কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

শাহনাজ নাসরীন



 

সমকালীন ছোটগল্প 

এইসব মাথা ব্যথার দিনে


কে যেন বলেছে আবেগের মধ্যে থার্ডক্লাশ আবেগ হলো অভিমান। অথচ অভিমান আমার শিরায় শিরায়। ছোটবেলায় যদিও জানতাম না যে অভিমান এতো খারাপ আবেগ। তবু আমি অভিমান লুকাতাম। অভিমান করে নিজেকে বঞ্চিত করতাম খুব। সবাই হৈ চৈ করে মাঠে খেলতে যাচ্ছে, আমি মাথাব্যথার ভান করে পড়ে থাকতাম, কারণ খেলতে যাওয়ার জন্য আমার প্রাণ ফেটে যাচ্ছে আর নিজেকে সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে আমি শোধ নিচ্ছি। একবার পাড়ার বড় আপার বিয়েতে সবাই খুব আনন্দ করলো, আমার একটাও ভালো জামা নেই মা-ও তার একটা শাড়ি দিলো না পরতে। আমি নাকি নষ্ট করে ফেলবো। তো ভান ধরলাম তীব্র মাথা  ব্যথার।

আজকাল আর ভান করতে হয় না। অভিমান হলে তীব্র মাথাব্যথা সত্যি সত্যিই হয়। মাথা এত ভারী হয় যে ছিড়ে পড়তে চায়। এখন বরং মাথাব্যথা অস্বীকার করে স্বাভাবিকতার ভান করি। ক’দিন ধরে তুমি আড়ে আড়ে লক্ষ্য করো খেয়াল করেছি। আজ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছো, কী হয়েছে? আমি অবাক হবার ভান করে বলেছি, কী আবার হবে! তুমি বললে, শিওর! সব ঠিক আছে? আমি লম্বা করে বলি,  হ্যাঁ-এ-এ সব ঠিকঠাক। কী করবো বিকারগ্রস্থ প্রেমিক যে আমাকে মৃতপ্রায় করে রেখেছে, তা তোমাকে বলা সম্ভব নয়।

এই করোনাকালে মৃত্যুর সাথে বসবাস করতে করতে দিনগুলি রাতগুলি মৃত্যুভাবনায় ঘিরে থাকে। দশমাস বাড়ির বাইরে যাই না, তবু ঘুমোতে যাওয়ার সময় প্রতিদিনই মনে হয় আজই শেষরাত। যেন খুব জ্বর এসেছে। থার্মোমিটারে  টেম্পারেচার না পেলে মনে হয় থার্মোমিটার নষ্ট হয়ে গেছে। আবার ভাবি করোনা তো আমার অন্তর্গত অশান্তির কাছে নস্যি! বরং স্ট্রেসে ঘুমের মধ্যে হার্ট এটাক বা স্ট্রোক করে মরে শক্ত হয়ে থাকব আর আগামীকাল ভোরে ঘুম ভাঙাতে গিয়ে আমাকে মৃত আবিষ্কার করে তুমি থ হয়ে যাবে। এরপর কি কাঁদবে হাউমাউ করে?  মনে হয় না। তুমি যৌক্তিক আচরণই করবে। তুমি জানো মৃত্যু অবধারিত। কাজেই বাস্তববাদী তুমি শান্তভাবেই কর্তব্য স্থির করবে। নিশ্চিতভাবে আমার পরিবার এবং তোমার পরিবারে খবর দেবে। প্রথম ফোনটি কাকে করবে তাও জানি নিঃসন্দেহে। পরিবারের ডাক্তার সদস্যটিকেই প্রথমে ডাকবে সঙ্গতকারণে। আসলে সে আসার পরেই মৃত্যুটি নিশ্চিন্ত হয়ে তারপর সবাইকে জানানোর ব্যবস্থা নেবে।

সেই সবার মধ্যে আমার বন্ধুরা অবশ্য থাকবে না। তোমার কাছে তাদের কারও ফোন নম্বর নেই আর আমার মোবাইল তো তখন অটোলক হয়ে আছে। তুমি পাসওয়ার্ডও জানো না, তাই সেই মুহূর্তে ওটা খোলা তো সম্ভব হবে না! ফেসবুকেও তুমি অ্যক্টিভ না, তাই দুঃখ দুঃখ স্ট্যাটাস সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও  শূন্য। কাজেই তারা যখন নিত্যকার ফেসবুকিং করছে, গ্রুপে কল দিচ্ছে, আমার  অনুপস্থিতি নিয়ে টুকটাক কিছু বলছে, কেউ বা একটা মেসেজ রেখে দিচ্ছে, তারা কেউই জানবে না আমি তখন কবরে পচতে শুরু করেছি। অবশ্য জানলেও এই  করোনাকালে ছুটে আসতে তো পারতো না! আলোচনার মধ্যেই হয়তো স্মৃতিচারণে  দুঃখগুলি গলে গলে পড়তো। তো দুঃখের আয়ুই বা কদিন; খুবই সামান্য।

তবে পাগলা টুসি হয়তো পরপর দু’তিনদিন মেসেজের কোন উত্তর না পেয়ে মোবাইলেই কল দেবে আর ঘটনা জেনে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আরও কাউকে কাউকে জানাবে। আমার ফেসবুক এডিক্টেড বোনের স্ট্যাটাস থেকেও দু’চারজন জানবে হয়তো। শুধু আমার রাগী প্রেমিক এক সপ্তাহের আগে কিছুই বুঝতে পারবে না। আমি কেন লিখছি না তা সে নিজে থেকে জানতে চাইবে না। বরং একটা গল্প নিজেই বানিয়ে নেবে। সর্বশেষ মেসেজ-এর লেখাগুলো পড়ে পড়ে  অন্তর্নিহিত অর্থ নতুনভাবে বুঝতে চাইবে, ভিন্ন অর্থ বের করতে চেষ্টা করবে,  ঝগড়ার চিহ্ন খুঁজবে। অন্য কোন ইঙ্গিত আছে কিনা এসব যাচাই বাছাই শেষ করতে করতে খবরটি তার কাছে পৌঁছে যেতে পারে, তবে তার কুণো স্বভাবের কারণে না পৌঁছা্নোর সম্ভাবনাই বেশি।

যদি তখনও খবর না পৌঁছায়, ততদিনে তার রাগের পারদ সর্বোচ্চ মাত্রায় অবস্থান  করছে। সেই রাগের কথা ভেবে আমি এখনই ঘামছি। এরকম অবস্থায় সাধারণত সে তোমাকে সবকিছু ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেয়। সুতরাং একটা হেস্তনেস্ত করার অভিপ্রায় জানিয়ে কঠিন হুমকি সম্বলিত এসএমএস ইনবক্সে জমা হতে থাকবে।

তুমি করিৎকর্মা। হয়তো সেদিনই আমার ফোনের পাসওয়ার্ড ভেঙে এনেছ। আর সেই এসএমএস পড়ে তোমার ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠছে। বেঁচে থাকলে এরপর কী কী ঘটতো আমি জানি, কিন্তু যে কিনা সব তাপ উত্তাপের বাইরে তাকে নিয়ে খুব মাথা  ঘামাবে কি তোমার প্র্যাকটিক্যাল মন? তবে আগের মেসেজগুলো পড়তে পড়তে  ইগো হার্ট হয়ে ফোনটা আছাড় মেরে চুরমার করার সম্ভাবনা প্রবল। আবার তার এই ধারাবাহিক মর্ষকামের বিবরণে কিছুটা আনন্দও হতে পারে আমি কেমন ধরা খেয়েছি বুঝে।

আমার যন্ত্রণাগুলো দেখে তোমার ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া হবে স্পষ্ট ধারণা করতে পারছি না, আমাদের দীর্ঘ যৌথতায় আবেগ নিয়ে তেমন ডিল করা হয়নি বলে। বল  এখন তোমার হাতে। ওকে ইচ্ছেমতো খেলতে খেলাতে পারো জানি। শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থাও নিতে পারো। স্মৃতিচারণ করতে করতে তোমার সামনে ততক্ষণে আমার মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হয়ে গেছে।

কিন্তু তাই কি করবে তুমি?  বোধহয় না। মানুষ হিসেবে তুমি উত্তম এটা আমি নির্দ্বিধায় বলি। তবে সেটা ছাড়াও নোংরা ঘেঁটে যেহেতু লাভ নেই আমাকে তো আর পাওয়া যাবে না শাস্তি দেবার জন্য, তাই সেই যন্ত্রণা কাঁধে নেয়ার মতো বোকামি তুমি করবে না, বরং ছোট করে আসল খবরটি দিয়ে দেবে এমনই মনে হচ্ছে।

তাই কোরো প্লিজ। যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের মৃত্যু ঘটাতাম তাহলে সব গুছিয়ে মরা যেত। কিন্তু যদিও প্রতি মুহূর্তেই মরছি তবু আত্মহত্যা করা হবে না আমার তা বুঝে গেছি। এই ভাবনার কথাগুলো যখন লিখে রাখছি সম্ভাবনার হিসেব করে তোমাকে একটা সুত্র ধরিয়ে দিতে, তখন আমার মরার প্রবল ইচ্ছে হেরে যাচ্ছে বাঁচার আকাঙ্ক্ষার কাছে। যেন জীবন আর মৃত্যু এক বিন্দুতে স্থির হয়ে গেছে। বিষাদাক্রান্ত  মন যখন প্রবল অবসাদে ঘুমিয়ে পড়তে চাইছে, জীবন ডাকছে আরও কী কী সে করতে পারে, কতটা নামতে পারে জানার কৌতূহলে, আরও কত আমি সইতে পারি  সেই চ্যালেঞ্জে। নিজেকে আরও ভাঙচূর করার তৃষ্ণা এখনও আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন