অর্বাচীনের রবিযাপন
(পর্ব
৩)
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেদিন চলে গেলেন, তার ক’দিন আগেই
মনখারাপের এক দুপুর জুড়ে
‘মাল্যদান’ আবার দেখা। কেউ বলতেই পারেন, ‘চারুলতা’, ‘সমাপ্তি’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’
ছেড়ে কিনা ‘মাল্যদান’! কী আর করা যায়, মনের টানটা যে ওইদিকেই বেশি! ‘গল্পগুচ্ছ’
থেকে রুপোলি পর্দায় রূপান্তরের এতগুলো মণিমুক্তোর ভিড়ে ‘মাল্যদান’ কেমন যেন ‘অর্বাচীন’! অজয় করের সেরা
কাজগুলোর মধ্যেও এ ছবিটাকে ধরতে চান না অনেকে। অথচ চমৎকার অভিনয়, ছবির স্বার্থে
একেবারে মানানসই কিছু পরিবর্তন আর সংযোজন, টানটান চিত্রনাট্যে প্রায়
নিখুঁত ছোটগল্পের মেজাজ, গান, আবহ, সংলাপ - শেষ হয়েও
শেষ না হওয়ার অনুভূতি
- কীসে কম ছবিখানা?
ছবির শুরুতেই যতীন হাঁটতে হাঁটতে ঢুকছে খুড়তুতো বোনের শ্বশুরবাড়ির দেশে। এ
হাঁটা সন্দীপের নয়, অমূল্যর নয়, কালেক্টরবাবুর নয় - এ হাঁটার
কোন বৃহত্তর বা ‘ক্লাসিক’ উদ্দেশ্য নেই। একেবারেই সহজ-সাধারণভাবে ছুটি কাটাতে
কলকাতার বাইরে আসা। গাঁয়ের রাস্তায় এতখানি হাঁটার অভ্যেস নেই, তাই খানিক ক্লান্তির
ছাপও আছে মুখে। এমনিতেও সে একটু গম্ভীর মানুষ, কিন্তু খোলা বাতাসে, সবুজ গাছপালার
মাঝখান দিয়ে হাঁটতে যে একেবারেই ভালো লাগবে না, এতটা নীরসও নয়। নেপথ্যে হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘এই তো ভাল লেগেছিল’ গানটি তার হেঁটে চলার গল্পটাকেই ধরে সুরে
সুরে।
তার চোখের সামনে এক এক করে ফুটে ওঠে গ্রাম্য প্রকৃতি আর মানুষজনের একেবারে
স্বাভাবিক ছবি সব
- হাটের পথিক চলে ধেয়ে, ছোটমেয়ে ধুলায়
বসে খেলা সাজায়... আর যতীনের চোখ দিয়ে পল্লীজীবন আর প্রকৃতি দেখার ক্লাইম্যাক্স
আসে, যখন গানটা থেমে যায় মুহূর্তের জন্য। তার চোখ পড়ে খরগোশের ছানা হাতে নিয়ে কুড়ানির অবাক, ডাগর
চোখদুটোয়। কুড়ানি অচেনা লোকটির দিকে একটুখানি তাকিয়ে চলে যায়, আবার গান শুরু হয়
একবারে মোক্ষম জায়গা থেকে - “মজেছে মন, মজল আঁখি,
মিথ্যে আমায় ডাকাডাকি...” যতীনও আবার হাঁটতে থাকে। মূল গল্পে ওদের প্রথম দেখা
পটলের বাড়িতেই, রাস্তার ধারে নয়। কিন্তু ছবির ভাষায়, ওই অসামান্য গানের ছাড়া-ধরার
ফাঁকটুকুতে এইভাবে দেখা হয়ে যাওয়া দর্শককে নাড়িয়ে দেবার মত।
গল্পে হরকুমারবাবুর কথায়, ‘কুড়ানি’ বনের হরিণী। তাকে নারী বলে ভুল করলেই
সমস্যা। আর ছবির প্রয়োজনে গল্প যেটুকু বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে, তাতে ‘কুড়ানি’ প্রকৃতির
মানুষী রূপ হয়ে ধরা দিয়েছে বারবার। জেলেদের জাল খুলে সে মাছগুলোকে ফিরিয়ে দেয় জলে, পাখিমারা বন্দুকের টোটা লুকিয়ে রেখে বাঁচিয়ে দেয় না
জানি কত পাখির সংসার। এই সংযোজন যেন বয়ে আনে অন্য এক কাহিনির আভাস- ‘মা নিষাদ...’
রত্নাকরের মন বদলের মূলেও তো ছিল প্রকৃতি-সারদার লীলা — যদিও সে
কাহিনির মেজাজ আলাদা। আর স্বপ্নদৃশ্যটি তো অতুলনীয় — ধনা
মালীর সঙ্গে বিয়েবাড়ি ঘুরে এসে কুড়ানি অবচেতনে নিজেকে কল্পনা করে কনের সাজে, আর
তাকে দেখেও মুখ ফিরিয়ে চলে যায় যতীন, যাকে কুড়ানির ‘বর’ বলে এতকাল মজা করে এসেছিল
পটল। আশ্চর্য মায়াবী আর নাটকীয় আবহসঙ্গীত, আর তেমনি ভোলার নয় সৌমিত্র-নন্দিনী
মালিয়ার চোখের ভাষা। কেন জানি না মনে হয়, এই দৃশ্যের চিত্রায়ন আর সুরযোজনায়
‘চিত্রাঙ্গদা’র প্রত্যাখ্যান-দৃশ্যের ভাবনা কি কাজ করেছে পরিচালক আর সঙ্গীত
পরিচালকের মাথায়?
ধনা মালী আর তার বউয়ের উল্লেখটুকুই কেবল আছে গল্পে, কিন্তু ছবিতে এ চরিত্র
দুটি হয়ে উঠেছে কুড়ানির বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠার যাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভানু
বন্দ্যোপাধ্যায় আর গীতা দে’র অভিনয় শুধু হাসানোর জন্যই যে নয়, তাও দেখিয়ে দেয় এ
ছবি। তারা কখন ঝগড়া করে আর কখন যে ভালবাসে, সেই ধাঁধার সমাধান খুঁজতে গিয়ে কখন যে
বড় হয়ে ওঠে অবোধ মেয়েটা, সে নিজেও বুঝতে পারে না। তাদের সঙ্গে বিয়েবাড়ি যাওয়ার পর
পরই কী যে ঘটে যায় তার মনের মধ্যে, নিজের খেয়ালে মালা গেঁথে নিজেই তা নিয়ে আসে
নায়কের জন্য। পটলের শিখিয়ে দেবার দরকার পড়ে না।
আরও বলতে হয় দু-একটি সংযোজনের কথা, যা গল্পে ছিল না, কিন্তু ছবিতে
গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রেখে গেছে। প্লেগ হাসপাতালে একের পর এক মৃত্যুর মাঝেও জীবনরসের
সন্ধান মেলে, যখন একজন এসে ডাক্তার যতীনের পা জড়িয়ে ধরে - প্লেগের
রোগী মরলে পরিবারের হাতে তুলে দেবার নিয়ম নেই জেনেও সে শেষবারের মত তার বউয়ের
হাতদুটো ধরে ক্ষমা চাইবে, ডাক্তার যেন অনুমতি দেন। “জীবনে তার ওপর অনেক অত্যাচার
অবিচার করেছি ডাক্তারবাবু, তাই সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে”- শুনে যতীনের মনে যে
ভাঙাগড়ার খেলা চলে, তা বোঝানোর জন্য ওই ছোট্ট দৃশ্যটির অবদান অপরিসীম। এক আশ্চর্য
সমাপতন- মুখে মাস্ক পরা ডাক্তার, নার্স, মৃতদেহের কাছে কাউকে আসতে না দেবার নিয়ম-
সববিছুই যেন এই ক’মাস আগের পরিস্থিতি - বিষাদ আর আতঙ্কের আবহের সঙ্গে মিলে যায়।
গল্পের ‘পটল’ একেবারে জীবন্ত সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়গুণে। একদিকে, দিদি হয়েও বৌদি-সুলভ হাসিঠাট্টায় ভাইটিকে অতিষ্ঠ করে তোলা, রসিকতার ঢঙে ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’ গানে ঠোঁট মেলানো (নেপথ্যকণ্ঠে রাণু মুখোপাধ্যায়), কুড়ানিকে সামনে এগিয়ে দেওয়া, যা অনাথ মেয়েটির প্রতি একধরনের মাতৃস্নেহ সত্ত্বেও, নিজের অজান্তেই এক এক সময় নিষ্ঠুর কৌতুকের পর্যায়ে চলে যায়, আবার অন্যদিকে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ভেঙে পড়া, কুড়ানিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠা, তার শেষ শয্যায় তাকে সাজিয়ে দিয়ে বলা, “আমার ওপর তোর আর রাগ নেই তো? ... বোন, তোর কপাল ভাল, জীবনের চেয়ে তোর মরণ সুখের।” গল্পের শেষে যতীন বলেছিল, “যাঁহার ধন তিনিই লইলেন, আমাকেও বঞ্চিত করিলেন না।” আর ছবির শেষে কুড়ানির চন্দনে সাজানো মুখের ওপর আলো পড়ে, আবহে বাজতে থাকে এমন এক সুর, যা চেনা-চেনা মনে হয়েও বড় অচেনা লাগে। এ পৃথিবীর রোগ, শোক, না-পাওয়ার ব্যথা—এসবের ঊর্ধ্বে নয়, বরং এ সব কিছুকে স্বীকার করে নিয়েই এক অশেষ-করা অনুভব জেগে থাকে সেই সুরে।
‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ এমনই আর এক ছবি, খুব মাটির কাছাকাছি থাকা ছবি--
একগুচ্ছ ‘ক্লাসিক’-এর মাঝে পড়ে যা চলে গেছে অর্বাচীনের দলে। ১৯৬০-এ মুক্তি পেয়েছিল;
চুপচাপ পেরিয়ে গেল এ ছবির ষাট বছর। গল্প বাড়ানো হয়েছে অনেকখানি, দেখানো হয়েছে
রাইচরণ আর তার মনিবের ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, রাইচরণের সংসারজীবন, তার দিদি
আর স্ত্রীর চরিত্রও এসেছে চিত্রনাট্যের দাবি মেনে। কিন্তু তাতে মূল কাহিনির রস
একটুও এদিক ওদিক হয়নি, বরং পর্দায় অভিনয়ের পক্ষে অনেক বেশি দানা বাঁধতে সাহায্য
করেছে কাহিনিকে - সাদা চোখে তাই তো মনে হয়। আবহে, গানে, সঙ্গীত
পরিচালনায় অসাধারণ কাজ করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়; খোকাবাবুকে হারিয়ে যখন পাগলের মত ঘুরে
বেড়াচ্ছে রাইচরণ, তখন প্রায় সংলাপহীন পাঁচ-সাত মিনিটের দৃশ্য থেকেও চোখ সরানো যায় না
কেবল আবহ আর অভিব্যক্তির টানে বাণিজ্যিক বাংলা ছবিতে এমন উদাহরণ বোধহয় খুব বেশি
নেই। নদীর ঢেউ যখন পাড় ভাঙছে, বোঝাই যাচ্ছে উদ্দাম স্রোত টেনে নিয়ে গেছে খোকাকে - সেই মুহূর্তে এতক্ষণের চাপা আশঙ্কা আর জমানো হাহাকারের সুর যেভাবে গলায়
তুলে আনেন সুরকার-শিল্পী — সে তো গায়ে
কাঁটা দিয়ে ওঠার মত। বাবুর ভূমিকায় অসিতবরণের অন্যতম সেরা অভিনয় পাই এ ছবিতে, আর
রাইচরণের চরিত্রে নিজেকে ভেঙেচুরে চমৎকার অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমারও। মহানায়ককে এমন
গ্ল্যামারবিহীন ভূমিকায় দেখতে চায়নি ভক্তরা,
সেজন্যই কি তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারল না ছবিটা? নিজের ছেলেকে ‘খোকাবাবু’ সাজিয়ে
মনিবের হাতে তুলে দিয়ে ভবঘুরে সাধুর মত দূরে মিলিয়ে যাওয়া রাইচরণের মতই বোধহয়
ছবিটাও হারিয়ে গেছে একালের বেশিরভাগ দর্শকের মন থেকে।
‘বউঠাকুরানীর হাট’ ছবিটাকেও বোধহয় একালের দর্শকরা ভুলেই গেছেন প্রায়। ১৯৫৩ সালের ছবি — আজকের নিরিখে অভিনয় একটু যাত্রাঘেঁষা আর অতিনাটকীয় মনে হতেই পারে। উত্তমকুমার আছেন, কিন্তু তখনও তিনি সে অর্থে সফল নায়ক হয়ে ওঠেন নি। তবে চোখে লেগে থাকার মত নীতিশ মুখার্জি, পাহাড়ি সান্যাল, মঞ্জু দে আর শম্ভু মিত্রের অভিনয়, আর কানে-প্রাণে লেগে থাকার মত সব গান - ‘আজ তোমারে দেখতে এলেম’, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’, ‘শাঙন গগনে’, ‘কাঁদালে তুমি মোরে’, ‘গ্রাম ছাড়া ওই’, ‘আমারে পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায়’, ‘আমি ফিরব না রে’। ইতিহাসের ডিটেল উৎসুক সমালোচক বলবেন, রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল? তা ছিল না ঠিকই, তবে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ আর ‘পরিত্রাণ’ নাটক মিলিয়ে বসন্তরায় আর ধনঞ্জয় বৈরাগীর মুখে তো এ গানগুলো ছিলই। নটীদের গান হিসেবে ‘চাঁদের হাসির’-ও ছিল, কেবল ‘শাঙন গগনে’ ছিল না, কিন্তু খুব বেমানান হয়েছে কি? তাতে ‘বউঠাকুরানীর হাট’ অশুদ্ধ হল তো হল, অর্বাচীনের অত খবরে কাজ কী!
পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘স্ত্রীর পত্র’কে প্রায়-ভুলে-যাওয়া ছবির দলে ফেলা যায়
না, অনেকগুলো পুরস্কার আছে তার ঝুলিতে। আবার কাবুলিওয়ালা-চারুলতা-তিনকন্যা-অতিথির
মত খুব বিখ্যাত বলাও মুশকিল। কিন্তু ‘চারুলতা’র চেয়ে কোন অংশে কম নয় এ ছবিতে
মৃণালের ভূমিকায় মাধবী মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়। পাশাপাশি অনবদ্য রাজেশ্বরী রায়চৌধুরী,
স্মিতা সিনহা, নিমু ভৌমিক-রাও। গল্প বলার ধরনটা একটু সোজা দাগের, মূল কাহিনির যে
আকর্ষণ অর্থাৎ চিঠির ভাবনাটা তা থেকে
অনেকটা সরে এসেছে ঠিকই। কিন্তু সেই অভাবটুকু বুঝতে দেয় না
চিত্রশিল্পী-কবি-পরিচালকের চোখ দিয়ে দেখানো অসাধারণ সব ফ্রেম। মৃণালের প্রতিবাদ যে
শুধু স্বামীকে লেখা একখানা চিঠিতে জ্বলে উঠেই শেষ হয়ে যাবার নয়, বরং লেখালেখি সে
করত অনেকদিন ধরেই
— সেটা ধরা পড়ে কয়েকটি দৃশ্যের যোগে,
যেখানে ‘মেজবউ’ পরিচয়ের বাইরে মৃণালের আর এক রূপ দেখতে পাই, তার একান্ত অবসরে। ছবি
মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে। সঙ্গীত পরিচালনায় রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আসায় সে
সময় অনেকে অবাক হয়েছিলেন, তবে যাঁর গল্প তাঁরই গান ঢোকাতে হবে, এই ধারণা তো
‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ভেঙেছে অনেক আগেই। বরং
পুরাতনী গানের আমেজে মৃণালের রক্ষণশীল শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ, বিশ শতকের শুরুর দিকের
সমাজ-সময়কাল ফুটেছে ভালই।
আর একুশ শতকে রবি-কাহিনি-নির্ভর অথবা প্রভাবিত, ভাললাগা ছবির কথা বলতে গেলে? না, ‘নৌকাডুবি’ বা ‘চোখের বালি’ বা ‘চার অধ্যায়’ নয়, অর্বাচীনের মনে অনেক বেশি দাগ কেটে যায় ‘নোবেল চোর’ আর ‘মুক্তধারা’। নোবেল চোর-এর গল্পটা নেহাতই বানানো, আর দুটো প্রশ্ন তুলব মনে করলে তোলাই যায়, ভানুর গ্রামটা তো শান্তিনিকেতনের কাছেই, কুড়িয়ে পাওয়া পদকটা কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দেবার জন্য ভালমানুষ গোবেচারাকে একা একা না পাঠিয়ে, সোজা বিশ্বভারতীতে যোগাযোগ করার কথা কারও মাথায় এল না? আর শেষে একেবারে গুলি করে মারার মত কাঁচা কাজ পোড়খাওয়া পুলিশবাবুরা করলেন কি করে? তবে এই দুটো খটকা বাদ দিলে, ভালো লাগার মত ছবি। শহরের উঁচুতলার ব্যবসায়ী, সংগ্রাহক, টলি ক্লাবের বাবুদের চেহারাটা আসলে কেমন? তাদের মধ্যে কেউ ‘ঠাকুর’কে সোনার চলতি দরের সাথে বাড়তি টোয়েণ্টি পারসেণ্ট জুড়ে কিনতে চায়, কেউ বা ‘সেলিব্রিটির মেমোরাবিলিয়া’ হিসেবে দর কষে, আবার কেউ ভাবে, বিদেশে তাঁকে বেচে ‘লাল’ হয়ে যাবে। অথচ ভাড়াটে খুনে মস্তান তাঁর ছবি দেখে রিভলভার চালাতে পারে না, আর পেঁয়াজ-চালের দামকে ‘মূল্যবোধ’ বলে জেনে আসা চাষি ভানু, সে কিনা নিজের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে যায়, “এ জিনিস বিক্কিরি করবার নয়, মাথায় করে রাখবার।” আর মুক্তধারা? সংশোধনাগারের আবাসিকদের স্বাভাবিক, সুস্থ জীবনে ফিরে আসার, ‘অপরাধী’দের গলায় গান আর হাতে ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ নৃত্যনাট্যের ‘প্রপস্’ বানানোর সরঞ্জাম তুলে নেবার কথা বলে এ ছবি।
একেবারে বাস্তব থেকে উঠে আসা এই গল্পে এক হয়ে যান বাল্মীকি-ইউসুফ-নাইজেল, সরস্বতী-নীহারিকা-অলকানন্দা। এ ছবিতে যারাই মূল ভূমিকা নিয়েছে, তাদের কোন না কোনভাবে বন্দিদশার কালো ছায়া পেছনে টেনে রাখতে চেয়েছে পদে পদে। কেউ অপরাধী অতীতের ভারে বন্দি, তো কেউ বন্দি অস্বস্তিকর দাম্পত্যে, এমনকি ছোট্ট মেয়েটাও বন্দি ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন’ শৈশবের দুর্ভাগ্যে, যা তার নিজের বাবার কাছেই লুকিয়ে রাখার, লজ্জার, ঘৃণার। সেইসব বাঁধন কেটে বেরনোর স্বপ্ন দেখায় মুক্তধারা, শিল্পের হাত ধরে। অভিনয়ের ফাঁকে জেলজীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও, সে সুযোগ ফেলে ‘থাম, থাম, কি করিবি বধিয়া পাখিটির প্রাণ’ উচ্চারণের মুহূর্তে মঞ্চে ফিরে আসে যে মানুষটি, সে কি সত্যিই এক রূপান্তরিত রত্নাকর নয়? ছবি শেষ হয় সংশোধনাগারের আবাসিকদের একসাথে গেয়ে ওঠায় — “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়... গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে/ এই আকাশে...”
ঘুরেটুরে সেই গানেই ফিরতে হয় তাহলে। সব পথ এসে মিলে গেল শেষে... গানে গানে... তোমার পানে, তোমা-আ-র পানে, তোমা-আ-আ র পানে। অর্বাচীনের পাগলামি আর কাকে বলে!
ঋতুপর্ণর আগে অজয় কর 'নৌকাডুবি'করেছিলেন, যেখানে ছিলেন হেমন্ত। সেটি দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি, লেখিকার কোনদিন হয়েছিলো কি?
উত্তরমুছুন