কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০

দীপক সেনগুপ্ত

সমকালীন ছোটগল্প 



মহেশ কেস


সদ্য বিয়ে দেওয়া মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গেছিলাম দেখা করতে। বেয়াই বেয়াইনের পিড়াপিড়িতে আটকে পড়লাম। রাতে আর ফেরা সম্ভব হলো না। অথচ পরদিন অফিস আছে। তাই ঠিক করলাম খুব ভোরে ফার্স্ট ট্রেনেই ফিরবো। বর্ধমান লোকাল। শীতের দিন। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে যখন কুয়াশা ঘেরা প্ল্যাটফর্মে  পৌছালাম, দেখি ট্রেন ঢুকছে। ট্রেন পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ট্রেন ছেড়ে দিলো। ছুটতে ছুটতে কোনোমতে লাস্ট কামরার হাতল আঁকড়ে উঠতে পারলাম। শীতের দিনের ফার্স্ট লোকাল। গোটা কামরা একদম ফাঁকা। শুধু এক কোণায় চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি দিয়ে একজন বসে আছে। আমি ধপ করে সিটে বসে পড়ে হাঁফাতে  লাগলাম। ট্রেন ছুটে চললো। এতই ঘন কুয়াশায় চারদিক ঢাকা যে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন মনে হচ্ছে বিশালাকার তুলোর পিন্ডের মধ্য দিয়ে ট্রেনটা যাচ্ছে। ভাবনা হলো ড্রাইভার ঠিক মতো দেখতে পাচ্ছে তো? মাঝে মধ্যে ট্রেনটা স্টপেজ দিচ্ছে। এই শীতের ভোরে প্ল্যাটফর্মে লোকজন বিশেষ নেই।  থাকলেও হয়ত সামনের দিকে আছে। এত পেছনে কেউ নেই। দেখতে দেখতে অনেকগুলো  স্টেশনই পেরিয়ে গেলো। আমাদের কামরায় আর একজনও উঠলো না। ধীরে ধীরে কুয়াশা পাতলা হচ্ছিলো।

একটু পরের দিকের একটা স্টেশনে দেখলাম বড়ো বড়ো দুধের ক্যান নিয়ে গোয়ালারা ট্রেন ধরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। না‌ তারাও আমাদের কামরায় উঠলো না। তবে হঠাৎ একটা গোঙানির শব্দ শুনে দেখলাম শব্দটার উৎস আমার কামরায় উপস্থিত দ্বিতীয় লোকটা। কি ব্যাপার কাঁদছে নাকি? চাদরে জড়ানো শরীর। মুখটা হাতের মধ্যে গোঁজা। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। ট্রেন আবারো ছুটতে লেগেছে। কামরার অল্প আলোতে লোকটাকে যতটা সম্ভব ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। ধুতিপরা গ্রামীন মানুষ। দেখে মাঝবয়সী বলেই মনে হচ্ছে। হঠাৎ নজরে পড়লো ধুতিটাতে চাপ চাপ কিছু লেগে আছে। ঠাহর করে দেখতেই বুঝতে পারলাম, ওগুলো রক্তের দাগ। মনের মধ্যে সামান্য খটকা লাগলো।  লোকটা মুখ তুলে চাইলো। দেখলাম কান্নাভেজা ফোলা ফোলা চোখ মুখ। সত্যি সত্যিই কাঁদছিলো লোকটা। চাদরটা আলগা হয়ে গেছিলো। লোকটা সেটা খুলে আবার সারা গায়ে জড়িয়ে নিলো। চমকে দেখলাম গায়ের জামাতেও চাপ চাপ রক্তের দাগ। সে দাগগুলো আবার আরো বড়ো বড়ো। আমার মনের খটকাটা একলাফে মহা আশংকায় পরিণত হয়ে গেলো। সব্বোনাশ! এ তো কাউকে খুন করে এসেছে! হয়তো প্রিয়জন কাউকেই। তাই কাঁদছে। কামরায় আমি একা।  কোনো কিছু বলার বা করার সাহস হলো না। মনে মনে ঠিক করলাম পরের স্টেশনে গাড়ি থামলে নেমে কামরা পাল্টে নেবো। কিন্তু পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই দুজন প্যাসেঞ্জার কামরায় উঠলেন। তাঁদের হাঁপানির ধরন দেখে  বুঝলাম আমার মতই কেস। দৌড়ে এসে কোনোমতে ট্রেন ধরেছেন। ওনারা এসে সিটে বসার পর আমার মনে সাহস এলো। আমি ওনাদের ডেকে লোকটাকে  দেখালাম। এখনো সে হাতে মাথা গুঁজে চাদর জড়িয়ে বসে আছে। আমি ইশারায় নতুন প্যাসেঞ্জারদের লোকটার রক্তমাখা ধুতি দেখালাম। বললাম, আমি দেখেছি ওর জামাতেও অনেক অনেক রক্তের দাগ। মনে হয় খুন টুন করে লোকটা পালাচ্ছে। আমরা তিনজনই রাজি হলাম, হাওড়া পৌঁছে লোকটাকে পুলিশের  হাতে তুলে দিতে হবে। এটাও ঠিক হলো, মাঝপথে যদি নামতে চায় বাধা দিতে  হবে। একটা আশংকা অবশ্য আমাদের মনে খচ খচ করছিলো। যদি সাথে অস্ত্র থাকে? মরিয়া হয়ে যদি উল্টে আমাদের আক্রমণ করে বসে?

এসব কিছুই অবশ্যি দরকার হলো না। ট্রেন যথা সময়ে হাওড়ায় ঢুকলো। ততক্ষণে আরো কয়েকজন প্যাসেঞ্জার উঠেছে এই কামরায়। ট্রেন থামতেই আমরা সবাই লোকটাকে ঘিরে ধরলাম। কয়েকজন ছুটলো পুলিশকে খবর দিতে। আমাদের ঘিরে ধরতে দেখে লোকটা ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। আমাদের তখন প্রবল সাহস। সবাই নানা প্রশ্ন করতে লাগলাম। লোকটা এক সময় ডুকরে কেঁদে উঠলো "বাসন্তী রে এএএএএ..."
আমরা বুঝলাম নিশ্চয় লোকটার বউএর নাম বাসন্তী। ব্যাটা নির্ঘাত বউকেই খুন করে এসেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে গেলো। আমরা লোকটাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ  করে দিয়ে যে যার অফিসে রওনা দিলাম। সমস্ত দিন অফিসে এই ঘটনার চর্চা চললো। কিছু কিছু বাদ দিয়ে কিছু কিছু জুড়ে দিয়ে আমি গল্পটাকে আরো জমজমাট করে তুললাম। অনেকেই অনেক অনুমান অনেক থিওরি খাড়া করতে লাগলো। মোট কথা লোকটার জীবনে যাই ঘটে থাকুক, আমরা অফিসের সবাই  একটা উত্তেজক দিন কাটালাম। যেহেতু ঘটনাটাতে আমার বেশ বড়ো সড়ো ভুমিকা আছে, তাই আমি এক ধরনের আত্মপ্রসাদও অনুভব করছিলাম। সেটা হাবে ভাবে প্রকাশও করছিলাম। একজন জানালো, বিদেশে হলে আমাকে
রেকগনিশান হিসেবে নিশ্চয় পুরোস্কৃত করা হতো। আমার মনে হলো এখানেও হওয়া দরকার।

বিকেলে অফিস ফেরত নিছক কৌতুহল বশে হাজির হলাম হাওড়া স্টেশনের পুলিশ চৌকিতে। জিজ্ঞেস করলাম লোকটার কথা। প্রথমে তো কেউ চিনতেই পারে না। শেষে একজন কনেস্টবল বলল, ‘আরে ঐ পাগলটার কথা বলছেন?  যাকে সকালে বর্ধমান লোকাল থেকে ধরা হয়েছিলো? জামাকাপড়ে রক্তের দাগ বলে প্যাসেঞ্জাররা কমপ্লেইন করেছিলো?’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ আমি সায় দিলাম। ‘ওকে তো  ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওর ছেলেরা এসে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে’।

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। ‘ছেড়ে দিলেন? ঐ খুনিটাকে? জানেন ও ওর  বউকে খুন করেছে। ওর বউএর নাম বাসন্তী’। এই শুনে পুলিশটা হো হো করে  হেসে উঠলো। ‘আরে না না। বাসন্তী ওর বউএর নাম নয়। ওটা ওর বুড়ি গাইয়ের নাম। এখন আর দুধ টুধ দিচ্ছিলো না। তো ছেলেরা কসাই ডেকে বেচে দিচ্ছিলো। তাতেই লোকটা ক্ষেপে গিয়ে, "কসাইয়ের হাতে কেন, মরলে আমার হাতেই মরবে” বলে গরুটাকে কাটারি মেরে দিয়েছে। শরতবাবুর মহেশ কেস আর কী!’ সুযোগ পেয়ে পুলিশ কনস্টেবল নিজের সাহিত্যজ্ঞান জাহির করে দিলো। এদিকে আমি তো সব শুনে রীতিমত হতভম্ব। পুলিশ যেন আমাকেই ভরসা দিতে জানালো, ‘দাম হয়তো একটু কম দেবে। কসাইরা নিয়েই নেবে ঘায়েল গরুটাকে। খুব বেশি লস হবে না’।

অনেকদিন আগের কথা। লোকটা তখন বেঁচে গেছিলো। আজকের দিনে হলে গোরক্ষকদের পাল্লায় পড়ে বাঁচতো না নিশ্চয়ই!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন