কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

শিবাংশু দে

 

কবিরা খড়া বজার মেঁ - ২

----------------------------------




জাতি জুলাহা নাম কবিরা, বনি বনি ফিরো উদাসী...

জুলাহা, বাংলায় যার নাম জোলা, অর্থাৎ তন্তুবায় নামের শ্রমজীবী শ্রেণী ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিলো। কিন্তু সেই সময় এইদেশের যেসব প্রান্তে বয়নশিল্পের চূড়ান্ত উন্নতি ঘটেছিলো, সেখানে স্বাভাবিকভাবে তন্তুবায়বর্গের মানুষদের বৃহৎ বসতিও প্রতিষ্ঠিত হয়। বারাণসী ছিলো উত্তর ভারতে সে রকম একটি  কেন্দ্র। সেখানেই জন্ম সন্ত কবিরের এবং তিনি স্বীকার করেছিলেন পালক পিতার বৃত্তিগত পরিচয়। পরবর্তী কালের গবেষকরা অবশ্য কবিরের জাতি নিয়ে খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি নিজেকে 'জুলাহা' বা 'কোরী' বলে উল্লেখ করেছেন। এই দুই তন্তুবায় বৃত্তির মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুসলমান ছিলেন। 'কোরী'রা ছিলেন জুলাহাদের থেকেও নিম্নবর্গের শ্রমজীবী মানুষ। কবির নিজের পিতার সম্বন্ধে 'গুসাই' বা গোঁসাই শব্দ উল্লেখ করেছিলেন। হজারিপ্রসাদ দ্বিবেদীর মতে তাঁরা ছিলেন 'যোগী' বা 'যুগী' সম্প্রদায়ের  মানুষ। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরেও তাঁরা নাথপন্থী পরিব্রাজক সন্ন্যাসীদের শিষ্য থেকে গিয়েছিলেন। কবির নিজেকে কখনও 'মুসলমান' বলেননি। 'হিন্দু'ও বলেননি। বস্তুত তিনি চতুর্বর্ণ ভারতীয় সমাজকেই অগ্রাহ্য করেছিলেন। একটি দোহায় এই বিষয়ে তাঁর অবস্থানটি স্পষ্ট করেছিলেন তিনি,

 

'জোগী গোরখ গোরখ করই, হিন্দু রাম-নাম উচরই।

মুসলমান কহই এক খুদাই,

কবিরা কো স্বামী ঘটি ঘটি রহয়ো সমাই।। '

(যোগীরা (নাথ) শুধু গোরখ, গোরখ (গোরখনাথ) করে। হিন্দুরা রাম-নাম উচ্চারণ করে। মুসলমানরা বলে একই খুদা। কিন্তু কবিরের স্বামি (আরাধ্য) সর্ব ঘটে (অর্থাৎ, সর্বত্র) বিরাজ করেন।)

সেই সূত্রে মুসলিম হলেও অধ্যাত্মদর্শনের প্রথম গুরুমুখী পাঠ তিনি নিয়েছিলেন সন্ত রামানন্দের (আনুমানিক ১২৯৯- ১৪১০) কাছে।  ভারতবর্ষে মধ্যযুগের ভক্তিবাদী অধ্যাত্ম আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রধান পুরুষ। তাঁর দর্শনের সঙ্গে পারস্য থেকে আসা ইসলামি সুফি দর্শন মিলেমিশে তৈরি হয় এ দেশের প্রথম সমন্বয়বাদী অধ্যাত্মসাধনা। পরবর্তীকালের ভারতবর্ষে বৃহত্তর জনমানসে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন বলতে যে বোধটি বিকশিত হয়েছে তার অংকুর এই সময়েই স্ফুরিত হয়। এই আন্দোলনের সমস্ত নায়করা, যেমন, সন্ত কবির, সন্ত রবিদাস, সন্ত নানক, পরবর্তীকালে সন্ত তুকারাম সবাই সন্ত রামানন্দের ভাবশিষ্য। সন্ত রামানন্দ ও কবিরের সম্পর্কটি ভারতবর্ষে পরবর্তীকালের অধ্যাত্ম ও রাজনৈতিক জগতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিংবদন্তি বলে, সন্ত কবির নিজের জন্মপরিচয়  লুকিয়ে সন্ত রামানন্দের থেকে শিক্ষা নেন। কারণ তখনও পর্যন্ত প্রয়াগের ব্রাহ্মণ রামানন্দ কোনও 'বিধর্মী'কে তাঁর উপদেশ দিতে স্বীকৃত ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস বলে, সন্ত রামানন্দ ও সন্ত কবিরের মধ্যে দীর্ঘ বোধবিনিময়ের ধারা দুজনকেই  একসঙ্গে সমৃদ্ধ করে তোলে। এমন রটনাও রয়েছে যে কবিরের মাতা ছিলেন এক অকালবিধবা ব্রাহ্মণ রমণী। রামানন্দ তাঁকে পুত্রবতী হবার বর দিয়েছিলেন। ফলতঃ তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তবে সম্ভবতঃ ঘটনা হলো, কবিরের প্রকৃত পিতা  রামানন্দের একজন ব্রাহ্মণ শিষ্য এবং কবিরের গর্ভধারিণী সেই ব্রাহ্মণ বিধবা রমণী। লোকলজ্জায় তাঁরা সদ্যোজাত সন্তানকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন লহরতারার জলে। সেখান থেকেই 'ম্লেচ্ছ' জোলা নিরু আর নিমা তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। অবশ্য আধুনিককালের পণ্ডিতরা এই কিংবদন্তি'তে আস্থা রাখেন না। শার্ল ভডভিল বলেছেন, কবির ছিলেন একেবারে নিম্নবর্গের আতরাফ মুসলমান পরিবারের সন্তান, যাঁরা আদত ইসলামি ধর্ম বা লোকাচার সম্বন্ধে বিশেষ ওয়কিবহাল ছিলেন না। তাঁরা সম্ভবত ছিলেন পুরুষানুক্রমিক নাথপন্থী  ইতরবর্গের মানুষ। হয়তো নেহাৎ অর্বাচীন, কলমা কবুল করা মুসলমান। যার ফলে কবিরের রচনায় যেসব উদাহরণ, চিত্রকল্প, প্রতীকী সন্দর্ভ আমরা বারবার দেখতে পাই, সেখানে তন্ত্র, নাথপন্থা ও অন্যান্য লোকজ বিশ্বাসের প্রভাব বিশেষ প্রকট। ওয়েন্ডি ডনিগার তো সরাসরি বলেছেন, কবির সচেতনভাবে হিন্দু ও ইসলাম দুটি ধর্মবিশ্বাসকেই প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব 'ধর্মমত' প্রচার করেছিলেন এই দুটি ধর্মের ধ্বংসাবশেষের উপর। এ বিষয়ে তাঁর উত্তরসূরি ছিলেন মধ্যযুগের বহু সুফি সাধক।

তবে সন্ত কবিরের নিজস্ব ব্যাখ্যায় সন্ত রামানন্দ অনুসৃত শ্রীরামানুজ কথিত নির্গুণ ব্রহ্ম, একেশ্বরবাদ ও প্রেমভক্তির পথে ঈশ্বর, আল্লাহ, হরি, রাম বা অলখ নিরঞ্জনলাভ দর্শনতত্ত্ব সেই সময় থেকেই আপামর ভারতবাসীর মধ্যে অত্যন্ত কার্যকরীভাবে গৃহীত হয়েছিলো। অনেকদিন পরের মানুষ আমাদের লালন সাঁই বলছেন,

'শুদ্ধভক্তি মাতোয়ালা, ভক্ত কবির জেতে জোলা

সে ধরেছে ব্রজের কালা, দিয়ে সর্বস্বধন তাই।।

'ভক্তের দোরে বাঁধা আছেন সাঁই।।'

--------------------------------

জব ম্যঁয় থা, তব হরি নহি

অব হরি হ্যাঁয়, ম্যঁয় নহি

সব অঁধিয়ারা মিট গয়া

জব দীপক দেখা ম্যঁয়নে।।

সেই অন্ধকারযুগে সহায়হীন নিপীড়িত শ্রমজীবী শ্রেণীর ইতরমানুষদের আত্মার শুশ্রূষায় প্রদীপের আলো হাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন সন্ত কবির। তিনি সন্ন্যাসী ছিলেন না। সংসার করেছিলেন, পত্নীর নাম ছিলো লো'ই। তাঁর কোনও বংশপরিচয় পাওয়া যায় না। তিনি সুরূপা ছিলেন না। কবিরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিলো বেশ তিক্ত। কবিরের রচনায় লো'ই সম্বন্ধে নানা বিরূপ মন্তব্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যদিকে লো'ই দুঃখ করতেন, কবির তাঁর সব 'উপার্জন' সাধুসেবায় ব্যয় করেন। তাঁকে শুধু 'চনা' (ছোলা) খেয়ে বাঁচতে হয়। কবির 'গৃহস্থ' রীতিনীতি অনুসরণ করতেন না। জাতব্যবসা ত্যাগ করে তিনি ঈশ্বর-সন্ধান করতেন। কবিরের নিজের তো পার্থিব ভোগসুখের প্রতি কোনও টান ছিলো না। তাঁর মনোভাব বোঝা যাবে এই দোহাটিতে,

 

"চাহ মিটি, চিন্তা মিটি, মনওয়া বেপরওয়াহ

জিসকো কুছ নহি চাহিয়ে, উওহ হ্যাঁয় শহনশাহ।।"

স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য তা ছিলো অত্যন্ত কষ্টকর। কবিরের এক পুত্র কমাল আর কন্যা কমালি। পুত্র কমাল পিতার সাধনার মর্ম বুঝতেন না। কবিরের মতে তিনি ছিলেন ‘বিষয়বিষে’ বিজড়িত। আক্ষেপ করে কবির বলেছিলেন,

 

'বুরা বংস কবির কা, উপজা পুত কমাল

হরি কে সুমিরন ছোড়কে, ঘর লে আয়া মাল।।'

যদিও কবিরপন্থীরা অস্বীকার করেন, কিন্তু একটি কিংবদন্তি আছে 'ধনিয়া' বা 'রমজনিয়া' নামে এক নারী তাঁর কৃপাধন্যা ছিলেন। সম্ভবত তিনি ছিলেন বৃত্তিতে গণিকা। তাঁদের মধ্যে সম্পর্কটি ঠিক কী ছিলো তা জানা যায় না। সম্ভবত কবিরকে হীন প্রতিপন্ন করার জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের রটনা ছিলো এসব। ইতিহাসে গোঁড়া ধর্মান্ধদের এই জাতীয় আচরণ বারবার দেখা যায়। স্বয়ং যিশুকেও মেরি ম্যাগদালেনকে কেন্দ্র করে এই ধরনের কুৎসিত প্রচারের লক্ষ্য হতে হয়েছিলো।  তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত এই সব রটনা বা ‘তথ্য’ প্রমাণ করে একান্তভাবেই তিনি ছিলেন সমাজের একেবারে প্রান্তিক বর্গের অংশ। ভারতবর্ষের বরেণ্য মনস্বী সন্তানদের মধ্যে অনেকেই অত্যন্ত দরিদ্র, নিম্নবর্গীয় সমাজ থেকে এসেছিলেন। কবির ছিলেন তাঁদের মধ্যেও নিপীড়িত-তম অংশের প্রতিনিধি।

ঈশ্বরবোধের সন্ধানে কবির দেশের বহু তীর্থ ও প্রান্ত পরিব্রজন করেছিলেন। কিন্তু গুরু রামানন্দ ও শিষ্য কবিরের মূল কর্মক্ষেত্র ছিলো শহর বনারস। গুরু ছিলেন সে সময়ের ভারতবর্ষে একজন শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত, দার্শনিক ও প্রসিদ্ধ চিন্তানায়ক আর চেলা ছিলেন 'নিরক্ষর' সামাজিক মর্যাদাহীন জোলা। কবিরের আরেকজন দিগদর্শক ছিলেন পণ্ডিত শেখ তকী। নিজের সম্বন্ধে কবির বলেছিলেন,

 

'মসি কাগদ ছুয়ো নহি

কলম গহি নহি হাথ।।'

আর গুরু সম্বন্ধে বলেছিলেন,

'গুরু গোবিন্দ দোনো খড়েঁ

কাকে লাগু পাঁয়

বলিহারি গুরু আপনো

গোবিন্দ দিয়ো মিলায়।।'

------------------------------------

সন্ত কবির ছিলেন ভারতবর্ষের শাশ্বত ইতরযানী বোধিবিশ্বের ভাণ্ডারী ও নায়ক। ব্রাহ্মণ্য বোধ ও উপলব্ধির চেনা কক্ষপথের বাইরে  আবহমানকাল ধরে এদেশে গরিষ্ঠ মানুষের মননজগতের  শ্রেষ্ঠ ফসল উদ্গত হয় সন্ত কবিরের এইসব অমৃতবাণীর মাধ্যমে। তাঁর বাণীর প্রথম প্রামাণ্য সংকলন পাওয়া গুরু অর্জনদেব সংগৃহীত শিখদের 'আদিগ্রন্থ' আর গোবিন্দওয়াল পোথির মধ্যে। তারপর রাজস্থান থেকে সংগৃহীত 'বীজক' আর বুন্দেলখন্ড থেকে নথিবদ্ধ করা 'অনুরাগসাগর'। এসবের প্রণেতা ছিলেন নিরক্ষর, তাই এর প্রামাণ্যতা শুধু বাচনিক ঐতিহ্যের মধ্যে বিচরণ করেছে।  উইলসন-সাহেবের মতে কবিরের রচিত দোহা সংকলনের সংখ্যা আট। বিশপ ওয়েস্টকট সাহেব বলেছেন সংখ্যাটি চুরাশি। অন্যমতে রামদাস গৌড় বলেন কবিরের রচনার একাত্তরটি সংগ্রহ রয়েছে। তবে তাঁর সমস্ত রচনাই 'বীজকে'র মধ্যে মোটামুটি গ্রন্থিত আছে। বীজকের তিনটি ভাগ আছে, রমৈনি, সবদ আর সারওয়ি। শৈলির বিচারে তাঁর রচনায় রয়েছে তিনধরনের  রচনা। দোহে, সলোক (শ্লোক) আর সাখি (সাক্ষী)। তাঁর রচনাগুলি যেহেতু ভক্তদের শ্রুতির মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিলো, তাই অনেক ভাষায় তার নানা রূপ দেখা যায়। যেমন, পঞ্জাবি, ব্রজভাখ, রাজস্থানী, খড়ি বোলি, অওধি, পুরবি ইত্যাদি।

-----------------------------------------

তিনি ছিলেন এক গর্বিত 'জুলাহা'। যেখানেই নিজের সম্পর্কে কিছু বলার, তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে নিজের শ্রমজীবী জাতিপরিচয় নিয়ে সরব হয়েছেন। জীবৎকালে কবিরকে ব্রাহ্মণ্য ও অশরাফি মুসলিম সংস্কৃতির ধ্বজাধারীদের থেকে তুমুলভাবে নিগৃহীত হতে হয়েছে। শুধু মানসিক নয়, তাঁকে বারবার শারীরিক ভাবেও নির্যাতন করা হয়েছে। শেখ তকী বলেছিলেন কবিরের স্পষ্ট কথা আর প্রচলিত সামাজিক দমনপীড়নের বিরুদ্ধে নেওয়া অবস্থানের জন্য তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই ঘৃণিত হয়েছিলেন। কিংবদন্তি অনুযায়ী সুলতান সিকন্দর লোদি থেকে শুরু করে গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য সমাজ, সবাই তাঁকে অত্যন্ত হেনস্থা করতেন। হিন্দুরা তাঁকে বলতো অচ্ছুত ম্লেচ্ছ, আর মুসলিমরা বলতো কাফির। কিন্তু কবিরের কাব্য ও দর্শনচিন্তা তাঁকে পরবর্তী বহু শতকের মানুষের কাছে শ্রদ্ধেয় ও 'প্রাসঙ্গিক' করে রেখেছে। বিশপ ওয়েস্টকটের গ্রন্থের ভূমিকায় তাঁকে 'পঞ্চদশ শতকের ভারতীয় লুথার' (মার্টিন লুথার) বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো।

কবির যেন একজন 'মানুষ' ছিলেন না। তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানবাত্মার কাছে  এক স্বপ্নময় পরিত্রাতা। একটি আশ্বাসের  বিগ্রহ। তাঁর সম্বন্ধে প্রচলিত লোকবিশ্বাস ও তথ্যসূত্র সব কিছুই যেন এক রহস্যময়তার আবরণে ঢাকা। তাঁর প্রয়াণের সময়কাল নিয়েও বহু মত দেখা  যায়। একটি মত অনুযায়ী তা ১৪৪৭ সালে। অন্যমতে ১৫১১ সাল। অথবা শ্যামসুন্দর দাসের মতে ১৫১৭ সাল।  হান্টার সাহেবের মতে কবিরের সময়কাল ১৩৮০ থেকে ১৪২০ সাল। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে এই এই সময়কাল ১৩৯৮ থেকে ১৫১৮ পর্যন্ত বিস্তৃত  ছিলো। অর্থাৎ তাঁর মতে কবির দীর্ঘ একশো কুড়ি বছর জীবিত ছিলেন।

কবিরের তিরোভাব হয়েছিলো বারাণসী থেকে প্রায় দুশো কিমি দূরে গোরখপুরের কাছে মগহরে। তাঁর জন্মের কাহিনী এতো-ই অস্পষ্ট যে তাঁর প্রকৃত জন্মস্থান বারাণসী কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কিন্তু বনারস তাঁর কর্মভূমি এবং চিরকালীন ভারতবোধে এই স্থান ও কবির অচ্ছেদ্য সম্পর্কে বাঁধা। একসময়ের গণিকা, কসাই ও অন্যান্য 'অসামাজিক' পেশায় নিয়োজিত মানুষ অধ্যুষিত এই স্থানে বসবাস করে মহাত্মা কবির কোন প্রেরণায় নিখিল মানবাত্মার কাছে তাঁর শাশ্বত সন্দেশ পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন, তা হৃদয়ঙ্গম করার একটা বাসনা  আমাকে তাঁর দিকে টেনে নিয়ে যায়। অন্ধকার মধ্যযুগে ভারতদর্শনের সারসংক্ষেপ একজন 'অশিক্ষিত', হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিলো আর্যাবর্তের সংখ্যাগুরু নিপীড়িত, দরিদ্র, হতমান ইতর মানবজাতির কাছে আত্মার শুশ্রূষা হয়ে।

পশ্চিমের সংস্পর্শে আসা ভারতীয়দের মধ্যে  বিদেশে কবিরবাণী প্রচারের প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৯১৫ সালে 'সংস অফ কবির' নামে তাঁর অনুদিত কবিরের একশোটি কবিতা লন্ডনে প্রকাশিত হয়। ইভলিন আন্ডারহিল  এই সংকলনটির ভূমিকা লিখে দেন। এই বইটি পড়েই ডব্লিউ বি ইয়েটস পশ্চিমে কবিরকে বিস্তৃত পরিচিতি দান করেন। অবশ্য পরবর্তীকালের গবেষকদের মতে এই একশোটি কবিতার মধ্যে বড়ো জোর ছ'টি কবিতা কবিরের নিজস্ব রচনা। বাকিগুলি সম্ভবতঃ কবিরের শিষ্য-প্রশিষ্য নানা ভক্ত সাধকের সৃষ্টি। যদিও  সেগুলিতে কবিরের দর্শন ও রচনাশৈলি বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করা হয়েছিলো।

ঈশ্বর কবিরের কাছে একজন শ্রেষ্ঠ তন্তুবায়। ঠিক যেভাবে একজন জোলা সুতোর সঙ্গে সুতোর খেলায় মত্ত হয়ে অনুপুঙ্খ কৌশলে শিল্পসৃষ্টি করে, সেভাবেই ঈশ্বর মাতৃগর্ভ নামক তাঁত থেকে সমস্ত প্রাণ, সারা জগতসংসারকে উৎপন্ন করছেন। এই ধারণাটি তন্ত্র ও আগমের একটি মুখ্য সূত্র। আরাধ্য 'হরি' সম্বন্ধে তাঁর মুগ্ধতা যেন সঞ্চারিত হয়ে যায় উত্তরসূরিদের মননে তাঁর প্রতি গড়ে ওঠা মুগ্ধতার প্লাবনে। এই দোহাটিতে তিনি যখন 'হরি'কে ইঙ্গিত করেন, আমরা 'হরি'র স্থানে তাকে পড়ি 'কবির'। খুব একটা ভুল হয় না আমাদের,

 

'সাত সমন্দর কী মসি করৌঁ

লেখনি সব বনরাই ।

ধরতি সব কাগদ করৌঁ

হরিগুণ লিখা ন জাই।।'


1 কমেন্টস্:

  1. অসম্ভব ভালো লাগল লেখা ।আরও পাওয়ার আশা বেড়ে গেল। একটি কথা আপনার লেখা আগেও পড়েছি,অনবদ্য তথ্য সমৃদ্ধ পাঠ পাওয়া যায়। অপূর্ব গদ্য। ভালো থাকবেন।
    জামশেদপুর থেকে বিমল চক্রবর্তী।

    উত্তরমুছুন