কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০

বিজয়দিত্য চক্রবর্তী




কাব্যগ্রন্থ - জর্দা বসন্ত

কবি - অগ্নি রায় 

প্রকাশনা - সিগনেট প্রেস

আলোচনা করেছেন – বিজয়দিত্য চক্রবর্তী (কবি এবং অর্থনীতির অধ্যাপক)





জর্দা বসন্ত। শব্দটা বসন্তের আগে এত অপ্রত্যাশিতভাবে না বসা অবধি এতটা জর্দাক্ত হইনি কখনও। এমনই অন্তর্ঘাতী সুরভিতে শুরু। অগ্নির স্বননভঙ্গির সঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ পরিচিতি আছে যাঁদের, তাঁরা এই চেতাবনীর মধ্যে দস্তখতি সংকেতটুকু পড়ে নিতে পারবেন। কিন্তু এই বই একার্থে ওর কবিতা প্রত্যয়ের সন্তর্পণ এক বাঁকবদলের স্বাক্ষী হয়ে থাকলো।

ওর লেখায় দুটি প্রতিবেশী রঙের মেরুজ্যোতি। প্রথমত, উৎস অথবা লক্ষ্য হিসাবে নীরবতার নিভৃততম বিচ্ছুরণ, যা হয়তো খুব বিরল নয়। দ্বিতীয় ব্যাপারটি খুব বিস্ময়কর। কবিত্ব ওর ভাষার আত্মমেধী সর্জনপ্রক্রিয়ায় নিহিত, যে  ভাষা মেটাফর ও মেটানিমির শর্ট সার্কিটে এমন ক্রমাগত সব যুক্তি ফাটলের জন্ম দেয় যেখান থেকে পশ্চাদপসরণ না মুমকিন। অসংলগ্নতার পাঁচিল বরাবর  হাঁটতে হাঁটতে পিছপা হয় না, দরকারে মেসেজের নির্দিষ্টতার জন্য প্রয়োজনীয় সংহতির শাসনকে বুড়ো আঙুল দেখায়। ওর কবিতায় কোথাও ঠিক পৌঁছানোর তাড়া থাকত না। সেভাবে ভাবলে কেউ একে অন্যতম প্রাচীন ও অসচেতনতম অধুনান্তিক এক কবির অভিধা দিলে আশ্চর্য হব না। 

‘‘এতই জটিল এই মাসকাবারি জঞ্জাল
ফুলের গন্ধ কাছে এলে মনে হয় পরকীয়া!’’ 

এভাবে বলে চলা ওর স্বভাবগত। একটু দাঁড়ালাম। মাসকাবারি কথাটা নেহাত বলার জন্য নয়। গেরস্থালির দিকে তার নির্দেশ, তার চটচটে পৌনপৌনিকতা,  তার বিকল্পহীন উপস্থিতি — সব মিলে এক স্তর খুলে যেতে থাকে, কতটা তা পাঠসম্ভব প্রশ্ন জাগে। আবার জঞ্জাল কথাটা তার ঠিক পরেই। 

‘‘যে যেভাবে পারে টপকায় 
দাম্পত্য, ময়দান, প্রতিষ্ঠানগুলি’’

দাম্পত্য, যাকে হাজত ভেবে এগোতে থাকি, তারপরই ময়দান এসে পড়ে। টপকায়? আমারও পড়া থেমে যায়। আবার শুরু করি। 

‘‘পাহাড়ি রেলস্টেশন যেমন ট্রেন পাস করানোর আগে ও পরে থমথমে বিধুর, ঠিক তেমনই টিফিনবেলা আর ছুটির সময়টুকু ছাড়া নিঃসঙ্গ গেটের বাণিজ্য।’’ (ইস্কুল ফেরত) 

কথাটা আমায় আবার ছোটবেলার ইস্কুলগেটের দিকে আবার তাকাতে বাধ্য করে, অপেক্ষা করায়  টয়ট্রেন চলে না-যাওয়া অবধি। গত শতকের উপান্ত থেকে ভাষাতত্ত্বের নিউরোবায়োলজি নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। আমরা জেনেছি, কবিত্বের আঁতুরঘর এক মেটাফর-কীর্ণ মস্তিষ্ক। তাতে মস্তিষ্কের বামার্ধের যুক্তিগণিতধারের দপদপানি কম, বরং দক্ষিণার্ধের মৃদু টোকা ও  উলোটপা্লোটগুলো অনেক গুরুভার। কবিত্ব যে এক জৈবস্নায়বিক বিরলতা তা আমরা টের পাই। ধারণাগুলি বারবার স্পর্শসম্ভব অবয়ব নেয়, যেন বস্তুসামগ্রী। ভাষা হয়ে ওঠে তার আধার। কমিউনিকেশন তখন এসব জিনিসপত্র উপহারস্রোতের মতো পাঠকের কোলে তুলে দেওয়া মাত্র কলকেশনের  (collocation)  নিয়মগুলো বাড়তি মনে হয়। 

‘পাতলা সুত্র মতো জড়ানো আঁশগন্ধ’ (দুপুর কথা)

‘স্মৃতিকে আর পেনাল্টিবক্স পর্যন্ত টানা যাচ্ছে না’ (অ্যালবাম কথা)

‘বীজগণিত খেলতে খেলতে চারদিক ইন্দ্রজাল কমিকস হয়ে এল’ (পিকনিক)

তবুও ‘জর্দা বসন্ত’ এই সব দুঃস্থিত শব্দযৌগ ও ছাঁচভাঙা বুননকৌশলের সমান্তরালে আরও একটি লক্ষ্যে এগিয়েছে। শহর তাঁর আত্মায়। একটি একটি অনু-দৃশ্য দিয়ে সেই নাগরিক স্মৃতিসহগনৈরিকার আঁকা হয়েছে। পাঠশেষে সেই দৃশ্যের বিশদ ধরা দেয়, যেমন দালির প্যারানোইয়াক। কাছে থেকে যা গালার প্রেয়সী নগ্নিকারূপ, দূরে গেলে তাই আব্রাহাম লিঙ্কনের মুখ হয়ে ওঠে! ট্যাক্সি ড্রাইভারের স্পর্ধিত কবজি, কলোনিমহল, গোলপোস্ট, ময়দান, সুঁড়িপথ, সৈকত, কাগজ অফিস — শেষে হাসপাতালের গল্পে বঁড়শির মতো গেঁথে থাকে  তার অবধূত সংবেদনা। কলকাতা, দিল্লি, বাফালো — নাম ভাগাভাগি করে নেয় মানসিক ভূখন্ডগুলি। তার স্তব্ধ রিরংসাকে নিজের করে পেতে হাসপাতাল এক  কাঙ্ক্ষিত বিভাজনভাষ্য এনে দেয়। 

‘ভিজিটিং আওয়ার ফুরিয়ে যাওয়ার পর মখমলি কিংখাব থেকে গোপন গুপ্তি বের হয়। নিজেদের মধ্যে চোখ পাল্টে নেয় নথ না ভাঙা অ্যাম্পিউলেরা।’ (হাসপাতালের ডায়েরি)  

অথবা 

‘সুস্থতার পাঁচিল টপকে এপারে এসে সদ্য নাকে নল লাগিয়েছে যে পরমশিশু, তার লাল বলটা এখনও ড্রপ খাচ্ছে ওপারে।’ (হাসপাতালের ডায়েরি)

আবার পাঁচিল টপকানো!



কিছু পাঠ কিছু সেবনের রসদ হিসাবে ‘জর্দা বসন্ত’ বারংবার আমাকে তার স্নায়ুমুখের মোহনায় টানবে। শশব্যস্ত ও স্ব-সাব্যস্ত পাঠকের জন্য আছে কিছু লেখা, সাগরে ভাসমান চিঠিভরা বোতলের মত পাঠ-সহজ স্মৃতিধার্য। অন্যদের জন্য মেসেজ নয়, রইল সংক্ষোভের বিচিত্র প্রকাশভঙ্গির সেই কোহিনূর, যা কেবলমাত্র ও চিরদিন কবিত্বের চকিত ঝলকে উদ্ভাসিত। শুধু তার জন্যই অন্যসব শিল্প আঙ্গিক থেকে ছুটি নিয়ে কবিতার একান্তে বসার মানে হয়। আজ এবং আজও। কিছু খেলা ময়দানে হল, বাকি রেফারিহারা ও বিরতিবিহীন খেলা ইতঃস্তত ছড়ানো রয়েছে।

1 কমেন্টস্:

  1. সুন্দর আলোচনা| "কবিত্ব যে এক জৈবস্নায়বিক বিরলতা", আলোচনায় তার টের পাওয়া গেল|

    উত্তরমুছুন