সন্ধ্যায় হেমন্ত
ঘরে
ঘরে ডাক পাঠালো,
দীপালিকায়
জ্বালাও আলো
জ্বালাও
আলো, আপন আলো,
শুনাও
আলোর জয়বাণী রে
হিমের
রাতে ঐ গগনের দীপগুলিরে – হেমন্তিকা…
এই হেমন্ত শুনলেই আমার মনে দুটো একেবারে বিপরীত চিত্র ভেসে ওঠে। প্রথমটা হেমন্তের কুয়াশাভরা, ধোঁয়া ধোঁয়া এক রহস্যময়ীর মলিন আঁচলঘেরা, বিবর্ণ অন্ধকার সন্ধ্যার ছবি। কেমন একটা দিশাহারা অনিশ্চয়তা - অবসন্ন, বিষাদগ্রস্ত, পথের আলোগুলো মাকড়সার জালে স্তিমিত, নিস্তেজ। জীবনের একটা অস্পষ্ট চিত্রপট - হেমন্তের একটা বিষণ্ণ সন্ধ্যার রূ্প। আর দ্বিতীয়টি আমাদের প্রাণের মানুষ আছেন প্রাণে, যিনি সুরের তরণী বেয়ে আমাদের আলোর পথের সারথি, ঘরে ঘরে যাঁর অনিন্দিত কন্ঠস্বর স্মৃতির সুখে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আমাদের সবার প্রিয় সংগীতজগতের এক উজ্জ্বল, জ্বলন্ত কিংবদন্তী - অতুলনীয়, অবিস্মরণীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। স্বভাবতই আমরা আলোর সন্ধানী, তাই ঐ অবসন্ন বিষাদগ্রস্ত সন্ধ্যার অন্ধকার মূহূর্তগুলোকে সরিয়ে দেওয়াই আমাদের জীবনের গতি, শান্তির বার্তা। এবং ঐ বিষাদের দু:সহ সমুদ্র পার করার একমাত্র উপায় ‘জগতে আনন্দলোকের উৎসসন্ধানে’ নেমে পড়া। আর সেই সন্ধানের কাজটা আমার একেবারেই সহজ হয়ে যায়, কারণ কি জানেন? ‘সাথে আছেন ভগবান, হবে জয়’।
তবে, আমি যে ভগবানের কথা বলছি তিনি কিন্তু নিরাকার নন, গোলকধাম বা কৈলাসবাসীও নন, জলজ্যান্ত জোড়াসাঁকোর বাসিন্দা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন, সর্বভূতে বিরাজিত। তিনি আমাদের সর্বকালের সুখ দু:খের কান্ডারী। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই, আমার ভগবান হচ্ছেন সেই ঠাকুর - রবীন্দ্রনাথ। যিনি নিজেই বিষণ্ণ অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, যিনি জোড়াসাঁকোর সেই খোলা জানলার ধারে বসে সারা বিশ্বের নাড়ি ধরে স্মিতমুখে অসাধারণ লেখনীর সাবলীল চলনে সমস্ত দু:খ বিষাদ, বিসুখ সারিয়ে অনায়াসে ভুবনে আনন্দধারা বইয়ে দিতে পারেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি আমার চলার পথের জ্বালানি শক্তি। এবং সেই দেবতার প্রসাদ ও বাণী মানুষের রক্তকণিকায় পৌঁছে দেবার অন্যতম প্রধান বাহন হচ্ছেন - শ্রীহেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এটাই হেমন্তের আর একটি রূপ - এক জ্বলন্ত উদ্ভাসিত কিংবদন্তি যিনি ঘরে ঘরে দীপালিকার মায়াময় শিখায় আমাদের জীবন আলোকিত করে দিয়ে গেছেন।
তাহলে চলুন ভুলে যাই ওপরে লেখা হেমন্ত সন্ধ্যার বিষণ্ণত, চোখটা বন্ধ করে একবার রবীন্দ্রসদনের আলো আঁধারে উন্মুখ একটি মনোরম আশাবরী সন্ধ্যার ছবি দেখা যাক্। মঞ্চে আলো ছড়াচ্ছেন কণুই পর্যন্ত আস্তিন গোটানো সাদা শার্ট, পাট করা ধুতি, উল্টে আঁচড়ানো কালো চুলের ঝিলিক নিয়ে এক দীর্ঘ, ঋজু অসাধারণ ব্যক্তিত্ব - স্রেফ একটি হারমোনিয়ম নিয়ে বসে, পাশে শুধুই এস্রাজ আর তালবাদ্য - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে চিনতে ভুল হবার কথা নয়।
তফাত আছে বৈকি এদের মধ্যে – ‘হেমন্তের সন্ধ্যা’ , ‘হেমন্ত ও সন্ধ্যা’ এবং ‘সন্ধ্যায় হেমন্ত’। প্রথমটি দিশাহারা বিষণ্ণতা, দ্বিতীয় - সুরের ঝর্ণাধারার যুগলবন্দীতে বিগলিত স্বর্গীয় সুষমা, এবং তৃতীয়টি - অবর্ণনীয় কন্ঠস্বরের আবেশে শ্রোতামন্ডলীকে স্তব্ধ, সম্মোহিত করে দেবার মানুষের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা।
মেনকা সিনেমাহলের পেছন দিকে এক অতি সাধারণ তিন চারতলা বাড়ি, সিঁড়ি বেয়েই নামছি এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করে। ঐ তলাতে শেষ ধাপটা নামতেই চোখে পড়ল বন্ধ দরজায় অতি সাদামাটা কালো প্ল্যাস্টিকের পাতের ওপর, প্রায় বিবর্ণ সাদা ইংরাজী হরফে লেখা ‘হেমন্তকুমার’। আটলান্টিকের অশান্ত ঢেউএর ঝাপটা ঐ ল্যান্ডিং থেকে মুহূর্তে উড়িয়ে নিয়ে এইচ এম ভি’র ৭৮ আর পি এমের পাকে পাকে ঘোরাতে লাগলো আমাকে, শৈশবের ঝাপসা স্মৃতিটা আলাদীনের প্রদীপের মত ঝকঝক করে উঠলো। অনুরোধের আসর, অল ইন্ডিয়া রেডিও - স্বপ্নের মত মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠল এক শোভাযাত্রা একটি লাজবতী গাঁয়ের বধু, পরিশ্রান্ত পাল্কি বেহারাদের ক্লান্ত পায়ের চলন, কী দেখি পাই না ভেবে গো। আর, তারপরেই বুকে ঝড তুললো এই ছোট্ট নেমপ্লেটটার পেছনে জমা থাকা নীরব লহরীর অশেষ, গভীর বিস্তার। সঙ্গে ছিল রীতা আর ফ্রকে ঘেরা দুই কন্যা - আট আর দশ বছরের দুটি গোলাপের নিখুঁত পাঁপডি। ঐ দুর্দম স্মৃতির ঢেউয়ের ধাক্কায় নেমপ্নেটটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে উঠলাম
“হেমন্ত
কুমারের সংগে দেখা করবি?”
বড়
জন অবিশ্বাস্য কৌতূহলে বলে উঠলো, “বাবা, তোমাকে চেনেন নাকি?”
বললাম, “উনি আমাকে চেনেন না, কিন্তু আমি তো ওনাকে ছোটবেলা থেকে জানি!”
ঘোরের মধ্যেই কিন্তু ততক্ষণে আমি কলিং বেলটা টিপে দিয়েছি - টিংটং করে বেজেও উঠেছে ওটা সঙ্গে সঙ্গেই। দু’তিন মিনিটের দুরু দুরু প্রতীক্ষায় হৃদপিন্ডে কামারশালের হাতুড়ির ঘা ধক্ ধক্ ধক্ ধক্ - একটার ওজন আর আঘাত আগেরটার থেকে তীব্রতর।
অবশেষে, খুললো বন্ধ দরজা - কী দিয়ে শুরু করবো, মনের ভেতরের তোলাপড়ার মধ্যেই দরজার ফ্রেমে ছোট মাপের এক মিষ্টি মহিলা, হাসমুখে তাকিয়ে। শ্রীমতী বেলা মুখোপাধ্যায়।
আমার
শুকনো গলাটা হয়তো একটু খসখসেই শোনাল - “হেমন্তবাবু আছেন?”
“আপনারা?”
“অম্লান বোস। ইনি রীতা আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে - ইন্দোনেশীয়া থেকে। একটু দেখা হতে পারে?”
আর কোন প্রশ্ন নেই তাঁর, জড়তা নেই, একটুও ইতস্তত ভাব নেই। সরে দাঁড়িয়ে বললেন – “আসুন”। সোফাটা দেখিয়ে পর্দা সরিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে পড়লেন। তখনই চোখে পড়ল দরজার সামনে অনেক জোড়া চটি, জুতো ছড়িয়ে। ছাত্রছাত্রীদের তালিম হচ্ছে নিশ্চয়ই এবং আমার দুরাশা সফল হবার নয়। এবার আমি খুবই অস্বস্তিতে পড়লাম, ওনার ব্যস্ততার কথা আমার মনে রাখা উচিত ছিল। অপ্রতিভ অবস্হা থেকে বেরোতে আমাকে কখনই কোন অসুবিধায় পড়তে হয় নি, কিন্তু এই জ্বলন্ত প্রতিভার সামনে, যিনি আমার কাছে সংগীতের দেবরাজ, তাঁকে সাধনার বেদী থেকে তুলে এনে কী কথা বলবো? নিজের অবৃমিষ্যকারিতায় দগ্ধ হচ্ছি আমি।
পর্দা সরে গেল, ছ’ফুটের কাছাকাছি, সটান ঋজু মূর্তি, সাদা শার্ট, ধুতি, ব্যাকব্রাশ চুলের পালিশে জ্বলজ্বলে। সুদূর মঞ্চে অধিস্ঠিত, ছবিতে অসংখ্যবার দেখা হাজার হাজার মানুষের হৃদয়ে বাঁধানো মূর্তি মাত্র তিন চার ফিটের মধ্যে। হতবাক বোবা হয়ে তো নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকা যায় না বেশিক্ষণ!
“নমস্কার
হেমন্তবাবু। সরি, অসময়ে এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম…”
“না না, ঠিক আছে, বসুন বসুন। বলুন!”
চোখ বন্ধ করলে বোধহয় উত্তমকুমারের গলাটাই শুনতাম। সত্যিই অসম্ভব মিল দুজনের কন্ঠস্বরে। অবশ্য, এটা সত্যিকারের মিল, নাকি ওঁদের লক্ষ লক্ষ শ্রোতা ভক্তদের হৃদয়ের চাহিদার অনুভূতি, তা গ্যারান্টি দিতে পারব না।
“এই, তোরা প্রণাম কর - গুরুদেব উনি। আসলে আপনাকে দেখার জন্যে আর মেয়েদের জন্যেই আসা। ওপরের ডক্টর সেন আমার আত্মীয়।”
“ও,
আচ্ছা? খুবই ভাল মানুষ উনি”।
“আপনাকে
সুস্হ দেখে এত ভাল লাগছে - আপনার শরীর খারাপের কথা শুনেছিলাম”।
“না, এখন তো আমি সম্পূর্ণ সুস্হ। আমার গান শোনেন তো” ?
অবাক হয়ে গেলাম, এটা একটা প্রশ্ন হল, আমাকে? অবশ্য উনি কী করেই বা জানবেন আমার মত কত শত শত যুবক যুবতী, প্রৌঢ়, বয়স্ক মানুষের প্রাণে উনি গাঢ সুরের মায়ায় নিজের অজান্তে প্রেম, ভালবাসা আর ভক্তির আলো জ্বালিয়েছেন!
ততক্ষণে আমি ওনার অমায়িক ব্যবহারে একটু সতেজ হয়ে উঠেছি।
“কী বলছেন হেমন্তবাবু! কত রাত জেগে, সে দমদমেই হোক বা রবীন্দ্রসদন অথবা আপনার নিজের যাদবপুরের অডিটোরিয়ামেই হোক, খুব কমই বাদ দিয়েছি। সত্যিকথা, আপনাকে শোনাবার মত নতুন কোন কথা বলা সম্ভব নয়। সব প্রশংসাই আপনার কাছে মাথা নিচু করে থাকে”।
“না না - এ কী বলছেন!” একদম সাদাসিধে মানুষের অভিব্যক্তি, একটা আলগা লজ্জায় ভেজা। আমি ততক্ষণে জ্বালানি পেয়ে গেছি।
“আপনি আমাদের সংগীতজগতে যা দিয়ে চলেছেন, তার কোন তুলনা হয় না হেমন্তবাবু! বাংলা ও হিন্দীগান, কলকাতা বম্বে ছায়াছবিতে সগৌরবে সুর আর গলা, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল, অতুলপ্রসাদ আর কখনও পল্লিগীতি, দ্বিজেন্দ্রগীতিতে অপ্রতিহত বিচরণ। শুনেছি মারাঠি, গুজরাটি গানও আপনি গেয়েছেন!”
“হ্যাঁ, আর ঐ কয়েকটা অহমিয়া, তামিল আর ওড়িশি গানেও যুক্ত ছিলাম। ওরা বড্ড ধরেছিল, ফেলতে পারি নি”।
“আর দুটি জাতীয় পুরস্কার!”
“তা পেয়েছি বটে, তবে কি জানেন অম্লানবাবু, এখনও কিন্তু কলকাতার শ্রোতৃমন্ডলীকে আমার খুবই ভয় করে। কোনদিন কোনকারণে যদি গলাটা সুরের সঙ্গ না দিতে পারে - পচাডিম, টমেটো, কলার খোসা ছুঁড়তে থাকে”।
এই অসম্ভব কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? হেসে উড়িয়ে দেওয়াও যাবে না - বক্তা যে স্বয়ং হেমন্ত, হাজার লোকের প্রণম্য, অত্যন্ত গর্বের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়!
অনিশ্চিত গলায় একটুও অবিশ্বাসের ছোঁয়া না লাগিয়ে হাল্কা প্রতিবাদের মিনমিনে গলায় বললাম, “অসম্ভব! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে টমেটো? তা হয় নাকি? এই তো গত বছরেই লেক স্টেডিয়ামে আমি আপনার পপুলারিটি আর কনফিডেনস্ দেখলাম। মনে আছে কি আপনার? প্রায় সব গুণী সঙ্গীতজ্ঞরা আসবেন - আসর শুরু হবার আগে থেকেই জনসমুদ্র অস্হির আবেগে ফুটছে। হঠাৎ গুঞ্জন উঠলো কিশোরকুমার আসছেন না, কথাটা কানে কানে এগোতে এগোতে ফ্রাস্ট্রেশান সোচ্চার হল ঝড়ের মত”। বলতে বলতে আমি নিতান্তই উত্তজিত হয়ে পড়েছি - ওদিকে তাকিয়ে দেখলাম হেমন্তবাবুর মুখে সূক্ষ্ম কৌতুক।
“খোলা আকাশের নীচে শ্রোতারা ক্ষোভে, হতাশায় আর রাগে উত্তাল। প্রচন্ড চিৎকার, হুডোহুডি, বিশৃঙ্খলা ফেটে বেরোচ্ছে। দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় উঁচু গলায় জনতাকে শান্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। উনি তখন যথেষ্ট পপুলার - কেউ কিন্তু কোন কথা শোনবার পাত্র নয়। কর্মকর্তারা হিমসিম খাচ্ছেন - অত গোলমালে তুমুল অরাজকতা। এমন সময় হঠাৎ, বলতে গেলে আজও আমার চোখে জল চলে আসে, সব গোলমাল ছাপিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে - “ও আকাশ সোনা সোনা, এ মাটি সবুজ সবুজ”। এক মিনিটও হবে না বোধহয়, প্রেসারকুকারের ভালভ খুলে ফেললে যেমন হয়, তেমনি করেই সমস্ত গালাগাল, টিটকিরি, উষ্মা, হিসহিসানি সব ম্যাজিকের মত হুস করে মিলিয়ে গেল, বিশাল জনসমুদ্র পিন ড্রপ সাইলেন্স। ভাবা যায়? আপনি সামনে আছেন বলে বা আপনাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি বলে নয়, আমি জোর গলায় বলতে পারি, অন্য কোন শিল্পীর ঐ উন্মাদ জনতার বাঁধভাঙ্গা গন্ডগোলের মধ্যে মঞ্চে উঠবার সাহসই হত না! আর আপনি বলছেন ডিম, টমেটোর কথা?”
আমার অহেতুক উত্তেজনার জন্যে এবার আমি নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়েছি। উনি তখন বেলাদেবীর দিকে তাকিয়ে, মনে হল, একটু বিব্রত সঙ্কোচ।
মুহূর্তেই তা ঝেড়ে ফেলে মেয়েদের দিকে ফিরে বলে উঠলেন, “এই, তোরা আমার গান শুনেছিস?” বলা বাহুল্য অতিমাত্রার ভদ্রলোক প্রসঙ্গ পরিবর্তনে বদ্ধপরিকর।
“হ্যাঁ…
“কী গান শুনেছিস? নিলামওলা ছে আনা, আয় খুকু আয়, পাল্কি চলে?”
শেষেরটাই ছিল ওদের আয়ত্তের মধ্যে। লম্বা করে ঘাড়টা নাড়িয়ে দিতেই উনি যেন ওদের বয়সে নেমে পড়লেন। বহুশ্রুত, অবিস্মরণীয়, স্বর্ণকন্ঠে গেয়ে উঠলেন তালে তালে মাথা নাড়িয়ে, “পাল্কি দেখে - হূঁহুম্ নাহ্, আসছে ছুটে - হূঁহুম নাহ্, ন্যাংটা খোকা - হূঁহুম নাহ্, মাথায় পুঁটে”
এবং নিশ্চয়ই বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের জন্যেই ঐ বিশেষ একটা শব্দের ওপর জোর দিয়ে দুবার রিপিট করলেন। দুই মেয়ে তখন দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসি গোপন করার বৃথা চেষ্টা করতে করতে মায়ের লজ্জারাঙ্গা মুখের দিকে তাকিয়ে। হেসে গড়িয়ে পড়ার অনুমতির অপেক্ষায়।
আর বেশিক্ষণ ওনাকে আটকে রাখাটা অমার্জনীয় অপরাধ। উঠে পড়লাম। হেমন্তবাবু হাতজোড় করে বিনয়ী হাসিতে বিদায় জানালেন। বেলাদেবী দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সাবেকি বঙ্গরমণীর ধারা বজায় রেখে চিরকালীন বিদায়বার্তা শোনালেন, “আবার আসবেন”।
স্বপ্নের ঘোরে দুলছি, দুলছি আর সিঁড়ির ধাপগুলি ভাঙ্গছি। স্মৃতির টৈটম্বুর অমৃতসাগরে ভাসতে ভাসতে ভাবছিলাম, এইরকম এক বিশাল ব্যক্তিত্বের মধ্যে এত বিনয়, এইরকম নিরহঙ্কার মনোভাব, এতটা সরলতা, এত মাটির কাছাকাছি আসা কি সম্ভব! নাকি আমি এ্যালিসের মতো একটা স্বপ্নরাজ্যে ঘুরে এলাম? যাঁর আকাশছোঁয়া ব্যক্তিত্ব, অননুকরণীয় কন্ঠস্বর, যাঁর সুরের জালে ভারতের আবাল বৃদ্ধ বনিতা উন্মাদ, মুম্বাই কলকাতার ছায়াছবির জগত, গুণমুগ্ধ শিল্পীসম্প্রদায়, মিডিয়া, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট দল, সর্বস্তরের মানুষ কয়েক দশক ধরে সম্মোহিত, ইনিই কি সেই ‘হৃদয়বসন্তবনে মাধুরী বিকাশিত’ করার দেবদূত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়?
পথে নেমে এলাম। গলি পার হয়ে মেনকা সিনেমার সামনে দিয়ে, রবীন্দ্র সরোবরের পাশ দিয়ে ভাসতে ভাসতে এগোলাম। আলো ঝলমল রাস্তায় বা সরোবরের নিরালাতে কেউই জানলো না, ওদের অজান্তে আমি কী বিপুল সম্পদ সঙ্গে নিয়ে পথ চলছি, যা একান্তই আপনার, পৃথিবীর কারোরই ভাগ বসানার ক্ষমতা নেই।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন