তার প্রত্যক্ষ প্রভাব আমরা দেখত পাই আমাদের কাব্যজীবনে। আর সেই প্রভাব থেকে শহীদ কাদরীও বের হয়ে আসতে পারেননি । আর তাই ১৯৭০ সালের পর যুদ্ধোত্তর সময়ের ট্র্যাজিক জীবনচৈতন্যের অঙ্গীকার ফুটে ওঠে এসময় শহীদ কাদরীর কবিতায়।
“সে
ছিল রক্তের গাঢ় লাল ছদ্মবেশ পরে
হন্তারক
হাতের তালু থেকে গড়িয়ে পড়েছে বহুবার
ট্রেঞ্জের
কাদায়, সৈনিকের
শাদা
কোরটিতে। অনেক দীর্ঘশ্বাস, জ্বলে – যাওয়া গ্রাম,
অনেক
মৃত বালকের কলরোল সঙ্গে নিয়ে এসেছে এ গোলাপ
একে
আমি কোথায় রাখি? কোন হিরণ্ময় পাত্রে তাকে ঢাকি? “
[প্রত্যহের
কালো রণাঙ্গনে – ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’]
“ভয়
নেই, আমি এমন ব্যাবস্থা করবো
স্টেটব্যাঙ্কে
গিয়ে
গোলাপ
কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার লক্ষ টাকা পাপ্যা যাবে
একটি
বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয়
নেই, ভয় নেই
ভয়
নেই
আমি
এমন ব্যাবস্থা করবো
নৌ,
বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবন
তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে
নিশিদিন
অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা”।
[তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা]
শহীদ কাদরীর কবিতা আমাদের মোহাবিষ্ট করে রাখে তার ব্যাপকতায় ও গভীরতায়। তাঁর কবিতার মহিমা আমাদের চিত্তকে করে আবিষ্ট ও আশ্লিষ্ট। ক্লিশে ও অতিরঞ্জিত শব্দপুঞ্জ, উপমা-উৎপ্রেক্ষাকে স্বদিচ্ছায় এড়িয়ে তিনি ভাষাভঙ্গি ও অনুভবের জাল বিস্তার করেছেন আমাদের মনোজগতে তাতে আমরা খুঁজে পাই আধুনিক বিশ্বভাবনার সাথে স্বাদেশিকতার এক অপূর্ব মিশেল। তাঁর প্রতিটি কবিতাই নিত্যনতুন যাতে রয়েছে শিল্পময় কাব্যভঙ্গির অনায়াস চর্চা।
“মধ্য-দুপুরে
ধবংসস্তুপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক
কাঁচ,
লোহা, টুকরো ইট, বিদীর্ণ কড়ি- কাঠ, একফালি টিন
ছেঁড়া
চট, জং ধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ
ঐন্দ্রজালিকের
মতো যত্নে
এবং
অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু করার আগেই
প্রায়
অন্যমনস্কভাবে তৈরি করলো কয়েকটা অক্ষরঃ ‘স্বা-ধী-ন-তা’।
[নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে – ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’]
“আমার
বাবা প্রথমে ছিলেন একজন
শিক্ষিত
সংস্কৃতিবান সম্পাদক
তারপর
হলেন এক
জাঁদরেল
অফিসার;
তিনি
স্বপনের ভিতর
টাকা
নিয়ে লুফালুফি খেলতেন
টাকা
নিয়ে,
আমি
তার ছেলে প্রথমে হলাম বেকার,
তারপর
বেল্লিক
তারপর
বেকুব
এখন
লিখি কবিতা
আমি
স্বপনের ভেতর
নক্ষত্র
নিয়ে লুফালুফি করি নক্ষত্র নিয়ে”
[একটি
উত্থান-পতনের গল্প – ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’]
তাঁর মা ছিলেন বর্ধমান জেলার মানুষ। বড়ভাই শাহেদ কাদরী ছিলেন ছিলেন একজন বিদ্বান, বিচক্ষণ ও সাহিত্যপাগল মানুষ। একমাত্র বোনের নাম নাফিসা। কবি শহীদ কাদরীর পরিবারের উপর ১৯৫০ সালে পিতার আকস্মিক মৃত্যুর ফলে নেমে আসে এক নিদারুণ বিপর্যয়। একদিকে ভয়াবহ দাঙ্গা, জীবনের ঝুঁকি, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা অন্যদিকে বাবার মৃত্যু এই পরিবারটিকে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করে। ১৯৫২ সালে কাদরী পরিবার স্থায়ীভাবে চলে আসেন ঢাকায়। কবি শহীদ কাদরীর কাছে তখন ঢাকা এক অজানা শহর। প্রিয় জন্মস্থান কলকাতার স্মৃতি হিসেবে সাথে আছে কার্লটন সিগারেটের টিনের প্যাকেট ভর্তি কিছু পাথর। অচেনা এই শহরেও কিছুদিনের মধ্যেই জুটে গেলো বেশ কিছু বন্ধু। বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ান এই শহরের অলিতে গলিতে আর কিনতে থাকেন নানা ধরনের বইপত্র। তিনি সেসময় ভক্ত হয়ে ওঠেন কবি শেলি, স্পেন্ডার, বাইরনের কবিতার। এরইমাঝে ইংরেজি সাহিত্যের পাশাপাশি পরিচয় হতে থাকে বাংলা সাহিত্যের অফুরন্ত ভাণ্ডারের সাথেও। পড়তে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, বঙ্কিম, বিষ্ণুদে, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত, সুকান্ত প্রভৃতি কবি সাহিত্যিকদের রচনাবলী। একইসাথে চলতে থাকে কবিতা লেখাও। ১৯৬৩ সালে ঢাকার এক অবিরাম বর্ষণমুখর দিনে তিনি লিখে ফেললেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’। ১৯৬৭ সালে ‘বইঘর’ থেকে প্রকাশিত হলো তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’।
“সহসা
সন্ত্রাস ছুঁলো। ঘর-ফেরা রঙিন সন্ধ্যার ভীড়ে
যারা
তন্দ্রালস দিগ্বিদিক ছুটলো, চৌদিকে
ঝাঁকে
ঝাঁকে লাল আরশোলার মত যেন বা মড়কে
শহর
উজাড় হবে, বলে গেল কেউ শহরের
পরিচিত
ঘণ্টা নেড়ে খুব ঠাণ্ডা এক ভয়াল গলায়
এবং
হঠাৎ
সুগোল
তিমির মতো আকাশের পেটে
বিদ্ধ
হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম!”
[বৃষ্টি,
বৃষ্টি – ‘উত্তরাধিকার’]
বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লেখেননি এমন কবি কি একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের বাংলা কাব্য- সাহিত্যের জগতে? কিন্তু বৃষ্টিবন্দনার এই আশ্চর্য এবং অভূতপূর্ব রূপ এর আগে কিন্তু আমরা আমাদের কবিতায় দেখতে পাইনি। বৃষ্টির সাথে নিসর্গ নস্টালজিয়ার যে সম্পর্ক আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করি, কবি শহীদ কাদরী শুধু তার মধ্যেই অর্থাৎ শুধু নিসর্গতার মাঝেই প্রকৃতিকে আবদ্ধ করে রাখেননি। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন নগরবাস্তবতার এক ভিন্ন রূপও।
বজ্র-শিলাসহ বৃষ্টিকে তিনি উপলব্ধি করেছেন এক ভিন্নমাত্রায় যেখানে তিনি আকস্মিক বজ্রপাতকে, তুমুল বৃষ্টিপাতকে সন্ত্রাসের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন নগর জীবনের কিছু মানুষকে যারা হয়তো সারাদিনের পরিশ্রমের পর তন্দ্রালস হয়ে ধীরে ধীরে ঘরের দিকে ফিরছিলো আর ঠিক সে সময় বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত শুরু হলো যা তাদের কাছে রোম্যান্টিকতার চেয়ে সন্ত্রাসের সাথে বেশী তুলনীয় মনে হলো। এই দৃশ্যকে তিনি তুলনা করেছেন কী বিচিত্র চিত্রকল্পের সাথে ‘সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম’। আকাশের সাথে নানা জিনিসের তুলনা করেছেন কবিরা কিন্তু সুগোল তিমির পেটের মতো আকাশ! বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম যেখানে গিয়ে বিদ্ধ হচ্ছে। এমন এক ভীষণ চিত্রকল্প! এ তো সত্যি সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
“বৃষ্টি
পড়ে মোটরের বনেটে টেরচা
ভেতরে
নিস্তব্ধ যাত্রী, মাথা নিচু
ত্রাস
আর উৎকণ্ঠায় হঠাৎ চমকে
দ্যাখে,
- জল,
অবিরল
জল,
জল, জল
তীব্র
হিংস্র
খল,
আর
ইচ্ছায় অনচ্ছিয়ায় শোনে
ক্রন্দন,
ক্রন্দন
নিজস্ব
হৃতপিন্ডে আর অদ্ভুত উড়নচণ্ডী এই
বর্ষার
ঊষর বন্দনায়"।
[বৃষ্টি,
বৃষ্টি]
শহীদ কাদরীর কবিমন মেধাবী, অনুসন্ধিৎস্যু। তাঁর নাগরিক চোখ দেখতে পায় মোটর গাড়ির ভিতর বৃষ্টিতে আবদ্ধ হয়ে থাকা নাগরিকের ভীষণ উৎকণ্ঠা। হঠাৎ বজ্রপাত ও বৃষ্টি গাড়িতে বন্ধি হয়ে থাকা নাগরিককে করে দারুণ আতঙ্কিত, ত্রাস তার হৃদপিণ্ডের ভিতরে বিমর্ষতা ও ক্রন্দন এনে দেয়। শহীদ কাদরীর বিশিষ্টতা, তার মুন্সিয়ানা এখানেই। তিনি রোম্যান্টিক কবিদের মতো শুধু সৌন্দর্য মণ্ডিত প্রকৃতিই শুধু দেখেন না। তিনি প্রকৃতিকে নানাদিক থেকে বিবেচনায় এনেছেন। তবে শহীদ কাদরী নিজে কিন্তু তাঁর কবিতাকে একেবারেই অন্যভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি তার ‘বৃষ্টি! বৃষ্টি!’ কবিতাটি সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি এখানে আদপেই কোন বৃষ্টির কথা বলেননি। তার নিজের ভাষায়, “সবাই মনে করে এটা নাগরিক বৃষ্টি। নাগরিক বৃষ্টি ওটা না। ওটায় দেখানো হয়েছে শহরটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর নগরে রাজত্ব হচ্ছে কাদের? যারা আজীবন ভিক্ষুক, যারা আজীবন নগ্ন, যারা আজীবন ক্ষুধার্ত। আর যারা রাজস্ব আদায় করে তারা সব পালিয়েছে। এই যে একটা প্রচণ্ড শক্তি তা এই নগরকে, যে নগরকে আমরা ধ্যানজ্ঞান মনে করছিঃ, সে নগরকে একটা বিরাট শক্তি ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই শক্তিকে আমি আঙুল দিয়ে শনাক্ত করিনি। এটা রাজনৈতিক শক্তি হতে পারে, এটা গণজাগরণ হতে পারে, বৈপ্লবিক উত্থান হতে পারে। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে আনন্দিত হচ্ছে কারা, নগর দখল করেছে কারা? আজীবন ভিক্ষুক, আজীবন নগ্ন, আজীবন ক্ষুধার্তরা। এই শহরে বসবাস করার অনুভূতিগুলো সংক্রমিত করার চেষ্টা করেছি। কখনো পেরেছি, কখনো পারিনি”। [বই – ‘অভিবাদন শহীদ কাদরী’, সাক্ষাৎকার, পৃষ্ঠা – ১০৮]
এই হলো শহীদ কাদরী যিনি বাংলা কাব্যের অপার জগতের এক অভিনব ব্রক্ষ্মা। তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, শব্দ, শব্দানুষঙ্গ, রূপক, প্রতীক ও চিত্রকল্পের সতর্ক মনোযোগিতা তাঁর কবিতাকে করেছে সর্বদা অনন্য, বিচিত্র ও সংবেদনশীল। কবিতার রূপনির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলা কবিতায় তিনি সন্দেহাতীতভাবে ভীষণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই তিনি যেন হয়ে উঠেছেন আমাদের কাব্য আকাশে বিদ্যুতের এক উড়ন্ত বল্লম। যিনি হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলসে উঠে যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছেন ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন সব কিছু ছেড়েছুড়ে ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানোর। এবং করলেনও তাই। কেন তিনি এমন প্রবাসী জীবন বা স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিলেন তার সঠিক উত্তর হয়তো কখনোই জানা সম্ভব নয়। তবে চির বোহেমিয়ান শহীদ কাদরী মানেই, বিউটি বোডিং আর রেক্সে অফুরান্ত আড্ডায় বুঁদ হয়ে থাকা এমন এক কবি যিনি দেশভাগ হিন্দু-মুসল্মানের দাঙ্গার স্মৃতি আজীবন বুকের মাঝে বয়ে বেড়িয়েছেন। তিনি এমনই এক আলো যিনি মানুষ ও প্রকৃতিকে এক সুত্রে গেঁথেছেন তাঁর তারুণ্যময় ব্যক্তিত্বের ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে। তিনি লিখেছেন অল্প, ভেবেছেন বেশী, পড়েছেন আরও অনেক অনেক বেশী। মাত্র ৪টি কবিতার বই যাতে কবিতার সংখ্যা ১২৬টি। তাঁর অফুরন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার, আড্ডার রসবোধ, কৌতুক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক যে আলোক বিচ্ছুরণ ঘটত তা সাহিত্য রসবোদ্ধা ও সংস্কৃতিপ্রেমিদের তাঁর প্রতি চিরকাল আকৃষ্ট করে রেখেছিলো। স্বাদেশিকতার বোধই ছিল তাঁর জীবনবোধের প্রধান প্রবণতা। তিনি বাংলা কাব্যজগতের অহংকার, তাঁর স্থান নক্ষত্রের মতো চিরকাল সমুজ্জ্বল থাকবে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় আকাশে।
১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমানে ভারত) রাজধানী কলকাতা শহরের পার্ক সার্কাসে কবি শহীদ কাদরী জন্মগ্রহণ করেন। এই শহরেই কেটেছে তাঁর শৈশব। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে দশ বছর বয়সে তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। এরপর প্রায় তিন দশক তিনি ঢাকা শহরে অবস্থান করেন এবং ১৯৭৮ সালে প্রবাসে চলে যান। তিনি বার্লিন, লন্ডন, বোস্টন ইত্যাদি শহরে ঘুরে অবশেষে নিউইয়র্কে থিতু হন। ২০১৬ সালের ২৮ অগাস্ট তিনি নিউ ইয়র্কের নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন