কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০

শতাব্দী দাশ


সমকালীন ছোটগল্প 
দাগ, না-পাক


প্রথমে থাই-এর মাসলগুলো মোচড় দিয়ে উঠল। তারপর তলপেটে টান ধরল। আনায়ার ঘুম
ভেঙে  গেল। চমকে তাকালো বিছানায়। দাগ আছে? নেই। স্বস্তি।
আশফাক ঘুমোচ্ছে৷ আশফাকের পেটের উপর আম্মুর হাত। আম্মুর বুক উঠছে পড়ছে৷
সর্পিল দুপাট্টা বালিশের পাশে ৷ মেঝেতে গদির উপর বিছানা পেতে তারা তিনজন, যেমন
শোয়। আব্বু চৌকিতে। মাঝেমাঝে আম্মুকে উঠে যেতে হয় চৌকিতে, আনায়া জানে।
হুটোপাটি হয়। আশফাক ঘুমায়। আনায়াও দম চেপে শুয়ে থাকে। পিসাব পেলেও চেপে
থাকতে হয়।

আব্বু আজ ডাকেনি আম্মুকে। আজ সব সন্নাটা। এখন বলে নয়, সকাল থেকে।
সেলাইকলগুলো নিচের ঘরে চুপ মেরে আছে। আব্বু আর আম্মু একসঙ্গে সেলাইকল
চালালে ঘড়ঘড় আওয়াজ ওঠে। বুরখা সেলাই হয়। দুপাট্টা, সালোয়ার আর কামিজ। আব্বু
সকাল সকাল ঝাঁপ ফেলে দিল৷ গণ্ডগোল লাগতে পারে। আব্বু আর আম্মু দাদিকে দেখছিল।
বুড়িকে টেনে কোথাও নিয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা!
আনায়া উঠে বসে। দরজা ঠেলে বেরোয়।
বাথরুমের দরজা বন্ধ। দাদি বেশক্। ডিভান খালি।

আনায়া ঢিলা সালোয়ারের মধ্যে দিয়ে বাঁ হাতটা চালিয়ে দেয়। যোনিমুখ স্পর্শ করে। হাত
বের করে। আঙুলে দাগ খোঁজে। ঘোলাটে সাদা তরল শুধু৷ আর কিচ্ছু না৷ অথচ তলপেটে
মোচড় দিচ্ছে৷ উরুতে টান ধরছে। শরীর উচাটন৷ আনায়া জানে, আর কিছুক্ষণ পরেই
না-পাক হবে সে৷  
ফোন বেজে উঠল। আব্বুর জড়ানো গলায় 'হ্যালোওও!'  আম্মুর উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন, তাও শোনা
গেল৷

দাদি বেরিয়েছে। পায়ের ব্যামোয় দাদির চলাফেরা খানিক হাঁসের মতো। দুপায়ের মধ্যে
বেশ খানিকটা ফাঁক রেখে, পাতাদুটো বিপরীতমুখী করে মন্থর ভাবে নড়েচড়ে।  
-পালাতে হবে।
-আর সামান?
-আলমারিতে ডেলিভারির মাল আছে৷ তালা লাগাও জলদি। পালাও। পরে এসে নিয়ে যাব।

আব্বুর সামনে বলা গেল না, ছাদের এককোণায় রাখা একটা অন্ধকার কৌটোর কথা৷
ন্যাকড়া চোকড়া আছে ওখানে৷ কৌটোটাকে আনায়া ঘেন্না করে৷ খুললে  বোঁটকা গন্ধ।
অন্ধকারটাও বিশ্রী। কিন্তু ওগুলো দরকার হতে পারে।

আব্বু আর আম্মু ঘোড়ার মতো ক্ষিপ্র হয়ে উঠেছে। তিনটে আলমারিতে তালা লাগালো
ঝটপট। আশফাক চোখ কচলাচ্ছে। ট্রাইসাইকেল নিতে চাইছে। আম্মু এক চড়ে শান্ত করল
তাকে। দাদি হাঁসের মতো পাছা দুলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামার চেষ্টা করছে।

রাস্তায় তখন অর্ধেক পাড়া। কে যেন বলছে, মসজিদে আশ্রয় নেওয়া নিরাপদ হবে। আনায়া
ভাবে, মসজিদে বেমক্কা শুরু হয়ে গেলে নরকেও কি জায়গা হবে তার? আরেকজন বলল,
মসজিদও জ্বালিয়ে দিচ্ছে। পালাতে হবে এলাকা ছেড়ে। বড় রাস্তা নেওয়া চলবে না।
গুলিগোলা চলছে। গলিঘুঁজি দিয়ে বেরিয়ে
মুস্তাফাবাদে পৌঁছতে পারলে আশ্রয় মিলতে পারে। আনায়ার পা অবশ হয়ে আসছে।

গলিগুলো ভুলভুলাইয়া হয়ে গেছে রাতে। কোনদিকে বিপদ আর কোনদিকে আলো, জানা  
নেই৷  গুলির শব্দ পেলেই উদভ্রান্ত দল দিক পরিবর্তন করছে৷ আশফাক আব্বুর কোলে।
দাদি বসে পড়েছে বেপাড়ার রোয়াকে। আনায়া হাঁফাতে হাঁফাতে আম্মির কাছে পৌঁছয়।  
এতক্ষণে একা পাওয়া গেছে, কথা বলা যাবে কানে কানে।
হঠাৎ পিছনে চেনা হুঙ্কার। এসে গেছে ওরা৷ হাতে উদ্যত পিস্তল৷ পিস্তল, গুলি- এসব
ভোজবাজি আগে দেখেনি আশফাক। একটা তীব্র শব্দ। আর দাদি লুটিয়ে পড়ল রোয়াকে।
আশফাক ম্যাজিকটা হজম করে উঠতে পারেনি। তাকিয়ে আছে হাঁমুখ। আব্বু দৌড়ে
এল। আম্মুও। ওরা রোয়াকের রক্তধারা অগ্রাহ্য করে দাদির শরীরে প্রাণ খুঁজছিল।

আনায়ার মনে হল, কুলকুল টের পাওয়া গেল।  সালোয়ারে হাত গলিয়ে দেখারও দরকার
নেই। রক্ত বেরোচ্ছে হু হু। প্যান্টি ভিজল। সালোয়ার ভিজবে এইবার। দাগকে ভয় পেতে
হয়, আম্মু বলেছে। দাগ লজ্জার। দাদিও বলত। এ পাড়ার বাড়িগুলোতে লুঠপাট চলছে।
একটা মাজাভাঙা ট্রাই-সাইকেল রাস্তায় আছড়ে পড়ল। কে যেন প্যান্টের চেইন খুলে
দেশপ্রেম দেখিয়ে গেল৷ হাতে নিজের পৌরুষ তুলে বলল, 'ইয়ে লে আজাদি!'

'দেশপ্রেম' বড় অশ্লীল দেখতে। বড়ই না-পাক।

আম্মুর হ্যাঁচকা টানে আবার যখন আনায়া চলতে শুরু করল, ততক্ষণে অনেকখানি ভিজে
সে। এই প্রথমবার, রক্তাক্ত হচ্ছে আনায়া লজ্জাহীন। এই প্রথমবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিতে
হচ্ছে না, কামিজে দাগ লাগল কিনা! এই প্রথমবার এত রক্ত, যে সাফা কাপড়কেই দাগ
বলে ভুল হবে।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন