কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০

কাজল সেন



ঝুরোগল্প 



টান  


সেমন্তী ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, তার একমাত্র মেয়ে রেনেটার সঙ্গে আজও কেন সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠল না! দোষটা কার? তার? নাকি রেটিনার? দোষ  ত্রুটির কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল, তাহলে কি তাদের দুজনের মধ্যে কারও কোনো ব্যাপারে কিছু খামতি আছে? স্বামী মনোহরকে কথাটা বললে, মনোহর এড়িয়ে যেতে চায়। বলে, এটা তোমাদের মা ও মেয়ের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা। আমাকে এরমধ্যে টানাটানি কোরো না! সেমন্তী মনোহরকে বোঝাতে পারে না, সমস্যাটা টানাটানির নয়, বরং টানের। মেয়ে তার মায়ের প্রতি কোনো টান অনুভব করে না। অথচ বাবার সাথে তো মেয়ের নিতান্তই সহজ সম্পর্ক! সেমন্তী নিজেও তো রেনেটাকে খুবই ভালোবাসে, কাছে পেতে চায়। অথচ রেনেটা একেবারেই ধরাছোঁয়া দিতে চায় না, নিজেকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখে। আর এই দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটা চলে আসছে রেনেটার সেই ছেলেবেলা থেকেই। তখন শ্বশুর ও শাশুড়িমা একইসঙ্গে থাকতেন। রেনেটা জন্মানোর পর তার পরিচর্যা যতটুকু সেমন্তী করেছে, তার থেকে বেশি করেছেন শাশুড়িমা। তেল মাখানো, চান করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সবকিছুই। এমনকি রেনেটা মায়ের কোলে শুয়ে মাতৃদুগ্ধ পান করার সময়টুকু ছাড়া সেমন্তীর কাছে থাকতেই  চাইত না। সমানে কাঁদত। আর ঠাম্মার কোলে উঠলেই একমুখ হাসি।

সেই যে নিতান্ত ছেলেবেলা থেকে মা ও মেয়ের মধ্যে একটা অদৃশ্য দেওয়াল একটু একটু করে মাথা তুলতে শুরু করেছিল, তা আর কখনও সরানো যায়নি। সেমন্তী অনেক চেষ্টা করেও সরাতে পারেনি। বরং আরও যেন পাকাপোক্ত হয়ে চেপে বসেছে। এবং এভাবেই চলতে চলতে পারস্পরিক সম্পর্কটা আজ এমন একটা অবস্থানে এসে পৌঁছেছে যে, সেমন্তী রেনেটাকে কোনো প্রশ্ন করলে,  রেনেটা তার উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’র মধ্যেই সীমিত রাখে, খুব বেশি হলে একটি বা দুটি সংক্ষিপ্ত শব্দবন্ধ। বিপ্রতীপে রেনেটা কোনো প্রশ্নই করে না সেমন্তীকে। যেন  তার কিছু বলারও নেই, জানারও নেই মায়ের কাছে 
রেনেটা এখন দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ছে। সেমন্তী মনোহরের কাছে জেনেছে,   উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনার পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য জয়েন্ট এন্ট্রাস পরীক্ষার জন্যও তৈরি হচ্ছে। পড়ার সুযোগ পেলেই ঘর ছেড়ে চলে যাবে। হস্টেলে থাকবে। আর তারপর যা হয়, বি টেক ডিগ্রী অর্জন করে দেশের কোনো এক শহরে কোনো এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে যোগদান করে সেখানেই থাকবে। মাঝে মাঝে সেখান থেকে ইচ্ছে হলে ছুটি নিয়ে এসে বাবার সঙ্গে দেখা করে যাবে। না, সেমন্তী একথা ভাবতেও পারে না যে, মেয়ে তার সঙ্গে কখনও দেখা করতে আসতে পারে।

এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল, অথচ মায়ের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কটা কেন এত নিরুত্তাপ থেকে গেল, তার কোনো উত্তর খুজে পায় না সেমন্তী। অস্বস্তি লাগে আশঙ্কাও জাগে। তার প্রতি মেয়ের এই বিতৃষ্ণা কি আসলে কোনো জটিল  মানসিক কারণে একটি নারীর অন্য একটি নারীর প্রতি বিতৃষ্ণা? সেমন্তীর ভয় করে। সে নিজেও কি তাই? সেমন্তী নিজের অজান্তেই হাতড়াতে থাকে তার নিজেরও মনের আনাচকানাচ।  

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন