সমকালীন ছোটগল্প |
ছাতা
—হায় আল্লা! হেই
পানি কি আমাগো ভিজাইবার লগেই সৃষ্টি করস?
সেদিন প্রবল বৃষ্টিটা যখন শুরু হল
তখন মোজাম্মেল মিঞা ব্যস্ত ছিল তার জমিতে নিড়ান দিতে। দুই দেশের
সীমান্ত লাগোয়া তার ছোট্ট এক টুকরো জমি। সেদিন তার বউ সাবিনাবিবি পইপই করে বেরোতে নিষেধ করেছিল তাকে। সে শোনেনি। তার বিবির এক সহজাত গুণ
ছিল। সে হাত গুণে বলে দিতে পারত কবে বৃষ্টি হবে, কতটা বৃষ্টি
হবে। কিন্তু তার এই ভবিষ্যৎবাণীর প্রতি মোজাম্মেল মিঞা
বরাবরই অদ্ভুত রকম উদাসীন থাকত। যখনই সে বৃষ্টি নিয়ে কিছু
বলতে আসত, মিঞা তাকে থামিয়ে দিয়ে উলটে জিজ্ঞেস করত, ‘তুই বরং হাত গুণে বল দিকি আজ
ওই সেপাইরা বন্দুক মাইরবে কি না? পরানডা বেবাক হারাইয়া ফেলুম না তো?’ আজকেও সে একই প্রশ্ন করেছিল। সাবিনাবিবি খানিকক্ষণ চুপ থেকে তার হাতে
ছাতাটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘এইডা লইয়া যাও। কাম আইবে।’
মেলে ধরা ছাতাকে হার মানিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা মোজাম্মেল মিঞাকে
ভিজিয়ে দিতে শুরু করলে মিঞা তখন এদিক-ওদিক একটু আশ্রয় খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু
এখানে আশ্রয় কোথায় পাবে! এ পাশে ধূধূ প্রান্তর। সবই আবাদী জমি, কিন্তু কেউ চাষ
করতে আসে না। সিপাই এলাকা বলে ভয় পায়। প্রায়ই সিপাইদের গুলিতে চাষাভুষা মানুষ মারা
পড়ে। এদিকের সিপাইরা মোজাম্মেলদের কিচ্ছু বলে না, কিন্তু ওদিকের সিপাইরা সুযোগ পেলেই চোর বলে গুলি মারে। এপাশের
সিপাইরাও নিশ্চয় একইভাবে ওপারের সাধারণ লোকেদের মারে। সিপাইদের স্বভাব তো আর কিছু
আলাদা হয় না! সব পাশেই এক।মাঝখানে পড়ে
থেকে থেকে এদিক-ওদিক ঝোপঝাড় গজিয়ে উঠেছে মোজাম্মেলদের ওইসব জমিগুলোতে। কিন্তু বড়ো
গাছ নেই একটাও। যে দু-একটা গাছ ছিল আলপথের ধারে ধারে, এপারের সিপাইরা কেটে নিয়ে
চলে গেছে। গাছ থাকলে তাদের নাকি পাহারা দিতে সমস্যা হয়! আড়াল হয়! এপারের সেনা
ছাউনি এখান থেকে কয়েকশো গজ আগে আছে একটা। তারা ওখান থেকেই পুরো এলাকা নজরে
রাখে।কিন্তু মোজাম্মেল মিঞার জমির ওপাশে হাত পঞ্চাশ দূরেই কাঁটাতার, আর সেখান থেকে আর হাত পঞ্চাশেক ভিতরেই ওদের
দেশের সেনাছাউনি। বলতে গেলে মোজাম্মেল মিঞার জমির সোজাসুজিই
ওই ছাউনিটা। তাই মোজাম্মেলকে প্রাণ হাতে করে কাজ করতে হয় জমিতে। অন্য সবাই বলে মোজাম্মেলের খুব সাহস, তার জীবন নিয়ে ভয়ডর নেই।
মোজাম্মেলের বেশ লাগে তার সাহসের সেইসব কথা শুনতে। সে
নিজেকে সাহসী বলেই ভাবে। তাই সাবিনাবিবির বৃষ্টি নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী
শুনলে তার মনে হয় তার বিবি বৃষ্টিকে অহেতুক ভয় পায়। তাইএসব বলে-টলে। সে ঠাট্টা করে তার হাত গোণা নিয়ে।
—হেদেহি এক্কেরে গোলার মতো গায়ে আইস্যা লাগতাসে গো! হে কেমন
পানি শুরু হইল আল্লা!
ঝোড়ো বাতাসটা বইছে কাঁটাতারের দিক থেকে। জলের ঝাপটা আটকানো
যাচ্ছে না কালো রঙা ছাতাটায়। আটকাতে গেলে মাথা ভিজে যাচ্ছে। মোজাম্মেল মিঞা আবার
এদিক-ওদিক খুঁজতে শুরু করে। এলাকায় একটাই বড়ো গাছ আছে। পাকুড় গাছ। ঠিক কাঁটাতার
মাঝখান দিয়ে। এই গাছটা মোজাম্মেলের বাপ-দাদার আমলের গাছ। যখন কাঁটাতার বলে কিছুই
ছিল না এই এলাকায়, যখন এখানকার সবারই ভয়ডর বলে কিছু ছিল না, যখন এখানকার সমস্ত
জমিতে ভরপুর চাষ-আবাদ হত, তখন থেকে এই গাছটা দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ওই গাছটা কোনো
পক্ষের সিপাইরাই কাটেনি, কারণ গাছটি দু-দেশের সীমানায় পড়েছে। কারা কাটবে সেই
সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছতে পারেনি কোনো পক্ষই।
মোজাম্মেলের এবারে একটু ভয় করে। ও কোনোদিন ওর জমি পেরিয়ে
কাঁটাতারের দিকে এগোয়নি। কাঁটাতারের দিকে কাউকে এগোতে দেখলে বা সন্দেহজনক কিছু
দেখলেই ওরা গুলি করে। মোজাম্মেল শুনেছে। কিন্তু এখন কিছুই করার নেই। এই দাপুটে
বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে গেলে ওই গাছটাই ভরসা। মোজাম্মেল দৌড়ে এগোতে থাকে গাছটার
দিকে। কিন্তু একটু এগিয়েই থেমে যায়। ভাবে, ওকে দৌড়তে দেখে যদি ওরা গুলি করে?
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে তারপর হেঁটে হেঁটে এগোতে থাকে গাছটার দিকে। ধীরে ধীরে।
গাছটার নিচে পৌঁছে ও বারবার সেনা ছাউনিটার দিকে দেখতে থাকে।
কেউ দেখছে না তো ওকে? এই বৃষ্টিতে বাইরে কেউ নেই, কিন্তু ভিতর থেকে নিশ্চয়ই নজর
রাখছে। ওরা কি বুঝতে পারছে যে মিঞা শুধু বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যেই এই
গাছতলায় এসেছে? ওরা বন্দুক তাক করছে না তো? মোজাম্মেল মিঞার ভয় বেড়ে যায়। বুক ধড়ফড়
করতে শুরু করে। কিন্তু এই বৃষ্টিতে এখান থেকে চলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সবে এখানে
এসেছে, এখনই আবার চলে গেলে ওদের যদি বেশি করে সন্দেহ হয়? নাহ, এখন আর কিছুই করার
নেই!
মিঞা গাছতলায় বসে পড়ে। ছাউনির
দিকে পিঠ দিয়ে। সে ওদিকে তাকাতে চাইছে না আর। কিন্তু প্রায়ই চোখ চলে যাচ্ছে। ঘুরে
ঘুরে দেখার চেষ্টা করছে কেউ কিছু করছে কিনা। তার ভয় করছে ভীষণ। এখানে মাথার উপরে
জলটা অনেক কম পড়ছে। গাছটা বাঁচাচ্ছে। কিন্তু পিছন দিক থেকে ঝাপটাটা এসেই চলেছে।
গুলি এলেও ওদিক থেকেই আসবে। এবং যে কোনো সময় ছুটে আসবে। মিঞা ছাতাটা মাথার উপর
থেকে নামিয়ে তার পিঠের দিকটা আড়াল করে বসে। বসার পরে মিঞার মনে পড়ে আজ সকালে
বেরনোর সময় হাত গুণতে পারা সাবিনা বিবির
বলা শেষ কথাগুলো। ‘বিবি কইসে, এই ছাতাখানই কাম আইবে। উডাই বাঁচাইবে মোরে। পানি
থিক্কাও, গুলি থিক্কাও’।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন